• এক 'মেয়েলি' ছেলের স্কুলবেলা : শুভব্রত দত্ত-র সাথে কথোপকথনে শ্রমণা দাস


    3    2550

    September 27, 2018

     

    বয়ঃসন্ধি বড় বিচিত্র জিনিস – সে যে আসছে তা তো টের পাওয়াই যায়, আর দিব্যি স্পষ্ট হয় বড় হওয়ার প্রথম চিহ্নগুলো। ক্লাসের বালকটির গালে হঠাৎ চিকন দাড়ি-গুম্ফ ফুটে ওঠে; বালিকাটি আর সচরাচর ঝমঝমে বৃষ্টিতে সপসপে ভেজেনা - বিশেষত সাদা সুতির ব্লাউস পরলে। ব্লাউস - এটিও একটি পদক্ষেপ বটে। এতকাল ইস্কুলের ইউনিফর্ম ছিল হলুদ-সাদা; সাদা শার্ট‌ আর হলুদ পাৎলুন বা ইস্কার্ট যাকে কেউ কেউ ঘাগড়াও বলত। তারপর অষ্টম শ্রেণীর জট কাটিয়ে নবম শ্রেণী হওয়া। একদিকে ‘আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন শাড়ি’ আর অন্যদিকে ক্লাসের বেণীমাধবরা হঠাৎ নারী হিসেবে চিনে ফেলেছে এতদিনের মারপিট্টি-লাথি-ঘুষি-র সঙ্গীদের। কিন্তু সম্ভাব্য মানসী-র শাড়ি খুলে যাওয়া একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয়, এইটে ‘ম্যানেজ’ করতে আমরা নাস্তানাবুদ। এহেন সংকটকালে ছিল দত্ত। শুভব্রত দত্ত। শাড়ী ম্যানেজ করতে না পারলে যে ব্লাউসের পিঠে সেফটিপিন লাগানো যায়, এই মহামূল্য খবরটা নারায়ণদার অংক ক্লাসের পর দত্তই আমায় বলেছিল। দত্ত-র গালেও ফুরফুরে দাড়ি তখন- চাঁপার কলির মত আঙুল। বাকিরা যখন রাবারের চপ্পল পরে বৃষ্টিতে ফুটবল খেলত, দত্ত ঘাসে বসে খেলা দেখত। ওকে কখনো রাবারের চপ্পল পরতে দেখিনি- ওর ছিল কোলাপুরি। ওর ছিল বেশভূষা। চালচলনে সহজাত রুচির ছাপ – চিন্তাভাবনা করে বাছা তাঁতের পাঞ্জাবি, অসমের ঝোলা ব্যাগ।

    শুভব্রত দত্ত

    আমাদের বাংলা মিডিয়াম স্কুল, কো-এডুকেশনাল, এবং কিছুটা অন্যরকম বা ‘অলটারনেটিভ’ তো বটেই। শান্তিনিকেতনে শুধু গাছের তলায় ক্লাস হয় তাই নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ইতিহাস আছে। পড়ুয়ারা আসে সমাজের নানা স্তর থেকে। পর্যটকরা আসেন রবি ঠাকুরের আশ্রম দেখতে। ফি মঙ্গলবার সান্ধ্য সাহিত্যসভা ছাড়াও, শান্তিনিকেতনে বারো মাসে চব্বিশ পার্বন লেগেই আছে। আর পার্বন মানেই নাচ, গান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আমাদের ইস্কুলে নৃত্য-গীত-চারুকলা ইত্যাদি কম্পালসারি। নাচের ক্লাসের প্রতি যদিও ছেলেদের বিশেষ উদাসীনতা প্রকাশ পায়। তবু, আমাদের ‘সি’ সেকশনে নৃত্যশিল্পী হিসাবে নাম করেছিল শুভব্রত দত্ত। ক্লাস ফোর কি ফাইভ, তখন থেকেই ছেলেদের নাচের ক্লাসে দুই প্রতিভাধর ছাত্রের সুখ্যাতি ছড়িয়ে গেছে। দুজনে প্রাণের বন্ধু - অর্ঘ্য আর দত্ত। অর্ঘ্য ক্রিকেট খেলে, আবার নাচেও। দত্ত কিন্তু খেলাধুলোর ধার দিয়েও যায়না - বরং ছবি আঁকা আর হাতের কাজে তার ইণ্টারেস্ট। কে জানে, হয়ত তাঁত বুনতে বা সেলাই করতেও ভালো পারত ও; কিন্তু সুযোগ ছিলনা – পাঠভবনের মত ইস্কুলেও ছেলে আর মেয়েদের আলাদা আলাদা হাতের কাজ শেখানো হয়! মেয়েরা তাঁত বোনে, রুমালে প্যাটার্ন তোলে। ছেলেরা কাঠের কাজ শেখে, বীরপুরুষের যোগ্য নানান চর্চা করে। মন থেকে খুব চাইলেও আমি কাঠের কাজ শিখতে পারিনি- ভাইস প্রিন্সিপ্যাল অব্দি এই লিখিত নিয়ম লঙ্ঘন করতে পারেননি। দত্তও তাই রুমালে ফুল তোলেনি কখনও। অবশ্য, ভাগ্যিস তোলেনি! তাঁত না বুনে, তুলোর পুতুলে পুঁতি না বসিয়েও ‘মেয়েলি’ বলে তার এমন বদনাম হয়েছিল বলার নয়! 

    ক্লাসের ছেলেরা দত্তকে জড়িয়ে ধরত, গালে চুমু খেত, ডাকত গার্লফ্রেন্ড বলে। তার প্রাণের বন্ধুরাই তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার শরীরে হাত দিয়েছে একাধিক বার। মাষ্টারমশাইরা কোনওদিন নজর করেন নি। বন্ধুরা রুখে দাঁড়ায় নি। কারো নজরে পড়েনি তা নয়, তবে অস্বাভাবিক মনে হয়নি। জনৈক মাষ্টারমশাইয়ের মেয়েলি হাঁটার ধরন যথেষ্ট হাসির খোরাক ছিল যেখানে, সেখানে দত্ত তো বালক মাত্র! যে ছেলে পায়ে ঘুঙুর পরে মেরুন লিপ্সটিক আর ফাউন্ডেশন লাগিয়ে নাচ করে, সে তো যে পুরুষেরা নাচতে চাইত না, তাদের চোখে একদিকে অস্বাভাবিক, অন্যদিকে লাস্যময়। তার দামও দিতে হয়েছে দত্তকে। বহুবার। ‘বন্ধু’-রা ওর গায়ে হাত দিত, ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। ওর ‘বন্ধু’-রা কত বড় তখন? ক্লাস সেভেন কি এইট! তখনই কিন্তু খুব ‘পুরুষ’ হয়ে গেছে তারা - আর দত্তকে চিনে নিয়েছে না-পুরুষ বলে। 

    দত্ত-র কথায়,

    - “... একান্নবর্তী পরিবারে মেয়ে মহলে বড় হয়েছি আমি। আমার দাদারা সবাই বয়েসে অনেক বড় বলে সমবয়সী হিসাবে দিদি আর বোনেদেরই পেয়েছিলাম। তাদের সাথে থেকে তাদের মত আচরণ করাটাই স্বাভাবিক মনে হত। ছোট ছিলাম বলে কারো মনে হয়নি যে বড় হয়ে এসব আমার জন্য খুব সমস্যার হয়ে দাঁড়াতে পারে।... স্কুলে যাওয়ার পর বুঝলাম যে ক্লাসের ছেলেদের থেকে আমি আলাদা। আমি তাদের মত হাঁটি না, কথা বলি না, খেলাধুলো পারি না, আমার গায়ে জোর কম,…। কিন্তু অন্যদিকে, আমি ছবি আঁকতে পারি, নাচতে পারি, গাইতে পারি।”

    দত্ত শুধু ‘ফেমিনিন’ জিনিসই পারত। ওর মনে হত, ও যথেষ্ট ‘ম্যাসকুলিন’ নয়। একদিন নাচের ক্লাসে দত্ত খেয়াল করেছিল, ছেলেদের হাত-পা যেন বড় আড়ষ্ট। তারা সাবলীল ভাবে নাচতে পারেনা, শরীর ভাসাতে পারেনা। অথচ দত্ত-র হাতে মুদ্রা আসে, পায়ে তাল আসে, মুখে বোল আসে। মাষ্টারমশাই সামনের লাইনে তাকে দাঁড় করিয়ে বলেছিলেন, সবাই যেন ওকে দেখে শেখে।

    - “সেইদিন মনে হয়েছিল বাকিদের মত ম্যাসকুলিনিটি আমার নেই, কিন্তু অন্য কিছু আছে- তা তো কারও থেকে কম না!” 

    স্কুলের পরে ইউনিভার্সিটিতেও এ জ্বালা কমেনি, বরং বেড়েছে - ইস্কুলে যা ছিল মূলত মৌখিক হেনস্থা ও মাঝেসাঝে শারীরিক অত্যাচার, তা প্রাত্যহিক শারীরিক নির্যাতন আর লাঞ্ছনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

    - “না, সাহায্য পাইনি কারো কাছে। চাইওনি। পাত্তা না দেওয়ার চেষ্টা করি রে - বেশিরভাগ লোকেই বলে আমার নিজেকে বদলানো উচিত, আমার “ফ্ল” গুলো বদলানো উচিত।

    - তাহলে কি করে কষ্টগুলোর সাথে যুঝিস?

    - কনফিডেন্স।”

    এই লেখাটা যখন পড়ছেন, ততদিনে আজকের তারিখটা পেরিয়ে গেছে; তাই এই ভাগে বলে রাখি, আজ ৬ সেপ্টেম্বর। আজ ৩৭৭ ধারা-র শেষ (একটা বড় অংশে অন্তত), আজ রাস্তায় রামধনু মিছিল, যুদ্ধের ইতিহাসে আজ একরকম বিজয়ের দিন। আজ মনে পড়ছে, ছোট বয়সেই কেমন আমরা মেপে নিয়েছিলাম দত্ত ‘গে’ কারণ ও “মেয়েলি”। সেক্স এডুকেশন আমাদের স্কুলে ছিল না, সেক্স নিয়ে ইন্টেরেস্ট ছিল খুব। ‘গে’ কথাটা তেমন চালু ছিল না; তবে কানাঘুষো শোনা যেত যে “এইসবও হয়”। আজ খুব লজ্জা হয় এইভাবে বড় হয়েছি বলে।

    দত্ত, তুই বলেছিলিস তোর খুব কষ্ট হয়েছে, তোর খুব কষ্ট হয়। আমিও কষ্ট পেয়েছি তোকে দেখে, কিন্তু জোর গলায় এক-দু’বারের বেশি রুখে তো দাঁড়াইনি! তোর মনে আছে, লিপিকা অডিটোরিয়ামে নাচের অনুষ্ঠানের আগে পাঞ্জাবি-ধুতি-মেরুন লিপস্টিকে সাজানোর কথা? আয়নায় নিজের সাজটা দেখে নেওয়ার সময় তোর সলজ্জ সুন্দর হাসিটা খুব মনে পড়ছে আজ। আমাদের ‘অলটারনেটিভ’ ইস্কুলে তুই নাচ ভালোবাসতিস বলে ‘নাচিয়ে’, সৌম্যদীপের অনেকদিন দাড়ি-গোঁফ বেরোয়নি বলে ‘মাকুন্দ’ বলেছে। সেসব হয়ত না বুঝেই, কারণ পুরুষতন্ত্রের শিক্ষা তো হিংসা আর হেনস্থাকে স্বাভাবিক ভাবতে শেখায়।

    আজকের রাত জুড়ে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক উপচে পড়ছে ছবিতে, সাত রং এ, শুভেচ্ছায়। কিন্তু কাল সকালই আবার হয়ত সুগম হবে না। তবু, লড়াই জারি রহে।

     
     



    Tags
     



    Comments (3)
    • খুব ভালো লিখেছো। কিন্তু ” Effeminate” হলেই যে ” Gay” হয়না, ওই জায়গাটা নিয়ে আরেকটু লিখলে স্পষ্টভাবে পাঠকদের কাছে তুলে ধরা যেত। ্

    • Lekha ta pore bhalo laglo khub,Subho r mane Subhobroto Dutta amar bhai r moton,khub ekta mela mesha hoini kintu jototukuni hyeche tokhuni bujhte pari je o ektu alada,or somo boyeshi amar arek bhai Arnab Majumdar(bunty) onek tai alada,
      Bola bahullo ektu ugro.
      Jai hok ektu alada howa ta bhalo amr mote.

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics