• চাকুরে কন্যার কাহিনি (তৃতীয় পর্ব)


    5    233

    May 23, 2017

     

    আগের পর্বে চাকুরিররতা কন্যার দুঃখদায়ী কাহিনি সবে শুরু করেছিলাম। এই তৃতীয় পর্বেও, প্রথম পর্বের মতই, শুরু করি একটা বিচ্ছিরি রসিকতা দিয়ে।
    এক সাংবাদিক গেছিলেন আফগানিস্তানে। আফগান মেয়েরা পুরুষের দশ পা পেছনে পেছনে হাঁটে, দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলেন, এটাই রীতিরেওয়াজ। মেয়েরা পুরুষদের থেকে হীন, তাই স্বামীর পেছনে চলে। খুব বিরক্ত হলেন সাংবাদিক।
    দশ বছর পরে, আমেরিকার আফগানিস্তানে চড়াও হবার পর, সেই সাংবাদিক ফিরে গেলেন। এবার দেখলেন মেয়েরা পুরুষের দশ পা আগে আগে হাঁটছে। উল্লসিত সাংবাদিক জানতে চাইলেন, কী এমন ঘটল যে রীতিরেওয়াজ আমূল পালটে গেল? নারীদের এত উন্নতির পেছনে কী আছে?  
    উত্তর এল, ল্যান্ডমাইন।
    বিপদে মোরে রক্ষা কর, এ প্রার্থনা কোনওদিনই মেয়েরা করতে পারেনি। তাত্ত্বিকভাবে বলা হয় দুর্বল জাতি কিনা, তাই সঙ্গে পুরুষমানুষ দরকার। কিন্তু বিপদ যখন আসে, তখন বুক দিয়ে পরিবারকে রক্ষা করার ঘটা মেয়েদেরই বেশি – আর সেটা ল্যান্ডমাইন পাতা মাটিতে আগে আগে হেঁটে, নিজের প্রাণ দিয়ে পরখ করার মতই সহজ, টেকেন ফর গ্রান্টেড, স্বতঃসিদ্ধ।
    বাঙাল ভাষায় বলা হত, করবে না কিয়া?
    কেনই বা কষ্ট করবে না মেয়েরা। তারা শারীরিকভাবেই তো কষ্ট করার জন্য তৈরি। তা সে তুমি সরকারি চাকুরে হও আর কেরানি (যদিও সরকারি চাকুরের কপালে জুটবে শাশুড়ির মন্তব্য, কেরানি হলেই ভাল হত, অফিসার বলেই ত চারটেতে বাড়ি ফিরতে পারে না!), অথবা পথের ধারের তেলেভাজা বিক্রেতার মহিলা ভার্শান, যে বাড়ির সবার খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেও সারাদিন উনুনের সামনে বসে ভাজাভাজি করবে। অথবা হাসপাতালের আয়া, যারা সারাদিন কাজ করে এসে নাইটডিউটিতে টুলে পা ছড়িয়ে বসে বসে ঘুমোতে দক্ষ, আবার ভোরবেলা বাড়ির সবার রান্না করে টিফিন গুছিয়ে রেখে কাজে আসতেও পিছপা নয়, দুপুরে রুগি ঘুমোলে ঝিমিয়ে পুষিয়ে নেবে।
    তবে পারিবারিক জগতে মেয়েদের ‘ডবল ডিউটি’ আমাদের এ লেখার অভীষ্ট নয়। আমাদের কথা এখন চাকরির ক্ষেত্রেই আবদ্ধ রাখা হবে।
    আগেই বলেছি, সরকারি চাকুরেরা সমগ্র ভারতীয়দের অতি ক্ষুদ্র অংশ। তাই, গোটা ভারতের পরিসংখ্যানের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিতে পারলে ভাল, নইলে যে অংশের হয়ে আমি কথা বলছি তার প্রতিনিধিত্বের মূল্যমান কতটা তা স্পষ্ট হবে না পাঠকের কাছে।  
    ২০০১ এর সেন্সাস বা জনগণনা অনুসারে ভারতের মোট কর্মক্ষম জনগণের সংখ্যা ৪০ কোটি। তা গোটা দেশের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ। এর ভেতরে ৩১.২ কোটি মূল কর্মী আর ৮.৮ কোটি হলেন প্রান্তিক কর্মী, অর্থাৎ যাঁদের তার আগের বছরে ১৮৩ দিনের ওপরে কাজ ছিল না।

