• সুন্দরবনে ফেলে আসা মেয়েবেলা


    10    866

    November 3, 2017

     

    শুধু সুন্দরবন চর্চা পত্রিকার ১৫ জানুয়ারি ২০১৭ সংখ্যার প্রচ্ছদ

    ভারি খুশি খুশি শুরু হয়েছিল সেই দিনদুটো আমাদের丨 আমার আর আমার খুড়তুতো বোন বুলির৷ কারণ পাঠশালায় যেতে হবে না আজ৷ নিরঞ্জনবাবুদের সরু সাঁকো পেরিয়ে, অতীন মণ্ডলের খাটাপায়খানার পাশ দিয়ে, আমাদের পাঠশালার পথ৷ পাঠশালায় না যাওয়াটাই তো আনন্দের, পথ-টথ যাই হোক৷ হাঁটু জলই হোক বা কোমর সমান, জামা গুটিয়ে বগলে বই আঁকড়ে, আমরা ভেসে থাকা বিষ্ঠার পাশ দিয়ে আজন্মের বর্ষা-শরৎ হেঁটেছি—ওতে আর অসুবিধা কী? ওপার বাংলা থেকে এপারে এসে আমার ঠাকুরদারা ভূমি পেয়েছিল , পথ পায়নি৷ আমরা তাই যেন আজও পথহারা৷ দেখতাম , নিরঞ্জনবাবুদের সঙ্গে ঝগড়া হলে, সাঁকো উঠে যেত। আর অতীন মোড়লের সঙ্গে ঝগড়া বাঁধলে, ওদের ব্যাড়েখানার (বাড়ির চারপাশের সংকীর্ণ পরিখা) সংলগ্ন ধানজমির ডোবা অংশ,যা আমাদের চলার রাস্তা,তাতে খেজুরকাঁটা দিয়ে দিত৷ আর ঠিক ঐ কাঁটা পচে মাটি না হওয়া অবধিই, আমাদের যা একটু আধটু অসুবিধা হতো৷ অনেকের ধানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে অথবা নৌকা করে যেতে হত, পথ পাবার আশায়৷ না হলে যথাসম্ভব জামা গুটিয়ে, কাদায় পড়তে পড়তে, ভিজতে ভিজতে হাজার জোঁকের কিলিবিলি পেরিয়ে স্কুলে যেতে আমাদের কোন অসুবিধাই হত না৷ একটা বিষয়ে শুধু, গোপন ঈর্ষা হয়তো আটকে যেত আমাদের সবার মনেই৷ ভেসে থাকা বর্জ্যে চোখ পড়লেই বোঝা যেত ঐ খড়ের মধ্যে সমান্তরাল কাঠ ফেলা শৌচালয়ের মানুষগুলো ভাতই খায়৷ প্রতিদিন ভাত! প্রতিদিন? অবশ্য স্বাভাবিক , ওরা বড়লোক l কিন্তু সে কি প্রতিদিন পূর্ণিমার মত বিম্ময়কর নয় ?

    আমাদের পাঠশালার মাস্টারমশাই সুভাষদা৷ অতীন মণ্ডলের দলচি ঘরে আমাদের পাঠশালা৷ দলচি ঘর মানে দক্ষিণঘর৷ বত্রিশ-ছত্রিশ জনের সংসারে একটা সাধারণ ঘর , দু-তিনদিক খোলা, স্টেজের মতো৷ যেখানে বাড়ির পুরুষেরা হুঁকো খেতে খেতে আড্ডা দেবে৷ অবিবাহিত যুবকেরা, বহিরাগত পুরুষেরা ও  মুনিশরা রাত কাটাবে আর পাটের দড়ি বানাতে বানাতে সমাজের নানান সমস্যার উচ্চকিত সমাধান করবে  ৷
     
    অমন সুন্দর দলচি ঘর থেকে আমাদের পাঠশালাটি , ওদের গোয়ালঘরে জায়গা পেল৷ গোবর-গোচোনাকে তো আমরা প্রকৃত অর্থেই পবিত্র জেনেছি চিরকাল৷ গোয়ালঘরটাও ওদের মাইনে করা লোকই পরিষ্কার করে দিত৷ কিন্তু বর্ষার সময় তো আর গরুকে বাইরে বের করা যায় না৷ তাই সহাবস্থানে চলত আমাদের ডাকপড়া আর অধ্যয়ন ৷ তাতে পড়াশুনায় কোন ত্রুটি হত বলে মনে হয় না তো, আজও ৷
     
    মা ছাড়া এই সুভাষদাই আমাদের প্রথম শিক্ষক ৷ প্রথম আদর্শ ৷ গোয়ালঘরে পড়তাম আমরা আশি নব্বই জন ছাত্রছাত্রী, গোচোনা জমার চড়াই- উৎরাই, কাদা হয়ে থাকা মেঝেতে চ্যাটাই পেতে৷ গোয়াল মানেই তীব্র হুলধারী বড় বড় ডাঁস পোকা, মাছি আর মশা l কিন্তু কী মজারই না বিষয় ছিল তারা আমাদেরl একটা খুঁটির কাছে থাকত সুভাষদার বসার জলচৌকি৷ সেখানেই এখন নত হয়ে আসছে মন ,সে স্মৃৃতিচারণে l
     
     আমাদের সবার হাতের লেখা ছিল ঝকঝকে সুন্দর৷ আমাদের অধিকাংশই খাতায় লিখতো প্রথমে পেনসিল দিয়ে l পুরো খাতা শেষ হলে ইরেজার দিয়ে ঘসে তুলে, আবার পেনসিলে l লেখা শেষ হলে ইরেজ না করে তার উপরেই শেষবার লিখতো কালি দিয়ে৷ সবার জামা ছিল একটাই—স্কুলে যাওয়ার জন্য ৷ বড় স্কুলে ওঠার পরও ঐ ইউনিফর্মটাই একমাত্র ড্রেস, শীতে গায়ে গামছা জড়ানো৷ গরীব বড়লোকে এক্ষেত্রে তেমন  তফাৎ ছিল না কিছু l
     
    প্রাইমারী স্কুলে পরীক্ষা দিতে যেতাম আমরা৷ পাঠশালার সবাই প্রথম দিকের রোলগুলো দখল করত৷ সরকার থেকে আসা বই আমরা কালে-ভদ্রে পেতাম৷ একটা বই পাওয়া আমাদের শৃঙ্গ জয়ের অভিজ্ঞতা৷ একটা বই পেলেই আগে বাঁধাইটা খুলে, যতগুলো সম্ভব ভাগ করে নিয়ে, সেলাই করে মলাট দিতাম৷ তারপর এক-একটা ভাগ তিন চার জন মিলে তারস্বরে চীৎকার করে পড়তাম৷ প্রত্যেক পাতাতেই দ্রুত পড়ার কম্পিটিশন উঠতো জমে l কে,-কে আগে পাতা ওলটানোর জন্য হাত বাড়াতে পারে l যে কোনো বইয়ের এমাথা ওমাথা আমাদের মুখস্থ থাকত তাই l ফাঁকির সুযোগের ফাঁক থাকতই না ৷ দারিদ্রের এই মাহাত্মটুকু যদি দেওয়া যেত সন্তানকে..বেশ হত l
     
    প্রাইমারী স্কুলের মতো, আমাদের পাঠশালায়, কামাই এবং মুখ খারাপ চলত না৷ রেজাল্টেও আমরাই এগিয়ে, তাই কোলকাতায় ডন বস্কোর ছাত্রদের মত আমাদেরও চাপা অহংকার ছিল পাঠশালায় পড়ার৷ আমরা তিন ভাইবোন অবশ্য বাড়িতেও মুখ খারাপ করতে পারতাম না৷ মায়ের এই বাড়াবাড়ি রকমের অন্যায় শাসনে ,আমাদের বিপদ ও অসহায়তার সীমা থাকত না—সবাই বলছে, সবাই, সবাই, সব্বাই—এমনকি মা-ও কখনো-সখনো, অথচ আমাদের সাধ্য কী পিটুনির ভয়ে, সেসব মুখ থেকে পিছলোয়৷
     
    একবার পুতুলদি আমার ছিপ নিয়ে মাছ ধরল, চাইতে গেলেই মুখের ভাষায় ছিপটার কী না কী অশ্লীল ব্যবহার করল৷ ভয় দেখালাম ‘সুভাষদাকে বলে দেব’৷ তীব্র উপেক্ষায় বলল ‘বল গে যা’৷ 'আমাকে যা বলবি বল, সুভাষদাকেও' ! এত্ত সাহস ! নালিশ করলে, ওর ঔদ্ধত্যের কিছুটা শাস্তি হবে, ভাবলাম মনে মনে৷ পাঠশালায় গিয়ে এক সুযোগে থাকতে না পেরে কথাটা পাড়লাম৷ অত ছাত্রছাত্রী সামলাতে সামলাতে সুভাষদা বোধকরি বে-খেয়ালেই বলে বসল ‘কি মুখ খারাপ করেছে রে ? কী বলেছে ও, আমার নামে, বল’৷ এমন সুযোগ কে ছাড়ে—চ্যাটাইতে বসে, উত্থিত দু’ হাঁটুতে শ্লেট আঁকড়ে, তারই এককোনা কামড়াতে, হঠাৎ আসা আদুরে গলায়, বলতে শুরু করে দিলাম, কী কী বলেছিল পুতুলদি৷ ব্যাস্.. হাসিতে ফেটে পড়ল সারা ঘর৷ সুভাষদাও প্রচণ্ড হাসতে হাসতে বলল, ‘এই ধরে আনতো ওটাকে, পেটাই’৷ পিটুনি পড়েনি আর, কিন্তু সত্য মাত্রেই যে সুন্দর নয়—বুঝেছিলাম সেদিন৷
    ছবি - শুধু সুন্দরবন চর্চা
     
    সত্য ভাষণ৷ এই এক বোধ, চেতনাতে ঢুকিয়ে দিয়েছিল মা৷ সততার বড্ড নিখাদ গভীর বীজ পুঁতেছিল মনে৷ অশিক্ষায় ডুবে থাকা গ্রামে যেন একমাত্র শিক্ষিত, আধুনিক, স্বপ্নপসারী আমাদের মা , আমাদের একমাত্র দেবতা হয়ে উঠেছিল তাই৷ আমরা বুঝতে পারতাম আমরা আলাদা, আমরা সবার থেকে আলাদা—অনাহার আমাদের ছুঁতে পারবে না, অজ্ঞানতা আমাদের ধরে রাখতে পারবে না৷ একটা নতুন আলো অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে l আর সেই এক বোধে আমরা ধনী ছিলাম, প্রতিদিন ভাত খাওয়া মানুষগুলোর থেকেও—এখনও দেখি ওই আশ্চর্য মন্ত্রে ,ধনী আমরা পৃথিবীর সেরা ধনীর মতোই৷
     
    বিয়ের পরে মায়ের কামনা ছিল, যেন সন্তান না আসে ঐ অভাবের দিনে l অথচ স্বপ্নে ছিল একটি মেয়ে, সেই পুত্র কামনার সর্বজনীনতার দিনে l আর ভেবেছিল তার মেয়ে হবে এমন একজন, দশজন যাকে এক ডাকে চিনবে৷ তিনটি সন্তানের পর সে মানুষটি ঠাকুরঘরে প্রবেশ নিষিদ্ধ হবে জেনেও সেই প্রথমবার শ্বশুরবাড়ির নিষেধ অগ্রাহ্য করেছিল, লাইগেশনে, গ্রামের হাতেখড়ি দিয়ে l সে যে কী বিপ্লব, কী দুস্তর পারাবার, কী অসম্ভব 'জার্নি, আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে বোঝবার ক্ষমতা সম্ভবত কারও নেই৷
     
    না, কথা হচ্ছিল বুলিকে নিয়ে৷ আমার চেয়ে এক বছর দশ মাসের ছোটো—আমার সঙ্গী৷ শৈশবের দিকে তাকালে দেখি আমরা দুজন বীজতলায়, গামছায় রোদ আড়াল করে বসে ,বাবুই পাখি তাড়াই, ভাঙা শামুকের গুচ্ছের খঞ্জনি বাজিয়ে৷ সমবয়সী ভাইরা, ফুটবল বানিয়ে নিয়েে খেলতে যায়, আমরা ফুলেট খেলি৷ পিসিমার সঙ্গে ম্যাখানি মারি, মশারিকে জালের মতো টেনে নিয়ে নিয়ে৷ আদুড় গায়ে কবে আসে কিশোরী বেলার ডাক—সে আলোচনা হয়ে যায় দুজনের৷ বুলির মধ্যে ছিল আশ্চর্য এক তেজ৷ আমার মাকে মা পেলে বুলি এখনও থাকতো দুর্মর, উচ্ছ্বাসে উদ্যমে ভরা, উত্তর চল্লিশের আশ্চর্য তরুণী l না—বুলির বিয়ে হল ১৪-তে৷ ভারি ভালো ছেলেটি, খুব স্নেহ করি তাকে৷ ২০ বিঘে জমির মালিক হবে জেনে, বছর পনেরোর বড়ো, নিতান্ত অল্পবুদ্ধি মানুষটির সঙ্গে বুলির বিয়ে হয়ে গেল৷ বুলিও তাকে স্নেহ করে খুব ৷ পাট্টা, খাস কী-সব শব্দে জমিগুলো আজ উধাও l আর , হায় দাম্পত্য ! না, থাক সে সব কথা, কিন্তু বুলির সেই ছোট্ট মেয়েটি? তারও মেয়েটি? আহা,ভালো থাকে যেন সে৷ আমার বোন বুলি চল্লিশ পেরোনোর আগেই বিধ্বস্ত দিদা, থাক সে কথা—
     
    মেজোবৌদির আজ ছেলে হল , রাতে ৷ দাইমা ডাকতে যেতে হবে৷ আমরা দুজন নির্বাচিত৷ কি আনন্দ৷ দাইমার বাড়ি দেখা যায় বাড়ি থেকে৷ কিলোমিটার দেড়েক air distance-এ l আমরা যাব মাঠ পেরিয়ে, তাই ওই air distance- এই যাবো l সদ্য আষাঢ়, জলে ভরা অবারিত মাঠ, কোথাও লাঙল টেনে চষা মাটির বুক উথাল পাথাল, ওই মাঠে আমরা গামছা নিয়ে ট্যাংরা, পুঁটি, জাবালি (ছোটো পোনা) ধরি, শালুক ফুল দেখে দৌড়ে তুলে আনি, আধা জল হয়ে যাওয়া গোবরও আমরা তুলে নিই ঝুড়িতে, কাঁখে করে নিতে কষ্ট হলে মাথায় তুলি৷ ভিজে যাওয়া সর্ব শরীর, আবার ভরা বর্ষার জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ধুয়ে নিই৷ বুলি ও আমি যেন হাওয়ায় ভর করে যাই আনন্দে l জোঁকের হাত থেকে বাঁচতে বাঁচতে আর স্ফূর্তিতে লাফাতে লাফাতে চলি l হঠাৎ বাঁ পায়ে পাঁচড়ার গভীরে ছোট্ট সবুজাভ কালো জিনিস আবিষ্কার করি চিনচিনে জ্বালা থেকে l জোঁক, চিনে জোঁক, খুব ছোট্ট l সবাই আমাকে সাহসী বলে জানে অথচ জোঁকে আমার ভয়ঙ্কর ভয়৷ বুলি যত ছাড়াতে যায়—আমি তত চিৎকার করি, তত লাফাই৷ ছুটতে থাকি এলোমেলো৷ অবশেষে আশেপাশে চাষ করছিল যারা তারা চেপে ধরে ছাড়িয়ে দিয়ে যায় আর আমরাও দাইমার বাড়ি পৌঁছে যাই ঠিক ৷ বুড়ি দাইমা ছাগল বেঁধে, হাঁস মুরগিকে গুঁড়ো খেতে দিয়ে আরো ঘন্টাখানেক পরে বেরোয় l চষা মাঠে চলতে পারবে না খোঁড়া বুড়িমা l তাই ঘুরপথে ফেরা l
     সে পথ কি যে-সে পথ ! ওখানে কেউ ধান রোঁবে না—সরকারি জায়গা—, ওটাই পথ আমাদের৷ কাদায়  ঘণ্টা দেঁড়েক লাগে দাইমার l একলা জীবনে তার, পূর্ণ একবাটি চাল, একটা টাকা আর এই  সম্মান.. এত্তসবও তো কম পাওয়া হবে না l হাতে লাঠি, অন্য হাতে আমাদের একজনের হাত, এভাবেই শেষে এসে পৌঁছায় ৷ বদনায় জল রাখা দুয়ারে৷ ওই জলেই হাত পা ধুয়ে সাঁজালে (প্রসূতির ঘরের সামনে থাকা মালসায় তুষের আগুন) হাত সেঁকে ঘরে আসেন দাইমা৷ হাত ধরে পৌঁছে দিই৷ বস্তার ওপরে বসে আছে মেজোবৌদি৷ এখনও সদ্যপ্রসূতিকে হোম ডেলিভারির ক্ষেত্রে বস্তাতেই বসানো হয়৷ প্রচুর রক্তক্ষরণ হবে যে l এক পা মুড়তে না পারা দাইমা অতিকষ্টে বসে, নলগাছ আনতে বলে l তাই কেটে তারই ধার দিয়ে কাটা হল সদ্যোজাতের নাড়ি (কর্ড), আমরা ততক্ষণে বাইরে৷
     আশ্চর্য হয়ে দেখলাম কাঁসার থালায় পান্তাভাত বেড়েছে বড়োবৌদি, সকালে খেয়ে যাইনি আমরা, না খাওয়া সে তো আমাদের প্রতিদিনের৷ বৈশাখের পর ভাত থাকে না কোনদিনই৷ আমাদের নিজস্ব নিরীক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করে বুঝি বটে—বড়বৌরা মাঝে মাঝে ভাত খায়—কিন্তু আমাদের? এখন? ভাত ? কি জানি, বুলি আর আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই৷ বড়োবৌদি যত খেতে বলে, আমাদের কান্না পায়৷ আমার ভাই দুটো কতদিন ভাত খায়নি৷ আটাঘোটাই একমাত্র ভরসা কতদিন ধরে৷ তাও কখন আসবে আটা , কেউ জানে না৷ হাঁড়িতে জল ফোটে৷ কোনও কাকা জেঠা হয়তো কখনও কেজি খানেক কোনওদিন একটু বেশি আটা আনে৷ মায়েরা গুলে ঢেলে দেয় সেই জলে—ওপরে ভেসে ওঠে মরা পোকার সারি—আমরা আনন্দে খেতে বসি৷ আমরা জানি ভাত খাবো ধান উঠলে রোদে পিঠ দিয়ে বসে, লাল শাকের ঝোল দিয়ে লাল করে মেখে৷ আর এখন এই অসময়ে...
     
    পুতুলদি দুলালদা কখনও ভাত চাইত না ছোটোবেলায়—ওদের চান করালেই বলত, 'পাথরায় দেও, আটাঘোটা দেও' l পাথরের থালায় আটাঘোটা l তাই নাকি চান করানো হত না ওদের, অনেক অনেক দিন৷
     
    যেদিন চাল জুটতো মিশিয়ে দেওয়া হত ওই আটাঘোটার মিশ্রণে৷ বত্রিশ জনের সংসার, কাকা জেঠারা নাকি ভাবত কাজ করে যা পাওয়া যাবে এতজনের মুখে হবে তা ? শুয়েই থাকত তাই—যে কারণে নাকি গরীব মাতালরা মদ খায় ৷ আর মায়েরা ? কী পরিশ্রম করত৷ জোঁক-সাপ উপেক্ষা করে ধানের শিস ধরে, পাকা ধানটি বেছে বেছে এনে ভেজে চাল করে বত্রিশ জনের সংসারে প্রথম নবান্নের ভাতের স্বাদ এনে দিত৷
     
    আজ এ সময়ে অতটা ভাত! এমন হঠাৎ৷ একলা একলা খাব আমরা, ওদের না দিয়ে ? খাব ?
     
    আমি তিনবার না খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছি৷ বড়লোক নিরঞ্জনবাবু আমার মেসো—কতবার আমার জেঠিমা, মাকে বলেছে, "বোনের বাড়িতে নিয়ে গেলে তো দুটো খেতে দেয়"৷
     আমার জেঠিমাও আমার মা—মা বলেই ডাকি, মা বলেই চিনি l ছোটবেলায় যখন আমার নাক মুখ দিয়ে একহাত সমান লম্বা লম্বা গোলকৃমি বেরোত, আমার এই মা-ই তো একমাত্র ভরসা তখন৷ আমার মায়ের দ্বিতীয় সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে যখন সাত মাস শয্যাগত—কেবল জ্বর, কেবল বার্লি ভরসার জীবন মা ও শিশুর—তখন থেকে আমি তার দুগ্ধপোষ্য মেয়ে৷
     
    জেঠিমার কথার উত্তরে মা বলেছে, "কোলে মরুক মেজদি, আমি কারও কাছে চাইতে যেতে পারব না"৷ তবে, আমি কি ভাইদের জন্য চেয়ে নিয়ে যেতে পারি? কি জানি—কি পারি আর কি পারি না, আজও তো বুঝি না, হয়তো পারি না কিছুই৷ হয়তো ভাগ্য আর সময় নিয়ন্ত্রণ করে সব৷ শুধু এইটুকু জানি বুলি আর আমি তাকাতে পারিনি দুজনের দিকে—নরম, মজা ভাতের মধুর স্পর্শ, মধুর ঘ্রাণ, আমাদের ছাপিয়ে আসা চোখের জলের সঙ্গে কিভাবে মিশেছিল ঠিক ধারণা করতে পারি না—কেবল সেই কাঁসার থালা, সেই ছোট্ট টিলার মতো সাদা ভাত—মায়ের মতো বড়বৌদি—স্মৃতিটা ফিরে ফিরে আসে৷
     
    এমন একটা ছুটির দিন আমাদের আবার এল৷ না এলেই ভালো হতো৷ অন্য ঠাকুরদার বাড়িতে আর এক বৌদির বাচ্চা হল৷ সংসার কর্ত্রী সেখানে জ্যাঠাইমা৷ আবার সেই পথ—পথ শেষে দাইমা নিয়ে ফেরা৷ আনন্দ আনন্দ আর আনন্দ৷ কিন্তু তা বলে আবার পান্তার থালা? আরও সাদা? বাসি চিংড়ি মাছ সঙ্গে ! আমরা আবারও কথা বলতে পারি না—কারও দিকে তাকাতে পারলাম না এবারও৷ অবাক হব? অবাক কতবার হয়? অস্বীকার করব? করতে তো পারিনি আগেরবার, কি জানি কেন—আমরা যেন পেশাদার হয়ে গেলাম৷ ওইটুকু পথ হাঁটা আসলে ভাত পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা—জেনে গেলাম৷ আবার যদি সেই সুযোগ আসত—আমরা কি ভাইদের ফেলে নিজেকে যোগ্য প্রমাণের চেষ্টা করতাম! কি জানি! নিজেদের মধ্যে কেমন যেন একটা কালি৷ আনন্দগুলো কেন যে এমন কালি মেখে ফেলে৷ না না ওসব মনে রাখতে নেই, ভুলে যাই তাই…
     
    চোখে ভাসে এক প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকার৷ সদ্য জ্বলা খড়ের আগুনের আঁচে মুখ দেখা যায় না বালক বালিকাদের৷ হিহি করে কেবল হাসি৷ ঠকঠক করে কাঁপুনি৷ উত্তরে হাওয়ায় সামনে লোম ছাড়ানো আধপোড়া মুণ্ডহীন গোটা একটা হাঁস কুটবার অপেক্ষায়৷ আজ মাংস হবে, বাড়িতে অতিথি এসেছে, বুলির বোন দুলি হিহি করে হেসে, গড়িয়ে পড়ে বলছে, "স্বপনদাটাকে দেখিস খাইয়ে উঠতি পারবে না, আবার হাত ধুরে তুলতে হবে"৷ হিসেব করে লাভ নেই বত্রিশ জনের সংসারে কত গ্রাম মাংস পাবে এক একজন—হিসেবেই কি আনন্দ থাকে ? হঠাৎ ছোটো কাকার হুংকার 'আক্কেল দেখো, বাঘে নে যায় যদি, ছেলেপিলেগুলোর'—সত্যি কথা। ধানভরা মাঠে বড্ড বাঘের ভয়, কিন্তু বাঘে নেয়নি, সাপেও কাটেনি, বেঁচে আছি আমরা l বেঁচে আছি, বেঁচে থাকাটাই তো আনন্দ৷ স্মৃতির আবেশ টাইম মেশিনে নিয়ে ফেলেছে ওই অন্ধকার আবছায়ার হু হু শীতে৷ হাত সেঁকতে সেঁকতে ঢোঁক গিলতে গিলতে, মাংসটা একটু টিপে দিয়ে বলি, 'ভাগ্যিস আজ আমার মামা আইয়েছে', আগুনের তাপে সিক্ত রসনায় আনন্দ ধারা বয়ে যায়৷

    [শুধু সুন্দরবন চর্চা, ১৫ জানুয়ারি ২০১৭ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত। বানান ও ভাষা অপরিবর্তিত রেখে পত্রিকার সম্পাদকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত।]

     
     



    Tags
     



    Comments (10)
    • একেই বলে সাহিত্য। মন্তব্য করতে বসে ভাবছি, কোনো বিশেষণ ই কি যথেষ্ট ভালোলাগা কে প্রকাশ করবে?এটুকু বলতে পারি মনের মধ্যে ভাষাহারা একটা ভালোলাগার​ রেশ রয়েই গেল।

    • একেই বলে সাহিত্য। মন্তব্য করতে গিয়ে ভাবছি,এই অসাধারণ লেখার জন্য কোন বিশেষণ যথেষ্ট হবে? শুধু বলতে পারি ভাষা হারা এক অনুভূতির রেশ রয়েই গেল।

    • অসাধারণ । লেখাটা পড়ে বিভূতি ভূষণ এর পথের পাঁচালীর স্বাদ পেলাম যেন , লেখক এর আরও লেখা পড়তে চাই।

    • Anek din por jharjhare ato sundor Goddya porlam . Bolar apekkha rakhe na anek kichhu janlam . Suvechha roilo aki sangge apekkhao porer lekhar jonno

    • …..ধান উঠলে রোদে পিঠ দিয়ে সেই নতুন ধানের ভাত লাল শাকের ঝোল দিয়ে লাল করে মেখে……শঙ্করী,তোমাদের বাড়িঘর-দোরে রোজ এক কড়াই আনন্দ রান্না হয়,নাগো?সবাই তাই দিয়ে ভাত মেখে খাও…..সে কথাটা যে বললে না!

      বাঘে না নিক,সাপে না কাটুক,এমন জীবন-যোদ্ধাদের,চ্যাম্পিয়ানদের!
      লেখাটি পড়ার সুযোগ করে দেবার জন্য এবং আলাপ এর কাজে কৃতজ্ঞ।

    • অসাধারন। লেখাটির মধ্যে আছে তথ্য আর আছে সুন্দর একটি গল্প। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় এ গল্প এক্কেবারে সত্য ঘটনা। মুগ্ধ হলাম লেখকের সাহিত্য প্রতিভায়। প্রণাম জানাই সুন্দরবনের ঐ মাকে ।কি অসীম আত্মসন্মান বোধ ও চারিত্রীক দৃঢতা।

    • খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে… উনি এখন কি করেন, কোথায় থাকেন….

    • কি অসাধারণ লেখা! কি কলমের জোর।পড়তে পড়তে কাঁদি, গায়ে কাঁটা দেয়… আরও লিখুন, শংকরী। পরের লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।

    • জীবন ছেঁকে নেওয়া নির্যাস। কি সামান্য জানি আমরা । লেখককে শুভেচ্ছা ।

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics