• আত্মবিশ্বাসের প্রথম পাঠ ও আমার ছাত্রীরা


    0    184

    September 5, 2018

     

    গ্রামবাংলার সবুজে ঘেরা প্রান্তর পেরিয়ে এক-একটা  গ্রাম। গ্রামগুলোর শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে মেঠো মানুষগুলোর ঘরের সন্তানদের সুশিক্ষিত করে তোলার জন্য আশেপাশের বর্ধিষ্ণু এলাকায় গড়ে উঠেছে সরকার পোষিত অবৈতনিক বিদ্যালয় বা মাদ্রাসা। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে সরকারি বদান্যতায় শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকলেও তা প্রায়শই প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তাই আধপেটা খাওয়া ছেলেমেয়েরা শ্রেণিকক্ষে ঠাসাঠাসি করে বসে থাকে আর দিদিমণি বা মাস্টারমশাইরা নির্দিষ্ট সময়ে পাঠদান করে তাদের কর্তব্য পালন করে যান। ফলে বেশির ভাগ শিশু শিক্ষার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়। তাই স্কুলছুট অধিকাংশ মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার আর ছেলেগুলো বেশিরভাগই শিশুশ্রমিকে পরিণত হয়।

    আমি নিজে এ-বঙ্গের পিছিয়ে পড়া জেলা মুর্শিদাবাদের বেলডাঙ্গা ১ ব্লকের দেবকুন্ড নামে একটি রক্ষণশীল গ্রামে একটি সরকার পোষিত মেয়েদের হাই মাদ্রাসায় প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে কাজ করি। মাদ্রাসা শিক্ষা সম্বন্ধে বহু শিক্ষিত মানুষই সঠিক তথ্য জানতে প্রায় উদাসীন। আমাদের রাজ্যে সরকার পোষিত ৬১৪ টি হাই মাদ্রাসায় সিলেবাস, শিক্ষক ও পরিকাঠামো সাধারণ বিদ্যালয় এর মতই, শুধুমাত্র ১০০ নম্বর ‘ইসলামের ইতিহাস’ পড়তে হয়। অর্থাৎ অন্য স্কুলে মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৭০০ নম্বর আর মাদ্রাসায় ৮০০ নম্বর এবং সঙ্গে আরবি ভাষা শেখা আবশ্যিক। এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানে আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মুসলিম পরিবারের ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে। উল্লেখ্য যে ১৫-২০ শতাংশ উপজাতি, তফসিলি সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা এখানে পড়ে এবং ২২-২৫ শতাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকা মুসলিম সম্প্রদায় ব্যতীত অন্য সম্প্রদায় থেকে এখানে শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত আছেন। আমার হাই মাদ্রাসাটিতে পড়তে আসা মেয়েরা ১০০ শতাংশই মুসলিম পরিবার থেকে আসা। এসব পরিবারের কর্তারা ভিনরাজ্যে রাজমিস্ত্রি হিসাবে পাড়ি দেয়, অনেকের আবার একাধিক স্ত্রী, অনেক মেয়ের মা বাবা দুজনেই অন্য কারো সঙ্গে ঘর বেঁধেছে, ফলে বলা যায় তারা‌ বেওয়ারিশ!

    এইসব বাড়িতে জন্মনিয়ন্ত্রণ হীন মায়েরা গড়ে ৫-৬ জন বাচ্চা নিয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কোনক্রমে বেঁচে থাকে। স্বাস্থ্য-পুষ্টি-শিক্ষা সবকিছুই এই বিড়ি শ্রমিক মায়েদের কাছে গৌণ। হতদরিদ্র ঘরের মেয়েরা হাজার প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে মাদ্রাসায় আসে দু'কলম বাংলার সাথে আরবি শিখলে বিয়ের বাজারে কদর বাড়বে বলেই। বারো বছর বয়স পেরোলেই ওদের বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়। অনেক বাড়িতে গিয়ে দেখেছি মা মেয়ে কেউই নিজেদের নিয়ে তিলমাত্র ভাবে না। ওদের কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া বা স্বপ্ন দেখা বারণ। অধিকাংশ ছাত্রীর হাজিরা অনিয়মিত, মায়েদের মিটিংয়ে দেখেছি তাঁরাও জীবন নিয়ে উদাসীন। এঁরা অনেকে নিজেরা বাল্যবিবাহের শিকার; তবুও তাঁদের মধ্যে মেয়ের বাল্যবিবাহ রোধে তেমন কোন ভূমিকা নেই। মেয়েগুলো ভোরে উঠে বাড়ির সব কাজ সেরে বাড়ির বাচ্চার সামলায়। অনেক মেয়ে আবার মায়ের সাথে শিশুশ্রমিকের কাজ করে। ইদানিং কালে অনেক মা ও মেয়েরা বিড়ি শ্রমিকের পাশাপাশি মেয়েদের মাথার চুলের নতুন ব্যবসায় চুল ছাড়ানোর কাজে নিয়োজিত হয়েছে। কিছু পয়সা এলেও স্বাস্থ্য দিনের পর দিন আরও ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে। বাড়ির এমন বেহাল দশায় মেয়ে সন্তান সব থেকে অবহেলিত। ফলে তার শারীরিক মানসিক অবস্থা কহতব্য নয়। নিজেকে নিয়ে বিয়ের বাইরে এরা অন্যকিছু ভাবতেই পারেনা। কাউন্সেলিং করলে শুধু হাসে আর উদাস হয়ে তাকায়। ‘কী হতে চাও?’ - এই প্রশ্ন টি শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে এরা। আমরা শিক্ষিকারা বেশ কিছু ধারাবাহিক কর্মসূচির মাধ্যমে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা শুরু করেছি -

    • পঞ্চম শ্রেণীতে ছাত্রীরা ভর্তি হওয়ার পরই ‘ভিত জরিপ’ বা ‘বেসলাইন সার্ভে’ করা হয়। তারপর তাদের মান অনুযায়ী বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করে তাদের স্কুলের পাঠ এবং সহপাঠক্রমিক কাজে উৎসাহিত করা হয়। এইভাবে ক্রমান্বয়ে কাঙ্খিত মানের কাছাকাছি এলে আবার অন্য বিভাগে উত্তীর্ণ করা হয়। এতে যথেষ্ট ভাল ফল পাওয়া যাচ্ছে।
    • দীর্ঘদিন যাবৎ মাদ্রাসাতে শিক্ষক নিয়োগে জটিলতা থাকায় মাদ্রাসাগুলোর ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ভীষণভাবে বেড়ে গেছে। আমাদের মাদ্রাসায় অবস্থা আরো করুণ। বর্তমানে ১,১২৮ জন ছাত্রী আর শিক্ষিকা মাত্র ৯ জন। এই সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য দুটো উপায় অবলম্বন করেছি।

    প্রথমত, চাইল্ড-ক্যাবিনেটের মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, লাইব্রেরী মন্ত্রী, পরিবেশমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী এভাবে প্রতি ক্লাস থেকে এরকম ৮ জন করে মন্ত্রী বাছাই করে ১২ টি ইউনিটের মোট ৯৬ জন এগিয়ে থাকা অংশের মেয়েকে ট্রেনিং দেওয়া হয় প্রতি শনিবার বিদ্যালয়ের ছুটির পর। এই ট্রেনিংপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষের যাবতীয় কাজ সামলায় এবং এদের আত্মবিশ্বাস ও নেতৃত্বে অন্য পিছিয়ে পড়া মেয়েদের উৎসাহ বাড়ে।

    দ্বিতীয়ত, গ্রামে গঞ্জে যে সমস্ত ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষিত কিন্তু এখনও তেমন কোনও কাজে যুক্ত হয়নি, তাদের স্বেচ্ছায় পাঠদানের জন্য অনুপ্রাণিত করে আমাদের মেয়েদের শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সাহায্য করতে আনা হয়।

    • বিকাশের ক্ষেত্রে বলতে গেলে বলতে হয়, মানসিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া কিছুটা রক্ষণশীল একটি সাধারণ গ্রামের মাদ্রাসায় ধর্মীয় কারণে নাচ, গান বা মঞ্চে অভিনয় করা নিষিদ্ধ। কিন্তু ক্রমশ এলাকার নেতা-নেত্রী, ধর্মীয় গুরুজন, অভিভাবক-অভিভাবিকাদের বুঝিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস ও বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালন করা হয় যেখানে মেয়েরা নাচ-গান-অভিনয় সবই করে। আর এর মাধ্যমে মেয়েরা দারুণ আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে।

    • মেয়েদের দৈনন্দিন জীবনে অভাবনীয় পরিশ্রম ও কর্মক্ষমতা লক্ষ্য করে আমরা খোখো, কাবাডি, ব্যাডমিণ্টন সহ বিভিন্ন খেলাধুলার দল তৈরি করেছি মেয়েদের নিয়ে। এতে মেয়েদের বিপুল সাড়া পেলেও, ধর্মীয় ও সামাজিক বাধানিষেধের বেড়াজাল রয়েই গেছে। তবু সেগুলো ক্রমশই কাটিয়ে উঠে মেয়েরা বর্তমানে জাতীয় স্তরে খেলছে। আর এ কাজে আমরা এলাকার এক হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে, জাতীয় স্তরের খেলোয়াড় মিলনতারা-র নিরলস সাহায্য পেয়েছি। আমাদের ছাত্রীরা কুড়ি কিমি সাইক্লিং, কাবাডি টুর্নামেণ্ট, আন্তঃ-বিদ্যালয় কন্যাশ্রী যোদ্ধা টুর্নামেণ্ট ইত্যাদিতে অংশ নিয়েছে এবং অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে। যদিও খেলতে গিয়ে হাফপ্যান্ট পরা নিয়ে তুমুল আপত্তি করেছে তথাকথিত সমাজপতিরা। কিন্তু শেষপর্যন্ত কোনকিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।

    • ছাত্রীদের সামাজিক কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সামাজিক সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে উৎসাহিত করার চেষ্টা করছি আমরা। বিশেষ করে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে মেয়েদের ভূমিকা অতুলনীয়। বর্তমানে আমাদের হাই মাদ্রাসার ক্যাবিনেটের মেয়েরা টিম করে এলাকায় বাল্যবিবাহের শিকার বন্ধুদের বিয়ে আটকায়, তারা কখনো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে ফোন করে, বা কখনো স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা নেয়। গোপনে চালু থাকলেও এর ফলে গ্রামে বাল্যবিবাহের হার অনেক কমে গেছে।
    • অনেক ছাত্রী পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের সহায়তায় সমাজের কুসংস্কার রোধ এবং বিজ্ঞান সচেতনতা বাড়ানোর কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
    • বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মেয়েদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলা এবং স্বনির্ভরতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে। কোনও মেয়ে সমস্যায় পড়লে অন্য ছাত্রীরা এসে শিক্ষিকাদের খবর দিচ্ছে আর সাধ্যমত তাদের পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। বাল্যবিবাহ বন্ধ করে মেয়েদের বিদ্যালয় মুখী করার জন্য কেরিয়ার কাউন্সেলিং এ উৎসাহিত হচ্ছে মাদ্রাসার ছাত্রীরা।

    মেয়েদের হাই মাদ্রাসার মধ্যে থেকে আমাদের এই কর্মসূচি অনেকটাই সফল। বহু মেয়ে তাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার লড়াই লড়ছে নিজেই। তবে এখনো বহু মেয়ে অন্ধকারে ডুবে আছে। প্রত্যেক ছাত্রীর কাছে তার নিজস্ব আত্মবিশ্বাসটুকু ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যেই ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছি আমরা।

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics