• রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রাতের বাসে


    9    1171

    June 6, 2017

     

    কুমোরের দোকান থেকে উল্টোদিকে গুহা শহর কাপাদখিয়া। ছবি - লেখক

    আমার পড়ন্ত যৌবন আর ভরন্ত শরীর সহায় করে বীরদর্পে যদিও যেকোনোখানেই চলে যাই, তবু তুরস্ক দেশ যাবার আগে একটু আধটু দুর্ভাবনা হচ্ছিলো—আমার চেনা কেউই একা একা যাননি এবং সন্ধেবেলা একটা ইয়ুথ হস্টেলে এসে ওঠেন নি। কিন্তু যতই হোক আমাদের কামাল পাশার দেশ। পরনে আমার ভারী শরিয়তপন্থী জামাকাপড়—সদাসর্বদার কালো টি-শার্ট আর ঘন নীল জিন্স, পা ঢাকা জুতো আর বেশিরভাগ সময়ে গলাব্যথা কানব্যথা ইনফেকশন হতে থাকে বলে কান গলা জড়ানো থাকে। সাধারনতঃ কোনো দিক থেকেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করি না। প্রদর্শনীয় তেমন কোন বৈভব থাকে না কোনও অর্থেই—পাসপোর্ট, ফোন আর সামান্য কিছু বৈদেশিক মুদ্রা ছাড়া।

    এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে মনে হলো ইস্তানবুলকে ইওরোপের কোনও একটা শহরের মত দেখতে, শহরটার চালচলনও ইওরোপ ঘেঁষা—তাহলে আর লাভ কী হলো কন্সট্যান্টিনোপলে এসে? কিন্তু সন্ধের দিকে যখন সুলতানামেত পার্কের কাছে নামলাম স্থানীয় রেলগাড়ি চড়ে তখন মনের সব কালিমা, দুর্ভাবনা দূর হয়ে গেলো পবিত্র কাবাবের গন্ধে—হাগিয়া সোফিয়া আর তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা ব্লু মস্কের দিকে তাকিয়ে—সঙ্গে সঙ্গে এক দৈবযোগের মতো যেন পুরো চত্বরটা মথিত হয়ে বেজে উঠলো আজানের ধ্বনি—মাগ্রীব হবে। আমি নিশ্চিত হলাম—নাহ, দেশ থেকে দূরে, ইওরোপও না—অন্য একটা নতুন দেশে এসে পৌঁছতে পেরেছি!

    ৯-১০ দিনে বেড়ানোর তালিকাটি নেহাত ছোটো ছিলো না। ইস্তানবুল থেকে বেরিয়ে পরের দিন এরোপ্লেনে চড়ে জালালুদ্দিন রুমির শহর কণ্যা বা কনিয়ায় যাওয়া তাঁর সমাধিক্ষেত্র দেখতে, তারপর গুহাশহর কাপাদখিয়া এবং ট্রয়নগরী ও আসোস-এর টিলার উপর আথেনার মন্দির, সেখান থেকে গ্রীস দেখা যায় অন্যপারে—গ্রীসের লেসবস দ্বীপ।

    একটা ধন্দ হতে থাকলো—দেশের সর্বত্রই কামাল পাশার ছবি রয়েছে! কিন্তু যখনই এর তার কাছে তাঁর নাম করে, ছোটবেলা ইশকুলে তাঁর নামে কবিতা পড়েছি বলে সুবিশেষ পাত্তা পাওয়ার চেষ্টা করছি খুব একটা সুবিধে হচ্ছে না। দোকানী বলছেন, ‘ওঁর স্যুভেনির ম্যাগনেট চাও? নাও না।’ কেউ বলছে- ‘হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিকই বলেছো, তা তো বটেই—উনি হলেন কিনা আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব—চিনবেই তো! উনি দেশের চেয়ে বেশি পরিচিত।’ বুদ্ধি করে একটা কিছু গোলমাল টের পেয়ে আর বেশি নাম করছি না। ধন্দের অবসান ঘটালেন ট্রয় অঞ্চলের থেকে বাসে করে ফেরার সময় এক বয়স্ক অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্কার মেহমেত এমির, যিনি বর্তমানে একজন কৃষক। পোষাক আশাকে খাস ইওরোপীয়, চমৎকার ইংরেজি বলেন, তিন মেয়ের বাবা, ছোটটি আমার বয়েসী। তিনি বললেন, ‘কামাল পাশা দুটো বিপ্লব চমৎকার করেছিলেন—একটা অ্যালফাবেট আর একটা কস্টিউম! ভাষাটার আত্মা তো অ্যালফাবেটে—উনি সবটা রোমান করে দিলেন—তোমাদের সুবিধে হলো—জায়গার নাম পড়তে পারছো—কিন্তু দেশটা তো শুধু পর্যটকদের না—আমাদেরও—আমার ভাষার অক্ষরগুলোর অস্তিত্বই রইলো না! আর দেখো এখন মেয়েরা সবাই মদ সিগারেট খাচ্ছে, কিন্ত তারা বোরখা পরছে—তারা পরতে চায় বলে পরছে। বাইরেটা আমাদের পশ্চিমের কিন্তু আত্মা তো প্রাচ্যের!’ আমার আগে ওঁর বাসের স্টপেজ এসে গেছে—নামবার আগে দরজা থেকে ঘুরে আমাকে বলে গেলেন, ‘কামাল পাশাও খুব ফান্ডামেন্টাল কিন্তু—ওঁর কবরে কোনো মেয়ে বোরখা পরে যেতে পারবে না, খুলে যেতে হবে—সত্যিকারের মুক্তমন হলে কারও উপর এটাও চাপিয়ে দিতেন কি?’ আমার মাথার মধ্যে প্রশ্নগুলো জট পাকিয়ে রইল।

    মৌলানা রুমির সমাধিস্থল। কণ্যা, তুরস্ক। ছবি - লেখক

    কণ্যা থেকে ফিরে সেদিন রাতেই আমার চ্যানাকেল যাওয়ার রাত্রিভোরের বাস। ছাড়বে রাত ১.২০ তে। আমার হোস্টেলের ম্যানেজারকে বললাম, ‘আমি কি ১০টার মধ্যে চলে যাবো?’ সিনান তো অবাক, ‘একি প্লেন নাকি? বাস তো, তুমি একটায় পৌঁছলেই হবে, আর এখান থেকে যেতে বড়জোর ২০ মিনিট। ১২.৩০ টার আগে বেরোবে কেন?’ আমার চক্ষু কপালে—চারিদিক তো শুনশান হয়ে যায় এগারোটার মধ্যে—তারপর আমি এখান থেকে হেঁটে হেঁটে যাবো—প্রায় ৭-১০ মিনিটের পথ তো ট্রেন স্টেশন। আমি ভারতবর্ষ থেকে এসেছি—রাত্রিবেলা হেঁটে আমাদের স্টেশনে যাওয়া মানা আবাল-বৃদ্ধা-বণিতা সকলের, সে কথা মুখ ফুটে ওকে বলি কী করে? কোনোমতে বললাম একটা ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না? সে জানিয়ে দিল ট্যাক্সি হবে না তখন। আমি অগত্যা ওকে লুকিয়ে এগারোটার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম।

    রাস্তা সত্যিই শুনসান। একটা হাত যেন ঠান্ডা লাগছে এমন ভাব করে ব্যাগের মধ্যে পুরে পাসপোর্টটা ধরে আছি! মেট্রো স্টেশনে পৌঁছলাম। টিকিট কাটার সময় বুঝলাম, অন্য একটা স্টেশনে নেমে ট্রেন চেঞ্জ করে যেতে হবে। পরবর্তী টিকিট পরের স্টেশন থেকেই কিনতে হবে।

    স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এসে দেখি আমি একা—একদম অন্য প্রান্ত থেকে একজন স্থানীয় ব্যক্তি আসছেন। মাত্র দুটি প্রাণী স্টেশনে—আর তাঁর চোখে তীব্র দৃষ্টি আমারই দিকে নিক্ষিপ্ত। আমার মনের অবস্থা যাই হোক না কেন মুখের অবস্থা নিশ্চিত লালমোহনবাবুর মত—আকর্ণ হাসি হেসে বললাম, ‘হেলো ব্রাদার, তুমি কি ইংরেজী বলো? তবে কি বলতে পারো অমুক স্টেশনের ট্রেন কি এইদিকে আসবে?’ সে তৎপরতার সঙ্গে জানালো, আলবাত আসবে কিন্তু একটু এগিয়ে দাঁড়ালে একেবারে সিঁড়ির সামনে নামা যাবে এবং পরবর্তী মেট্রো ধরতে সুবিধে হবে। আমি একটু মনে বল পেলাম জনমনিষ্যির সন্ধান পেয়ে। তিনি জানালেন তিনিও একই দিকে যাবেন এবং আমার বাস স্টেশনের দুট স্টপ পেরিয়ে তাঁর স্টেশন আসবে। অতএব তাঁর সঙ্গে আমি জুটে গেলাম। এবার তিনি আমার সঙ্গে অতিরিক্ত বাক্যালাপে উৎসাহী হয়ে পড়লেন—এমনকি বয়েস মাইনে সব কিছু। বয়েসটা যত বেশি তার চেয়েও বছর পাঁচেক বাড়িয়ে বললাম। মাঝে মাঝেই ওঁর তীব্র দৃষ্টিপাতে আমি নারীসুলভ অস্বস্তিতে পড়ছি। এই মূহুর্তে পাসপোর্ট বা সতীত্ব দুটোই সমানভাবে বিপন্ন বলে মনে হতে থাকলো। ট্রেন এলো—দুজনেই উঠলাম—কামরা ফাঁকার দিকে। আমি ছাড়া কোন নারীর চিহ্ন নেই। আর দুয়েকজন যাঁরা ছিলেন তাঁদেরকে আমার সহযাত্রীটি চেনেন। উনি কী একটা বললেন, সবাই আমার দিকে তাকাল, হাসির ধরন আমার তখন ভালো লাগলো না। এর পরের স্টেশন আসতে আমি কাকুতিমিনতি করলাম, ‘এখন সবটা বুঝে গেছি, তুমি যাও, আমি ঠিক পারবো!’ তিনি আমল দিলেন না, ‘এসো, আমরা তো একটাই ট্রেন নেব।’ আমি দৌড়লাম টিকিট কাউন্টারের দিকে। তিনি হাঁক পাড়লেন, ‘তুমি তো অতিথি, আমার মান্থলি কাটা আছে—তোমার জন্য আমি সোয়াইপ করে দিয়েছি, এস।’ তখুনি প্রতিবাদ করলে যদি আরও রেগে যায় তাই অনুসরণ করলাম।

    পরবর্তী ট্রেনে দুজনে মুখোমুখি বসেছি, হঠাৎ ওঁর ফোনের স্ক্রীনে দেখি একটা ছোট্ট মিষ্টি বাচ্চার ছবি।  আমি দেখছি দেখে তিনি বললেন, ‘মাই ডটার!’ আমার ভয়ভীত ঘর্মাক্ত মুখে একটু যেন ঠান্ডা বাতাস লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে ফোন খুলে আমার দিদির মেয়ে আর বোনের ছেলের ছবি দেখিয়ে বললাম, আমার ছেলে, আমার মেয়ে! বোঝাতে চাইলাম যে আমিও দুই বাচ্চার মা! তিনি কেবল অর্থপূর্ণ হাসি হাসলেন। তারপর উঠে গিয়ে গিয়ে বাইরেটা দেখছেন আর বলছেন, ‘একটা স্টেশন পরেই তোমার বাস স্টেশনের রাস্তা। কিন্তু এখান থেকে বেরিয়ে বেশ খানিকটা হাঁটতে হবে—প্রথমে বাঁদিক, তারপর ডানদিক, তারপর সোজা—তারপর রাস্তা ক্রশ ইত্যাদি ইত্যাদি। পারবে তো? যতটা ঘাড় কাত করা সম্ভব ততটা করতেও দেখি সেই ব্যক্তির মুখে অসন্তোষ স্পষ্ট। তিনি ঘড়ি দেখছেন আর আমার মুখের দিক—ভিতরে আমি ভীতা হরিণী আর মুখে লালমোহন গাঙ্গুলি। হাসি মুখে বলছি, ‘ছোট্ট মিষ্টি বাচ্চাটা জেগে আছে—তুমি তোমার ইমেল দাও, ফোন নম্বর, আমি তোমায় চ্যানাকেল পৌঁছে জানিয়ে দেবো। চাও কি ইন্ডিয়া পৌঁছেও!’ তিনি একটা কাগজে লিখে দিলেন। তারপরেও ভ্রুকুঞ্চিত করে তাকিয়ে আছেন। আমার স্টেশন আসছে, আমি উঠে দাঁড়াতে তিনিও উঠে দাঁড়িয়েছেন। আমি একটু কড়া ভাবেই বললাম, ‘আমার অনুরোধ তুমি কিন্তু আসবে না! আমি যেতে পারব।’ দরজার দিকে এগোচ্ছি আর পেছনের চোখ আমাকে বলছে তিনি আসছেন, ইষ্টনাম জপ করা ছাড়া কোন উপায় নেই! ট্রেন থামতেই আমি জনশূন্য প্ল্যাটফর্মে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম, বিদায় সম্ভাষণটুকুও করিনি সহযাত্রীটিকে। আলো অন্ধকারের প্ল্যাটফর্মে ছুটছি সিঁড়ির দিকে—সিঁড়িতে পা পড়তেই পেছনে জলদগম্ভীর কন্ঠস্বর, ‘দাঁড়াও!’ আমি শুনছি না—কয়েকধাপ উঠতেই আমার আমার কাঁধের উপর একটা হাত এসে পড়লো। অসহায় চোখে তাকালাম—ব্যক্তির চোখ আরও অনেক তীব্র। তিনিও হাঁপাচ্ছেন। বললেন, ‘তোমায় ছেড়ে দিলে আমি রাতে ঘুমোতে পারতাম না! আমি বালকান প্রদেশের মানুষ! একজন বিদেশী মহিলাকে এত রাতে একা ছেড়ে দিতে পারি না, আমি স্থানীয় লোক—কোনোভাবে চলে যাবো বাড়ি! চলো।’ নিজে এগিয়ে গেলেন আমার দিকে না তাকিয়ে—আমি সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দৌড়লাম। শীত আর বৃষ্টি নেমেছে গুড়ি গুড়ি, অন্ধকার অঞ্চল পেরিয়ে তিনি আমাকে নিয়ে চললেন। স্টেশনে পৌঁছে মহিলা শৌচালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি ঘুরে এস, তোমার বাসে শৌচালয় নেই। যাও!’ আমি এখন মন্ত্রমুগ্ধের মত করে তাঁর আদেশ পালন করলাম। দূরপাল্লার বাসস্টেশনে মানুষজনের ভিড়। লোকটি আমাকে সঠিক গেটের সামনে বসিয়ে হঠাৎ কোথায় গেলেন, ফেরত এলেন এককাপ গরম কফি আর একটা চিপসের প্যাকেট নিয়ে, বললেন, ‘এখন তো ১ ঘন্টা দেরী আছে, এটা খাও, আমি আসি, হয়তো লাস্ট মেট্রো পেয়েও যেতে পারি।’ আমি উঠে দাঁড়িয়ে ওঁকে আলিঙ্গন করে বললাম, ‘তোমাকে কী বলবো জানি না ব্রাদার, কিন্তু আমি তিনদিন পরে ইস্তানবুল ফিরে এসে তোমার সঙ্গে এক কাপ কফি খাবো। সুবিধে হলে একবার তোমার পুতুলের মত মেয়েটাকে দেখে আসবো!’

    আমার ইস্তানবুল ফেরা হয়নি- চ্যানাকেল থেকে হঠাৎ দেশে ফিরতে হয়েছিলো। কীভাবে জানিনা ওঁর নাম  ঠিকানা ফোন নম্বর লেখা কাগজটা হারিয়ে গেলো। কিন্তু যদি ইস্তানবুল আবার কখনও যাই, ওঁকে ঠিক খুঁজে পাবই—আমি নিশ্চিত!

     
     



    Tags
     



    Comments (9)

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics