৩৭৭ পরীপুকুর লেন
1 180১
বড় রাস্তার মোড় থেকে এই যে সরু লম্বা গলিটা শুরু হয়েছে, তার নাম পরীপুকুর কেন কেউ ঠিক বলতে পারে না। কেউ বলে কোনও এক কালে এই গলিতে প্যারি সাহেব বলে এক সাহেবের কুঠি ছিল, সেই বাড়িতে একটা বিশাল পুকুর ছিল। তারই নামে গলির নাম। কেউ বলে পরী নামে কোনও একটি মেয়ে এই পাড়ার পুকুরে আত্মহত্যা করেছিল। মাঝে মাঝেই তার ছায়া এই গলিতে দেখা যেত, তাই এর নাম পরীপুকুর লেন। সেই সাহবের বাড়ি কোথায় ছিল তাও কেউ আর বলতে পারে না, কোনও পুকুরের চিহ্নও আর নেই। তবু নামটা টিকে গিয়েছে। এখন অবশ্য কোনও এক স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতার নামে গলির নামকরণ হয়েছে, রাস্তার মোড়ে একটা টিনের পাতে সেটা টাঙিয়েও দেওয়া হয়েছে, তবু লোকে এখনও পুরোনো নামটাই ব্যবহার করে।
২
বাথরুমে যাওয়ার দরকার ছিল, কিন্তু মনোরমা উঠতে পারলেন না। কোমর থেকে ওপরটা আবার পড়ে গেল বিছানায়। ক’দিন হল এই ঝামেলাটা শুরু হয়েছে। এবার আর টানা যাবে না। টানার কথাও নয়। টেবিলের ওপর ছবিটার দিকে তাকালেন মনোরমা। নুপুর চলে গেছে তাও তিরিশ বছর হয়ে গেল। সেই দিনটার কথা মনে পড়ল মনোরমার। ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল তিনি, একেবারে সামনের বেঞ্চে বসতেন। অন্য কোনও স্কুল থেকে নুপুর এল এই ক্লাসে, বসতে শুরু করল একেবারে শেষের বেঞ্চে। হাফ ইয়ার্লি-র রেজাল্ট বেরোলে দেখা গেল নুপুর সেকেন্ড হয়েছে। সেদিন লাস্ট পিরিয়ডের শেষে বই গুছোনোর ছুতো করে সবার শেষে ক্লাসরুম থেকে বেরোলেন মনোরমা, ভাবলেন মেয়েটার সঙ্গে আলাপ করতেই হবে।
করিডোরে বেরিয়ে দেখলেন, বাকি সবাই এগিয়ে গেলেও নুপুর যেন স্লো-মোশনে হাঁটছিল। জানালা দিয়ে তেরচা আলোর রেখায়, ১৬ বছরের সেই রুনুঝুনু নুপুর। কী বলে ডাকবেন, নাম ধরে না “এই” বলে, ভাবতে ভাবতে, নুপুর ফিরে তাকালো। সেই চোখ দুটো, সেই রোগা মুখটা, কী রকম আলোয় উদ্ভাসিত! প্রহর শেষের রাঙা আলোয় কী ভাবে কারও চোখে নিজের সর্বনাশ দেখা যায়, মনোরমা সেই দিনই বুঝেছিলেন। তারপর বন্ধুত্ব, বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। বুঝতে পারা যে শুধু মন নয়, শরীরেও টান লেগেছে। সবার চোখ এড়িয়ে একদিন স্কুলের ছাতের রেলিং-এর আড়ালে বসে প্রথম চুমু খাওয়া। কী আবেশ! কিন্তু কী ভয়। লোকের ভয় তো বটেই, কেউ জানলে তো সর্বনাশ। কিন্তু নিজের মধ্যেও কী কম ভয়? এ আমরা কী করছি? এটা তো ঠিক নয়। এটা তো একেবারেই ঠিক নয়। কিন্তু কোনও পাপবোধ তো তাঁদের আটকাতে পারেনি। দুটি মেয়ের মধ্যে সম্পর্কের একটা সুবিধেও ছিল, মাঝে মধ্যে এক সঙ্গে রাত কাটাতেও সমস্যা হত না। মনোরমাদের বাড়িটাই ছিল বড়, নুপুররা ছিল গরিব। ওর বাবাও ছিল না। নুপুরই আসত মনোরমার বাড়ি, তখন একটা মেয়ের নিজের আলাদা ঘর ক’টা বাড়িতেই বা থাকত। মনোরমার ভাই বোন আর হয়নি বলে তাই। কখন যেন দু’জনে দু’জনকে পরী বলে ডাকতে শুরু করেছিলেন। নুপুর বলত, ‘আমরা পরীপুকুরের নতুন পরী, তবে দেখিস, আমরা মরবো না, সাঁতার কাটব’।
৩
সন্দেহটা প্রথম করেছিল মা। মনোরমা বনেদি বাড়ির সুন্দরী মেয়ে, স্কুলের সময় থেকেই একের পর এক বিয়ের সম্বন্ধ আসছিল। মনোরমা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। তখন মা বলল, ‘বিয়ে করবে না তো কী করবে তুমি?’ মনোরমা বলেছিলেন, ‘আরও পড়াশোনা করে চাকরি করব। বাবার মত ইঞ্জিনিয়র হব’। মা বলেছিল, ‘আজ আমরা আছি, দু’দিন বাদে থাকব না, বিয়ে না করলে কে দেখবে তোমাকে? ওই নুপুর? ওর সঙ্গে জীবন কাটাবে তুমি? মেয়েদের জীবনে অনেক কর্তব্য থাকে, স্বামী, সংসার, সন্তান। তার কী হবে? এই জন্যই কী লেখাপড়া শেখানো হল তোমাকে? চাকরি কাকে বলে জানো?’ নুপুরকে দেখতে পারত না মা। তাঁদের সম্পর্কের কতটা বুঝত মা, মনোরমা জানেন না। কখনও কোনও আভাস পেলেও আজকের মত ‘লেসবিয়ান’ বা ‘সমকামী’ বলে চিহ্নিত করার মত শব্দ তো তাঁর কাছে লভ্য ছিল না। শারীরিক দিকটা টের পেতেন কী না কে জানে। তবে মেয়েকে নেশাগ্রস্ত করেছে ওই নুপুর এটা বুঝতেন। নুপুর যেন এক প্রতিদ্বন্দ্বী যে ওঁর কাছ থেকে মেয়েকে কেড়ে নিচ্ছিল।
মা’ই বাবার কাছে নিয়ে গিয়েছিল মনোরমাকে, ‘তোমার মেয়ে বিয়ে করবে না বলছে’। পড়ন্ত ব্যবসার শেষ মালিক হিসেবে একের পর এক যুদ্ধে হারতে হারতে তত দিনে বড় ক্লান্ত হয়ে এসেছিল বাবা। আর ছোটবেলা থেকে মেয়েকে বাধা দেয় নি কিছুতেই। এক সময় বার্মিংহাম থেকে ইঞ্জিনিয়র হয়ে এসে পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেছিল, কিন্তু যুদ্ধের বাজারে যুঝে ওঠার মত ব্যবসা-বুদ্ধি তার ছিল না। বাবা শুধু বলেছিল, ‘উমা, ও যা চায়, করতে দাও। জোর ক’রো না। আমার বাবা আমাকে জোর করে এই ব্যবসা করতে ঢুকিয়েছিলেন, দেখলে তো কী হল’। বলে বাবা উঠে গিয়েছিল। মা মনোরমাকে বলেছিল, ‘তুমি বিয়ে না করলে আমি গলায় দড়ি দেব’।৪
কিন্তু গলায় দড়ি দিতে হয়নি মা’কে। কলকাতা শহরে এক ভয়ঙ্কর কলেরা এসেছিল, ওদের সবার শরীর খারাপ হয়েছিল। মা চলে গেল। বাবা আরও চুপচাপ হয়ে গেল। বিয়ের চাপ দেওয়ারও আর কেউ রইল না। ইঞ্জিনিয়র হলেন না মনোরমা, ফিজিক্স ওঁর প্রিয় সাবজেক্ট ছিল, ভালো ফলের জোরে সরকারি চাকরি পেয়ে গেলেন। কখন যেন নুপুর এসে পাকাপাকি ঢুকে গেল ওঁর ঘরে। বাবাও কিছু বলল না। কিছু ভাবল কি না কে জানে। পাড়ায় কিছু হয়ত কথা হল, কেউ কেউ হয়ত ভাবল, কী নোংরা ব্যাপার। কিন্তু সন্দেহটাকে গুছিয়ে ভাবা বা প্রকাশ করা এতই জটিল হত সেই সময়ে, যে কেউ সেটা ঠিক মতো করে উঠতে পারল না। মানে, মনে এলেও বলবে কে? আর কোন ভাষায়ই বা বলবে? মনোরমা শুনেছেন সমকামিতা বিরোধী আইনে পুরুষে পুরুষে সমকামিতা অপরাধ বলে চিহ্নিত ছিল, নারীতে নারীতে সমকামিতার অস্তিত্বেরই স্বীকৃতি ছিল না। মানে গোড়ার দিকে এটার সম্ভাব্যতাই স্বীকার করা হয়নি। পাড়ার মান বলেও তো একটা কথা ছিল। ওদের পাড়ায় সাধারণ ভাবে গল্পটা দাঁড়িয়েছিল, রায় বাড়ির মনোরমা ওর গরিব বন্ধুকে বোনের মত কাছে রেখেছে। দুটি মেয়ে যে একসঙ্গেই বড়ও হয়েছে। পাড়ার অনেকেই বলত, আহা তোরা যেন দুই বোন। বোন!!! তারা যদি জানত, কি উদ্দাম শরীরী তাদের সম্পর্ক, রাতের বিছানায় ওই রোগা মেয়েটা কী রকম পাগল করে তুলতে পারত সবার চোখে শান্তশিষ্ট ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল মেয়েটিকে। শরীর আর মন যে এত সুখ পেতে পারে কে জানত। “আমার জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছ দান, তুমি জান নাই, তার মূল্যের পরিমাণ”।
৫
গ্র্যাজুয়েশেনের পর মনোরমা চেয়েছিলেন, অত ভাল রেজাল্ট করেছে নুপুর, ও চাকরিতে ঢুকুক। নুপুর কিন্তু বেঁকে বসল, বলল, তুই তো বর-পরী, তুই চাকরি করবি। আমি কেন চাকরি করব, আমি বউ-পরী হয়ে সংসার করব। মনোরমা বলতেন, আমাদের আবার বউ-বর কী? নুপুর বলত, আছে। আমার খুব ইচ্ছে আমি সিঁদুর পরি আর তুই ধুতি পাঞ্জাবি পরিস। আর আমরা হাত ধরাধরি করে সিনেমা-থেটার-বাজার-পুজো-পুরী সব জায়গায় ঘুরতে যাই। সেটা অবশ্য হয়নি। তবে মনোরমার মনে আছে এক বার ঘরের মধ্যে বর-বউ সেজে ওঁরা ফুলশয্যা ফুলশয্যা খেলেছিলেন। মায়ের বাক্স থেকে সিঁদুর বের করে। তারপর মাঝরাতে নুপুর শ্যাম্পু দিয়ে সিঁথি ধুয়েছিল, নইলে সকালে কাজের মেয়ে মালতী আবার কী ভাববে! বাবা যত দিন ছিলেন, নুপুর ওঁর দেখাশোনা করেছিল। কোনও ত্রুটি হয়নি। পরীর মাও কখন এক সময় চলে গেলেন। ওঁরা কেবল দু’জন হয়ে গেলেন।
যত দিন নুপুর বেঁচেছিল, ঘরের দরজার বাইরে বোন পরিচয়েই বেঁচে থাকতে হয়েছিল। মনোরমাই ছিলেন বেশি ভীতু, বাইরে কখনও হাত ধরতে চাইতেন না তিনি। নুপুর বলত, পরী, বোনেরাও তো বাইরে হাত ধরে ঘোরে, তোর এত লজ্জা কীসের? কী যেন একটা ভয় সব সময় তাড়া করত মনোরমাকে। ঠিক জানতেন না সেটা কী। ওঁর যখন হিস্ট্রেকটমি করতে হল, নার্সিংহোমে নুপুরকে কাগজে সই করতে হল, ‘সিস্টার’ বলে। আর কী লিখতই বা? ‘ওয়াইফ’? সে তো অসম্ভব! ‘পার্টনার’? সে কথাটা তখনও কেবল ব্যবসায় চলত, পরিবারে আসেনি।
এক দিন নুপুরও চলে গেল ক্যানসারে। অসুখটা ধরা পড়ার পর ডাক্তার এক বছর সময় দিয়েছিলেন। চির দিনের ঠান্ডা মাথার মনোরমা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ঠান্ডা মাথায়। সব জমা টাকা তুলে নিয়ে চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেই একটা বছর কাটিয়েছিলেন গোটাটাই নুপুরের সঙ্গে, দশ’টা-পাঁচটা’র ফাঁকটাও আর ছিল না। অনেক জায়গায় ঘুরতেও গিয়েছিলেন দু’জনে। যদিও মনোরমা বলেননি ওকে রোগটার নাম, নুপুর টের পেয়েছিল, বলেছিল, সুখ বেশি দিন সয় না রে। আমাদের তো এত সুখ পাওয়ার কথা ছিল না, কোনও একটা ভুল বিয়ের জেলে আটকে পচে মরার কথা ছিল, এক জীবনে কতগুলো জীবনের সুখ পেলাম বল তো। মাথায় টিউমারটা বাড়ছিল। নুপুর শেষ দিকে সব কিছু বুঝতে পারত না। কথাও অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার বলেছিলেন অপারেশন করে কিছু করা যাবে না। শুধু ব্যাথাটা কম রাখার ওষুধ চলত। নুপুর জানতো মনোরমা উইদাউট পে ছুটি নিয়েছেন, দিন তারিখের হিসেব আর তার ছিল না। একদম শেষ দিকে নুপুরকে হাসপাতালে রাখতে হয়েছিল, নুপুরের শেষ কথা নার্স বুঝতে পারেনি, মনোরমা পেরেছিলেন, ওঁর হাত ধরে নুপুর বলেছিল, ‘পরী, থ্যাঙ্ক ইউ’।
৬
তারপর কত দিন কেটে গেল। এই ৩৭৭ পরীপুকুর লেনের বাড়ি আস্তে আস্তে ধ্বসে গেল। মনোরমার টাকা শেষ হতে হতে ফুরিয়ে গেল। প্রায় ২০ বছর টিউশন করে চলেছিল, তারপর কবে যেন ছাত্র আসা বন্ধ হয়ে গেল। পেছনের উঠোন, পাশের ঘর সব একে একে গ্যারেজ, ক্লাব এদের দখলে চলে গেল। মনোরমা অচল হয়ে পড়লেন। কাকে আটকাবেন? আর কী করে? প্রোমোটারদের ক্লাবের ছেলেরাই আটকাল বোধ হয়, কারণ বেআইনি দখলের মত অতটা জায়গা, আইনি বাড়ি উঠলে ওরা পাবে না। পুরোনো ঘরে বদল এল না। কিন্তু ঘরের বাইরে কত নতুন কিছু হল। ক্লাব থেকে বিকেলে পাওয়া খবরের কাগজ আর পুরোনো টিভিটাতে দেখলেন গে, লেসবিয়ান, ট্রান্সজেন্ডার, রূপান্তরকামী, সমকামী, সমপ্রেমী, কতি, এরকম কত পরিচয়ের লোক অধিকার চাইতে লাগল। আন্দোলন শুরু হল। নুপুরের কথা খুব মনে হত মনোরমার। আজকে যদি নুপুর থাকত, তাহলে কি আগের মতন নিজেদের সম্পর্ক আর লুকিয়ে রাখতেন ওঁরা? না নুপুর ওকে টানতে টানতে ওই মিছিলে নিয়ে যেত? পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর?
আস্তে আস্তে চোখ মাথা ঝাপসা হওয়া শুরু হল। ডাক্তার দেখানোর ইচ্ছে বা পয়সা কিছুই বাকি ছিল না। খবরের কাগজ আর পড়তে পারলেন না। টিভিতে ৩৭৭ নং আইনের কথা বার বার উঠে আসার পর, মনোরমার কী রকম মনে হতে শুরু করেছিল, তাঁদের বাড়ির নম্বরটা কী শুধুই কাকতালীয়? না তার অন্য কোনও মানে আছে?
৭
আবার বাথরুমে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করেও উঠতে গিয়ে পারলেন না মনোরমা। বিছানাটা ভিজে যেতে লাগল। একটা গরম অনু্ভূতি তাঁর নিম্নাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল। মনে হল নুপুর তাঁকে জড়িয়ে ধরে আদর করছে, তার উষ্ণ জিভ ঘোরাফেরা করছে, যাহা কিছু আছে সকলই ঝাঁপিয়া, জীবন ছাপিয়া, ভুবন ব্যাপিয়া... তবে কি এই বাড়ির ঠিকানার নিষেধাজ্ঞা ভেঙে নুপুর আবার আন্দোলন শুরু করল? ‘৩৭৭ নিপাত যাক, নিপাত যাক।’ ‘নারীতে নারীতে প্রেমকে স্বীকৃতি দাও, স্বীকৃতি দাও’। ‘কোনও ভালোবাসাই অপরাধ নয়’। ‘শুনে রাখ ভারতবাসী, আমি মেয়ে, এই মেয়েটিকে ভালোবাসি’। ‘পরী, পরী, পরী... থামিস না, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। পরী পরী, থ্যাঙ্ক ইউ। থামিস না, পরী থামিস না, থ্যাঙ্ক ইউ’।
৮
শৈবাল এসে জানাল, ভাতের হোটেলের বাচ্চাটা বিকেলের চা দিতে এসে দেখে মাসীমা মরে পড়ে আছে। শৈবালই মনোরমার দেখা শোনা করত। অবশ্য তার মানে খুব বেশি কিছু নয়। সকালে বিকেলে দু কাপ চা, দু বাটি মুড়ি, দুপুরে ডাল ভাত আর রাতে দুটো রুটি আর ডাল। পাড়ার ভাতের হোটেলের বাচ্চাটা দিয়ে যেত। বদলে মাসীমার রান্না ঘরে ওদের গুদাম ঘর করতে দিয়েছিল ক্লাব থেকে। আর সামনের বড় বারান্দাটা ঘিরে নিয়ে শৈবাল একটা মোবাইলের দোকান খুলেছে। ভাড়ার কোনও গল্প নেই। ক্লাব থেকেই ঠিক করেছিল ওকে তার বদলে মাসীমাকে একটু দেখে দিতে হবে। ক্লাব ঘরটাও এই বাড়িরই আরেকটা ঘরে, বাড়িটার মস্ত উঠোন আর পেছনের দিকটা নিয়ে বিনয়ের মোটর গ্যারেজ, তাই কালিতে মাখামাখি। খবরটা শুনে কেউ খুব একটা অবাক হল না। কারণ, মনোরমা যে বেঁচে ছিলেন, তাই সবাই ঠিক জানত না। এই বাড়িতে গাড়ির ইঞ্জিন, ক্যারমের গুটি পড়ার উল্লাস, মাঝে মাঝে যে কোনও উৎসবে কালো বক্সের গাঁক-গাঁকানি ছাপিয়ে এক বৃদ্ধার একক জীবন ধারণের কোনও শব্দ কখনও ভেসে ওঠার সুযোগ পায়নি।
৯
এর পরের কাজগুলো ক্লাবের ছেলেদের পরিচিত। এদের বাপদাদারা এই কাজ যখন করত তখনও ছিল কাঁধে করে শব বয়ে নিয়ে গিয়ে দাহ করবার দিন। তারপরে এসেছিল ম্যাটাডোর। এখন লোকাল এমএলএ সুবীর দাঁ-এর অনুদানে ক্লাবের একটা শববাহী গাড়ি হয়ে গিয়েছে, ভাড়াও পাওয়া যায়, সমাজসেবাও হয়। মাসীমার হয়ে গাড়ি ভাড়া দেওয়ার কেউ নেই। কিন্তু তাই বলে তাঁর দাহ হবে না, তা তো হয় না। ঠিক ভাবেই সব হবে, মাসীমার নিজের লোক বলতে তো ওরাই, এত বছরে কাউকে তো কোনও দিন মাসীমার কাছে আসতে দেখেনি। ক্লাব ঘরটাও এখানেই, এবার মাসীমার শোবার ঘরটা পেলে গোটাটাকে সাফ করে পেছনের উঠোনটার খানিকটা ব্যবস্থা করে তো বিয়ে বাড়ি ভাড়াও দেওয়া যাবে, ওতে আজকাল ভালো রোজগার।
হঠাৎ বুদাই বলল, হ্যাঁ রে, মাসীমার নামটা কী? সবাই টের পেল, মাসীমার নাম তারা কোনও দিনই জানত না। সত্যি কথা বলতে কী বয়স্কা মহিলাদের নাম কেই বা জানে! সবাই তো এমনি ‘মাসীমা’ কিংবা ‘বুদাইয়ের মা মাসীমা’, ‘পিন্টুর মা মাসীমা’ এই রকম। দেওয়ালে একটা ফ্রেমে একটা সার্টিফিকেট, গোখেল মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলের পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়ার সার্টিফিকেট, নাম লেখা মনোরমা রায়। গাড়িটা পেছনের গলি দিয়ে বের করে সামনের রাস্তায় এলে বডিটা তুলতে হবে। মার্কিন কাপড় এসে গিয়েছে। ঘরটায় দু একটা বাসন ছাড়া আর কিছুই নেই। একটা পুরোনো গোদরেজের আলমারি, তার দরজায় তালা ঝুলছে, কাপড় চোপড় কিছু থাকত। ও সব পরে খুলে পরিষ্কার করতে হবে। কে যেন বলল, মাসীমা নিশ্চয় বিধবা ছিলেন, সিঁদুর তো পরতেন না। সবাই বলল, তাই হবে, ও সব ঝামেলায় যাওয়ার দরকার নেই।
ঘরের কোনায় একটা পড়ার টেবিল, তাতে কিছু ইংরেজি বাংলা বই, আর একটা ছবি, একটি গাছের নীচে দুটি কিশোরী মেয়ে শাড়ি পরে হাসি মুখে হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ছবির নীচে মেয়েলি হাতে লেখা “তোমায় আমায় হেসে খেলে কাটিয়ে যাবো দোঁহে, স্বপ্ন মধুর মোহে”। বুদাই বলল, ‘বোন ফোন হবে, কাজিন মনে হয়, নিশ্চয় অনেক আগেই টেঁসে গিয়েছে’। শ্যামল ছবিটা তুলে দেখল পেছনে লেখা: বটানিকাল গার্ডেন, নুপুরের জন্মদিন। ১৯৪০। আমাদের একমাত্র ছবি।
১০
সন্ধের মুখে ৩৭৭ পরীপুকুর লেন থেকে যখন শববাহী গাড়িটা বেরোল, রাস্তার মোড়ে তখন পাড়ার বিস্তৃত যৌন পল্লী থেকে রাস্তায় বেরিয়ে আসা নানান লিঙ্গের মানুয আর একটি এনজিও-র ছেলেমেয়েরা আনন্দে আবির খেলছিল। কারণ, আজ দেশের সুপ্রিম কোর্ট ৩৭৭ ধারার অনেকটা অংশ বাতিল করে দিয়েছে। সাবালক সাবালিকাদের মধ্যে সম্মতি ভিত্তিক সমকামী যৌনতা আর অপরাধ নয়। কেউ নাচছে, কেউ হাসছে, কেউ স্লোগান দিচ্ছে, পথচারীদের সম্মতি নিয়ে আবীর লাগাচ্ছে কেউ। ভিড় বাড়ছে। গাড়িটার রাস্তা করে দেওয়ার জন্য আবির মাখা মানুষেরা একটু সরে দাঁড়াল। এ শহরে মৃতদেহকে সম্মান করার প্রথা রয়েছে। তাই আবির মাখা মানুষদের কেউ কেউ অভ্যাস মত শবদেহের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাল। সেই সময় হঠাৎ একটা আশ্চর্য হাওয়া বয়, সেই গাড়ির কাঁচের দরজা খুলে গিয়ে কিছুটা আবির মনোরমার কপালে গিয়ে লাগে। দরজা তারপর নিজেই বন্ধ হয়ে যায়। গাড়ি চলতে থাকে। সন্ধের সূর্যেও তখন আবিরের রঙ। আকাশে বাতাসে একটা জোরালো আওয়াজ শোনা যায়। কিসের আওয়াজ? ভিক্টোরিয়ার মাথায় দাঁড়ানো পরী কি তার শিঙায় ফুঁ দিয়েছিল, না কি ও কেবল পরীপুকুরের কোনও বাড়িতে সন্ধে দেওয়ার শঙ্খের শব্দ? কে জানে!
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Rangan, Poripukur poRe stobdho hoye bose achhi. Ki romantic narrative!Tomar kolom aro choluk!