• কেমন গেল এই বছরটা পুরুষ হিসেবে?


    3    196

    December 15, 2017

     

    একটা বছর প্রায় ফুরিয়ে এল, হাতে আর কয়েকদিন মাত্র আছে। কেমন গেল এই বছরটা পুরুষ হিসেবে? খুব ভালো নয় বলেই মনে হয়। গোটা বছর পুরুষেরা আরও অনেক ধর্ষণ করল,ধর্ষিতদের মধ্যে অনেকেই একেবারে ছোটো, দু তিন বছরের বাচ্চাদেরও বাদ দিইনি। মেয়েদের ওপর অত্যাচার অবশ্যই বেশি তবে ছেলেরাও রেহাই পায়নি। কাজেই বাসে পাশে বসা বাচ্চার মা যদি আমাকে দেখেই বাচ্চাটাকে অন্য দিকে সরিয়ে বসান, দোষ দিই কী করে, শুধু মনটা খারাপ হয়, বলতে ইচ্ছে করে আমি ওরকম নই।কিন্তু তিনি ভরসা পাবেন কেন?

    আর শুধু তো যৌনতা নয়, সব কিছুতেই যা করে চলেছি আমরা পুরুষ জাত! বছরের শেষে তো আবার শুরু হয়েছে জেরুসালেম নিয়ে নতুন নাটক, সিরিয়া থিতিয়ে আসছে, যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে তো, তাই নতুন নতুন খোঁচা মেরে নতুন করে আগুন লাগাতে হবে।

    নিজরাই লাফিয়ে পড়ে ভুবনের ভার নিয়ে এমন অবস্থা। দিল্লির নাভিশ্বাস উঠছে, খেলতে গিয়ে বমি করছে সবাই, কী সাংঘাতিক সফল আমাদের সরকার। কিন্তু গাড়ি কমছে না। ফসল পোড়ানোর রাজনীতিও সহজ নয়।

    সত্যি ছেলে হয়ে জন্মেছি বলে মাঝে মাঝে হাত পা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে, কী লজ্জা, কী লজ্জা। আজকেই মুম্বাইয়ের কাগজে পড়লাম এক বাবা তার নাবালিকা মেয়েকে বহু বছর ধরে ধর্ষণ করছিলেন, মেয়েটির ঋতু শুরু হওয়া মাত্র তিনি অত্যাচার শুরু করেছিলেন, মে্য়েটির মা জানতেন, তিনিও মেয়েটিকে বাধ্য করতেন, মেয়েটির বহু বার গর্ভপাত করতে হয়েছে। এই অবধি গল্পটা চেনা, স্বামীর ওপর জীবন নির্ভর বলে আর নিজের ও মেয়ের নারীত্বের ওপর নিরূপায় ঘৃণা তেরি হয় বলে অনেক মায়েরা এই ভাবে অন্যায়ে শামিল হন। ভাবেন নারীর যৌনতাই একটা পাপ, তার তো এই প্রাপ্য। মেয়েটির বিয়ের পরে একটু অন্য রকম কাণ্ড ঘটে। সম্বন্ধ করে, স্বাভাবিক ভাবেই অত্যাচার গর্ভপাত ইত্যাদি গোপন রেখে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের পর মেয়েটি কী ভাবে যেন সাহস করে স্বামীকে ব্যাপারটা বলে। তার মানে এমন একটা সম্পর্ক ছেলেটির সঙ্গে তার হয়, যাতে সে সেই জোর পায়, আমাদের দেখা অনেক বিয়ের ক্ষেত্রেই প্রায় অসম্ভব বলেই মনে হয়। একজন বৌ তার স্বামীকে তার বিয়ের আগের যৌন অত্যাচারের কথা জানাতে পেরেছে, এটা বেশ অসাধারণ ঘটনা। কারণ, ওদিকে তো আমাদের আইআইটি, আইআইএম পাশ করা স্বামীরা বৌ অক্ষতযোনি বলে বিশ্বাস না হলে মসকিটো কয়েলের ছ্যাঁকা মারছে, আজকালকার স্বাস্থ্য সচেতন ছেলেরা তো আবার জিমে যায়, তারা  সিগারেট খায় না, তাই ‘টরটয়েজ’ এখন খুব বাজারে এগোচ্ছে। যাই হোক এখন সেই বাপটি গ্রেফতার হয়েছে, মা-টিও খুব সম্ভবত: গ্রেফতার। তবে এই মামলা তো এখন দু-তিনশো বছর চলবে, কাজেই কী হবে কে জানে, যেটুকু হয়েছে সেটাই অনেক। এই স্বামীটিকে তো জানি না, তবে সুমনের গানের সেই লাইন মনে হয়, ‘ভরসা থাকুক’।

