• ‘স্ত্রী-কমোড’ ও ভালমানুষ স্বামীদের গল্প


    1    226

    December 1, 2018

     

    জানো সুমি, আমার মাঝে মাঝেই খুব ভয় হত আমার দুঃস্বপ্নের মতো দিনগুলো কেউ বিশ্বাস করবে না।  কারণ, রূপ অন্য সবার প্রতি এত ভালো, এমনকী নিজের ক্ষতি করে ভালো, যে ঠিক কী ভাবে সে শুধু আমার প্রতিই এতটা খারাপ হতে পারে, এটা আমার নিজেরই মাথায় ঢুকতো না।

    নির্মোহীর বাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল রূপ আর নির্মোহীর সদ্যবিচ্ছেদ নিয়ে। আগে এবিষয়ে কথা বলতে গিয়ে নির্মোহী খুব আলোড়িত হত - কেঁদেকেটে চোখ ফুলিয়ে, হেঁচকি তুলে একাকার। এবারটা তেমন ছিল না। কারণ নির্মোহী নিজের কিছু পুরনো প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিল নিজের মধ্যেই। আর তার ডায়েরির পুরনো পাতাটাও ছিল সত্যবাদী। ‘এখন আলাপ’-এর জন্য যখন লিঙ্গ সচেতনতা নিয়ে কিছু লেখার সুযোগ পেলাম, ভাবলাম নির্মোহীর ডায়েরি থেকে খানিকটা ঝেঁপে দেবো; আর তার সঙ্গে বিকেলে নির্মোহীর নতুন ছোট্ট উঁচু ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে অল্প অল্প চুমুকে কফির সঙ্গে আমার আর নির্মোহীর বার্তালাপের নির্যাসটুকু।

    অভাবী সংসারের সন্তান রূপ। নিজের রোজগারে সে তার ছয় ভাইবোনকে পড়িয়ে, লিখিয়ে, বাড়ি ঘর ক'রে দিয়ে, বিয়ে থা দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। সমাজের ভালোমন্দে বিশ্বাসী, গরিব ছাত্রদের পড়তে সাহায্য করা জনদরদী মানুষ রূপ। ওর অধীনে যারা কাজ করে, ঊর্ধ্বতন হিসেবে তাদের সবাইকে মেয়ে পুরুষ নির্বিশেষে সমান সুযোগ দেয় ও। অথচ, আমাদের তথাকথিত ‘প্রেম করে বিয়ে’ হবার পর থেকেই, সে কখনো আমার মধ্যে কোনও ভালো দেখতে পেল না – যেকোনও একটা ভালো, যেটা একে অন্যের মধ্যে খুঁজে পেয়ে, আলো-ছায়া-জল দিয়ে লালন পালন করলে, বুড়ো বয়েসে সেই জোড়া গাছের নীচের ছায়ায় আরাম করা যায়। আমি  বইপত্র পড়লে রূপ উঠিয়ে দেয় চা খাওয়ার অছিলায়, আমি গান গাইলে ঘুমিয়ে পড়ে।  আমি  বাগান করলে মুখ উল্টোয়, স্পিডে গাড়ি চালালে কুমন্তব্য করে। চাকরিতে প্রোমোশন পেলে ব্যঙ্গ করে। সঙ্গমের সময়ে আমার  পাছার পুরুত্ব আর ঊরুর বাঁক নিয়ে অবরুদ্ধ গলায় আহা, আর ক্ক্বচিৎ কদাচিৎ আমার  রান্নার ছোটখাটো  প্রশংসা, এর বাইরে আমার  সমস্ত অস্তিত্ব রূপের কাছে হয় অবজ্ঞার, নয় তাচ্ছিল্যের বস্তু। কেন?

    উদোম ঝগড়ার পরের দিন কাজের মহিলা না এলে, আমি যখন রান্নাঘরে খুটখাট করি সকাল থেকে, বেলা গড়াতে গড়াতে রূপ হঠাৎ কেমন নরম হয়ে আসে। সুঘন সংসারের একটা ছবি ফুটে ওঠে যেন। এমনকি রান্না ঘরে কিছু আলগা সাহায্যও করে।আমাদের তিতলি সোনাকে  স্কুলের পড়া পড়ায়। আর একা হলেই হাত টেনে ধরে, মিলন চেয়ে। প্রথম প্রথম এই বিরল আদর আমার বেশ লাগত। কিন্তু দিনের পর দিন এমন যেতে যেতে মনে হতে লাগল, এই একতরফা মিলন, এই ভূমিকাপালন যেন একটা বিকল গাড়িতে দিয়ে যাওয়া লুব্রিকেণ্ট তেল। আমার শরীরের শেষ স্নেহপদার্থের বিন্দু নিংড়ে বের করে নিয়ে, অচল গাড়ির ক্রমাগত আর্তনাদকে কিছু প্রশমিত করে নিচ্ছি আমি; সাময়িক ভাবে। সুমি জানো, আমার মনে হল সেবা, সঙ্গম, রান্না যেন প্রতিদিনের সুখের টিকিট।

    কিন্তু রূপের মা-বাবা-ভাই-বোন-বন্ধু-কর্মচারী কাউকেই এমন পরীক্ষা দিতে হয় না! আমার ক্ষেত্রে তাহলে এমন কেন? উত্তরটা আমি নিজের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছি। এই যে মেয়েটিকে দেখছো, রমা নাম, যে আমাদের  চা দিয়ে গেলো। আমার কাছে কাজ করে সে প্রায় দশ বচ্ছর। মাঝখানে আমি তার কাছে খুব ভয়ংকরী হয়ে উঠেছিলাম। আমাদের উচ্চ মধ্যবিত্ত এপার্টমেণ্টের অনেক অন্য বাড়ির মালকিনদের দেখাদেখি আমিও ভাবতে শুরু করলাম, কেন আমার টেবিলের শেষ কোণে ধুলো, খাটের পিছনে ময়লা! আমি তাদের ঘরকন্নার প্রয়োজনকে, তাদের এই ভীষণ রকমের পরিষ্কার সাজানো ঘরের ইচ্ছাটুকুকে নিজের উপরে চাপিয়ে নিয়ে রমাকে উঠতে বসতে কথা শোনাতে লাগলাম। এই ঠকে যাবার ভয়, আর রমার কাজ ছেড়ে দেবার সম্ভাবনা থেকে একটা বিজাতীয় বিদ্বেষ - এর মধ্যে পড়ে আমার কেবলই মনে হতে লাগল, আমাদের সকাল বেলার গল্পটুকু, একসঙ্গে বাগানে নতুন ফল আসা দেখবার মজাটুকু কিছুই নয়। অথচ একা হয়ে যাওয়া সংসারে আমার মতো গপ্পবাজ মানুষের জন্য এও কি কম ছিল? এর অর্থমূল্য ছিল না কোনও? আসলে আমি রমাকে যে ভূমিকায়, যে প্রয়োজনে চেয়েছি, সেই ভূমিকাটি এত ভ্রান্ত, এত একঘেয়ে, যান্ত্রিক, অস্বাভাবিক,  যে সেই শ্রেণীবিভাজনে, যে সেখানে মনুষ্যত্ব কোনও দামই পায় না। আর তাতে আমিও ভুগি সমান ভাবে, শুধু রমা নয়।

    আমার মতে সুমি, রূপ আর আমার সম্পর্কও এইরকম স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্সের শিকার। ও ছোটবেলা থেকেই ওর আধা-গ্রাম শহরের বাকি সবার মতই ধরে নিল যে স্ত্রী দুবেলা রান্না করবে, জামা কাপড় ভাঁজ ক'রে দেবে, রাতের অন্ধকারে আগ্রাসী যৌনতা আর দিনের বেলায় আঁচল টেনে নেওয়া - এই ভঙ্গীতে ব্যলান্স রাখবে। শুধু এই প্রয়োজনগুলো সাধন করলেই স্ত্রী হিসাবে তাকে ভালোবাসা যায়। নতুবা নয়। এটাই তো স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্স! যেমন ধর, কোনও একটি মানুষের কাছে তুমি ফুলদানি। তাহলে তুমি রোজ ফ্রিতে ফুলের সুগন্ধ পাবে, মাঝে মধ্যে ফুলে লুকোনো পিঁপড়ের কামড়। ঠিক তেমনি, যদি তুমি কোনও একটা পরিস্থিতিতে নিজেকে মলত্যাগের কমোডের ভূমিকায় পাও, তাহলে তোমার উপরে ভগবান বুদ্ধ বা গান্ধী আরূঢ় হলেন, নাকি পাড়ার গুণ্ডাটি, তাতে তোমার নিজের অভিজ্ঞতার তেমন হেরফের হবে না। ঠিক সেকারণেই রূপের মতো বাকি সবকিছুতে "ভালো" মানুষ খুব খারাপ স্বামী হয়ে ওঠে। কারণ তারা তাদের স্ত্রীদের বাড়িতে অপেক্ষমান একটা ‘মানুষ-কমোড’ ভাবে, যেখানে দিনান্তের সব অভিজ্ঞতার অতিরিক্তটুকু উগরে দেয়া যায় কেবল। আর যদি কমোড নড়ে চড়ে, তাহলে কে না বিরক্ত হয়? তাই তোমাকে সব ওগড়ানো আবর্জনা নিয়েও স্পিকটি নট থাকতে হবে। মহাত্মা গান্ধীর অতি প্রয়োজনীয় এবং অতি অপ্রয়োজনীয় সত্যির এক্সপেরিমেন্টগুলিতে তাই কস্তুরবা কেবল এক অনুগত মহিলার ভূমিকাতেই থাকতে পারেন। তাঁর চারিত্রিক দার্ঢ্যটি  ততটুকুই সহ্য করা হয়, যতটুকু সেই পরীক্ষানিরীক্ষার গেমের রুলের মধ্যে থাকে। সে গেমের পাশা উল্টে দিতে পারার ক্ষমতা কখনোই কস্তুরবা-র নেই। সমস্ত সফল পুরুষের পিছনে তাদের স্ত্রীদের অবস্থানের সূত্রটিও তাই। স্ত্রী হলেন অসাধারণ একটি ভোজের আগে এবং পরে এঁটোকাঁটা মোছার দায়িত্বে থাকা সেই নীরব কর্মী, যিনি সফল স্বামীর পিছনে থেকে ‘ঘ্রাণেন অর্ধভোজনং’ পদ্ধতিতে সাফল্যের গন্ধটি শুধু নেন।  তাঁর খিদের সেইটুকুই আইনসংগত সীমা। 

    যে পুরুষ সমাজের চোখে ভালো, সে অনেক ক্ষেত্রেই সমাজের বাকি সব কাঠামোটুকু মেনে নিয়েছে তার জীবনে -- ভালো সন্তান, ভালো ভাই, ভালো কর্মী , ভালো চাকর হবার সব কটি নিয়ম। তাই, সেই সামাজিক কাঠামোর যে কাঠামোজনিত হিংসা বা স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্স মেয়েদের উপর চাপানো আছে, সেটিকেও আত্তীকরণ করেছে তারা। ভালো পুরুষ তাই খুব খারাপ স্বামী বা প্রেমিক হতে পারে -- অন্তত জৈবিক-মানবিক খিদে আছে এমন মেয়েদের কাছে। আসলে তার কাছে এই খিদেটাই তো আপত্তিজনক! আবার, যে একটু স্বার্থপর মানুষ, সে একজন সুন্দরী মেয়ে, যে তার মা বাবার জন্যে রোজ পাঁচ পদ রাঁধে না, কিন্তু একসঙ্গে চাঁদ দেখতে ছাদে উঠতে চায়, বা একটি খামখেয়ালি অগোছালো মেয়ে যে খুব ভালো আদর করতে পারে, তাকে বউ বা প্রেমিকা হিসেবে পেয়ে তোফা থাকবে। সে বাজে সন্তান, দায়িত্বজ্ঞানহীন চাকুরে, একটু চটুল নারীসঙ্গকামী পাড়ার ছেলে হবার সঙ্গে সঙ্গে দারুণ প্রেমিক হবার ক্ষমতা রাখতেই পারে -- কারণ সে নিজেই সমাজের এই কাঠামোর বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, তাই নিজের স্বার্থেই এই কাঠামোগত হিংসার নিয়ম তার জন্য খাটে না।

    আসলে আমাদের সামাজিক কাঠামোতে মায়ের, প্রেমিকার, মেয়ের এবং বউ -এর যে রূপ বা ভূমিকা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে, সেই রূপে একটা মেয়ের নিজস্ব সত্ত্বাটা প্রায় সবটাই বাদ চলে গেছে। একটা অগোছালো মেয়ে, খামখেয়ালি  মেয়ে,  কুঁড়ে মেয়ে, পড়ুয়া মেয়ে, একটু বদমেজাজি মেয়ে, একটু কাঠ কাঠ মেয়ে, একটু ছন্নছাড়া মেয়ে -- এদের প্রায় কোনও জায়গাই নেই। স্বামী আহরণ করবে, আর স্ত্রী রক্ষণাবেক্ষণ, এই পুরনো কৃষি সভ্যতার রূপটি যদিও এখন বদলে গেছে -- দুজনেই আনে, দুজনেই খায়। তবু যোগ্যতার মাপকাঠিতে সেটা ধর্তব্য নয় আজও। সিডাকশন বা সেবা – মেয়েদের ক্ষেত্রে আর কোনও যোগ্যতাই যোগ্যতা নয়।

     
     



    Tags
     



    1 Comment

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics