ভূমিকন্যাদের কথা (তৃতীয় পর্ব)
2 256যাযাবর মেয়েদের কথা
ভ্রমণের সঙ্গী হিসেবে নারী গ্রহণযোগ্য নয়, (পথি নারী বিবর্জিতা) এমন কথা শাস্ত্রে কয়—কিন্তু যে সব মেয়েদের ঘর আর পথ এক হয়ে গেছে, তাদের জন্য কি বিধান?
মোটামুটি হিসেবে দুশোর কাছাকাছি সম্প্রদায় আছে আমাদের দেশে, যারা বছরের অধিকাংশ সময় কাটায় যাযাবর হয়ে। এদের মধ্যে আছে ব্রিটিশ সময়ে ক্রিমিনাল ট্রাইব হিসেবে চিহ্নিত জনসমাজ, যারা স্বাধীন ভারতে উক্ত আইনটি বিলুপ্ত হবার পর অপরাধী এই তকমা থেকে আইনত মুক্তি পেয়েছে। আছে যাযাবর এবং অর্ধ যাযাবর সম্প্রদায়। পূর্বতন অপরাধীচিহ্নিত সম্প্রদায়ের অনেকে চাষি বা কারিগর হিসেবে বসত করেছে, এদের অনেকেই এখনও ভ্রাম্যমান। তাছাড়া, ক্রিমিন্যাল ট্রাইব আইন লোপ পেলেও স্বাধীন ভারতে এসেছে ‘হ্যাবিচুয়াল অফেনডার অ্যাক্ট’ যার আওতায় পড়ে অপরাধের সঙ্গে নিয়মিতভাবে যুক্ত এমন মানুষজন। ছোটখাট অপরাধে সন্দেহের বশে এখনও এরা স্থানীয় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়, অপরাধ কবুলের জন্য অত্যাচারিত হয়। আইন যাই বলুক, সমাজের চোখ এখনও এদের অপরাধী ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না। শুনলে আশ্চর্য হতে হয় যে যাযাবর ও প্রায় যাযাবরদের সংখ্যা খুব কম নয়—আবার সেই মোটামুটি হিসেবে ১৩ কোটির মতন। এই সব সম্প্রদায় রাজ্যবিশেষে কোথাও আদিবাসী, কোথাও তফশিলি জাতি, কোথাও বা পশ্চাৎপদ বর্গ হিসেবে চিহ্নিত—কিন্তু এদের জীবনের মান, এবং বিপন্নতার মাত্রা মোটামুটি একইরকম।
এই সব সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রধানত চারধরনের মানুষ আছেন : যাঁরা পশুপালন ও পশুচারণ করেন, যাঁরা জড়িবুটি তাবিজ তেল ইত্যাদি বিক্রি করেন, যাঁরা কারিগরের কাজ করেন—কামার, মৃৎপাত্র তৈরি, পুতুল গড়া, কাপড় বোনা, পিতলের কাজ ইত্যাদি। এছাড়া আছেন—যাদুকর, বানর বা সাপের খেলা দেখিয়ে, পাখি শিকারী, নাচিয়ে-গাইয়ে সম্প্রদায়।
যে দেশে শহরে বা গ্রামে দরিদ্রের জীবনমাত্রই কঠিন সেখানে যাঁদের স্থায়ী বসত নেই, এবং যাঁদের জীবিকা অর্জনের জন্যই পথে ঘুরে বেড়াতে হয়, অনেক সময়েই সপরিবারে, তাঁদের পরিস্থিতি পরিচয়বিহীন, সুরক্ষাহীন, নাগরিকত্বহীনের সমান। এঁদের সমস্যা সমাধান দূরে থাক, সমস্যা বোঝার মত ধৈর্য বা অবকাশ এখনও শাসনব্যবস্থার হয়নি, তার একটা মূল কারণ হয়ত রাজনৈতিকভাবে এঁদের বৃহত্তম অংশের কোনও প্রতিনিধিত্ব নেই—সংক্ষেপে বলতে গেলে, এঁদের মধ্যে থেকে নেতারা এখনও উঠে আসেননি, এবং গ্রামসমাজও অস্থায়ী মানুষদের সন্দেহের চোখে দেখে, তাদের কথা শুনতে পাওয়া জরুরি বলে মনে করে না।
পশুচারণ ও পালনে বহু প্রজন্ম ধরে জড়িয়ে আছে রাজস্থানের রাইকা সম্প্রদায়। এঁদের পিতৃপুরুষের গ্রাম অবশ্য আছে, কোটার কাছে। কিন্তু সেখানে না আছে চাষের জমি, পশুর জন্য তৃণ এবং জলের সঞ্চয়। তাই বর্ষার পর এরা বেরিয়ে পড়ে দীর্ঘ এবং বহু পরিচিত পথ ধরে—রাজস্থানের সীমা পেরিয়ে মধ্যপ্রদেশের মধ্য দিয়ে, অরণ্য প্রান্তর পেরিয়ে তারপর মহারাষ্ট্রের মধ্যে দিয়ে ফেরা। এই দীর্ঘ পথে পদাতিক বাহিনীতে থাকেন পাগড়ি ও দেশজ পোশাক পরা লাঠি হাতে পুরুষরা, রঙিন শাড়ী ও কনুইয়েরও ওপর পর্যন্ত চুড়িতে সেজে মেয়েরা, ঘরের ছেলে ও মেয়েরা, অসংখ্য মেষ, এবং কয়েকটি উট। উটের পিঠে থাকে সংসারযাত্রার যাবতীয় সরঞ্জাম, রান্নার বাসন, জলের পাত্র, হাতে বোনা কাঁথা, শোবার খাটিয়া, উটের পিঠ ঢাকা থাকে মেয়েদের হাতে সেলাই করা রংবেরঙের চাদরে।
একটা সময় ছিল যখন পদাতিক ‘রাইকা’দের আগ্রহ ভরে ডেকে নিত গ্রামের চাষিরা। আ-চষা ক্ষেতে ‘ডেরা’ গাড়লে পশুদের বর্জ্য থেকে মাটির উৎপাদিকা শক্তি বাড়ে। চাষিরা ওদের দিত তেল, নুন, শস্য, টাকাও যৎসামান্য। এখন রাইকাদের পথ বিপদসংকুল। জঙ্গলের প্রহরীরা পশুদের চারণ বন্ধ করে দিয়েছে বনের ভিতর, এক এক জায়গায় বনের পথ বন্ধ করা আছে। জঙ্গলবিভাগ ও পুলিশের হয়রানি এবং চাপ দিয়ে টাকা আদায় লেগেই আছে, তার সঙ্গে বেড়েছে ডাকাতদলের আক্রমণ এবং পশুলুণ্ঠন। পুলিশ ওদের অভিযোগ নেয় না, যেহেতু ডাকাতরা স্থানীয় আর ‘রাইকা’রা বহিরাগত।
গ্রামে ঠাঁই দিতে আপত্তি করে চাষিরা, আজকাল রাইকাদেরই টাকা দিতে হয় কয়েক রাত থেকে পশুগুলিকে পথচলায় একটু বিশ্রাম দেবার জন্য।
দীর্ঘ পথ হাঁটে মেয়েরা, পুরুষদের সঙ্গে। ডেরা গাড়ার আগে থেকেই তাদের কাজ আরম্ভ হয়ে যায়। উটের পিঠ থেকে গৃহস্থালির সরঞ্জাম নামিয়ে চারটি করে লোহার খুঁটি পুঁতে মাচান তৈরি করে তারা। চাদর ঢাকা মাচানের নীচে ছায়ায় থাকে পশুদের বাচ্চারা আর কাপড়ের দোলায় মানুষের সন্তানরাও। বাকিরা সবাই দাঁড়িয়ে থাকবে রুক্ষু জমিতে। কয়েকটিমাত্র খাটিয়া। তাতে পুরুষ বিশেষ বয়োজ্যেষ্ঠরা বসলেও মেয়েদের দেখেছি মাটিতেই দাঁড়িয়ে বা বসে আছে।
কাছাকাছি জঙ্গল থেকে কাঠকুটো পাতা কুড়িয়ে এনে পাথরের টুকরোয় বানানো উনোনে রান্না চড়াচ্ছে। কিছু ছোট ভেড়া আছে, তারা সদ্য জন্মেছে। ছায়ায় তাদের রেখে বারবার দেখে আসছে ঠিক আছে কিনা। সন্ধেবেলা যখন পশুর বিশাল পাল নদী থেকে জল খেয়ে ধুলো উড়িয়ে ফেরে, তখন তাদের জন্য খুঁটি আর জালের ঘর তৈরি করা মেয়েদের কাজ। কী ক্ষিপ্রতায় দক্ষতায় যে তারা এই কাজটি করে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। হাতে হাতে খুঁটি পেতে জালের বেড়া দিয়ে মিনিট দশেকের মধ্যে কয়েকশো পশুর রাতের আশ্রয় তৈরি। মায়ের দুধ খাবার জন্য তখন ছানাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়। মা-মরা কিছু ছানা শান্তভাবে অপেক্ষা করে থাকে—কখন দুধ পাবে। মেয়েদের কাজ হল, সেই সব শাবকদের দুগ্ধবতী মায়েদের কাছে নিয়ে ধরা। দিনের বেলা সময় পেলে ছুঁচের কাজ নিয়ে বসেছে, খোলা আকাশের তলায়। ঘুম তো দূরে থাক, বিশ্রামও নিতে দেখিনি এই মেয়েদের।
পশুর দলকে একসঙ্গে তাড়িয়ে নিয়ে জল খাওয়াতে নিয়ে যায় মেয়েরা। ইন্দোরের কাছে দেখেছি ভাঙাচোরা ক্ষেতের মাটি পেরিয়ে ক্ষিপ্রা নদীতে যাচ্ছে। কিন্তু উটেদের জন্য বড় বড় পাত্রে জল এনে তাদের খোঁটাবাঁধা অবস্থাতেই খাওয়ায়। দেখলাম, সেই জল আনতেও কতবার নদীতে যাচ্ছে মেয়েরা।
উটেদের নদীতে জল খাওয়াতে নিয়ে গেলে সোজা হয় না? মেয়েরা হেসে বলল, না। উট নদীতে গেলে, ঘরের পোষা প্রাণীরা ভয় পেয়ে যায়। ছোটাছুটি করে। উট দেখে অভ্যেস নেই তো! গ্রামের লোকেরা আপত্তি করে। তাই ওদের জল এনে এখানেই খাওয়াই।
সারা বছর গ্রামের বাইরে থাকে বলে এদের না আছে কোনও পরিচয়পত্র, না র্যাশন কার্ড। যে রাজ্যের অতিথি ওরা, তারা কোনও সুবিধে দিতেই নারাজ। শিক্ষার প্রশ্ন নেই, কারণ ছোট শিশুরাও ভ্রাম্যমান। কিন্তু স্বাস্থ্য? গর্ভবতী মায়েরা প্রসবের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেন না, স্বাভাবিক প্রসব তো গাছের নীচেই হয়ে যায় কিন্তু জটিল কেস-এ প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে এমনও শুনেছি। বহিরাগতদের সন্দেহের চোখে দেখাই স্থায়ী বসতের স্বভাব। জঙ্গল বিভাগ, পুলিশ, ডাক্তারবদ্যি, কেউই এর ব্যতিক্রম নন।
মাঠঘাট রাত্রির অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেলে পশু, মানুষ সবারই বিশ্রামের সময়। তারই মধ্যে মেয়েরা রাঁধছে, রুটি বানাচ্ছে। দিনের খাওয়াটা সবাই হাতে হাতে রুটি নিয়ে দাঁড়িয়ে খায়, রাতেরটা বসে। অন্ধকারে আগুনের শিখা লকলকিয়ে উঠলে ওদের মুখ স্পষ্ট হচ্ছে, লালচে আভায় চিকচিক করছে কপালের টিপ, গালের উল্কি। ‘সামনের জন্মে যেন পথচলা বন্ধ হয়, যেন গ্রামে বসত করতে পারি স্বামী পরিবার নিয়ে। এ জন্ম তো বৃথা গেল—সামনের জন্মে যেন শান্তি পাই!’ মেয়েরা বলছে।
রাতেও ওদের ঘুম নেই। ডাকাতদল হামলা করবে, ট্রাকে ভেড়া উঠিয়ে নিয়ে পালাবে। সেই ভয়ে শীতে গ্রীষ্মে মেয়েপুরুষ সবাই পালা করে রাত জাগে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় জাগা ঘুমোনো ওদের সয়ে গেছে।
সময়ের সঙ্গে আদিবাসী ও প্রান্তিক সমাজ বদলেছে। কিন্তু যা বদলায়নি, তা হল শ্রমের বৈষম্যমূলক বিভাজন—নারী ও পুরুষের মধ্যে। বরং, কোথাও যেন শহুরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ঢুকে পড়ছে আপাত সাম্যবাদী আদিবাসী সমাজে। দিল্লির একেবারে প্রান্ত ঘেঁষেই হরিয়ানা। তার ‘গুড়গাঁওয়া’ যা এখন জাতীয়তাবাদী ‘গুরুগ্রাম’—ঐশ্বর্য্যে, পরিকাঠামো ও পরিষেবার আড়ম্বরে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তার আকাশচুম্বী বাড়ি, শপিং মলের ভাঁজে ভাঁজে যে বসত করে আছে তিরিশ হাজারের মত যাযাবর সম্প্রদায়ের মানুষ, এত কাছে বসেও বুঝতে পারিনি। ‘গাড়িয়া লোহার’ সম্প্রদায়কে ভ্রাম্যমান অবস্থা থেকে স্থায়ী বাসিন্দা বানানোর চেষ্টা করেছে কোনও কোনও রাজ্য। তাদের প্রচেষ্টা সফল হয়নি। ‘লোহার’ বা কর্মকারের বৃত্তি বহু প্রজন্ম ধরে অবলম্বন করে এসেছে এরা। তবে পথের ধারে নিজেদের শকটগাড়ী ছেড়ে কোথাও বসত করতে যাবে না। এদের মেয়েরা বংশানুক্রমে দেহব্যবসায় লিপ্ত, তবে তার কতটা স্বেচ্ছায় আর কতটা সামাজিক শোষণের জটিল পদ্ধতি, তা একনজরে বোঝা যায় না। গুড়গাঁওয়ের রাস্তার ধারে ঝুপড়ি বানিয়ে যে ‘গাড়িয়া লোহার’রা বাস করছে, আর নানা কারিগরি কাজ, মাটি ও ধাতুর জিনিস বিক্রি করছে পথচারিদের, তারা এখন গভীর সংকটে। কোনোমতে মাথার উপর একটি ছাদ জোটাতে না পারলে এ শহরে বসবাস অসম্ভব। তাদের ছেলেরা কিন্তু চোখে রোদচশমা, হাতে দামি ঘড়ি পরে ভাল ফোন নিয়ে মোটরবাইকে ঘুরে বেড়াচ্ছে—হয়ত টাকা রোজগারের কোনও অসামাজিক পন্থা খুঁজে পেয়ে গেছে তারা।
তরুণী মেয়ে ও তাদের মায়েরা ঝুপড়ি ঘরের জল আনা, রান্না ও অন্নসংস্থানের কাজ করে যাচ্ছে উদয়াস্ত খেটে। এরা না পেয়েছে পড়াশুনার সুযোগ, না কোনও স্থায়ী জীবিকার সন্ধান। পঞ্চাশটির মত মেয়েকে জামাকাপড়ে নকশা তোলা ও সেলাই ডিজাইন ইত্যাদির তিনমাসের ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থা হল। একটি বেসরকারী সংস্থায় অর্ডার সাপ্লাইয়ের কাজ করবে এরা। হাতে ট্রেনিং সার্টিফিকেট পেয়ে, চা জলখাবার ও স্টাইপেন্ড পেয়ে কী খুশি মেয়েরা। ওরা ‘বাড়ি’ পৌঁছনোর আগেই জানতে পারল, যে জায়গায় ঝুপড়ি বানিয়েছিল, সেগুলি হরিয়ানা সরকারের নগর উন্নয়ন বিভাগের খুব দামী জমি। বুলডোজার আনা হয়েছে, কালই গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে সব কটি ঝুপড়ি। কেন গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে, কোনও বিকল্প ব্যবস্থা না করেই? বিকল্প ব্যবস্থা আবার কী—এরা তো বেআইনী দখলদার! ওদের হয়ে, এবং বিপন্ন মুখগুলির দিকে চেয়ে হরিয়ানা সরকারকে যে চিঠি লিখেছিলাম, তার পরিণতি কি হয়েছিল জানা নেই। যারা স্থায়ী হতে চাইছিল, ঘর বসত বানাতে চাইছিল, আমাদের নগর সভ্যতা হয়ত তাদের ধাক্কা মেরে উঠিয়ে দিয়েছে। এই প্রক্রিয়া চলেছে সারা দেশ জুড়ে।
গত বছর তেলেঙ্গানার মেডক জেলায় যাযাবর সম্প্রদায়ের কিছু বসতে গিয়েছিলাম। পথের ধারেই এঁদের অনেকের বাস, সরকারী বা বেসরকারী জমিতে ঝুপড়ি বানিয়ে। পথের ধারটাই হল সবচেয়ে বড় বাজার। ছোটখাট সস্তা প্লাস্টিকের জিনিস, কাঁচের চুড়ি, চুলের ফিতে সবই এখানে বিকিয়ে যায়। এঁরা পথে পথে ঘুরতেন, জীবিকার চাপে তাঁদের বাড়ির মেয়েরা দোকান সাজিয়ে পথের উপর বসে আছেন। হায়দরাবাদ শহরেও পাথর ভেঙে খোদাই কাজের দোকানগুলি ওই যাযাবরদের। মাথার উপর ত্রিপল, অস্থায়ী জলের ব্যবস্থা, কোথাও অস্থায়ী শৌচাগার। পাথর কাটতে কাটতে টুকরো ছিটকে চোখে এসে অন্ধ হয়ে গেছে কত কারিগর। ওরই মধ্যে মেয়েরা আয়না ধরে চুল বাঁধছে, বালক বালিকারা সুটকেস নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। এক বালিকার গলায় সুতোয় বাঁধা ছোট চাবি। না। ঘরের নয়। ঘরের তো দরজাই নেই। এ চাবি বইখাতার বাক্সর। স্কুলে যেতে হবে যে! বড় হয়ে কী হবে জানতে চাওয়ায় বালিকাদের দলটি দু ভাগ হয়ে গেল—একদল বলল—টীচার! আর একদল বলল—পুলিশ! ওদেরও ঘরগুলি কবে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে বুলডোজার। আবার কোথায় উঠে যাবে এরা জানে না। তাই বলে গ্রামে যাঁরা বসত করেছেন, তাঁরাও খুব সুখে আছেন এমন বলা যাবে না।
‘ডোমমারা’ মেয়েরা। কী করুণ জীবন এঁদের! এঁদো, কাঁচা মেঝের স্যাঁতস্যাঁতে ঘর। এক একটি মেয়ের কোলে একটি করে শিশু, কারো দুটি। স্বামীরা থাকে না ওদের সঙ্গে। বয়স্কারা বললেন, আমাদের সমাজে মেয়েদের বিয়ে হয় তরবারির সঙ্গে। সত্যিকারের স্বামী হয় না। তবে সন্তানেরা? বোঝা গেল এরা শোষণের শিকার। সন্তানদের না আছে পিতৃপরিচয়, না আছে মায়েদের টাকাপয়সা বা জীবিকা। এঁরা গ্রামের প্রান্তে আছেন, সরকারের দেওয়া অল্প টাকার ঘর পেয়েছেন, কেউ কেউ কলের পানীয় জল, এই যা।
‘ডোমমারা’ সম্প্রদায়ের পুরুষরা আজও যাযাবর। গ্রামান্তরে ঘুরে নানা পণ্য, হাতের কাজ বিক্রি করে জীবিকা অর্জন করেন। মেয়েরা পড়ে থাকে গ্রামে। অপরিচিত পুরুষের পরিচয়হীন সন্তানকে অথৈ দারিদ্র্যের মধ্যে বড় করার চেষ্টায়। মেয়েগুলির হতাশ্বাস, করুণ মুখ দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল কয়েক শতক পিছিয়ে গেছি। চোখে জল আসছিল নিজের অজান্তে। ওদের জন্য হাতের কাজের ট্রেনিং, শিশুদের জন্য হস্টেলের ব্যবস্থা—খসখস করে সমাধান লেখা হচ্ছিল খাতায়। লিখছিলেন সাথী অফিসাররা—রাজ্য সরকার যাঁদের পাঠিয়েছেন আমার সঙ্গে। বুঝতে পারছিলাম, যাযাবর যখন সমাজের প্রান্তে একটু মাথা গোঁজার আশ্রয় চায়, তাকে দিতে হয় চড়া বিনিময় মূল্য। নইলে আবার সেই শ্বাপদসংকুল পথে চলে বেড়ানো।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
অসাধারণ লাগল। মেয়েদের যে কতো বঞ্চনা আর শোষণের গল্প !