    কর্মক্ষম চল্লিশ কোটি মানুষের ভেতরে ১২.৭ কোটি মাত্র নারী। অর্থাৎ ২৫.৬% নারী আছেন ভারতীয় কর্মক্ষেত্রে। মূলধারা আর প্রান্তিক কর্মীদের মধ্যে যদি তুলনা করি, দেখব, মূলধারায় মাত্র ২৩.৩ % কর্মী হলেন মহিলা। অথচ প্রান্তিক ধারায় মহিলারা পুরুষদের তুলনায় বেশি। অন্যদিকে কর্মী মহিলাদের ৮০ শতাংশই কিন্তু আসছেন গ্রাম থেকে। অর্থাৎ চাষবাসের কাজের সঙ্গে যুক্তদের একটা বিশাল অংশই যেমন প্রান্তিক ধারার, তাঁদের অর্ধেকের ওপরই মহিলা।
    শহরের কর্মীদের মধ্যে ঘরে ঘরে কাজ করার মহিলার সংখ্যাই বেশি।
    এবার আসি, সরকারি বেসরকারির হিসেবে। অবশ্যই এটা অর্গ্যানাইজড সেক্টরের কথা। লেবার ব্যুরো, কেন্দ্রীয় সরকারের ২০০৫-এর একটি কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৩০ লাখ মহিলা পাবলিক সেক্টরে কাজ করেন, আর ২১ লাখ মহিলা প্রাইভেট সেক্টরে। কিন্তু কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যানের যথাযথতা কতখানি বলা মুশকিল। একটা অর্থে ধরেই নিতে পারি যে অর্গ্যানাইজড সেক্টরে যেটুকু যা মেয়েদের অংশগ্রহণ, সেনসাসের মাধ্যমে বা অন্যান্য রিপোর্টিং-এর মাধ্যমে তা ধরা পড়বে। কাজেই এই তথ্যটুকুকে কাজে না লাগিয়ে আমাদের উপায় নেই।
    সাম্প্রতিক কিছু স্টাডিও বলছে, মেয়েদের অর্গ্যানাইজড সেক্টরে বেশি না আসার কারণ প্রথাগতভাবে বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা। এবং কিছু ক্ষেত্রে চাকরি ছেড়ে দেবে এই ভয়ে, তাদের প্রাইভেট সেক্টর ফার্মগুলি নিতে চাইছে না। অর্থাৎ একটা পঙ্কিল আবর্তের মত কাজ করছে এই ব্যাপারটি। এর সঙ্গে সঙ্গেই ওই স্টাডি থেকে আরো দেখা যাচ্ছে যে কর্মক্ষম মহিলাদের (১৫ থেকে ৫৯ বয়সী) মাত্র ৬.৫% হাই স্কুল পাশ করেছেন। সুতরাং যেসব কাজে কলেজ-পাশের বিদ্যে দরকার বা কোন বিশেষ কাজের দক্ষতার প্রশিক্ষণ দরকার এমন ভাল মাইনের চাকরি জুটবে না সেই সব মেয়েদের, যাঁরা সামান্য লেখাপড়া করেছেন। ফলত মেয়েরা অধিকাংশই কাজ করেন খুব খারাপ মাইনেতে।
    আর সেখানেই লিঙ্গবৈষম্য মারাত্মক। সামাজিক সুরক্ষা থেকে শুরু করে ছুটিছাটার সুযোগ (বিশেষ করে মেটার্নিটি লিভ) বা অন্য কোনোরকম সুযোগ সুবিধা তো তাঁদের নেইই, এমনকি সমান মেধা বা দক্ষতা সম্পন্ন পুরুষদের থেকেও তাঁরা অনেক কম মাইনে পান। যেখানে নিরক্ষর এক পুরুষের দিনমজুরি ১৭৭ টাকা, এক নিরক্ষর মহিলার মজুরি ৮৫ টাকা মাত্র।  

    জানার চেষ্টা করি, এইসব মেয়েরা কোথায় কাজ করছেন তাহলে?
    ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অরগ্যানাইজেশনের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০০৯-১০ এই সময়কালে, এক লক্ষ গৃহ থেকে সংকলিত তথ্যের ভিত্তিতে, ভারতে নারী কর্মীর সংখ্যা, ১১.২ কোটি (২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী দেশে নারীর সংখ্যা ৫৮ কোটি)। লক্ষ্য করবো, আগেই যে তথ্য পেশ করেছি, তার ভিত্তি ছিল ২০০১ এর জনগণনা। সেখানে বলা হয়েছে নারী কর্মীর সংখ্যা ১২.৭ কোটি। অর্থাৎ ২০০১ এর জনগণনার চেয়ে ২০১০ এর রিপোর্টে নারী কর্মীর সংখ্যা কম দেখা যাচ্ছে। যাই হোক, মূলত কোথায় কাজ করেন এঁরা?

    ১। চাষবাস, পশুপালন - ৬৮ %
    ২। তামাক শিল্প, বস্ত্র শিল্প, দর্জির কাজ- ১০.৮%
    ৩। গৃহনির্মাণ কাজ (মূলত ইঁট, বালি ইত্যাদির বহনের শ্রমিক হিসেবে) - ৫%
    ৪। ইস্কুল/কলেজ – বিভিন্ন স্তরে শিক্ষাদানের সঙ্গে যুক্ত থাকা -৩.৮%
    ৫। মুদি-দোকান দেওয়া (চাল, ডাল, তেল, খুচরো সবজি এবং পান-সিগারেটের দোকান দেওয়া) - ২.১%  
    ৬। গৃহকর্ম (ঝাড়পোঁছ, বাসন মাজা, কাপড়কাচা প্রভৃতি) - ১.৬%
    ৭। ব্যক্তিগত সেবা (ম্যাসাজ, বিউটি ট্রিটমেন্ট, বেবি সিটিং ইত্যাদি) - ১.৫%
    ৮। স্বাস্থ্য সেবা - ১.১ %
    ৯। ব্যুরোক্রেসি (সরকারি চাকরি) - ১%

    লক্ষ্যণীয় যে, চাষবাস থেকে শুরু করে নির্মাণ ও শিল্প সর্বত্রই সামান্য হলেও মেয়েদের যোগদান গত দশ বছরে কমে এসেছে দেখা যাচ্ছে। এমনকি গৃহকর্মের ক্ষেত্রেও মেয়েদের যোগদান কমেছে সংখ্যাতত্ত্বের নিরিখে। দুই শতাংশ থেকে নেমে ১.৬%। একমাত্র ব্যুরোক্রেসিতেই, ০.৭ % থেকে উঠে গেছে ১% এ!

    সেই এক শতাংশেরই একজন আমি। কেমন করে আর বলি, আমি তোমাদেরই লোক। সমাজ সুরক্ষা থেকে পেনশন, গ্রাচুইটি আরো নানা রকমের সুযোগ সুবিধায় লালিত সরকারি কর্মচারী, লোকে বলে এ চাকরি পাওয়া কঠিন, ছাড়া আরো কঠিন। ছাড়ালেও না ছাড়ে, আমার এক বান্ধবী স্বামীর সঙ্গে বিদেশ গিয়ে ছ’ বছর কাটিয়েছিল উইদাউট পে, তারপরও তার প্রোমোশন অর্ডার বেরিয়ে যায়, কালচক্রের নিয়ম অনুযায়ী, সে লিখে লিখেও নিজের রেজিগনেশন অ্যাক্সেপট করাতে পারছিল না তার ডিপার্টমেন্টে!

    তো এই হেন সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রটিতে বিচরণ করে আমরা কীভাবে বেড়াই? কতটা সুবিধাভোগী এই শ্রেণীর ভেতরে আবার মহিলা অফিসারকুল?

    দুটো গল্প বলি।
    এক, আমার এক সিনিয়র, আমারই সার্ভিসের, ভদ্রমহিলার সঙ্গে একদিন কথা হচ্ছিল। আশ্চর্যভাবে মিলে গেল দুটি অভিজ্ঞতা, যে গাড়িটি আমরা চড়ি, অফিস থেকে দেওয়া এবং বিশেষভাবেই চিহ্নিত, কারণ ওপরে গভর্মেন্ট অফ ইন্ডিয়া লেখা থাকে, এবং মাথায় একটি লাল টুপির মত বাতি থাকে (যে বাতিটা ইদানিং খুলে নিতে হয়েছে, অন্তহীন অপব্যবহারের ফলে যে বাতিটি এখন শুধুমাত্র গুটিকতক ব্যক্তিই ব্যবহার করতে পারবেন যে কোন রাজ্যে, রাজ্যপাল, চিফ জাস্টিস, মুখ্যমন্ত্রী, ইত্যাদি ইত্যাদি বাদে, আর কেউ নয়, কিন্তু সে অন্য এক গল্প)। গাড়িতে চড়ার জন্য পুরুষ অফিসারদের কিছু কেতা কানুন আছে, যেমন প্রতিবার তিনি যখন গাড়িতে উঠবেন বা নামবেন, সাদা পোশাক পরা ধোপদুরস্ত ড্রাইভার দরজা খুলে দেবেন। আমার সিনিয়র ভদ্রমহিলার পর্যবেক্ষণ বলে, মহিলারা এভাবে ড্রাইভারের দরজা খুলে দেওয়ার তোয়াক্কা করেন না, সটান নিজেই দরজা খুলে নেবে আসেন। এতে ড্রাইভাররা প্রথম প্রথম থতমত খেলেও, পরে দিব্যি মেনে নেয়, এবং গাড়ি থেকে নামবার নামটিও করে না। এই গল্পের সঙ্গেই ফুটনোট হিসেবে একটা ফাউ গল্প পাই তাঁর কাছে। তাঁর ভাইয়ের একবার একটা ছোট পথ দুর্ঘটনায় গাড়িটি জখম হয়, এবং যে গাড়িটি তার গাড়িকে ধাক্কা দিয়েছিল, সেই গাড়ির মালিক কোন রাজনীতিক বা প্রভাবশালী লোক, তাই ভাই ক্ষতিপূরণ পাবার বদলে গলাধাক্কা পেয়ে বাড়ি ফেরে। সেই প্রভাবশালীর ড্রাইভার ভাইটিকে শোনায়, জানেন এটা কার গাড়ি? অমুকচন্দ্র তমুক, অমুক মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান। পাঙ্গা নিতে আসবেন না। প্রবল অপমানিত হয়ে, ভাই সেই রাস্তাতেই চীৎকার করে বলে, আপনাকে দেখে নেব, আমার দিদিও অ্যাকাউন্টেন্ট জেনেরাল। ভয়ানক বিচলিত ও খুব আহত ভাই, তার দিদিকে ফিরেই চার্জ করে, দিদি, তুই আমার দিদি না হয়ে দাদা হলে আজ আমার বেশি সুবিধে হত, তুই যে অ্যাকাউন্টেন্ট জেনেরাল, তবু তোর নাম নিয়ে আমি কোন সুবিধে করতে পারলাম না! এখন ব্যবস্থা কর দেখি, ওই লোকটার গাড়ির লাইসেন্স বাতিল করিয়ে দে, অথবা অন্য কিছু?
    অ্যাকাউন্টেন্ট জেনেরাল, শব্দযুগল মনের ভেতর যে ছবিটা ফুটিয়ে তোলে তাতে অনেকটা সম্ভ্রম আর বেশ কিছুটা পৌরুষ আছে, মহিলা টিপ্পনী দিয়ে আমাকে বলেন। দাদা এ.জি. হলে যতটা ভাও পাওয়া যায়, দিদি এ.জি. হলে কি আর ততটা পাওয়া যায়?

