25-04-2024 01:46:10 am
Link: http://ebongalap.org/omon-mayer-mukhe-agun-poila-boishakh-special-blog-by-rangan-chakravarty
১
শ্মশানে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার এল অনি। প্রথমবার এসেছিল কলেজে থাকতে। সোহমের দাদু মারা গিয়েছিলেন, শ্মশানে এসেছিল ওরা কয়েকজন। ঘটনাটা মনে আছে অন্য কারণে, শ্মশান থেকে বাড়ি ফেরার পর মা স্যান্ডুইচ আর চা খেতে দিয়েছিল ওকে আর সুমিতাকে। সুমিতা একবার বলেছিল, আমরা কিন্তু শ্মশান থেকে এসেছি মাসীমা। রুমা বলেছিল, হাত পা ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ে নাও, তাহলেই হবে, বাড়ি গিয়ে চেঞ্জ করে নিও। অনি কাপড়টা পাল্টে নে, আর তোমরা বাইরের ঘরেই তো বসবে, অত ইনফেকশন নিয়ে বাড়াবাড়ির কিছু নেই। অনির মনে হয়েছিল মায়ের তুলনায় সেদিন অনেক কথা বলেছিল মা। আসলে মা সুমিতাকে পছন্দ করত, সুমিতাও মাকে। কিন্তু অত সহজে ঘটনাটা মেটে নি। বাসন্তীদিই ঠাকুমার কানে খবরটা লাগিয়েছিল। মা বাসন্তীদিকে কোনও দিন বকাবকি করেনি, ঘরের কাজ নিয়ে খিটখিট ঠাকুমাই করত, কিন্তু বাসন্তীদি কেন যেন মাকে সহ্য করতে পারত না, বলত এমন গিন্নি দেখিনি বাপু, সংসারের কোনও ব্যাপারে কোনও বক্তব্য নেই। গিন্নি তো নয় যেন টুরিস। ইংরেজি বলতে ভালোবাসে বাসন্তীদি। সেদিন তারপর সুমিতাকে শুনিয়ে ঠাকুমা নিজের ঘর থেকে চিৎকার করে বলেছিল, শ্মশান থেকে এসে আগুন ছোঁয়া নেই, কোনও আচার বিচার নেই, ছেলেকে কি শেখাচ্ছে? অমন মায়ের মুখে আগুন। আর যে ইচ্ছে সে ড্যাং ড্যাং করে যখন তখন আসে কেন. যত সব অসৈরন। শ্মশান না পিকনিক? সুমিতা চলে গিয়েছিল। অফিস থেকে ফেরার পর ঠাকুমার ঘর থেকে বেরিয়ে বাবা মাকে বলেছিল, ওইসব ভুলভাল শিক্ষা দিয়ে তো নিজের জীবনটা নষ্ট করেছ, এখন ছেলেরটাও নষ্ট না করলে চলছে না? মা কিছুই বলেনি আর। কারণ, মা কখনওই কিছু বলত না। যা বলার সব বাবা আর ঠাকুমা। মা অনিকে ছোটবেলায় অঙ্ক শেখাত। কী ভালো বোঝাত। অনি ক্লাস নাইনে ওঠার পর এক দিন বাবা বলল, অর্ধশিক্ষিত মাস্টারনি দিয়ে তো আর ছেলেকে পড়ানো চলবে না, এবার ওকে প্রোফেশনাল কোচিং-এ দাও। রোজ অনিকে দিয়ে আসত, নিয়ে আসতো ম, কিন্তু সেই দিনের পর আর ওর খাতায় হাত দেয়নি। খুব গোঁয়ার ছিল মনে হয় মা, ঠান্ডা জেদ। মা কিছুতেই ঠিক হারত না, ঠাকুমা, বাবা কেউ পারেনি। তাই কি ওরা আরও রেগে যেত? একটাই শুধু জোর করেছিল মা, ওদের ঘরে একটা ছোট টিভি কিনিয়েছিল বাবাকে দিয়ে, বাবা না থাকলেই নিউজ চ্যানেল দেখত, এনডিটিভি, বিবিসি, আল জাজিরা সব। এই নিয়েও ঠাকুমা আর বাসন্তীদি-র কী রাগ, মা যে ওদের সঙ্গে বসে সিরিয়াল দেখত না, তাই।
তারপর অনির চাকরি হল। সুমিতা তত দিনে দূরে সরে গিয়েছে। ঠাকুমা বলতে লাগল, অনির বিয়ে দেওয়া দরকার। মা কিছুই বলল না। একদিন মনে আছে বাবা মাকে বলছিল, ছেলের জন্য একটা সম্বন্ধ আনতে পারছ না? মা বলেছিল, আমি তো এ সব ঠিক জানি না। রেগে গিয়েছিল বাবা, কী জানো তুমি? কোন ছাইটা? যা জানতে সে তো আমার জানা আছে। মা আর কিছু বলেনি। বাবাই অফিসের কাদের সঙ্গে কথা বলে যোগাড়যন্ত্র করে সম্বন্ধ আনল। মা কিছুই বলল না, মেয়ে দেখতেও গেল না। তাই নিয়েও অশান্তি হল, মা বিয়ের বাকি সব কাজ চুপচাপ করে গেল। তারপর সেই বিয়ে ভেঙেও গেল, তুলিকা একটা চাকরি পেয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে গেল, অনি যেতে চাইল না। আসলে বুঝে উঠতে পারল না, কেন যাবে। বদলি হয়তো হয়ে যেত। তুলিকার বাবা বলেছিলেন, আইটিতে আছ, ব্যাঙ্গালোর যাবে না? কিছুদিন এই সেই টানাপোড়েন হল, তারপর তুলিকা জানাল, সে বিয়েটা ভেঙে দিতে চায়। বাবা চেঁচাল, ঠাকুমা কাঁদল, মা কিছুই বলল না। অনির কেন যেন বিয়েটা সম্পর্কে বিশেষ কিছু মনে ছিল না। এক বছর পর কাকুর কাছে বেড়াতে গিয়ে ভাইজ্যাগে ঠাকুমা মরে গেল, অনি আর বাবা গেল, মা গেল না। সত্যিই মা যেন এ বাড়িতে অতিথি ছিল। নিজের বলে কিছু ছিল না, অনিকেও যেন ভয় পেত, অনির কিছু হলে সবাই মাকে দোষী করবে বলে। ছোটবেলায়, অনেক রাতে মাঝে মাঝে অনেক রাতে ওর মাথায় হাত বোলাত, তাও যেন ভয়ে ভয়ে, বাবাকে লুকিয়ে। এই কয়েক মাস আগে, কেন যেন অনি মাকে একটা স্মার্টফোন কিনে দিয়েছিল। সেটাও মা ব্যবহার করত কি না কে জানে! মায়ের বাপের বাড়িতে তো কেউ ছিল না, বন্ধু কেউ ছিল বলে তো দেখেনি কখনও। ঝাড়গ্রামে নাকি কোনও চেনাজানারা থাকত, কেউ আসেনি কোনও দিন। তারপর মা নিজেই চলে গেল। প্যানক্রিয়াসে হয়েছিল ক্যান্সার। অনি চেয়েছিল মুম্বাই নিয়ে যেতে, মা রাজি হয়নি। বলেছিল… না মা কিছুই বলেনি, তবে মাকে নিয়ে যাওয়া যায়নি।
২
বাঁশের চাটাই মত জিনিসটার ওপর শুয়ে আছে মা, মানে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রচুর সিঁদুর মুখে মাথায় মেখে দিয়েছে বাসন্তীদি, যেন এত দিনে সুযোগ পেয়ে নিজের বিশ্বাস মায়ের মাথায় চাপিয়ে দিয়েছে। সিঁথিতে সিঁদুর নিয়ে যাওয়া নাকি মেয়েদের জন্য সাংঘাতিক সৌভাগ্য। কে জানে মা ভাগ্যে বিশ্বাস করত কিনা। এখন তো আর জানাও যাবে না। তবে রজনীগন্ধা মা খুব ভালোবাসত, সেই ফুলও অনেক আছে এখন এখানে। মা কি জানে? কানু কাকু, রীতা কাকিমা, পিকলু, শঙ্কর, পরেশদা ওরা এসেছে। খুব বেশি লোকবল নেই অনিদের। ম্যাটাডোরের লোকগুলো মাকে নামিয়ে টাকা নিয়ে চলে গিয়েছে। বাবা তো আসতে পারে নি, পরেশদাই সবটা দেখছে, করিৎকর্মা মানুষ, হাঁক ডাক দিচ্ছে, বডি এখন এক নম্বরে, এইসব বলছে। একজন পুরুত ডেকে এনেছে, সে কী সব বলছে, অনিকেও কী সব বলতে বলছে। অফিসের ধ্রুব ফিসফিস করে বলল, অনিরুদ্ধদা, মিস্টার কামাথ এসেছেন। অনি মুখ তুলে তাকাল, মিস্টার কামাথ মাথা নাড়লেন, তারপর খুব দামী সাদা ফুলের তোড়াটা মায়ের পায়ের কাছে নামালেন, নমস্কার করলেন। এবার একটা হাল্লা শুরু হল, বডি নাকি ঢুকবে, কামাথের ফুলের তোড়াটাকে কে একটা টান মেরে পাশের গাদাটায় ফেলে দিল, ধ্রুব চট করে তুলে নিয়ে বলল, স্যার, আমি বোকে-টা অনিরুদ্ধ-র ঘরে রেখে দেব, ওর মায়ের মেমোরিয়াল ফোটোর নীচে। কয়েকটা পাটকাঠি অনির হাতে দিয়ে পুরুত বলল, এবার এগুলোতে আগুন দিয়ে মায়ের মুখে একটু ছোঁয়াতে হবে। কীরকম একটা ভয় বুকের ভেতর উঠে এল, আগুন! মায়ের মুখে? মা’র লাগবে না? হাতটা ধরে পুরুত মায়েরর মুখের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ একটি মহিলার গলা বলল, অনিরুদ্ধ, যদি মাকে ভালোবাস, কমরেড রেবতীর মুখে আগুনটা দিও না বাবা।
৩
ধোঁয়া, ফুল, অগরু, সব গন্ধ মিলে মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল অনির। মা? রেবতী? মায়ের নাম তো রেবতী নয়। মায়ের নাম তো রুমা। কার গলা ছিল ওটা? অনি বলেই তো ডাকল। তারপর মায়ের মুখে আগুনটা অনি দিতে পারেনি। সব কী রকম গোলমাল হয়ে গিয়েছিল তার। পরেশদা ছুটে এসে কী সব বলল, বলল, ওকে, ওকে, অনি অল ওকে। এখন নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে অনি দেখল বসার ঘরে বাবা আর পরেশদা বসে আছে। সন্ধে হয়ে আসছে, বাসন্তীদি চা নিয়ে আসবে এবার। অনিকে দেখে পরেশদা বলল, আয় বোস। ঠিক আছিস? কে বল তো ওই মহিলা, একটা সিরিয়াস মোমেন্ট সাবোটাজ করে গেল। একে তখন তোর ওইরকম টেনশন, তখন তোকে কনফিউজ করে দিল, কী বলল বল তো ফিসফিস করে? ও দিকে গেট খুলে গিয়েছে। বডি তুলব না ওই মহিলাকে ফলো করব? যাই হোক, তুই কিছু ভাবিস না, আপনিও এ নিয়ে ভাববেন না মেসোমশাই। আমি সব মেকআপ করে দিয়েছি, পুরুতরা এই সব কেসে খুব এফেকটিভ, পুরোটা আমাদের দিকে পজিটিভই আছে। শাপ ফাপ দিয়ে কিছু করতে পারবে না। আর ওই মহিলা এলই বা কেন? গেলই বা কোথায়? খুব স্ট্রেঞ্জ না কেসটা? আরে আমার মায়ের মুখাগ্নি নিয়ে তোর বাঁ.. (কিছু একটা বলতে গিয়ে চেপে গেল) মানে, আপনি কিছু বুঝলেন নাকি মেশোমশাই? বাবা মাথা নাড়ল, না সে কিছু বোঝেনি। কিন্তু অনির মনে হল বাবা কিছু আন্দাজ করেছে, বলছে না। পরেশদা বললো, হতে পারে আগে পরের কোনও বডির ফ্যামিলি ডিসপিউট, রং নাম্বার করে বেরিয়ে গেল... বোকা...বাবার দিকে তাকিয়ে আবার চেপে গেল পরেশদা। বাসন্তীদি চা বিস্কুট নামাতে নামাতে বলল, কোথাকার কে এসে কী বলল, ছেলেটা না হয় মা হারিয়ে কনফুজ ছিল, তোমরা সবাই কি করলে? বৌদি যে এই ছেলে পেটে ধরেছিল সে তো আমি নিজের চোখে দেখেছি, আর মুখটা তো দাদাবাবুর কপি। মুখে আগুন দেবে না কেন? গলায় বিস্কুট আটকে পরেশদা বিষম খেল। অনি বুঝল, ঔরস, গর্ভ, পুৎ নামক নরক, ত্রাতা পুত্র, মুখাগ্নির অধিকার, সব মিলিয়ে বাসন্তীদি একেবারে ঠাকুমার ফর্মুলায় এক আখ্যান বানিয়েছে, এই সিরিয়াল আটকানো যাবে না।
৪
তিলজলার দিকে এর আগে কোনও দিন আসেনি অনি। বাগবাজার থেকে সেক্টর ফাইভে ছুটে চলা জীবনের রুটে এই দিকটা ছিল না কখনও। তবে, ওলা আর উবের সব জানে। সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠে দরজায় বেল দিল, এক মহিলা বেরিয়ে এলেন, মনে হল মায়ের বয়সিই হবেন, বললেন, অনি, এসো। শ্মশানের সেই কণ্ঠটা তার মাথায় বিদ্যুতের মত চমকাল। মহিলা বললেন, বোসো, চা আনি, বলে পাশের ঘরে চলে গেলেন। চার দিকে তাকিয়ে অনি দেখল, ছিমছাম সাজানো ছোট্ট ফ্ল্যাট। একটা ছোট টেলিভিসন, দুটো বড় তাকে বেশ কিছু বই, তার মধ্যে লর্ডস অফ দ্য রিং, রবীন্দ্র রচনাবলী চেনা যাচ্ছে, বেশ অনেক পেপারব্যাক, সারা পেরেটস্কি বলে কারওর অনেকগুলো বই। আর দেওয়ালে চে গুয়েভারার ছবি। ছোট্ট একটা ব্যুরোর ওপরে একটা ফ্রেমে অল্প বয়সি একটি মেয়ের ছবি, মনে হল এন.সি.সি ক্যাডেট বা কিছু হবে। দূর থেকে ঠিক বোঝা গেল না, উঠে দেখবার সাহস হল না। কিন্তু ছবিটা অনিকে টানতে থাকল।
চা বিস্কুট নিয়ে এসে মহিলা বললেন, আমি ছবি বারিক, রুমার ছোট বেলার বন্ধু। অবাক হল অনি। ছবি? কিন্তু মায়ের মোবাইলে তো একটাই নাম্বার সেভ করা, সেই নামটা তো নির্মলা। সেই নাম্বারে ফোন করেই তো ও জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি কি নির্মলা? মহিলা বলেছিলেন, হ্যাঁ। অনি বলল, আপনি ছবি? তাহলে নির্মলা কে? আর আপনি বলেছিলেন, কমরেড রেবতীর মুখে আগুন দিও না। রেবতী কে? কমরেড কেন? মায়ের নাম তো রুমা, বিয়ের আগে মাইতি ছিল, বিয়ের পরে দাস।
ছবি বললেন, তোমাকে সব বলছি বাবা। তোমার মা আর আমি পড়তাম ঝাড়গ্রাম কলেজে। তোমার মায়ের বাবা মা কেউ ছিল না, এক মামার কাছে বড় হয়েছিল, স্কুল থেকে আমরা এক সঙ্গে। তারপর এল নকশাল আন্দোলনের ঢেউ, আমরা দুজনেই ভিড়ে গেলাম, কলকাতায় তখন আন্দোলন শেষ হয়ে এসেছে, কিন্তু আমাদের ওদিকে নতুন করে ছড়িয়েছে। না বলে বাড়ি ছাড়লাম দু’জনে। আমাদের দলের সঙ্গে অন্ধ্রের নকশালদের যোগাযোগ ছিল, আমাদের নিয়ে যাওয়া হল জঙ্গলে রাইফেল চালানো শিখতে। উঠে গিয়ে সেই ছবিটা নিয়ে এলেন ছবি। বললেন, এই দেখ, তোমার মা, রাইফেল ট্রেনিং ক্যাম্পে। অনি দেখল পুরনো কোনও ক্যামেরায় তোলা সাদা কালো একটা ছবি, একটু ঝাপসা হয়ে এসেছে। তার অল্পবয়সি মা! কি সুন্দর দেখতে ছিল মাকে, কিরকম হাসছে বন্দুকটা কাঁধে নিয়ে, এই মা-ই ওরকম ম্লান হয়ে গিয়েছিল? এই হাসি তো সে কখনও দেখেনি। ছবি বললেন, আমাদের ছবি তোলার নিয়ম ছিল না, আমি লুকিয়ে তুলেছিলাম, ভাগ্যিস। একটাই ছবি আছে ওর আমার কাছে। জঙ্গলের ক্যাম্পে সব কমরেডদের নতুন নাম দেওয়া হত। আমাদের নাম দেওয়া হয়েছিল নির্মলা আর রেবতী, অন্ধ্রের দুই বিপ্লবী শহিদের নামে, দলের মধ্যে আমাদের ওই নামেই ডাকা হত। এর একটা কারণ ছিল। পুলিশ সব সময়ে সব পালিয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে জানতে পারত না। কিন্তু নাম বা ঠিকানা জেনে গেলে বাড়ির লোকেদের ওপর গিয়ে অত্যাচার করত। তবে কি জানো, বিপ্লবী দলেও সব কিছু যুক্তির ব্যাপার নয়, বিপ্লবটাই তো একটা রিচুয়াল। এই বিপ্লবী নাম আমাদের একটা মন্ত্রের মত ছিল। রাতে পাশাপাশি শুয়ে আমরা ফিসফিস করে পরস্পরকে ডাকতাম, কমরেড নির্মলা, কমরেড রেবতী, উচ্চারণটাই যেন একটা আলাদা জোর দিত। তোমার মা বলত, নতুন নামটা আসলে একটা নতুন জীবন। অনি বলল, মা বন্দুক চালাতে পারত? ছবি বললেন, রুমা ছিল আমাদের গ্রুপের সেরা শুটার। জঙ্গলের ক্যাম্প গার্ডদের একেবারে সামনে থাকত তোমার মা। অ্যাকশনে আগে আগে যেত। গ্রামে গ্রামে জোতদারদের বাড়িতে হানা দিতাম আমরা। ধানচাল নিয়ে চাষিদের মধ্যে বিলিয়ে দিতাম। প্যান্ট পরা মেয়ে, হাতে বন্দুক! গ্রামের বৌরা কী সম্মান করত আমাদের, বন্দুকে হাত বোলাত। বলতো, ওরাও আমাদের মত হবে। এমনি ভাবে কাটল দু’ বছর। তারপর এক রাতে ক্যাম্পেই ধরা পড়ে গেলাম আমরা ৭ জন, ২ জন মারা গেল পুলিশের গুলিতে। ভেতর থেকেই কেউ খবর দিয়েছিল। প্রথমে পুলিশের মার তার পর মেদিনীপুর জেলে নিয়মিত পিটুনি, ৫ বছর কাটল। একটা হাত দেখালেন ছবি, বিরাট কাটা দাগ। বললেন, মাটিতে ফেলে হাতের ওপর পাথর মারত, এখনও সোজা করতে পারি না। তোমার মায়ের পেটে লাথি মারত রোজ, রক্ত পড়ত খুব। কিন্তু মার খাওয়াটা সমস্যা ছিল না। সমস্যাটা ছিল অন্য… আমরা জেলে গিয়ে বুঝলাম, আমরা যা ভেবেছিলাম, গল্পটা ঠিক তা নয়। নেতারা সত্যি কেউ জানত না কীভাবে কী হবে, মারতে মারতে তো রাস্তা বেরোয় না। তার ওপর দলের মধ্যে এমন খেওখেয়ি যে সবাই পারলে সবাইকে ধরিয়ে দেয়। জেল থেকে বেরিয়ে আমরা দেখলাম, রুমার মামা মারা গিয়েছেন, ওর আর সত্যিই কেউ নেই। ও আমার বাড়িতেই এসে উঠল। আমরা ঠিক করলাম প্রাইভেটে পরীক্ষা দেব। রাতের পর রাত আমরা আলোচনা করতাম, কী হবে। আমি রাজনীতি থেকে বেরুতে চাইছিলাম, ভুলে যেতে চাইছিলাম। রুমা বলত, আমি ভুলতে পারছি না রে ছবি, পারছি না। ও বলত, ছবি, আমরা বড় ভুল করেছি, ওই লোকগুলোর কষ্ট, ওই পেটে লাথি মেরে শোষণ, এগুলো তো মিথ্যে নয়। আমরা ওদের জন্য কিছুই করতে পারিনি, বরং আমাদের জন্য ওরা আরও মার খেয়েছে। কী করব বল তো? কী করব? পরীক্ষাতে বসল না রুমা। ছটফট করতো সারাক্ষণ। বলল, আমি আর এইসব পড়তে পারব না। বললাম, কী করবি তবে? বিয়ে করে সংসার করবি? রুমা বলল, সেও তো আমি করতে জানি না। আমার তো সেই ট্রেনিং নেই। বলতাম, তবে কী করতে চাস? রুমা বলত, রাজনীতি, রাজনীতি করতে আমার বড় ভাল লাগে। একটা ঠিক রাজনীতি যদি পাই, চলে যাব। কিন্তু তার তো সুযোগ ছিল না। আমার বাড়ির লোক অস্থির হয়ে উঠছিল, দু’-দুটো জেল খাটা মেয়ে বাড়িতে। তোমার মা তো আবার পরের মেয়ে, বাড়তি দায়। রুমার সম্বন্ধ এল, তোমার বাবা আর ঠাকুমা দেখতে এলেন, রুমার মামার সামান্য যা জমি ছিল বেচে বিয়ে দেওয়া হল, আমার বাড়ির লোক বাঁচল।
তারপর বহু বছর কোনও যোগাযোগ ছিল না। আমি বিয়ে করিনি। প্রথমে স্কুলে, পরে কলেজে চাকরি করে জীবন কাটাচ্ছি। বাবা মা মারা গেলেন, ঝাড়গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে এই ফ্ল্যাটটা কিনেছি। তবে জানো, রুমার বিয়ের পরপর আমি তোমাদের বাড়ি একবার গিয়েছিলাম, তোমার বাবা আমাকে বলেছিলেন, আমি যেন কোনও দিন তোমাদের বাড়ি আর না যাই। তাই যাইনি। হঠাৎ কয়েক মাস আগে, তোমার মায়ের ফোন পেলাম, কী করে ঝাড়গ্রাম থেকে আমার নাম্বার যোগাড় করেছিল, আনন্দ হল খুব। রোজ সকাল ১১টায় সময় ঠিক হল। আমরা ফোনে কথা বলতাম। বেশিরভাগই রাজনীতির কথা বলত রুমা। সোনি সুরির কথা, নতুন দলিত আন্দোলনের কথা, মেয়েদের আন্দোলনের কথা। বলত, জানিস অনেক নতুন কিছু হচ্ছে, হয়তো একদিন আবার আমি আন্দোলনে যাব। তারপরে আবার নিজেই বলত, আমার আর হবে না, তাই নারে, তবে টিভিতে দেখি ভালো লাগে, আমার তো আর যোগাযোগ নেই। রুমা বলত, আমার বড় ভয় করে ছবি, আমরা এত বড় একটা আদর্শ নিয়ে এত ভুল করেছি যে অনিকে পথ দেখানোর দায়িত্ব আমি নিতে পারব না। ওকে ওর নিজের পথ বেছে নিতে হবে। ক্যান্সার হওয়ার খবরটা দিয়ে বলেছিল, ভালোই হল, অন্তত আর ভুল করবার সময়ও রইল না। ফোন বন্ধ হয়ে গেল। আমি হাসপাতালে আড়াল থেকে খোঁজ রাখতাম, ভেতরে যাওয়ার কার্ড তো ছিল না। তার ওপর তোমার বাবা যদি আমাকে দেখে ফেলেন...তখন তোমাকে দেখলাম, কত বড় হয়েছ তুমি, রুমার ছেলে। গতকাল হাসপাতালে গিয়ে শুনলাম, রুমা আর নেই। তোমাদের বাড়ি যাওয়ার সাহস হল না। কেন যে শ্মশানে গেলাম, কেন যে তোমাকে আটকালাম, আমি ঠিক জানি না। কিন্তু হঠাৎ তখন কেন যেন মনে হল আমার সেই পুরোনো কমরেড রেবতীর ছেলে আজ তার মুখাগ্নি করবে এটা তো হতে পারে না। রুমার জীবনে তো নিজের বিশ্বাস নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল, হয়তো পারেনি, আমরাই হয়তো দিইনি। ওর মৃত্যুর পরও তাই হবে? সেই সময়ে মুক্ত এলাকায় বুলেটে মৃত্যু হলে তো ওকে লাল কাপড়ে মুড়ে নিয়ে যেতাম, কত মানুষ আসতো সালাম জানাতে। এখানে শ্মশানে এখন এইসব হবে? যাতে ওর কোনও বিশ্বাস ছিল না, আজ ওর ছেলে, রুমার ছেলে তাই করবে? ওর দেহ নিয়ে? হঠাৎ রুমা মরে আমাকে কমরেড নির্মলা বানিয়ে দিল। কিছু মনে কোরো না বাবা। তোমাকে নিষেধ করার অধিকার তো আমার নেই, এটা পুরনো বামপন্থী স্পর্ধা বলতে পারো।
অনির সামনে একটি ২২ বছরের মেয়ের ছবি, হাতে বন্দুকের ট্রিগার, যে বিপ্লবের জন্ম দিতে চেয়েছিল। রুমা ওরফে কমরেড রেবতী। তার ভীরু, মুখচোরা মা।
© এবং আলাপ ও সংশ্লিষ্ট ব্লগার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। লেখা পুনঃপ্রকাশের জন্য www.ebongalap@gmail.com –এ ইমেল করুন।
Link: http://ebongalap.org/omon-mayer-mukhe-agun-poila-boishakh-special-blog-by-rangan-chakravarty