    তবে এ বছরে নানান খবর দেখে একটা ভয় খুব বেড়ে গিয়েছে। চারদিকে যৌন অত্যাচার আর প্রতিবাদের খবরে, যৌনতাই যেন একটা ভয়ের আর পুরুষদের অত্যাচারের ব্যাপার হয়ে উঠছে? সেটা কি খুব ভালো হবে? বেশি লিখব না, সবটা মাথায় পরিস্কার নয়। দুটো প্রশ্ন করে আজকে ছেড়ে দেব। হতে পারে আমার ভাবনা ভুল। তবে গালাগালি না করে ভুল শুধরে দিলে খুশি হব:

    প্রশ্ন ১: সব যৌন জটিলতা/অসাম্য/ঠকানো কি ধর্ষণ?

    এই লেখায় মেয়ের ওপর বাবার অত্যাচারের ঘটনাটা যে ধর্ষণ সেটা তো বোঝাই যায়: মতের বিরুদ্ধে জোর করে অত্যাচার ও লিঙ্গপ্রবেশ করানো। লিঙ্গপ্রবিষ্ট না হলেও এই ধরণের অত্যাচারকে ধর্ষণ নিশ্চয়ই বলা যায়। কিন্তু সমস্যা হল ধরুন একজন কর্মপ্রাথীর সঙ্গে কেউ একজন কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলেন, একবার বা বারবার যৌন সম্পর্ক হল, তারপর তিনি কাজটা দিলেন না, বা কাজ দিলেন। আবার দুটি প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে মেয়ে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হল, ছেলেটি কথা দিল যে সে মেয়েটিকে বিয়ে করবে, পরে করল না, এই ক্ষেত্রে ওই অপরাধগুলো অপরাধ তো বটেই কিন্তু ধর্ষণ কি? আবার একটি সাবালক ছেলে একটি নাবালিকা, দুজনেই বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে, না বা করে, সহবাস করল, তারপর ধরা পড়ে গেল, সে ক্ষেত্রেও ছেলেটি কি ধর্ষক? আমি জানি না। এইসব কিছুকে এক করে দেখলে কি সামাজিক রাজনীতি একটু গুলিয়ে যায় না? এমন কী মেয়েদের সিদ্ধান্তের দায়িত্বকেও একটু ছোট করা হয় না? নানানরকম ঠকানোর দায় ইত্যাদি তো অবশ্যই, কিন্তু ধর্ষণ কী? যৌনতা একটা জটিল বিষয়, ক্রমশই বেশি করে মনে হচ্ছে, যৌনতাই সব রকমের ক্ষমতার একেবারে গোড়ার একটা বিষয়, তাই এত লুকোনো, একটু খোলাখুলি বোধহয় কথা বলা দরকার। তা নইলে নারীর ক্ষমতায়ন বোধ হয় হয় না। উল্টে একটা পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধই জোরালো হয়ে ওঠে, যে মূল্যবোধ বিয়ে, পরিবারকেই যৌনতার একমাত্র বৈধ ক্ষেত্র বলে মনে করে। আজকের সামাজিক রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক রক্ষণশীল হিংস্র রাজনীতির মধ্যে দাঁড়িয়ে এই কথা আমাদের মনে রাখা দরকার। একেবার বাস্তব দিক থেকে আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ১৯ বছরের একটা ছেলে ১৭ বছরের একটা মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছিল, (বা মেয়েটিও ছেলেটিকে নিয়ে পালাতে পারে, আমার প্রথম বাক্যেই কিন্তু পুরুষের আধিপত্যের স্বর আছে, কেন ছেলেটিই পালাবে, মেয়েটি পালাতে পারে না?) ধরা পড়ার পর ছেলেটি জেলে পচছে, মেয়েটি উদ্ধার আশ্রম নামক একটি নরকে। দুটি জীবন গেল। আমরা হাত ধুয়ে ফেললাম। শাস্তি হয়ে গিয়েছে।

    প্রশ্ন ২: তাহলে সুপ্রস্তাব দেবে কে?

    ইদানিং যৌন হেনস্থা নিয়েও বহু আলোচনা হচ্ছে, হওয়া দরকার। কাজের ক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা যে একটা বড় সমস্যা সে তো সবাই জানি। কিন্তু আবার মনে হচ্ছে এখানেও কোথাও যেন, হেনস্থাবিরোধী হতে গিয়ে আমরা যৌনতা-বিরোধী হয়ে উঠছি। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলা দরকার। ক্ষমতা চিরকালই কিন্তু যৌনতাকে লাগাম পরাতে চেয়েছে। যৌন নিয়ন্ত্রণকে শ্রেণি, বর্ণ, ধর্ম রক্ষার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। এই আজকেও ‘লাভ জিহাদের’ প্রসঙ্গে সংখ্যালঘু ছেলেদের খুন করা চলছে, গত সপ্তাহেই রাজস্থানে একটি ছেলেকে খুন করে তার গায়ে আগুন লাগিয়ে ভিডিও তোলা হয়েছে, ছড়ানো হয়েছে। তার মানে এই নয় যে আমি বলছি অফিসে একটি মেয়েকে নোংরা কথা বলা বা ইঙ্গিত করাটা সঙ্গত। সমস্যাটা হল একটা অতি ভীতির আবহাওয়ায় কিন্তু নানারকমের সম্পর্কের স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে খর্ব হয়ে যায়। কোনোরকমের কথা বললেই যদি পুলিশ বা স্ত্রী-রক্ষক বাহিনীকে ডাকা হয়, তাহলে আলাপ শুরু হবে কি করে? ‘তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিল’ বললেই এফআইআর বা গোবর ভক্ষণের মাধ্যমে শুদ্ধিকরণ হলে কিন্তু মুশকিল।

    মানুষের জীবনের একটা গল্প ছিল আমরা গোরুদের থেকে একটু জটিল জীবনে বাস করতাম, সেখানে হাম্বা ছাড়াও সাম্বা নাচ ছিল, লা বাম্বা গান ছিল, এমন কী ‘তুমি আমাকে টাচ করবে না’ বলার পরেও, গল্প এগিয়েছিল, লক আপের বাইরেই। তাই বলছিলাম, সবটাকেই একটা পুরুষদের নোংরামি বললে, মেয়েদের চেয়েও বোধহয় কিছু প্রতিষ্ঠান আর তন্ত্রের লাভ বেশি, পুরোটা বুঝতে পারিনি, তাই সাহায্য চাইছি।

    আসুন আঠারোয় আমাদের চিন্তা প্রাপ্তমনস্ক করে তুলি।

     
     



    Tags
     



    Comments (3)
    • ধর্ষণবিরোধী হতে গিয়ে যৌনতা বিরোধী হবার রোগ লক্ষণ আমাদের শৈশব এর মহাভিক্টোরিয় মূল্যবোধে ছিল, আশ্রম মঠ ইশকুল সর্বত্র নিপীড়ন চলত স্বাভাবিকতা র, অবদমন ছিল এক।মাত্র সত্য। এখন আবার ঘুরে ফিরে সুরক্ষা র নামে সেই অবদমন ই প্রকট হবে? দারুণ সময়োপযোগী!

    • khub proyojoniyo proshno tulle, Rangan. Consent-er nana shades…seta niye kotha hoya joruri. Manushe manushe somporko-o ekmatrik noy, jounota toh noy-i…e bishoye amader toliye bhabte hobe.

    • সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করছি। মহিলা- মহলের মেকী বেড়ি সমান পরিত্যজ্য। এত মেপে জুকে কী আমরা দৈনিক জীবনে কথা বলি!

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics