• মিসেস ব্যাংকের মুক্তি


    0    155

    April 6, 2018

     

    ছোটবেলার খুব দুর্দান্ত স্মৃতি হল দুপুরবেলায় ডিভিডিতে মেরী পপিন্স দেখা। কোনো কারণে আমাদের টিভি ছিল না কখনোই। তাই একই ফিল্ম বারবার দেখে মুখস্ত হয়ে যেত। এরকমই ছিল মেরী পপিন্সের মিসেস ব্যাংকের গলায় সাফ্রাজেটদের গান, “We're clearly soldiers in petticoats/ And dauntless crusaders for woman's votes/ Though we adore men individually/ We agree that as a group they're rather stupid!” যার তালে তালে নাচা এবং গলা ছেড়ে গান করা আমার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। কিছুই বুঝিনি আগাগোড়া—আমার মনে হয়েছিল মিসেস ব্যাংক কোন গুপ্ত সমিতির সদস্য, যারা পেটিকোটের নীচে লম্বা সবুজ প্যান্টালুন পরে। মোদ্দা কথাটি আমি স্পষ্ট বুঝেঝিলাম—গুপ্ত সমিতির কোন এক মিসেস প্যানখারস্ট খুব বীরত্বের নমুনা দেখিয়ে নিজেকে শেকল দিয়ে বেঁধে ফেলেছেন। আর মিসেস ব্যাংকও অমনি মিছিল মিটিং করে শেকল-টেকল বেঁধে খুব দারুণ কিছু করতে চান। বস্তুত সিনেমার শেষে মেরী পপিন্সের নির্মম চলে যাওয়া ছাড়া আর যা কখনো মানতে পারিনি তা হল শেষ মিসেস ব্যাংকের অমন রেশমি বেগুনি সাদা ফিতেগুলো ঘুড়ির ল্যাজ করে ফেলতে হল।

    বিশ শতকের প্রাক্কালে ইংল্যান্ড, আমেরিকায় মহিলারা যে সমষ্টিগত বিপ্লব গড়ে তুলেছিলেন, তার সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না। সমান ভোটাধিকার যে নাগরিকত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে, তা নিয়ে আমার কোনো বোঝাপড়া তখনো তৈরি হয়নি। শুধু একটা কথা খুব স্পষ্ট মনে পড়ে—সবার সব ইচ্ছা পূরণ করেছিল মেরী পপিন্স। কেবল মনে হয়েছিল, সব পেয়েছির দেশে মিসেস ব্যাংকের ব্যাপারেই একটা নিশ্চুপ অন্যায় থেকে গেল। সত্যি কি তার লড়াকু গুপ্ত সমিতি ছেড়ে, ফিকে বেগুনি ঝান্ডাকে ছেলেমেয়ের ঘুড়ির ল্যাজে বেঁধে দিয়েই প্রকৃত সুখ পেলেন তিনি?

    সিনেমার গল্প দিয়ে লেখা শুরু করেছি, কিন্তু যে গল্পটি নিয়ে আসলে এই লেখা, তাকে আমরা রাখতে পারি মিসেস ব্যাংকের বিপরীতে। বইয়ের নাম Sally Heathcote: Suffragette(2014)—যাকে আমরা আজ চলতি কথায় গ্রাফিক নভেল বলে থাকি, বইটি সেই দলের। কেট চার্লসওয়ার্থ ও ব্রিটিশ কমিক্স-কিংবদন্তী ব্রায়ান ট্যালবটের সাদা-কালো-খয়েরি জলরঙের সাথে মেরী ট্যালবটের লেখার যুগলবন্দী এই গুরুত্বপূর্ণ নারীবাদী পাঠটি। গল্প বোনা হয়েছে এক সাধারণ খেটে খাওয়া মেয়ে স্যালির বয়ানে। Women's Social and Political Union-এর দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেত্রী মিসেস প্যানখারস্টের বাড়ির মেড সারভেন্ট সে। এ হল ধীরে ধীরে, চুপচাপ, সদাহাস্যময়ী স্যালির সশস্ত্র বিপ্লবে জড়িয়ে পড়ার গল্প। স্যালির যুদ্ধ এই গল্পে একটি critical lens নিয়ে আসে, তৈরি করে একটি নারীবাদী সমালোচনার জায়গা।

    স্যালির গল্পে যাওয়ার আগে গ্রাফিক ন্যারেটিভের ধারা নিয়ে একটু না বললেই নয়। ১৯৫০ থেকে ’৭০ এর দশক অবধি আমেরিকায় একটি আন্দোলন চলে, যার  নাম ‘আন্ডারগ্রাউন্ড কমিক্স মুভমেন্ট’। কমিক্স, যা সাধারণত ‘শিশু ও কিশোর সাহিত্য’-এর অন্তর্গত ছিল, তা একটি বামপন্থী, যুদ্ধবিরোধী, পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলনের অংশ হয়ে উঠল। জন ম্যাকমিলিয়ানের বিখ্যাত বই স্মোকিং টাইপরাইটারসে (2011) আমরা এর বিশদ আলোচনা পাই। অনেক সমকালীন কমিক্স এবং গ্রাফিক নভেল, বা গ্রাফিক ন্যারেটিভেও এই রাজনৈতিক ইতিহাসের শেকড় আমরা বুঝতে পারি।

    মেরী ও ব্রায়ান ট্যালবটের যুগ্ম প্রয়াসে সুনিশ্চিত নারীবাদী রাজনৈতিক লেখা আমরা প্রায়ই পাই। যেমন, উনিশ শতকের ফরাসী বিপ্লবী Louise Michel-এর অসামান্য লড়াই নিয়ে তারা লিখেছেন, তেমনই তাঁদের গ্রাফিক ন্যারেটিভে উঠে এসেছে সাহিত্যিক জেমস জয়েসের মেয়ে Lucia Joyce-এর ভাস্য। ভুলিয়ে দেওয়া হয় যেসব মহিলাদের কথা, যাঁরা বিখ্যাত পুরুষদের খ্যাতিতে ম্লান হয়ে যান—অর্থাৎ, প্রথাগত একমুখী ইতিহাসে যাঁদের জায়গা পুরুষতন্ত্র দেয় না, তাঁদের খুঁজে বের করাও এক মূল্যবান নারীবাদী প্রয়াস।

    স্যালি হিথকোট কিন্তু নিপাট কাল্পনিক। ইতিহাসের পাতায় তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু পাওয়া যাবে প্রায় তাঁরই মতন আরো অনেককে। স্যালি ছাড়া গল্পের বাকি চরিত্রদেরও পাওয়া যাবে অনায়াসে। যেমন ধরুন মিসেস প্যানখারস্ট, স্যালির অনুপ্রেরণা, এই মহিলাটির বাড়ির গল্প দিয়েই শুরু করি।

    টেবিলের উপরে কাগজ কলম স্তূপীকৃত। মিসেস প্যানখারস্ট পড়ে শোনাচ্ছেন লন্ডন থেকে এমেলিন পেথিক লরেন্সের পাঠানো কাগজগুলি: “দেখেছ, কি লিখেছে কাগজে, ‘Voterettes on the Warpath!” “তা হোক,” বলে তার মেয়ে সিলভিয়া, “ডেইলি মেলের দেওয়া নামটাই আমার সবচে’ পছন্দের। ওরা নাম দিয়েছে, ‘সাফ্রাজেট’।” ১৯০৬ সালের বসন্তে সাফ্রাজেটদের “Suffragette” নামকরণ হল।

    এইরকম কিছু অন্তরঙ্গ মুহূর্তের মধ্যে লেখক শিল্পীরা ইতিহাসের ধরতাই দিয়ে যান। সঙ্গে অবশ্যই থাকে ফুটনোটের মতো স্যালির মন্তব্য, যা একটি নারীবাদী পাঠ তৈরি করে। যেমন, ১৯০৬ সালে ট্রাফালগার স্কোয়ারের জমায়েতের বক্তৃতায় অনুপ্রাণিত স্যালি এটাও মনে করিয়ে দেয়, যে ‘Warrior Maiden’-এর মত গালভরা নামের একটা অন্যদিকও আছে : ‘আমাদের এম এরকম গালভারী নাম বানাতে ওস্তাদ”। অথবা, সাফ্রাজেটদের চিহ্ন দেওয়া জামায় লাগানোর পিন কিনতে গিয়ে স্যালির চোখ আটকে যায় পোর্সেলিনের টিপট সেটে, সাদায় সবুজে এঞ্জেল গেব্রিয়েলের ছাপ তোলা। কথায় কথায় উঠে আসে সিলভিয়া প্যানখারস্টের কথা—টিসেট তো চমৎকার হয়েছে, সিলভিয়া আর নতুন কি কি বানালেন? পাঠিকার ঝপ করে মনে পড়ে, তাই তো! সিলভিয়া প্রায় একা হাতেই সাফ্রাজেট প্রোপাগান্ডার সব শিল্পকলার ভার সামলেছিলেন। আবার একই সাথে স্যালি দেখে জামায় লাগানোর এক এক পিনের এক এক দাম—খেটে খাওয়া মানুষের শখ আর সচ্ছল লণ্ডনবাসী মধ্যবিত্তের সামর্থ্য যে কখনই এক নয়!

    গল্পের গতির সাথে নানান বিভাজন বাড়তে থাকে। স্যালি কখনো জড়িয়ে পড়ে ইয়াং হট ব্লাড দলের সশস্ত্র বিপ্লবে, কখনো সরে যায় পেথিক লরেন্সদের আশ্রয়ে। বিপ্লবের সংজ্ঞা আর সশস্ত্র বিপ্লবের সংজ্ঞা নিয়ে দলের মধ্যেকার বিভাজন, নেতৃত্বের শীর্ষে থাকার ক্ষমতার লড়াই ধরা পড়ে স্যালির বয়ানে। মিসেস প্যানখারস্টের অনুগত স্যালিরও মনে পড়ে যায় হ্যানা মিচেলের কথা: স্যালির মেডসারভেন্টের এপ্রন কে তিনি ‘দাসত্বের মসলিন ব্যাজ’ বলেছিলেন। স্যালি, সাফ্রাজেট স্যালি, কি কখনো সিলভিয়ার সমান ছিল?

    এই সমস্ত ছোট ছোট উক্তির, ঘটনার অনুপুঙ্খ সূচী দেওয়া আছে বইয়ের শেষে। দেওয়া আছে সাজানো তথ্য ও তথ্যের সূত্র। প্রত্যেকটি মিটিং, মিছিল, মারপিটের দৃশ্য নেওয়া হয়েছে সমকালীন ফোটোগ্রাফ থেকে। চার বছরের দীর্ঘ আর্কাইভাল কাজ ও শিল্প-সাহিত্যের মেলবন্ধনের ফসল স্যালি হিথকোট।

    এখানেই বইটির তফাত টোনি উল্ফ ও জাও ভিয়েরার জনপ্রিয় কমিক্স সাফ্রাজিতসুর সাথে। সাফ্রাজিতসু, যা সদ্য মুক্তি পাওয়া সাফ্রাজেট ছবিটির অনুপ্রেরণা, আন্দোলনের কেন্দ্রে রাখে মিসেস প্যানখারস্টের প্রমিলা বাহিনীর গল্প—যার অধিকাংশই কাল্পনিক। তাতে কোন সমস্যা ছিল না। জু জুতসুতে তো সত্যিই ট্রেনিং নিয়েছিলেন এই লড়াকু মহিলারা। কিন্তু সাফ্রাজেট আন্দোলন শুধু শহরের গল্প নয়, শুধু ‘মিসেস প্যানখারস্টের amazon’-দের গল্প নয়—এর মধ্যে এক বিপুল নারীবাদী জেহাদের সাথে মিলেমিশে আছে শহর-গ্রামের ভেদাভেদ, আছে শ্রেণী সংগ্রামের কথা, আছে চার্চের বিরুদ্ধতা অথচ বাইবেলের এঞ্জেলের চিহ্ন বহন করার জটিল বিন্যাস। এই জটিলতার মধ্যে দিয়েই নারীবাদের এই অন্যতম যুদ্ধ—পুরুষ, পুরুষতন্ত্র ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, উঠে আসে স্যালি হিথকোটের বয়ানে।

    Joe Gordon এর সাথে ২০১৪ সালের এক সাক্ষাৎকারে মেরী বলেছিলেন, ইতিহাসের সাথে সাহিত্যকে নাও মেশাতেন পারতেন তিনি। কিন্তু একসাথে  বিরাট এক প্যানোরমাকে ধরবার চেষ্টা ছিল তার। তাই স্যালিকে গড়ে তোলেন তিনি। গল্পটি সম্পূর্ণ বলে ফেলব না, শুধু এটুকু বলতে পারি, যে এই গল্পে ঠাই পায় সেই সব পুরুষদের কথাও, যাঁরা হাতে হাতে পোস্টার বিলি করেছেন, ছেপেছেন খবরের কাগজ। অর্থাৎ, একটি সুচিন্তিত রাজনৈতিক সংগ্রাম, যার মূলে আছে সাম্যের ভাবনা, তার কথাই বলে স্যালি। বইয়ের শেষে শয্যাসায়ী বৃদ্ধা স্যালি নাতনিকে বলে, “কত বয়স হল?”

    - “আঠারোয় পা দেব।”

    - “আঠারো? মানে ভোট দিতে পারবে তুমি!”

    নাতনী ঠাম্মাকে বলে রাজনীতিতে মাথাব্যথা নেই তার। একসূত্রে বইটি গেঁথে দেয় ব্রিটেনের সমসাময়িক বহু সাফ্রাজেটের বেদনা আর হতাশা। যে ভোটাধিকারের জন্য তাদের সহযোদ্ধারা প্রাণ দিয়েছে, অনশনে বসেছে, তার কি মূল্য দেবে পরের প্রজন্ম?

    মিসেস ব্যাংকের কথা আমার ততবার মনে হয়েছে, যতবার সাফ্রাজেট ও Anti-Suffragette-দের পোস্টার, লোগো, আর ম্যাগাজিনগুলো দেখেছি। মিসেস ব্যাংকের কথাই বলতে পারত স্যালি হিতকোট। বই শেষ হয়েছে নিশ্চুপ শ্লেষ দিয়ে, কিন্তু আদতে পরের প্রজন্মের হাতে তাদের বিপ্লবের ঝান্ডা ঘুড়ির লেজ করতে দেয়নি তো স্যালি। নিজের গল্প বুনে সে তো আরেকবার তাদের লড়াইয়ের কথাই বলে গেছে, যাতে মিসেস ব্যাংকরা তাঁদের নিশ্চুপ অন্যায়ের হাত থেকে মুক্তি পান—মেরী পপিন্সের ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’-র বোঝা ফেলে যেন তারা খোলা গলায় তাদের গান গাইতে পারে।

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics