26-04-2024 05:23:15 am
Link: http://ebongalap.org/judiciary-and-justice-triple-talaq
নাজিব ফেরেনি প্রায় দেড় বছর অতিক্রান্ত। আখলাখ ও কিশোর জুনাইদ হত্যার দগদগে ঘা বুকে। দেশের কোনায় কোনায় ‘লাভ জিহাদ’ ও গোরক্ষকদের বাড়বাড়ন্ত। অনিশ্চয়তা, সন্দেহ, অবিশ্বাসের ধারাবাহিক সফর যখন এভাবেই জারি তখন তিন তালাকের রায়কে ইসলামবিরোধী হিসাবে আখ্যায়িত করায় মুসলিম সমাজে প্রাথমিকভাবে একটা আলোড়নের সৃষ্টি হয়। তার কারণ যেমন জয় তেমনই অপ্রত্যাশিত এক প্রাপ্তি। বিগত দিনে শাসকের সদিচ্ছা নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো বিশ্বাসের বন্ধন তৈরি হয়নি। আশঙ্কা এই বুঝি কি হয়! কিন্তু দেখা গেল মুসলিম সমাজের যে দাবি ছিল যে, তিন তালাক কোরানে নেই সেই দাবিই বিচারে ভাষা পেল। তাই একদিকে ন্যায়বিচার অন্যদিকে ইসলামের নাম দিয়ে চালানো এক কুপ্রথা বন্ধ হল, মানে যে সংস্কার কোনো মুসলিম শাস্ত্রজ্ঞের করার কথা ছিল তা মহামান্য আদালত সম্পন্ন করল। পিটিশনার যেহেতু তিন তালাকের শিকার সুতরাং সমাজ সংস্কারে তাদের অগ্রগণ্য ভূমিকা ইতিহাস তৈরী করল। এই ঐতিহাসিক মুহুর্ত মুসলিম মেয়েদের একান্তভাবে অর্জিত। জয়ের পতাকা তাদের হাতেই রইল। আমরা উদযাপনের মিছিলে পা মেলালাম, শরিক হলাম। একই সাথে জেন্ডার জাস্টিস প্রতিষ্ঠিত হল। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ও সমাজনির্মিত বশ্যতা স্বীকারের বেঁধে দেওয়া গণ্ডীর বাইরে মুসলিম মেয়েরা পা রাখল। লক্ষণরেখা পেরোল সদর্পে, আদায় করে নিল যা তারা চেয়ে এসেছে বহুযুগ। প্রশ্ন রয়ে গেল দেশের সবখানে, সবপ্রান্তের সব মুসলিম মেয়েদের কি এই জিত? এই রায় তাদের জীবনে সত্যিই কি নতুন দিগন্তের বিস্তার করল? বদলে গেল কি তাদের আগামীর সকাল?
মুর্শিদাবাদে সোজা কথায় মুসলিমদের সংখ্যা অনেক। বিশেষত মেয়েরা প্রান্তিক। মাঠে স্বামী বা পরিবারকে নানা সাহায্য, বিড়ি বাঁধা, পারিবারিক গৃহকর্মে তাদের সারাদিনে ফুরসত মেলে না। জঙ্গীপুরের জামিলা বিবির স্বামী কেরালায় কাজে গেছেন। তিন ছেলেমেয়ে। বিড়ি বেঁধে সংসার চলে। স্বামী আগে ঈদের সময় আসত, এখন শুধু সামান্য টাকা পাঠায়। প্রথমে প্রতিবেশীর বাড়িতে ফোন করত, কিন্তু এখন তাও বন্ধ। তাকে তালাকের রায় নিয়ে জিজ্ঞাসা করায় সে জানাল, ‘মোবাইল নেই, চালাতেও পারি না। স্বামী তালাক দিলেও জানি না’। মাঠে স্বামীকে ভাত দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে নিজের পরিচয় ‘আমি সাদ্দামের মা’ বলা মহিলার ভাষায়, স্বামীর মুখে শুনেছি তিন তালাক হবে না। কিন্তু আমাদের এখানে মেয়েদের স্বামী বাইরে কাজে গিয়ে কয়েক বছর পর বাড়ি আসা বন্ধ করে দেয়। হাঁড়ির ভাত মেয়েরাই জোগাড় করে। তালাক না হয়েও তো তালাকি থেকে যায়’! লালবাগের সোহাগী জানায় ক্লাস টেন পাশের আগে বিয়ে হয় তার। স্বামী কিছুদিন পর আরেকটা বিয়ে করে তারপর মুম্বাই পালিয়ে যায়। এখন সে আর তার সতীন মিলে সেলাই মেসিন কিনে কাজ করে। দুজনেরই সন্তান না থাকায় কোনোরকমে চলে যায় দিন। তালাকের রায়ের কথা শুনে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বলে ‘এবার আনসারদের(তাদের স্বামী) রেহাই নাই তবে’! ইসলামপুরের সাবিনা বিবি জানায় ‘লেখাপড়া জানা মেয়েদের তালাক বড় সমস্যা নয় কিন্তু বাচ্চাওয়ালা পড়াশুনা না জানা মায়েদের খুব দুর্দশা’। বহরমপুরের জানেরা বলে, ‘কাজ করে খাই। স্বামী রিক্সা চালায়। ঘরে পয়সা দেয় না, নানা অজুহাতে টাকা কেড়ে নেয়। হাতের চুড়িটুকু আছে স্বামীর জন্য তাই কিচ্ছু বলি না। এমন স্বামীদের তো মেয়েদেরই তালাক দেওয়া উচিত’। ধুলিয়ানের শিরিন বলে ‘এলাকা জুড়ে মেয়েদের মধ্যে খুশির হাওয়া কিন্তু মৌলবিরা বলছে, তাদের কথাই কোর্ট বলেছে। এ আর নতুন কি? তালাক-ই-বিদ্দত তো ইসলামে ছিলই না’। যদিও বেশিরভাগ মুসলিম মহিলাদের এখানে প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিকস মিডিয়ার অ্যাক্সেস নেই। খবর শোনা বা কাগজ পড়া মেয়েদের সংখ্যা নগণ্য। বেশিরভাগ তারা যা শোনে তা পরিবার থেকে, তাই তাদের আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও প্রকাশ সেটাই পায় যেটা তাদের বোঝানো হয়। মোট কথা, তিন তালাক উঠে যাওয়া তাদের কাছে খুব ঐতিহাসিক হয়ে ওঠেনি। প্রতিদিনের টানাপোড়েন ও গৃহকর্মজীবনের চাকায় পিষে যাওয়া তাদের কাছে জীবনের মূল ইতিহাস।
শিক্ষিত, উদার মুসলিম পরিবার এই রায়কে একটি ভিন্ন দিশায় দেখছে। সকলেই সম্মতি দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে আগামীর দিকে তাকিয়ে বৃহত্তর পরিবর্তনের অপেক্ষায়। তারা মানছে মুসলিম মহিলাদের সমস্যা অনেক। তিন তালাক বন্ধ দিয়ে শুরু যে পথ চলা তা নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী মুসলিম সমাজ সংস্কারের ইতিহাসে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অধ্যাপক জানান, আদালতের রায় দিয়ে একটা সিস্টেমের পরিবর্তন হতে পারে না। শুধু তার প্রয়োগ সীমিত করে মাত্র। এখানে তিন তালাক সীমিত মাত্রায় প্রয়োগ হয়ে থাকে। মুসলিম মেয়েদের মূল সমস্যার পরিধি অনেক বিস্তৃত। যেমন অশিক্ষা, দারিদ্র, বহুগামিতা। পেশায় শিক্ষিক নাসরিন বেগম বলেন, শুধু তিন তালাক নয়, সামগ্রিক ভাবেই তালাক পদ্ধতির বিরোধিতা করছি। খুলা তালাকের অধিকার মুসলিম মেয়েদের একতরফা থাকলেও শুধুমাত্র শিক্ষিত ও আত্মনির্ভরশীল মেয়েরাই তার প্রয়োগ করতে পারে। ছেলেদের মত মুসলিম মেয়েদেরও তালাক দেওয়ার ব্যাপারে সমানাধিকার থাকা উচিত। সন্তান শুধু মেয়েদের—এই অজুহাতে ছেলেরা তালাক দিয়ে পালাচ্ছে। একজন মা ও তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীসহ সন্তানের ভরণপোষণ নিয়ে পারসোন্যাল ল কোনো সমাধানের পথ দেখায়নি। একইভাবে সমাজকর্মী মরিয়ম জানায়, তালাকের সঙ্গে নিয়মানুসারে মোহর মিটিয়ে দেওয়ার নিয়ম ছেলেপক্ষ কখনোই মেটায় না। তালাক পাওয়া মহিলাকে ভিটে ছাড়তেও বাধ্য করা যেখানে মহিলাদের হাতিয়ার গ্রামের সালিশি ও মৌলবিদের মতামত। কোর্টে যাওয়ার মত পয়সা বা পারিবারিক সমর্থন তারা পায় না। তিন তালাকের স্বল্প পরিসরের বাইরে মূল কথা স্পষ্ট—গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় থাকা হাজার হাজার অসংগঠিত তালাকপ্রাপ্ত মহিলাদের সুরক্ষা কে দেবে? স্থানীয় মওলানা নাকি আদালত?
রায়ে সম্মতি আপামর মুসলিম সমাজে। ভাষা বা ভাবনার হেরফের যাই হোক অসন্তোষ নেই কোনো কারণ রায় শরিয়ত সম্মত। পুরুষরা নিজেদের বিশ্বাস ও রায়ের মধ্যে ব্যাল্যান্স করে মতামত দিচ্ছে কিন্তু মেয়েদের মধ্যে থেকে প্রশ্ন উঠে এসেছে অনেক। যেমন এই রায় কি পুরুষের একাধিক বিয়ে বন্ধ করতে পারবে? তালাক দেওয়া মেয়েদের থাকার জায়গা, ছেলেদের লেখাপড়া নিয়ে কিছু সাহায্য স্বামীর কাছ থেকে পাও্য়া নিশ্চিত করবে? দৈনন্দিন খাওয়া-পরা, ঘুমোবার বিছানাটুকু জোগাড় যাদের কাছে জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য তাদের কাছে দিল্লী অনেক দূর। সমাজের বৃহৎ অংশে যুক্তি ও কুসংস্কারমুক্ত বাতাবরণ নির্মানের সম্ভাবনা সীমিত হয়ে আসছে। প্রতিবাদ গড়ে তোলার যে নিরাপত্তাহীনতা তা থেকে স্পষ্ট বক্তব্য রাখার মানুষের সংখ্যা কমছে। নিজের অবস্থান বাঁচাতে শিক্ষিত, বুদ্ধিমান মানুষ ব্যস্ত। একদম নীচের স্তরে যেখানে খুন্তি, কাস্তের বদলে প্রযুক্তি হাতিয়ার হয়নি সেখানে মেয়েদের মতামত প্রকাশের বলিষ্ঠতা নেই বললেই চলে। কিন্তু শোষণের পরিভাষা তারা বুঝেছে। তাই তারা উত্তর খুঁজছে।
