• ভূমিকন্যাদের কথা (প্রথম পর্ব)


    0    375

    August 15, 2017

     

    আরম্ভের আগে

    ওড়িশার মালকানগিরির আদিবাসী নেতা লক্ষ্মণ নায়েকের ফাঁসি হয় বেরহামপুর জেলে, ১৯৪৩ সালের ২৯শে মার্চ। লক্ষ্মণের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, মিলিতভাবে মাথিলি থানা আক্রমণের সময় লুঠপাঠ, অগ্নিসংযোগ ও খুনের। ফরেস্ট গার্ড রামাইয়া মাথায় আঘাত পেয়ে মারা যান। রামাইয়া আহত হবার অনেক আগেই লক্ষ্মণকে নৃশংসভাবে মারধর করে থানার মধ্যে ফেলে দেয় পুলিশ। খুব দ্রুত অনুষ্ঠিত হয় লক্ষ্মণ নায়েকের বিচারের প্রহসন। এবং শাস্তির সিদ্ধান্ত—ফাঁসি।

    জীবনের শুরুতে লক্ষ্মণ ছিলেন মুস্তাদার বা রাজস্ব আদায়কারি। পরবর্তীকালে তিনিই এই বিস্তীর্ণ অরণ্য পর্বতসংকুল প্রদেশে অত্যাচারিত আদিবাসীদের সংগঠিত করেছিলেন  জঙ্গলে, রাজস্ব ও পুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে। একদা কোয়া বিদ্রোহের (১৮৮০) ভূমি কোরাপুট মালকানগিরিতে নির্ভীক বঞ্চনামুক্ত যে জীবনের স্বপ্ন লক্ষ্মণ দেখিয়েছিলেন, তার প্রভাব পৌঁছেছিল সন্নিহিত বস্তার অঞ্চলেও।

    ফাঁসির অল্পদিন আগে বেরহামপুর জেলের সেল নম্বর ১৪-এর বন্দি লক্ষ্মণ তাঁর এক নিকট আত্মীয়কে বলেন, ‘ভারত স্বাধীন হবেই একদিন। আমি অবশ্য থাকব না। তোমরা সকলে মিলে এই স্বাধীনতার সুফল ভোগ করবে।’

    ১৯৯২-এর এক শরত অপরাহ্নে লক্ষ্মণ নায়েকের গ্রাম তেঁতুলিখুঁটির কাছে গিয়েছিলাম। সাক্ষরতা স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে মিটিং ছিল। বছর আটনয়েকের ছেঁড়া স্কুল ইউনিফর্ম পরা, লালচে চুলে বেড়াবিনুনী বাঁধা ছোটো মেয়েটিকে পড়ুয়াদের ভিড়ের মধ্যে থেকে হাত ধরে নিয়ে এসেছিল কেউ। শহীদ লক্ষ্মণ নায়েকের পৌত্রী। তাকে স্পর্শ করে, তার ঘ্রাণ নিয়ে আমি ১৯৪৩-এর এক দুর্মর স্বপ্নকে খুঁজছিলাম।

    সফল হয়েছে কি শহীদ আদিবাসী জননেতার স্বপ্ন? স্বাধীনতার ৭০ বছরে আদিবাসী জনপদগুলি দেশের দরিদ্রতম, পরিকাঠামোর হিসেবে অনুন্নত, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা পাহাড় ও জঙ্গলাকীর্ণ তাদের গ্রামগুলিতে অতি দুর্বল, অথচ মাটির নীচেকার খনিজ সম্পদ, নদীর উপরে বাঁধা জলভাণ্ডার তাদের বাস্তুচ্যুত করেছে কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই।

    সারা দেশে উন্নয়ন হয়েছে এই সাত দশকে, আদিবাসীদের ভূমিতেও হয়েছে। কিন্তু মাথাপিছু গড়পড়তা হিসেবের উন্নয়নে তাদের সমস্যার পরিমাপ হয় না। ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা, তার সঙ্গে ভাষা ও সংস্কৃতির বিভিন্নতা উন্নয়ন কর্মীদের সঙ্গে তাদের সংযোগকে করেছে দুরূহ। আমরা বুঝতে চাইনি—অরণ্যের সঙ্গে মৃত্তিকার সন্তানদের সম্পর্ক, তাদের স্বশাসনের দীর্ঘ উত্তরাধিকার। আদিবাসী সমাজের নিজস্ব সমাজ ও বিচারব্যবস্থা বিদেশী শাসনে বিপর্যস্ত হয়েছে, অথচ স্বাধীন দেশে যে সম্মান ও স্বাধীনতা তাদের প্রাপ্য ছিল, মৃত্তিকার সন্তানরা তা পায়নি। প্রসূতি ও শিশুমৃত্যুর হার এখনও আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি, সবচেয়ে কম স্ত্রী-শিক্ষার হার। স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীদের ৮৫ শতাংশ আজও আদিবাসী ও তফশিলি জাতি। জনসম্পদ যোজনায় বাস্তুচ্যুতদের ৪০ শতাংশ আদিবাসী, এদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ ঘর জমি ছেড়েছেন কোনও যথার্থ পুনর্বাসন ছাড়াই।

    আজও অপুষ্টিতে শিশুমৃত্যুর খবর যেমন ওড়িশার কোরাপুট থেকে আসে, তেমন বম্বের নিকটবর্তী থানে জেলার জেলার আদিবাসী অঞ্চল মেলঘাট, পালঘর থেকে। স্বাধীনতার ৭০ বর্ষ উদ্‌যাপনে কেবল সংখ্যাতত্ত্বের আলোচনা নয়, প্রয়োজন প্রকৃত অনুধাবন, জনসংগঠন, ও সমস্যাভিমুখী সম্পদ আবন্টনের।

    মহারাষ্ট্রের গড়চিরোলি থেকে ছিন্দওয়াড়া বস্তার হয়ে ওড়িশার মালকানগিরি কোরাপুট পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে আছে যে রাঙা করিডর, যেখানে অতি বাম ও আইনের রক্ষকদের মধ্যে দাঁড়িয়ে দেওয়ালে পিঠ আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলির, সেই পথ ধরেই স্বাধীনতার কোনও নতুন অধ্যায় রচনা করা যায় কিনা সেই আলোচনার মহড়া আরম্ভ হতে পারে। নিয়মগিরি পাহাড়ের কোলে এক গ্রামে এক বৃদ্ধ মোড়ল বলেছিল, ‘আমরা কি সত্যিই স্বাধীন দেশে থাকি? তাহলে আমাদের মনে এত কষ্ট কেন?’

    আদিবাসীদের ঘরের ঘরণী ও কন্যাদের লড়াই এই পটভূমিতে আরও তীব্র ও সংকটে দীর্ণ। শিশুর জন্ম থেকে তার পালন, পুষ্টি, জ্বালানি থেকে খাদ্য, বনজ সম্পদ থেকে দিনমজদুরি অথবা পাহাড়ের ঢালে জুম চাষ—তাদের দায়িত্ব পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি। উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় নারী সর্বত্রই প্রান্তিক, আদিবাসী রমণীর প্রান্তিকতা আরও গভীর। তাদের কণ্ঠস্বর শুনে তার তাৎপর্য অনুধাবন করার জন্য যে ইচ্ছে ও দায়িত্ববোধ প্রয়োজন, রাজনৈতিক বিভাজন তাকে প্রায় অসম্ভব করে রেখেছে। ভূমিকন্যাদের নিয়ে ৪টি পর্বে এই লেখা, স্বাধীনতার ৭০ বছর উদ্‌যাপনে তাদের সংগ্রামের প্রতি লেখকের অভিবাদন।

     

    জুয়াংগ মেয়েরা

    পাতলা ছোট্ট একটা বই ছিল আমার। আজ থেকে তেইশ বছর আগে লেখা, সাক্ষরতা অভিযানের সময়। ‘রতন মাস্টারের পাঠশালা’। বইটা এখন আর পাওয়া যায় না। রতন বলে এক ছোট্ট মাস্টারমশাইয়ের গল্প। রতন নিশ্চয়ই তার আসল নাম নয়। কিন্তু ওড়িশার কেওন্‌ঝর জেলার বাঁশপান ব্লকের ছোট এক জুয়াংগ বসতিতে সেই ছিল একমাত্র বালক, যে নিয়মিত স্কুলে যেত। বয়স্কদের কার্যকরী সাক্ষরতায় শামিল করার উৎসাহে তখন ভাসছে সারা দেশ—যেন নতুন স্বাধীনতা আন্দোলন! আমরা হন্যে হয়ে গ্রামে গ্রামে স্বেচ্ছাসেবী খুঁজছি—যারা নিরক্ষরদের পড়াবে। জুয়াংগ আদিবাসীদের বসতে বয়স্ক কেউ সাক্ষর ছিল না। তাই রতন বলেছিল, আমি বড়দের পড়াব। নিজের স্কুলের পড়াশুনোর শেষে সন্ধেবেলা রতন মাস্টারের ক্লাস। সেখানে ছাত্রী তার মা-ও। রতনের মায়ের অজস্র কাজ সারাদিন, বাবার চেয়ে অনেক বেশি। জঙ্গলের মাটিতে পড়ে থাকা পাতা, কাঠকুটো তুলে আনা, জল বয়ে আনা, ছাগলদের চরানো, রান্না, সম্বৎসরের খাবার জোগাড়, হাটে যাওয়া—এই সব করে সন্ধের মুখে যখন রতনের মা অঙ্ক নিয়ে বসে, তার ভুলভাল হয়, অক্ষর চিনতে পারে না, বাক্য গুলিয়ে ফেলে। রতন এসে মায়ের উপর কড়া নজর রাখে, আবার রাতে দেখা যায় মায়ের গায়ের উপর এক পা তুলে দিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়েছে।

