26-04-2024 07:06:21 am
Link: http://ebongalap.org/probase-eka-ebong-alap-shabnam-surita
গতকাল জীবনে প্রথমবারের মত নিজের কানে সত্যিকারের বন্দুকের আওয়াজ শুনলাম।
আমার এক বান্ধবী আছে, বেরনা, যে আমার জার্মান শুধরে দেয়, বদলে আমি তাঁকে ইংরেজি শেখাই। বেরনা তুর্কিভাষী জার্মান। আমি বাংলাভাষী ভারতীয়। আমরা একসাথে একটা সংগঠনে কাজ করি বাচ্চাদের সাথে। আমাদের ছাত্রীদের গল্পের ঝুড়ি খুললে শেষ হবার নয়। সে নাহয় আরেকদিনের জন্য তোলা থাক। সেসব আজ আর বলছি না। আজ বলি বন্দুকের গল্প।
যাই হোক, গতকাল আমি আর বেরনা দুজন মিলে রোদ মাথায় করে ইউনিভার্সিটির মাঠে গিয়ে বসি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয় আমাদের আড্ডায়, পড়াশোনায়। জার্মানিতে ইউরোপের অনেক দেশের মতই বসন্ত আর গ্রীষ্মকাল প্রায় একই রকম সেজে আসে। আগের শীতে ঝরে যাওয়া পাতারা সরে যায়। বদলে সদ্যজাত সবুজেরা গাছের ডালে উঁকি দেয়। মাঠের সবুজ যেন টিয়াপাখিকেও হার মানায়। আমি যে শহরে থাকি, সেই বন শহরের বৈশিষ্ট হচ্ছে চেরিগাছ। শহরটির পুরনো অংশের কয়েকটি রাস্তা জুড়ে সারি সারি চেরিগাছ। বসন্তের মাঝামাঝি গোটা রাস্তা জুড়ে গোলাপি হতে থাকে আশেপাশের সবকিছু সেই চেরিফুলের আভায়।
এমনই এক রৌদ্রজ্জ্বল দিনে মাঠে এসে বসি আমরা। এমন এক মূহুর্তে যখন আমরা দুজনেই মশগুল চরম আড্ডায়, হঠাৎ শুনতে পেলাম গুলির শব্দ! সে কী বিকট আওয়াজ! কিছুক্ষণ মাঠ জুড়ে সবাই কেমন মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। কিন্ত কয়েক মিনিট কাটতে না কাটতেই পরপর আরো তিনটি গুলির আওয়াজ! মানুষের কানফাটা চিৎকারে আমাদের তখন যায় যায় অবস্থা। চোখের সামনে দেখলাম অসহায়তা কেমন হয় আর আসলেই জীবনে আমাদের ঠিক কতটুক অপরিহার্য্য। হাতের ব্যাগ, সাইকেল, হেডফোন—যা কিছু ‘দামী’ সব এক লহমায় মাটিতে ফেলে কোলের বাচ্চাটুকুকে নিয়ে বাঁচতে চাওয়ার সেই এক আদিম দৌড়। আমিও কিন্ত দৌড়চ্ছি তখন, ব্যাগ-বোতল নিয়ে যতটুকু দৌড়নো যায়। আমার কাছে দামী বলতে কীই বা আছে এমন?
ততক্ষণে পুলিশ এসে গেছে। জানা গেছে, যে কেউ আহত হয়নি। একজন ডানপন্থী, বর্ণবিদ্বেষী ব্যক্তি খুব চেষ্টা করেছিলেন গুলি করতে বটে, কিন্ত সেই গুলি মানুষের গায়ে না লেগে, ফুটপাথে থাকা জলের হাইড্রান্টে লেগে যায়। ভাগ্যিস!
হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম আমরা দুজন। ক্ষণস্থায়ী ভয় কাটিয়ে ‘স্বাভাবিক’ হবার চেষ্টায় লাগলাম আবার। প্রায় আড়াই বছরের বিদেশযাপন থেকে আমার এটাই সবচেয়ে বড় শিক্ষা। আমার সাথে যাই হয়ে যাক না কেন, স্বাভাবিক হতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। কারণ এখানে আমি একা। আমার কোনো ‘আমরা’ নেই। রাতবিরেতের অসুখ, মাসকাবারির বাজার থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে দৌড়বার সময়ে হাতের ব্যাগটুকু—বিদেশ বিভুঁইয়ে এসব মিলিয়েই আমার রাজত্ব, আমার ঘরবাড়ি। ঠেকে শেখার ইস্কুলে একা শিক্ষার্থী আমিই এখানে। সুতরাং ঘাবড়ে গেলে চলবে না কিছুতেই। ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াতে হবে আমায়।
কিন্ত এই একা থাকাটাও বেশ অন্যরকম। প্রতিদিন একা একা চলতে গিয়ে আমার মতই আরো অনেকের সাথে পরিচয় হয়। তাদের চিনতে গিয়ে নিজেকেও বুঝতে শিখি। জানি, যে যুগটা উত্তর-আধুনিক ‘ফ্র্যাগমেন্টশন’-এর হলেও, এই একা চলতে শেখার মধ্যেও একটা ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’ আছে। বুঝি, আমি এমন এক প্রজন্মের প্রতিনিধি, যাদের এই বিদেশে থাকার একাকীত্ব দিয়েই একসূত্রে বাঁধা যায়। যাঁদের দৈনন্দিন লড়াই, উপলব্ধিগুলি পরোক্ষভাবে বিচ্ছিন্ন মনে হলেও আসলে একটি সুসংযুক্ত উপাখ্যান, যার পাঠে লুকিয়ে আছে একুশ শতকের নারী, শিক্ষা, শ্রমিক এবং রাষ্ট্রচিন্তার বিভিন্ন স্তর।
আমার সাথে বেরনার ভাষাগত, ধর্মগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক কোনো মিল না থাকলেও কোথাও একটা গিয়ে অনেক বড় কোনো এক সন্দর্ভে আমরা একাকার হয়ে গেছি। আমার এই লেখাগুচ্ছ তাই খুব একান্ত মনে হলেও, আসলে কিন্ত একার নয়। প্রবাসে থাকা আমার এই ধারাবাহিক ব্লগ নানাবিধ অভাবীদের গল্প শোনায়, যাঁদের কানের পাশ দিয়ে গুলি ছুটে গেলেও কোলে তুলে দৌড়বার কেউ নেই। যারা আপাতদৃষ্টিতে আলাদা। যাঁদের জীবনধারা বিচিত্র হলেও যাপনচিন্তায় গভীর সখ্য।
আমরা একলা থেকেও যৌথ হবার স্বপ্নে ভরপুর এই সিরিজের নাম হোক, প্রবাসে একা এবং আলাপ। যার হাত ধরে ব্যক্তি থেকে সমষ্টি হয়ে ওঠার পথে আমার, আমাদের পা আরেকটু শক্ত করে ফেলা যায়।
© এবং আলাপ ও সংশ্লিষ্ট ব্লগার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। লেখা পুনঃপ্রকাশের জন্য www.ebongalap@gmail.com –এ ইমেল করুন।
Link: http://ebongalap.org/probase-eka-ebong-alap-shabnam-surita