28-03-2024 21:30:20 pm
Link: http://ebongalap.org/jolotole-kharer-kathamo
আটত্রিশ বছরের বেশি সময় হয়ে গেছে৷ তবু দিনটা আমার মনের কাছে স্পষ্ট৷ জাতীয় আকাদেমী মুসৌরীতে ট্রেনিং নিচ্ছি৷ ভারতীয় প্রশাসনিক সেবায় যোগ দিয়েছি অল্প কিছুদিন৷ পৃথিবী যেন হাতের মুঠোয় - এত উৎসাহ উদ্যম শরীরে, মনে৷ আকাদেমীর ডায়রেক্টর হয়ে এসেছেন পি এস আপ্পু৷ সাদামাটা, শান্ত মানুষটির ভিতরে নাকি আছে রাজনীতিকদের উৎকর্ণ করে রাখার ক্ষমতা৷ বিহারের মুখ্যসচিব হিসেবে পোস্টিং হয়েছিল - প্রশাসনিক বিভাগকে চিঠি লিখেছিলেন, এই দায়িত্ব থেকে হয় তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হোক, নয় দেওয়া হোক পূর্ণ স্বাধীনতার সঙ্গে কাজ করবার সুযোগ৷ শুনে মুখ্যমন্ত্রী আশ্চর্য হয়েছিলেন৷ কিন্তু মেনেও নিয়েছিলেন শর্ত৷ মুখ্যসচিব পি. এস. আপ্পু ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিশ্বাস করতেন৷ এ বিষয়ে পাণ্ডিত্য এবং হাতে-কলমে দক্ষতা দুইই অর্জন করেছিলেন৷ ক্লাসে আমাদের শেখাতেন কৃষি, ভূমিসংস্কারের গোড়ার পাঠ এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের প্রয়োজনীয়তা৷ তাঁর আগে আকাদেমীর ডায়রেক্টর ছিলেন পাঞ্জাব ক্যাডারের একজন আইএএস অফিসার৷ তিনি এবং তাঁর স্ত্রী আদবকায়দা অনুশীলনের ল্যাবরেটরি বানিয়ে ছেড়েছিলেন জাতীয় আকাদেমীকে৷ তাঁর বাড়িতে আনুষ্ঠানিকভাবে দল বেঁধে চা খেতে গেলে, উর্দি ও কোমরবন্ধ পরিহিত খানসামা, সবুজ একটি পর্দা যা তাঁর বহির্মহল ও অন্দরমহলকে আলাদা করে রাখত, তারই দড়ি ধরে টান মেরে ঘোষণা করত - ডায়রেক্টর সাহাব পধার রহেঁ হেঁ - খড়ে হো যাইয়ে! এমনিতেই ফর্মাল অনুষ্ঠানের অন্ত নেই আকাদেমীতে, তার ওপর ফর্মাল ডিনার লাঞ্চের জন্য আদবকায়দা শিখতে শিখতে আমাদের মত বাংলা মাধ্যম মধ্যবিত্ত প্রোবেশনারি অফিসারদের প্রাণ ওষ্ঠাগত৷ পাঁচ কোর্স ডিনারে কিভাবে টোস্ট করতে হয়, কোন কাটলারি কোন পদের, বাইরে বড় বোর্ডে তার বিস্তারিত নির্দেশ দেওয়া থাকত৷ ভাল ভাল খাবার কোথায় আনন্দ করে খাব, কাঁটা চামচ চালাতেই সমস্ত মনোযোগ দিতে হত৷ ডায়রেক্টর মহাশয়ের যুক্তি - আমাদের অফিসাররা যেন ধনীর প্রাসাদে আর গরিবের কুটিরে একই রকম স্বাচ্ছন্দ্যে বিরাজ করতে পারে৷ এই শিক্ষার কোন অংশ যে গরিবের কাজে লাগবে, তা আমরা বুঝতে পারতাম না৷
যাইহোক শ্রীযুক্ত পি এস আপ্পু এসে সবুজ পর্দা টেনে আগমন ঘোষণা থেকে আরম্ভ করে কাটলারির বৈচিত্র্যপূর্ণ ফর্মাল ডিনার সবই তুলে দিয়ে আমাদের ট্রেনিং-এ প্রাণসঞ্চার করলেন৷ ডায়রেক্টরের বাংলোয় চা খেতে যেতে কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট লাগত না, দল বেঁধে বা একা৷ যে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সমস্যা, যার সমাধানের দায় ডায়রেক্টরের নয়, তা নিয়েও পি এস আপ্পুর কাছে গেছি৷ কেবল প্রশাসক নন, তরুণ তাজা অফিসারদের তিনি ছিলেন ‘মেন্টর’ - সর্বাঙ্গীণ বিকাশের সহায়ক এক শক্তি৷ ২০১২-য় তাঁর মৃত্যুর পর একদা সহকর্মী, এখন সমাজসেবক হর্ষ মন্দর লিখেছিলেন, কোনও এক অতিথি বক্তা তাঁর ভাষণে জনতার উপর পুলিশের গুলি চালনার সপক্ষে উল্লসিত কিছু মন্তব্য করেছিলেন৷ হর্ষ সেই ক্লাস থেকে বেরিয়ে চোখে জল আর রাগ নিয়ে ডায়রেক্টরের অফিসে সোজা ঢুকে নালিশ করেছিল৷
আমার নিজের জীবনের সেই দিনটা স্পষ্ট মনে পড়ে এই প্রসঙ্গে৷ কংগ্রেস রাজত্ব শেষ হয়ে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসেছে পশ্চিমবঙ্গে - কিন্তু রাজনৈতিক হিংসার যেন শেষ নেই৷ খবর আসার মাধ্যম ছিল খবর কাগজ; দিনের বেলা রেডিও বা টেলিভিশনের কাছে পৌঁছনোর অবকাশ ছিলনা৷ লাইব্রেরীতে বসে কাগজেই পড়েছিলাম সেই ভয়ানক সংবাদ৷ বাসে মলোটভ ককটেল বোমা ছোঁড়া হয়েছে এবং যাত্রীদের নামার কোনও সুযোগ দেওয়া হয়নি৷ তিন জন যাত্রী দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন বাসের মধ্যেই৷ এ কী ভয়াবহ হিংস্রতা! তখনও অবশ্য জানিনা, হিংসার তীব্রতা ও বৈচিত্র্যে পশ্চিমবঙ্গ একদিন ভারতের অন্যতম রাজ্য হবে৷ অফিসে কাজ করছিলেন শ্রী আপ্পু৷ আমি ওঁর কাছে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লাম৷ কেন এই কান্না তা বোঝানো শক্ত৷ ডায়রেক্টর বুঝলেন, এবং হাতের কাজ সরিয়ে রেখে চুপ করে আমার কান্না দেখলেন, কথা শুনলেন মন দিয়ে আর সান্ত্বনা দিলেন৷ নিজেকে বদলিও না, সংবেদনশীলতা কোনও ত্রুটি নয় প্রশাসকের পক্ষে - তাঁর বলা সে কথা মনে আছে৷ আসলে নিরপেক্ষ প্রশাসন বলে যে কিছু হয় না, তা আমরা শিখেছিলাম শ্রী আপ্পুর কাছেই৷ যে প্রশাসন দরিদ্র, প্রান্তিক এবং অত্যাচারিত মানুষের পক্ষে নয়, তার নিরপেক্ষতার কোনও অর্থ নেই৷ ভারতীয় প্রশাসনিক সেবার দুর্ভাগ্য, এমন মানুষ, এত উজ্জ্বল প্রশাসককে আমরা ধরে রাখতে পারিনি৷
১৯৮১ সালে গ্রামেগঞ্জে ট্রেনিং সেরে যখন ফিরে এলাম, মর্মান্তিক এক দুঃসংবাদ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল৷ এক দুর্বিনীত মদ্যপ আইএএস ট্রেনি গ্রামাঞ্চলে ট্রেনিং-এ গিয়ে মেয়েদের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাদের জীবন বিপন্ন করেছিল; পি এস আপ্পু সেই অফিসারকে বরখাস্ত করার জন্য ভারত সরকারকে চিঠি লেখেন৷ রাজনৈতিক ভাবে যথেষ্ট ভালোভাবে উঁচু তলার সঙ্গে সম্পর্কিত এই অফিসারের পক্ষ নিয়ে সরকার তাকে বরখাস্ত করতে রাজী হন না৷ যদিও প্রবেশন পিরিয়ডে ট্রেনিং অফিসারকে সামান্যতম দুর্ব্যবহারের কারণেই বরখাস্ত করা যায়৷ দীর্ঘ পত্রালাপের পর পি এস আপ্পু নিজেই পদত্যাগ করেন৷ পরে সংসদের চাপে অফিসারটি অবশ্য বহিষ্কৃত হয়৷ কিন্তু পি এস আপ্পুর পদত্যাগের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে সরকার আর রাজী হয় না৷ নির্ভীক মনোভাবের প্রতি প্রতিশোধমূলক মনোবৃত্তি ছাড়া আর কি বলা যায় একে?
আজ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে শ্রী আপ্পুর কথা বেশি করে মনে পড়ে৷ তাঁর মতন ব্যক্তিত্ব, ন্যায়বোধ এবং মেরুদণ্ড সোজা রেখে কাজ করার ক্ষমতা গত প্রায় চার দশকে কারো মধ্যেই আর দেখিনি৷ তবে বিহারে প্রথম কাজ করতে গিয়ে দু’জন অসাধারণ আইএএস অফিসারকে পেয়েছিলাম - একজন কে বি সাকসেনা; অন্যজন, যিনি আমাকে হাতে কলমে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেট অবস্থার কাজ শিখিয়েছিলেন৷ পাটনার বঙ্গসন্তান অনুপ মুখোপাধ্যায়৷ ন্যায়পরায়ণতা এবং সততা - এ দু’টি যে কাগজের তত্ত্বের বাইরে, জীবনে শিকড় জড়িয়ে রাখা এক সম্পূর্ণ জীবনদর্শন, অতি অল্প বয়সে এমন মানুষদের কাছে শিখে নেওয়ায় চলার পথের কষ্ট, বঞ্চনাবোধ অনেকটাই প্রশমিত হয়েছিল৷
প্রায় ছত্রিশ বছর একটানা প্রশাসনে থাকার ফলে আমি কর্মজীবনের মধ্যবর্তী পর্যায়ে এসে পেয়েছিলাম সেই গুরুত্বপূর্ণ বাঁক - অর্থনৈতিক উদারিকরণের প্রক্রিয়া ১৯৯২-তেই আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল৷ আমি যখন কলকাতার বৈদেশিক বাণিজ্য দফতরে কেন্দ্রীয় নির্দেশক ১৯৯৬-২০০১ এই পর্বে, তখন তা রীতিমত প্রস্ফূটিত৷ আর একবিংশ শতকের প্রভাতের উন্মোচনই হল বিশ্বায়নের ডানা মেলার মধ্য দিয়ে৷ ভারতীয় প্রশাসনিক সেবার কর্ম-সংস্কৃতি ও তার সদস্যদের মানসিকতার যে পরিবর্তন ঘটতে আরম্ভ করল, তার সূচনাও এই সময়৷ আমরা জীবন আরম্ভ করেছিলাম সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধতার শপথ মাথার মধ্যে নিয়ে - আমাদের কাজ ছিল গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য দূরীকরণ, শহরাঞ্চলে শিল্পায়নও পাশাপাশি চলেছে - কিন্তু আমাদের কাজের দায়বদ্ধতা যে সাধারণ মানুষের প্রতি, কাগজে কলমে অন্ততঃ তার শীলমোহর ছিল৷
সাক্ষরতা অভিযানের বিপুল জনসংযোগ পর্ব শেষ করে, গ্রামে গ্রামে ঘুরে আমি যখন রাজধানীতে ফিরলাম, তখন জলসম্পদ বিভাগের পরিকাঠামো পরিবর্তনে বিশ্বব্যাংকের বড়সড় বিনিয়োগ আমার তত্ত্বাবধানে এল৷ কিছু শর্তসাপেক্ষ অবশ্যই - তার মধ্যে জনকল্যাণকারী শর্ত হ’ল পূর্ণাঙ্গ একটি পুনর্বাসন নীতি; একইসঙ্গে একটি শঙ্কা জাগানো প্রস্তাব - বাজার দরে সেচ-এর ব্যয় আদায় চাষীদের কাছ থেকে৷ এর পর কলকাতায় যখন বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগে গেলাম, ততদিনে আমদানি রফতানি নিয়ন্ত্রক দফতর-এর নাম বদলে হয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্য বিকাশ মন্ত্রক৷ বাণিজ্য বিকাশ নামটির তাৎপর্য আছে। এই নামের পিছনে লুকিয়ে আছে সুদের হার হ্রাসের সাথে সাথে আমদানি শুল্ক হ্রাস বা বিলোপ এবং রফতানিতে প্রোৎসাহন(incentive) মূলক অনুদান৷ অর্থাৎ, একটি বিশেষ অঙ্কের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা যদি রফতানি মারফত আনা হয়, সেই রফতানিকারকের পাসবুকে দেওয়া হবে বিশেষ অঙ্কের ক্রেডিট, যা তিনি আমদানি শুল্কের জন্য খরচে ব্যবহার করতে পারবেন৷ কলকাতার অফিসে বসে দেখতে পেলাম বেশ কিছু অসৎ বণিকের চেষ্টা রফতানির অঙ্ক বাড়িয়ে দেখানোর৷ আমদানি শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতাও বেশি করে দৃশ্যমান হচ্ছিল৷ একই সঙ্গে বাড়ছিল হাওয়ালার কারবার৷ সন্ধিগ্ধ ব্যক্তি ও কম্পানিদের তালিকা এনফোর্সমেন্ট ডায়রেক্টরেট-এ পাঠিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম৷ কিন্তু উক্ত বণিকবৃন্দ যখন আদর-আপ্যায়ন করে পাঁচতারা হোটেলে লাঞ্চ বা ডিনারে ডাকতেন মিটিং-এর ছুতোয় তখন মুখোশের আড়ালে মুখ দৃশ্যমান হয়ে পড়ত এবং সে অন্ন গলা দিয়ে নামতো না৷
অর্থনীতিতে বৈদেশিক বাণিজ্য এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের গুরুত্ব বাড়ছিল৷ পরিপুষ্ট হচ্ছিল বণিক সমাজ, হাওয়ালা ব্যবসায়ীরা এবং মধ্যবর্তী বর্গ৷ একই সঙ্গে রাজস্বের স্রোত হিসেবে ভূমিরাজস্ব-র গুরুত্ব কমছিল, মূল্যবান হয়ে উঠছিল নগরায়ণ৷ মেট্রো শহর ও তার চেয়ে ছোট শহরের জমির পরিমাণ যথেষ্ট নয়৷ মফস্বল গ্রাম থেকে জীবিকার সন্ধানে আসা মানুষের স্রোত বাড়তে লেগেছে, কারণ কৃষি আর ছ’মাসের বেশি জীবিকার অবলম্বন যোগাতে সক্ষম নয়৷ নাগরিক দারিদ্র্য লক্ষ্য করার মত আকারে পৌঁছেছে এই সময় এবং বস্তি অঞ্চলে বেআইনি বস্তি ঝুপড়ির সেলামী ও ভাড়া আদায়ের কালোবাজারী গোষ্ঠীও ফুলে ফেঁপে উঠেছে৷
শহরে নব্বই-এর দশকে বসত বাড়ির ব্যবসায় যারা নেমেছিল সেই প্রোমোটারদের আদি ভার্সন হচ্ছেন একবিংশ শতকের গোড়ার দিকের ডেভেলপাররা৷ বড় বড় বিল্ডিং কমপ্লেক্স ও সন্নিহিত জমি - যার পোশাকি নাম রিয়েল এস্টেট, সেই ব্যবসায় হাত রাঙা করে এঁরা ঢুকতে চাইলেন স্পেশাল ইকনমিক জোন এর ক্রমপ্রসারমান অর্থনীতিতে৷ স্পেশাল ইকনমিক জোন প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রীয় আইন পাস হয়েছে ২০০৫-এ এবং বুদ্বুদটি বাড়তে বাড়তে প্রায় কেটেই গেছে এক দশকের মধ্যে৷ ‘উপযুক্ত’ প্রোৎসাহনের অভাবে পরিকাঠামো তৈরি হতে পারেনি, তাই নতুন শিল্প আসেনি, এবং ডেভেলপাররা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চাইছেন এসইজেড তকমা বার করে নিয়ে জমিগুলি নিজেদের কব্জাগত করতে৷ কারণ অধিকাংশ নতুন এসইজেড এর জমিই বাজারদরে চাষিদের কাছ থেকে কেনা৷ এসইজেড এর তকমা ক্যানসেল হলেও জমি ফেরানোর কোন আইনি পদ্ধতি নেই৷
বিশ্বায়নের ফলে যে আর্থসামাজিক পরিবর্তন চোখের ও মনের অগোচরে প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছিল, তা যেমন নির্বাচনের রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছিল, তেমনই ‘স্থায়ী প্রশাসক’ বর্গকে, যাঁরা রাজনীতির পরিবর্তনের স্রোতের মধ্যে দাঁড়িয়ে শাসনের কাঠামোটিকে অটুট ধরে রাখেন৷ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে মুনাফা কেন্দ্রিক নানা ধরনের অর্থ উপার্জনের রাস্তা তৈরি হচ্ছিল৷ অনেকেই জানেন না, তখনও, অর্থাৎ ষষ্ঠ পে কমিশনের আগে, একজন মোটামুটি সৎ প্রশাসক আয়ের হিসেবে নিতান্ত মধ্যবিত্ত৷
টাকার জোয়ারে নৈতিকতার কাঠামোর রং, মাটি, অলংকার ইত্যাদি ধুয়ে গিয়ে ভিতরের খড় আর দড়ি বেরিয়ে পড়ছিল৷ পরিচিত বন্ধু-সহকর্মীদের দেখছিলাম, তাঁরা মধ্যবর্তীদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে বিদেশে ও দেশে শপিং করছেন, বিদেশ যাত্রাকালে পকেটে ভরে দেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত বৈদেশিক মুদ্রা, দুয়ারে এসে দাঁড়াচ্ছে মার্সিডিজ, বিএমডব্লু৷ যে সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে সামাজিক আনাগোনা ছিল না, তাঁদের পার্টি আর গেট টুগেদারে পরিবার বর্গের আনাগোনা বাড়ছে৷ এমপি-র ডেভেলপার শ্যালক হয়ে যাচ্ছেন ডিএম এর টেনিস পার্টনার৷ অর্থাৎ আর্থ-সামাজিক ছুঁৎমার্গ থাকছে না৷ সার্ভিসের গোড়ার দিকে, আমি তখন হাজারিবাগে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেট, একজন সিনেমা হল মালিককে প্রতিবেশী জেলার ডিএম-এর কাঁধে হাত রাখতে দেখে আশ্চর্য হয়েছিলাম৷ মধ্যবিত্ত আমাদের সামনে যখন পুঁজিতান্ত্রিক ভোগবাদ শিং নেড়ে দাঁড়াল, তখন আর্থিক সামর্থ্যকে মজবুত করার জন্য বদলাতে হল সামাজিক আত্মীয়তার ধরন৷
এই সময় থেকেই প্রশাসনিক সেবায় সৎ অফিসাররা সংখ্যালঘু হয়ে গেলেন, এবং আপোসমুখী দুর্নীতিপরায়ণদের সংখ্যা বাড়ল৷ বলাই বাহুল্য যে, দুর্নীতির ব্যাপারটা কেবল অর্থভিত্তিক নয়৷ এর বহুমাত্রিক অস্তিত্ব নানা দিকে অ্যান্টেনা বাড়িয়ে আছে৷ আর্থিক দুর্নীতির বহু কেস যেমন এই পর্ব থেকে জনসমক্ষে এসেছে, রুদ্ধ হয়ে এসেছে ন্যায়পরায়ণতার পথ এবং অসাধুতার সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করার মত সাহস৷ হর্ষ মন্দরের মত নির্ভীক, ন্যায়পরায়ণ অফিসার রাজনৈতিক হিংস্রতার প্রতিবাদে সার্ভিস থেকে বিদায় নিয়েছেন৷ কিন্তু আরও আশ্চর্য, যে আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে তিনি কাজ করছিলেন, সরকারের চাপে তাঁরাও তাকে পরিত্যাগ করে৷ যাঁরা বুদ্ধিমান বিচক্ষণ এবং টাকার বহমানতাকে পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন, তাঁদের অনেকেই ব্যক্তিগত মালিকানার সংস্থায় যোগ দিয়েছেন সরকারকে ত্যাগ করে৷ একবার রক্তের স্বাদ পেলে জনসেবার মূল্যবান নীতিগুলি স্মরণে থাকে না৷
আজ যখন দেখি ভারতের বিদেশ সচিব অবসর গ্রহণের পর একবছর হতে না হতেই বৃহৎ বেসরকারী সংস্থার ডায়রেক্টরশিপ গ্রহণ করছেন, যিনি বেসরকারী বড় কম্পানীর জমি লীজ সংক্রান্ত বিষয় দেখছিলেন, সেই পূর্বতন মুখ্যসচিব যখন চাকরী ছেড়ে উক্ত কম্পানির বোর্ডকে অলংকৃত করতে বলেন, তখন বুঝি বিশ্বায়নের সঙ্গে প্রশাসনিক সেবার সদস্যদের নৈতিকতার পণ্যায়নও প্রায় সম্পূর্ণ৷
আমাদের অধিকাংশই এখন মুখে তো নয়ই, ফাইলের কাগজে দু’কলম লিখেও সরকারের জনবিরোধী কোনও নীতির প্রতিবাদ করতে সংকুচিত ও ভীত বোধ করেন৷ ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে একমত হওয়ার মধ্যে একধরনের আত্মসন্তুষ্টি আছে, ‘সত্য’ না হয়ে ‘প্রিয়’ হওয়ার মধ্যে যথেষ্ট আরাম৷ দরিদ্ররা আজও আছেন, দেশের দারিদ্র্য অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সঙ্গে পা মিলিয়ে বহুমাত্রিক হয়ে উঠেছে, কিন্তু আমাদের অধিকাংশ সতীর্থ-র চিত্ত থেকে হারিয়ে গেছে তাঁদের অস্তিত্ব৷ সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক শোষণ তাঁদের মনে তখন আর কোনও অনুভূতি তরঙ্গ তোলে না৷ তবু এখনও অল্পসংখ্যক কিছু মানুষ আছেন, আত্মমর্যাদা ও সংবিধানের প্রতি প্রত্যয় যাদের প্রান্তিক করেছে রাষ্ট্রের কাছে, কেন্দ্রের অহংকৃত অস্তিত্বের সামনে৷ তাঁরা এখনও পিছন ফিরে তাকান৷ জাতীয় আকাদেমীর সেই অনুপ্রেরণারঞ্জিত দিনগুলি মনে পড়ে৷ পি এস আপ্পুর মুখখানি এই দূরত্ব থেকে কেমন যেন ঝাপসা দেখায়৷
Link: http://ebongalap.org/jolotole-kharer-kathamo