    জুয়াংগ আদিবাসীরা মনে করে তাদের উৎপত্তি পৃথিবীর বুক থেকে, বৈতরণী নদীর উৎসস্থল গোনাসিকা পাহাড়ে। প্রথম দিকে তারা জঙ্গলে শিকার করেই দিন কাটাত, চাষবাস করত না। ব্রিটিশ শাসনের সময়ই তাদের বিচরণভূমি অরণ্য সংরক্ষণের আওতায় আসে—বনছাড়া হয়ে তারা চাষবাস আরম্ভ করে। ৬২টি আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস ওড়িশায়—যে রাজ্যে অনেক বছর কর্মসূত্রে কাটিয়েছি আমি। এদের মধ্যে ১৩টি সম্প্রদায়কে মনে করা হয় বিশেষভাবে বিপন্ন। জুয়াংগরা এমনি এক উপজাতি। এরা জুয়াংগ ভাষা বলে, আর কেওন্‌ঝর, ঢেনকানল, অনুগুল ও জাজপুর জেলার নানা বসতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে।

    আমার মনে আছে আড়াই দশক আগের সেই দিনগুলোয় রতনের মা আর তার মত জুয়াংগ মেয়েদের মধ্যে অক্ষর শেখা, সাধারণ হিসেব কিতেবের অঙ্ক শেখার জন্য কী আকুলতা ছিল। সবাইকে আমরা স্বেচ্ছাসেবী সাক্ষরদের সঙ্গে জুড়তেও পারিনি—সাক্ষরতার হার এতটাই কম ও অঞ্চলে। মেয়েদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ১০ শতাংশেরও কম।

    ওদের জন্য জেলা থেকে ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল—নানা রঙিন বই, অক্ষরের, গল্পের, অঙ্কের, তা ছাড়া স্লেট, খড়ি ইত্যাদি। স্বেচ্ছাসেবীরা পড়াবে বিনা খরচে—কারণ সেটা হল দেশের কাজ। পড়ুয়ারা পড়বে নিজেদের খরচে—কারণ গরজ তো তাদেরই। সাধারণ মানুষের জন্য—বিশেষ করে শিক্ষার রাজপথ পর্যন্ত কোনোদিন পৌঁছতে-না-পারা উপজাতি সম্প্রদায়ের জন্য, অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলির জন্য—সরকারের ব্যবস্থা সস্তার। কাজেই বই-স্লেট আছে তো কেরোসিনের ব্যবস্থা নেই। বয়স্ক পড়ুয়ারা সবাই পড়ে সন্ধেবেলা। অনেক পুরুষমানুষের দুপুরে সময় হয়—মেয়েরা কেউ আঁধার নামার আগে ঘরের কাজ থেকে ছুটি পায় না। মেয়েরা এসে আমার কাছে লন্ঠন চেয়েছিল, বলেছিল কেবল লন্ঠন দিও। কেরোসিন আমরা জোগাড় করে নেব।

    কি করে জোগাড় করবে, কেরোসিন?

    ওরা দেখিয়েছিল, ওদের বাঁশের ঝুড়ি। বলেছিল, যখন হাটে বেচতে যাই, তার আগে এক মুঠো করে সরিয়ে রাখি শাল, করঞ্জ, মহুয়ার বীজ। প্রত্যেকে। ওই দিয়ে কেরোসিন কিনি হাট থেকে।

    ভেজাল মেশানো চড়া দামের কেরোসিন।

    না, বাজেট ছিল না বলে লন্ঠনও ওদের আমি দিতে পারিনি।

    একমুঠো বীজও না বিক্রি করে কেরোসিন কেনার জন্য জমিয়ে রাখা, বিপুল খিদের মুখে, যে কী কঠিন, জানতে আমার বাকি ছিল না।

    মাঝে মাঝেই রাতে জুয়াংগ পল্লীর পাশের রাস্তা দিয়ে ফিরতে ফিরতে চোখে পড়েছে অন্ধকারের মধ্যে ক্ষীণ আলোর আভা।

    কিসের আলো, এই বিজন অন্ধকারে!

    আমাদের চালক গর্ব করে বলেছে, মেয়েরা পড়ছে। খালি পঞ্চায়েত-ঘরের মেঝেতে, হাতে-বোনা বাঁশের চাটাই পেতে একটিমাত্র কেরোসিনের ডিবরি মাটিতে রেখে দুলে দুলে পড়ছে পনের-কুড়িজন মেয়ে। হেমন্তের সন্ধে সাতটা আটটা মানে গ্রামাঞ্চলে নিশুতি রাত। সারাদিনের পরিশ্রমের পর, নিজেদের পয়সা বাঁচিয়ে কেনা কেরোসিনের আলোয় তাদের উদ্ভাসিত মুখে কী আগ্রহ, কী উত্তেজনা—যেন নতুন পৃথিবীর চাবিকাঠি এসে গেছে তাদের হাতে!

    সে চাবিকাঠি আমরা ছিনিয়ে নিয়েছিলাম মেয়েদের হাত থেকে। বঞ্চনা করেছি তাদের। গ্রামের পর গ্রাম সাক্ষর ঘোষণা করার সরকারি বাদ্যিবাজনার শেষে সাক্ষরতা উত্তর-পর্বে অনেকগুলি কাজ বাকি ছিল—নবসাক্ষরদের হাতে নতুন নতুন বই তুলে দেবার, তাদের পুরনো পড়া ঝালিয়ে দেবার, যেখানে ফাঁক পড়েছে, সেখানে আবার একটু পড়িয়ে শিখিয়ে দেবার।

    এইসব কাজে আগ্রহ ছিল না কারো। নবসাক্ষররা তাই অধিকাংশই ফিরে গেছে নিরক্ষরতায়—রোগ, কষ্ট আর দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়তে লড়তে হেরে গিয়ে।

    এর বছর পাঁচেক পর কলকাতার বৈদেশিক বাণিজ্য অফিসে বসে রফ্‌তানিকারিদের জন্য বিশেষ উৎসাহ-ভাতা মঞ্জুর করেছি, বিস্তর পরীক্ষানিরীক্ষার পর। বছরে আটহাজার কোটি টাকা। উৎসাহ-ভাতা, সরকারের তরফ থেকে, কারণ তারা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে আনে দেশের জন্য। তাদের রফতানির হিসেবে যে অনেক গরমিল, তা হয়তো পরে তদন্তে ধরা পড়ে, কিন্তু উৎসাহ-টাকাটা মঞ্জুর হয়ে যায় তৎক্ষণাৎ। কলকাতার অফিস অত বড় মাপের বাণিজ্য দেখে না, তাই অঙ্কটা আট হাজার কোটি—আজ থেকে কুড়ি বছর আগেকার কথা বলছি। বম্বের অফিসে বছরে তখন কুড়িহাজার কোটি মঞ্জুর হয়।

    এক্সপোর্ট কোম্পানিগুলির ফাইলে টাকা মঞ্জুর করতে করতে কি ঈষৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়তাম না? অতীতের আড়াল ঠেলে স্পষ্ট হয়ে উঠত শনিচরী, বুধবারী, লখাইয়া—জুয়াংগ মেয়েদের মুখ। তারা একটা করে লন্ঠন চেয়েছিল পড়ুয়াদল পিছু। আমি দিতে পারিনি। বাজেট দেয়নি সরকার। আজকের অফিসের এই আমি আর সেইদিনের আমি কি একজনই মানুষ? না দ্বিখণ্ডিত দুজন?