একশ্রেণীর আধুনিক মুসলিম মেয়েদের দেখা যাচ্ছে। সংখ্যায় কম হলেও যারা বোরখাকে নিজেদের চয়েস বা সুরক্ষা ভাবে। মুখ ঢেকে তারা সিনেমাহলে ‘লিপষ্টিক আন্ডার মাই বুরখা’ দেখতে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের ছবি আপলোড করছে। তিন তালাকের রায় তাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এমবিবিএস প্রথম বর্ষের ছাত্রী নূরিমা জানায়, আদর্শ ধর্মীয় চর্চার অভাব মুসলিম পুরুষদের বিপথে চালিত করছে। তারাই তিন তালাককে জিইয়ে রেখেছে! আজ শরিয়তের নতুন করে জয় হয়েছে’। আইনজীবী নাজমা জানায় ‘চুরি হলে বা জমিসংক্রান্ত বিবাদে আমরা থানায় যাচ্ছি কিন্তু তালাক হলে যাচ্ছি মৌলবির কাছে। এই দ্বিচারিতা থেকে মেয়েদের যে মুক্তি দরকার ছিল তা কিছুটা হলেও এবারে হবে’। দর্শনের অধ্যাপক ফিরদৌস পারভিনের মতে, মুসলিম মেয়েদের ভালো বিবি হতে শেখানো হয়, তারপর ভালো মুসলিম মেয়ে তারপর ভালো মানুষ। ট্রাজেডি এখানেই’। এই দুঃখের শেষ কোথায়? একরাশ দুশ্চিন্তা মুখে নিয়ে ফিরদৌস বলে, ‘মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম সংলগ্ন আমাদের গ্রামে স্বামীর ভাত খেতে অনিচ্ছুক এক মেয়েকে পারিবারিক উদ্যোগে আয়োজিত সালিশিতে ডেকে বলা হয়, মা আর মাগি আলাদা। বল তুমি কি হতে চাও? কিন্তু তালাক দেওয়া পুরুষদের সামজিক স্ট্যাটাস যথেষ্ট মর্যাদার’।
মুসলিম সমাজকে একবিংশ শতকের উপযুক্ত করে তুলতে শুধু আইন নয়, প্রয়োজন ধারাবাহিক জ্ঞান ও যুক্তিচর্চার, মনে করে বহরমপুর নিবাসী কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণারত ছাত্রী আইরিন মণ্ডল। তিন তালাকের রায় তার মনে কিছুটা আশা জাগায়। সে দৃঢতার সাথে জানায় একমাত্র স্টেট ল এই মুহুর্তে মুসলিম মেয়েদের রক্ষাকবচ হতে পারে। মুসলিম সমাজের আভ্যন্তরীণ সংস্কারের অপেক্ষায় পলিগ্যামি বা হালালা ম্যারেজকে ফেলে রাখা মানে মেয়েদের আত্মমর্যাদাকে বিনষ্ট করা। প্রসিদ্ধ পেইন্টার, নাট্যকার, বিজ্ঞানী সংখ্যায় উল্লেখযোগ্যভাবে নেই এই সমাজে কিন্তু ধর্মবিশারদ সব্বাই। ১৪০০ বছরের ফেলে আসা ধর্মীয় বিধানে সবাই সহজে ফিট কিন্তু রিফর্মের প্রশ্নে সব্বাই ডিফেন্সিভ। সেই সমাজ থেকে মেয়েদের জন্য অধিকার আদায় করা মানে মহাকাশে বাসযোগ্য জমি কেনার স্বপ্ন দেখা। তবে কি শিক্ষা ও সচেতনতা একমাত্র পথ? আইরিন জানায় মুর্শিদাবাদে মেয়েরা বাল্য বিবাহ রুখে দিচ্ছে থানায় গিয়ে। এটাই তো সচেতনতার প্রমাণ। একদিন এরাই পলিগ্যামি, হালালাকে চ্যালেঞ্জ জানাবে।
‘কুছ কিয়ে হি বিনা জয় জয়কার নেহি হোতি, কোশিশ করনেওয়ালো কি কভি হার নেহি হোতি’। মুসলিম মেয়েদের মুখে এখন এই জয়ধ্বনি। একজন রামমোহনের অপেক্ষা ছিল এতদিন, এবার তারা বেন্টিঙ্ককে খুঁজে পেতে বসাতে চায় সামনের সারিতে।
Link: http://ebongalap.org/judiciary-and-justice-triple-talaq