    আমার চোখে, এ গল্প এক বিশাল ভারতীয় লঘু কাহিনি। ভারতের আমলাতন্ত্র, ভারতের প্রদূষিত ভ্রষ্টাচারী রাজনীতিতন্ত্র, সুবিশাল ঐতিহ্যের মত বহন করা আমাদের মধ্যযুগীয় মানসিকতায় রাজকীয় এই শোষণ পদ্ধতি, এগুলির সঙ্গে পুরুষতন্ত্রও কতই না ওতপ্রোত। খারাপ একটা সিস্টেম বাপু আপনাদের এই পশ্চাৎপদ ভারতবর্ষের আমলা-নেতাতন্ত্র। বলতেই পারেন যে কেউ। তো, এ গল্প তারই এক ছোট টুকরো। এটা না হলেও চলে যায়, তাই এটা লঘু ঘটনা, কিন্তু ঘটনা তো বটেই!
    অন্য ঘটনা আমার নিজের চোখে দেখা। আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলে, মহিলা হিসেবে আমার নিজের কোন মাথাব্যথা নেই, কিন্তু অন্যদের কাছে আমার মহিলা আইডেন্টিটি খুব গুরুত্ব পেয়ে যায়, যখন, এক কনফারেন্স রুম ভর্তি পুরুষ অফিসারের মধ্যে বসে, আমি এক এবং অদ্বিতীয় মহিলা হিসেবে থাকি। প্রত্যেকটা মিটিং-এ তাদের মাথার ওপরে আমি আছি এটা টের পাওয়ানোর খেলাটা খেলতে খেলতে হঠাৎ খেয়াল করি, এই যে পুরুষসিংহের দল, যাঁদের আমি “আপনারা আমার টিম”, “আপনারা অডিট ডিপার্টমেন্টের স্তম্ভ” ইত্যাদি ভাল ভাল কথা বলে কাজে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি, এঁরা প্রত্যেকে তাঁদের পরিবারে এক একজন সম্রাট এবং স্ত্রীরা এঁদের কাছে হয়তো বা জুজু। এখানে মাথা নত করে এঁরা ‘ম্যাডামের’ কথা শুনছেন এবং বকাবকিতেও চুপ থাকছেন। বহু মিটিং চলতে শুরু করার অনেক অনেক পরে সচেতন হয়ে দেখেছি, আমার নারীসত্তা প্রকাশ্যে আমি নিজে আনিনি, কিন্তু পরিস্থিতিগত বৈষম্য আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে, হংস মধ্যে বক যথা আমি নারী হয়ে এঁদের পরিচালনায় আছি। এই সচেতনতা আমার মধ্যে এনে দিচ্ছে ছোট ছোট শরীরী ভাষা বা ইঙ্গিত হয়তো বা। তাই হয়তো, এঁদের ভেতরে যে যুগসঞ্চিত বিশাল পুরুষতন্ত্রের দেওয়ালটা আছে তাতে ধাক্কা লাগবে বলেই কি আমিও, আমার কন্ঠস্বরে আমার কথায় বন্ধুত্ব এবং টিম ওয়ার্কের কথা বলছি বার বার? এ আমারই অচেতন দুর্বলতার প্রকাশ নয়তো?
    একটা হাসির গল্প দিয়ে এই লঘুনাটিকার ইতি করি। অসম প্রদেশে অ্যাকাউন্টেন্ট জেনেরাল হিসেবে যোগ দেবার পর, কিছুদিনের মধ্যেই অসমের বেশ কিছু ভাল বাংলা পত্রপত্রিকার সন্ধান পাই, অনেক লেখক সম্পাদকের সঙ্গেও দিব্য জমে ওঠে আলাপ পরিচয়। সেখানেই সৌমেন ভারতিয়া-র সম্পাদিত ‘ব্যতিক্রম’ নামের পত্রিকাটিতে 'অসমের প্রথম মহিলা অ্যাকাউন্টেন্ট জেনেরাল' এই শব্দবন্ধ দিয়ে আমার একটা সাক্ষাৎকার প্রকাশ পায়। আমি এই শব্দবন্ধটিতে বড়ই জড়োসড়ো বোধ করি, কেননা, ঠিক যেভাবে চাকুরিক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ আমার নাপসন্দ, সেভাবেই, প্রথম মহিলা অমুক তমুক সেমুক হয়ে ওঠায় আমার বেশ অসুবিধে। কিন্তু এবার সচেতন হয়ে আমি সত্যিই দেখি আমার অফিসে রাখা বিশাল কাঠের ফলকে, যাতে ১৯৪৭ থেকে সব অ্যাকাউন্টেন্ট জেনেরালের নাম আছে, (আর এক মধ্যযুগীয় প্রথা) আমার নামটিই শুধু মিস/মিসেস/এমএস লাঞ্ছিত।
    বোঝাই যায় কেন অসমে গিয়ে, এয়ারপোর্টে আমাকে রিসিভ করতে আসা সেক্রেটারি সাহেব যখন গলা দু’ ধাপ নামিয়ে সামনের খাকি উর্দির লোকটিকে বলেছিলেন, আমাদের ম্যাডাম এ.জি., তখন খাকি উর্দির ভদ্রলোক আশেপাশে তাকিয়ে স্যার এ.জি.-কে খুঁজছিলেন।
    শুধু একবার নয়, বহুবার এই অভিজ্ঞতা। এ.জি. ম্যাডাম মানে, এ.জি. সায়েবের স্ত্রী, এটাই ছিল ও অঞ্চলের প্রায় অধিকাংশের ভাবনার দস্তুর। যে ম্যাডামটি এখন গাড়ি থেকে নামলেন তিনি যে কোনো জাঁদরেল পুরুষ্টু গোঁফসম্পন্ন কোন অফিসারের পত্নী নন, নিজেই অফিসার, এটা বিশ্বাস করার মত অভিজ্ঞতা বা ডেটাবেস হয়তো তাঁদের নেই, তাই এ নিয়ে বেশি ভাবিনি, নিছক গল্প করে বলার মত ঘটনা হিসেবে, হাসির খোরাক হিসেবেই আছে। সত্যি বলতে অসম ক্যাডারের আই.এ.এস.-এও, মহিলার সংখ্যা অতি নগণ্য। পারুল দাস বা এমিলি চৌধুরীর মত হাতে গোনা কয়েকজন মহিলাকেই আমি সিনিওর আমলাদের মধ্যে পেয়েছিলাম আমার অসম বাসকালে।

    রাজনীতির মঞ্চেই বা অসমে ক’জন মহিলাকে দেখা গেছে? সে অর্থে দেখলে, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীগুলি তো নির্ধারিত হয় তথ্য থেকেই। বারংবার এক একটা তথ্য চোখ কানের ওপর আছড়ে পড়ার গতিবেগে দৃষ্টিভঙ্গীও পরিবর্তিত হয়।

    আপাত দৃষ্টিতে অবশ্যই, একজন জনমজুর মহিলার চাইতে ক্যাডারভিত্তিক অফিসারদের ভেতরে পুরুষ-নারী বৈষম্যের ব্যাপারটা নেইই। মাইনে এক, প্রোমোশনের পদগুলি বা প্রোমোশন হবার জন্য যা যা করণীয় সে সবই পুরুষ-নারী নির্বিশেষে এক। বিদেশের নানা জার্নালে পড়া গ্লাস সিলিং-এর বিষয়টি তথাকথিতভাবে অন্তত আমাদের সার্ভিসে নেই। গ্লাস সিলিং অর্থে, অদৃশ্য বাধা, ওপরের দিকে উঠতে। যেখানে, একটি মানুষ, তার সমস্ত যোগ্যতা সত্ত্বেও, কেবলমাত্র নারী বলেই, সবচেয়ে উঁচু পদে উঠতে পারছেন না। কোনো কারণ না দর্শিয়েই তাঁকে রেখে দেওয়া হচ্ছে মধ্যমানের পদে। ম্যানেজেরিয়াল পোস্টে থেকেও, তিনি কখনোই সংস্থার নিয়ন্ত্রক ভূমিকায় আসতে পারছেন না। কেননা, তাঁর আশপাশের পুরুষরা কখনোই চাইছেন না, একজন মহিলা ওই পদে বসুন। অসংখ্য অধস্তন কর্মচারীর কাছেও একজন মহিলার কাছে জো হুজুর করাটা খুবই অসম্মানের।
    আপাতদৃষ্টিতে রুলস রেগুলেশনে বাঁধা আমাদের সার্ভিস। তার ভেতরে এই রকমের কোন আবছা পলিটিক্স নেই।
    কিন্তু সত্যিই কি নেই?

     
     



    Tags
     



    Comments (5)
    • সরকারী অফিসে উঁচু র‍্যাঙ্কের অফিসারদের ভেতরকার পৃথিবীটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি বিহার উত্তরপ্রদেশের মত পুরুষ শাসন… যা সভ্য সমাজে অকল্পনীয়। তারা কিন্তু সকলেই অত্যুচ্চ পদে বিরাজমান

    • আমার ধারণা শিক্ষকতায় মেয়েরা এলে লোকেদের সমস্যা কম হয়। অন্তত আমার ষোলো বছরের অধ্যাপনা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়। হয়তো এ প্রফেশনে মেয়েরা ১৮৫৫ থেকে এসেছেন বলে। মানুষের ট্যাবু কম। তবে ডবল ডিউটিতে কোনো ঘাটতি হয় না। এখন তাও শিশু কেয়ার লিভ পাওয়া যায়।

    • ভালো লিখেছেন। নিজে সরকারি অফিসার হিসাবে আমারও এ ধরনের কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। তবে মনে হয় মানসিকতা খানিকটা বদলেছে। এর পর চাকুরিজীবী মহিলাদের পারিবারিক চাপ নিয়ে লিখলে ভালো লাগবে।

    • তোমার লেখায় শেখা ও জানার উপাদানের শেষ নেই। এবারে যেটা শিখলাম ম্যাডাম এজি দুই প্রকার। এক সে নিজে আবার দুই সে এজির স্ত্রী।

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics