18-04-2024 13:45:41 pm
Link: http://ebongalap.org/menopause-series-3-article-1
মেনোপজ নিয়ে লিখতে বসে আজ খুব আমার মায়ের কথা মনে পড়ছে৷ প্রায়ই মাকে বলতে শুনেছি—‘এ আপদ বন্ধ হলে বাঁচি৷’ ঋতুস্রাব শুরু হলে মা বিছানায় শুয়ে পড়তেন৷ প্রতিমাসে তিনদিন আমি স্কুলে যেতে পারতাম না—সংসারের সব কাজ আমাকে সামলাতে হত৷ মেনোপজ হওয়ার পর মা প্রতিমাসের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন কিন্তু দুঃখের বিষয় অল্পদিনের মধ্যেই মাত্র ৫৬ বছর বয়সে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান৷
মায়ের কথা আর মেনোপজ প্রসঙ্গে খুব সহজেই মনে আসে ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার দিনগুলোর কথা৷ সে ছিল ভয়ঙ্কর আতঙ্কের দিন৷ মেয়েদের মাসিক হওয়া নিয়ে কিছু আবছা ধারণা ছিল, আর তা ছিল রহস্যাবৃত৷ নিজের জীবনে সে ঘটনা কবে ঘটবে, কিভাবে মোকাবিলা করব—এ সবের কোনকিছুরই প্রস্তুতি ছিল না৷ প্রথম রক্ত দেখে মাকে বলতেও ভরসা পাই নি৷ প্রথমদিন প্যান্ট পাল্টে পাল্টে সামলাবার চেষ্টা করেছি৷ কিন্তু দ্বিতীয় দিন কোনোভাবেই আর সামলাতে পারিনি৷ ঘরের মেঝেতে রক্তের দাগ দেখে মা আড়ালে ডেকে নিয়ে কাপড়ের প্যাড বানানো, প্যাড পরা শিখিয়ে দিলেন৷ তার সাথে সাবধানবাণী, 'এখন তুমি বড় হয়ে গেলে, ছেলেদের সাথে সাবধানে মেলামেশা করবে৷'
প্রশ্ন করি--কেন?
উত্তর--'পেটে বাচ্চা এসে যেতে পারে৷'
কী আতঙ্ক!!!
বড় হওয়ার আনন্দ কোথায়?
মাসিক হলে স্কুলে যাওয়া ছিল আরেক নরকযন্ত্রণা৷ স্কুলে মেয়েদের বাথরুম ছিল না৷ মাসিক শুরু হওয়ার দ্বিতীয় দিনে স্কুলে যেতেই পারতাম না৷ উল্লেখ করা দরকার যে স্কুলে পড়তাম সেটা ছিল ছেলেদের স্কুল৷ এলাকায় কোন মেয়েদের স্কুল ছিল না৷ সময়টা হল ১৯৬১ সাল, বর্ধমান জেলায় ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিস গড়ে উঠছে৷ বর্ধমান শহর থেকে একঘন্টা দশ মিনিট লাগত বাসে করে ওই এলাকায় পৌঁছতে৷
আমার বাবা ওখানকার বিডিও অফিসে কাজ করতেন৷ সরকারি কর্মচারির মেয়ে হওয়ার সুবাদে বিশেষ অনুমতি নিয়ে আমাকে ছেলেদের স্কুলে প্রায় জোর করে ভর্তি করা হয়৷ স্কুলে শ’য়ে শ’য়ে ছাত্র৷ কোন শিক্ষিকা নেই, সবাই শিক্ষক৷ আমি একা ছাত্রী, এই রকম স্কুলের পরিবেশে সকাল সাড়ে নটার সময় এক টুকরো কাপড়ের প্যাডের উপর ভরসা করে কপাল ঠুকে স্কুলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা কী ভয়ঙ্কর হতে পারে, আশা করি পাঠকেরা তা বুঝতে পারছেন৷
এর অনেক অনেক বছর পর মেনোপজ যখন ‘আসছি’ বলে জানান দিচ্ছে তখন আমি ইনটেলেকচুয়ালি অনেক প্রিভিলেজড৷ কলকাতায় থাকি। সেই সময় স্বয়মে কাজ করি৷ মেনোপজের নানা সমস্যা নিয়ে সহকর্মী, বন্ধুদের মধ্যে আলোচনা হত৷ আমার হঠাৎ হঠাৎ অসহ্য গরম লাগত৷ বালু হক্কাক লেনে তখন স্বয়ম-এর অফিস৷ মনে আছে একদিন এত গরম লাগছিল বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার খুলে বহুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম৷
না-জানা, ভুল-জানা
আমি অন্য অনেকের বেলায় দেখেছি চল্লিশের কাছাকাছি বয়স হলে ঋতুস্রাব অনিয়মিত হয়ে যায়৷ তখন তাঁরা ভাবেন তাঁদের মেনোপজ হয়ে গেছে৷ কিন্তু কিছুদিন বাদে গর্ভ ধারণের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে৷ অনেক সময় এতটাই দেরি হয়ে যায় যে গর্ভপাত করাবার সুযোগও থাকে না৷
যন্ত্রণাদায়ক ঋতুস্রাব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অনেকেই মেনোপজের জন্য অপেক্ষা করেন৷ তাড়াতাড়ি মেনোপজ না হলে তাঁরা ডাক্তারের পরামর্শে অপারেশন করিয়ে নেন৷ মেনোপজ যেমন কারো কারো ক্ষেত্রে মুক্তির আনন্দ এনে দেয় আবার অনেকের কাছে মেনোপজের ভয় মাথার ওপর খাঁড়া হয়ে ঝোলে৷ যারা একটু দেরীতে মা হওয়ার পরিকল্পনা করেন তাদের অনেকেরই ভয় থাকে—মেনোপজ হয়ে যাবে না তো! আমার এক বন্ধু মধ্য তিরিশে বিয়ে করে৷ বিয়ের কিছুদিন পরে জানতে পারি সে মা হতে চলেছে৷ খবরটা পেয়ে আমরা সবাই খুব খুশি৷ পরে জানতে পারি ডাক্তার ওকে পরীক্ষা করে বলেছেন, ওর গর্ভসঞ্চার হয়নি৷ ঋতুস্রাব বন্ধ হয়েছিল বলে আমার বন্ধু ভেবেছিলো ও গর্ভবতী হয়েছে আসলে ওর তখন মেনোপজ হয়ে গিয়েছিল৷
‘দ্বিতীয় বসন্ত’
চীনে মেনোপজকে বলা হয় ‘দ্বিতীয় বসন্ত’। এই ‘দ্বিতীয় বসন্ত’কে সৃষ্টিশীল এক নতুন যাত্রা শুরুর ইতিবাচক সময় হিসাবে দেখা হয়৷ অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে মহিলারা যে প্রজ্ঞা অর্জন করেছেন তার স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তাদের অভিজ্ঞতাকে নানাভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা হয়৷
২০১৩ সালে আইসলিঙ গ্রিমলে, একজন আইরিশ মহিলা ‘আমার দ্বিতীয় বসন্ত’ নামে একটি নিজস্ব ওয়েবসাইট গড়ে তোলেন৷ ৪৮ বছর বয়সে আইসলিঙ গ্রিমলের যখন মেনোপজ হয় তখন তিনি ছিলেন একেবারেই অপ্রস্তুত; মেনোপজজনিত নানা সমস্যার কিভাবে মোকাবিলা করবেন সেটা বোঝার জন্য তিনি যখন গুগুল সার্চ করেন তখন আইসলিঙ মহিলাদের উপযুক্ত বিশেষ কোন তথ্য জানতে পারেন না৷ এরপর তিনি বিষয়টি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং গবেষণালব্ধ তথ্য আইরিশ মেয়েদের সহায়তার জন্য ‘আমার দ্বিতীয় বসন্ত’ ওয়েবসাইটে দিতে থাকেন৷ তাঁর এই উদ্যোগের ফলে নিজের দেশে ও দেশের বাইরে, কয়েক হাজার মহিলার মেনোপজ সাপোর্ট গ্রুপ গড়ে ওঠে৷
উপরের উদাহরণগুলো উল্লেখ করলাম একটা কারণেই—কোন একটা শারীরবৃত্তীয় স্বাভাবিক বিষয়কে আমরা কোন দৃষ্টিতে দেখব, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ৷ হ্যাঁ, মেনোপজের সময় হট ফ্ল্যাশ হয়, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, প্রচুর ঘাম হয়, শরীরের ওজন বেড়ে যায়, এসট্রোজেন ও এজেসটেরন হরমন তৈরি কম হওয়ার জন্য হাড়ের ক্ষয় হয়, হঠাৎ হঠাৎ মুড চেঞ্জ হয়, হ্যাঁ হয়তো আরও অনেককিছু হয়—কিন্তু এই সব সমস্যাই কাটিয়ে ওঠার উপায়ও আছে৷ তার জন্য দরকার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি৷ এই সময়ে ডিপ্রেশন কাটিয়ে ওঠার জন্য মেনোপজ সাপোর্ট গ্রুপের সাহায্য, প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া দরকার৷ আর বন্ধুদের সাহচার্য অপরিহার্য৷ তবেই দ্বিতীয় বসন্তের সন্ধিক্ষণ কাটিয়ে মহিলারা হয়ে উঠবেন আরো প্রাজ্ঞ, জীবনকে উপভোগ করার জন্য আরো উদগ্রীব, আরো উন্মুখ!
আমার অবশ্য ‘দ্বিতীয় বসন্ত’-র সন্ধিক্ষণ সেভাবে টের পাওয়ার ফুরসৎ হয় নি। সে সময় আমার জীবনে এক ট্র্যাজেডি নেমে আসে৷ আমার স্বামী ক্যানসারে আক্রান্ত হন৷ ওই ক্যানসারের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিজের দিকে তাকাবার কোনো সময় ছিল না৷ অনেক বছর বাদে আজ আবার ফিরে দেখলাম।
Link: http://ebongalap.org/menopause-series-3-article-1