    উন্নয়ন বলতে আমরা সাধারণভাবে যা বুঝি, সেই পাকা রাস্তা, খনি, বাঁধ, পরিকাঠামো নির্মাণের কলরোলে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে জুয়াংদের মতন বিপন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের ছোট ছোট বসতিগুলি। সেগুলি পুরোপুরি গ্রামও নয়, কোথাও দুশো কোথাও পাঁচশো মানুষের বাস, তাদের আর পরবর্তী লোকালয়ের মধ্যে হয়তো সুউচ্চ পাহাড় অথবা গহিন জঙ্গল। আমাদের মাথাপিছু গড় ব্যয়ের হিসেব দিয়ে এদের জীবনে পরিবর্তন আনা অসম্ভব। পরিষেবার গুণগত দিকগুলি—অর্থাৎ প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছনো, শিক্ষার, পুষ্টিকর খাদ্যব্যবস্থার আওতায় প্রতিটি মানুষকে নিয়ে আসা—এগুলি নিয়ে বেশি সময় বা শ্রম ব্যবহার করা উন্নয়ন প্রচারকদের মনঃপূত নয়। এই গোষ্ঠীদের অনেকে একাধিকবার স্থানচ্যুত হয়েছে, উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য জমির প্রয়োজন বলে। তাতে আরও দুর্বল, বিপন্ন হয়েছে তাদের জীবন।

    গত বছর জুন মাস নাগাদ জুয়াংগ মহিলাদের আবার খবরের শিরোনামে উঠে আসতে দেখি, যখন জাজপুরের সুকিন্দা অঞ্চলে উনিশটি জুয়াংগ শিশুর মৃত্যুর খবর প্রকাশ পায়। মৃত্যুর মূল ঘটক ছিল চরম অপুষ্টি। নাগাড়া গ্রামটি এবং আরও সাতটি ছোট ছোট জুয়াংগ বসতি সুউচ্চ পাহাড়ের মাথায়। কার্যতঃ বিচ্ছিন্ন। সেখানে পাহাড় চড়ে পৌঁছতেই লাগে আড়াই ঘণ্টা। পাহাড়ের পাদদেশে একটি অঙ্গনবাড়ী। তারা পাহাড়ের মাথায় বিশেষ কোন পরিষেবাই পৌঁছতে পারে না। প্রচুর শিশুমৃত্যুর পর ওইসব বসতিতে পুষ্টিকর খাবার, ফলের চারা, স্বাস্থ্যপরিষেবা পৌঁছনোর তোড়জোড় আরম্ভ হয়েছে—কিন্তু তা কতদিন চালু রাখা যাবে বলা কঠিন।

    কেওন্‌ঝর অঞ্চলেই কয়েক বছর আগে ৫০ শতাংশেরও বেশি জুয়াংগ শিশুর মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টির লক্ষণ দেখা গিয়েছিল। সুকিন্দার মতন পর্বতসংকুল অঞ্চলে যেখানে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি পরিষেবা পৌঁছয় না, সেখানে এই হার আরও বেশি হবে তা স্বাভাবিক। অঙ্গনবাড়ীর সঙ্গে যোগাযোগ না থাকার ফলে শিশুদের অপুষ্টি এবং জীবনদায়ী টিকা কোনও কিছুর সঙ্গেই মায়েরা পরিচিত নয়। ফলে শিশুদের মৃত্যু এসেছে ধীর পদক্ষেপে এবং নিঃশব্দে। শিশুমৃত্যুর ঘটনার পর জানা গেছে জুয়াংদের ছোট ছোট বসতগুলিতে জাতীয় গ্রামীণ রোজগার গ্যারান্টি স্কীমের কার্ড পৌঁছয়নি, অন্ত্যোদয় খাদ্য যোজনার খাদ্যও। সরকারের নানা কল্যাণমূলক যোজনা থেকে জনপদগুলি বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে এতদিন। মায়েদের সাক্ষরতার হারকে ধরা হয় গুণগত উন্নয়নের একটি সূচক হিসেবে। অন্য সব বিপন্ন উপজাতি বসতের মত নাগাড়া পাহাড়েও শিশুমৃত্যুর হার বেশি এবং স্ত্রী-সাক্ষরতার হার রাজ্যের গড়ের চেয়ে অনেক কম ছিল। তাদের হাত নিরন্তর ধরে না থাকতে পারার ব্যর্থতার প্রসঙ্গে জুয়াংগ রমণীদের শালবীজ করঞ্জ জমিয়ে কেরোসিন কেনার ছবিটি মনে এসে যায়।

    গতবছরের শিশুমৃত্যুগুলি যেন ঘটার অপেক্ষাতেই ছিল।   

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics