• মরমিয়া প্রেমালাপ


    4    290

    February 14, 2018

     

    ছবি - শঙ্খ

    আজকাল নাকি সব কিছুই খুব হিসেব করে হয়। প্রেম-ট্রেম ভালবাসা বলে কিছু নেই, সবই হিসেব শুধুই হিসেব! কার সঙ্গে প্রেম করলে কত লাভবান হওয়া যাবে, এইসব কিছুর ওপরেই নাকি নির্ভর করে ভালোবাসা। কে ফেসবুকে কাকে কত ‘লাভ’ দিল সেসবও নাকি হিসেবে গণ্য হয়। আমি তো বাবা মেয়েকে এখন থেকেই যথেষ্ট হিসেব করতে শেখাই। এখন কি, আরও বছর কয়েক আগে থেকেই শেখাচ্ছি! যেমন ধরুন আমরা মা–মেয়ে দুজনে বসে জমিয়ে বাজে সময় নষ্ট করছি। অল্প সময়ের জন্য টিভি দেখার অনুমতি দিয়ে—টিভিতে সারাক্ষণ কার্টুনের বদলে ‘তুমি বরং শাহরুখ খানের সিনেমা দেখো’ এসব বলে বলে কার্টুনের বদলে যাতে সে মানুষের জগতে থাকে সেই চেষ্টা করছি। তো শাহরুখকে খুঁজতে খুঁজতে হয়তো এসে পড়ল পিকে বা বজরঙ্গি ভাইজান। তো অমনি দুজনেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যে, শাহরুখ তো আছেই, আপাতত অন্যদেরই দেখা যাক না হয়। এরকম সময়েই হয়তো দেখলাম দিল হ্যায় কে মানতা নেহি দেখানো হচ্ছে কোনো একটা চ্যানেলে। আমাদের সময়ের মানে ঐ বেশ ২৬-২৭ বছর আগের হিট ছবি। কেন্দ্রীয় চরিত্রে আমির খান-পূজা ভাট। বলাই বাহুল্য এই সমস্ত সিনেমা কোনোটারই শুরু বা শেষ দেখি না আমরা । যখন চালানো হয়, তখন মাঝখান থেকে যা দেখাচ্ছে সেখান থেকে খানিকক্ষণ দেখেই শেষ হয়ে যায় টিভি টাইম। এমনও অনেকবার হয়েছে যে এক একটা সিনেমা প্রতিবার আমরা প্রায় একই জায়গা থেকে দেখেছি এবং ঐ একই নির্দিষ্ট জায়গাতে ‘এখনো অনেক বাকী, অনেক দেরী আছে শেষ হতে, চল’ বলে বন্ধ করে দিয়েছি। তো এই দিল হ্যায় কি মানতা নেহি-র ক্ষেত্রেও যেখানে রঘু আর পূজা দুজনে প্রেমে হাবুডুবু এবং রাতে একটি গেস্ট হাউসের সামনে আগুন জ্বালিয়ে লুঙ্গির ওপরে পাঞ্জাবি পরে পূজা কেঁদে কেঁদে গান গেয়ে প্রেম নিবেদন করছে—এই ‘সীনটা’ আমাদের দেখতেই হয়।

    তো বছরখানেক আগের কথা, মেয়ে তখন সাত ছুঁই ছুঁই। আমির খানের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে নস্টালজিয়ায় ডোবার ফাঁকে আড়চোখে দেখি মেয়েও হাঁ করে গিলছে। এই করেই সর্বনাশগুলো হয়! চ্যানেল সরিয়ে দিলে আকর্ষণ বাড়বে আরো। ওদের ইশকুলে এমনিতেই বলেছে যে এখনকার বাচ্চাদের যা ‘এক্সপোজার’ এবং মানসিক অবস্থান তাতে, ওনারা কোনো বাচ্চার সঙ্গে কোনো সমস্যার কথা আলোচনার সময়ে তার বয়স তিন-চার বয়স বাড়িয়ে ধরেন। অর্থাৎ সেই হিসেবে মেয়ে এখন এগারো-বারো! অতএব মাকে ভাবতেই হয়। এবং শুরু হয় আমাদের কথোপকথন:

     - ইস কী অবস্থা দেখছিস তো!

    মেয়ে - (প্রথমে তো শুনতেই পায়না, তারপর ...এক হুংকার ছেড়ে ‘কীরে!!!’ বলার পরে একটা আওয়াজ আসে)- উঁ?

     - দেখছিস কী অবস্থা!

     - কীসের?

     - এই যে...মেয়েটা।

     - কী?

     - এই যে...কাজ নেই, কর্ম নেই সারাক্ষণ শুধু প্রেম করছে।

    মেয়ে অভ্যস্ত মায়ের কাছে থেকে এই ধরণের ডায়লগ শুনে, তবু উত্তর আসে, 

     - ও তো এর প্রেমে পড়েছে!

     - সেই তো বলছি...

     - এ তো ভাল ছেলে!

     - (একটু থমকাই) আরে মেয়েটার কথা বলছি!

     - ও তো আর ঐ ছেলেটার কাছে যাবে না(যাঁরা অজ্ঞান, তাঁদের জানাই, ছবিতে পূজা এক প্রভূত বড়লোক বাবার পুরোপুরি বিগড়ে যাওয়া মেয়ে। ছবির শুরুতেই সে পালায় ফিল্মস্টার দীপক কুমারকে বিয়ে করবে বলে। বাবার এই ছেলে পছন্দ নয় কারণ তিনি জানেন যে দীপক কুমার আদতে একটি ধান্ধাবাজ, চালিয়াত এবং মূলত পূজার টাকার জন্য ওকে বিয়ে করতে চায়। রাস্তায় পূজার আলাপ হয় এক ছোট হিন্দী কাগজের ফ্রীল্যান্স সাংবাদিক রঘু জেটলির সঙ্গে । তারপর যা হওয়ার হয়। এই জার্নির একটু পরের দিকে থেকে আমরা দেখি তাই গল্পটা মেয়ে মোটামুটি আন্দাজ করে নেয়, অবশ্যই পুরোটা নয়। আর এই রাস্তাতেই মেয়েটির ব্যাগ চুরি যায়, টাকা খোওয়া যায়—ফলে রঘুর দেওয়া লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি পরেই ঘুমোতে হয় বেচারীকে! এই অংশটুকু মেয়ের দেখা নেই। অর্থাৎ কেন মেয়েটি ঐ পোশাক পরে তার কারণটা সে দেখেনি। আমরা তার পরে টিভি চালিয়েছি! তারপর অনেক গল্প গড়ায়। আর এই গানটা হয় যখন দীপক কুমারের থেকে পূজার মন রঘুতে সমর্পিত)। 

    আমাদের কথাবার্তা গড়ায়...

     - তাতে কি? কি অবস্থা দেখেছিস? পরার জামা কাপড় নেই, থাকার জায়গা নেই, ছেঁড়া লুঙ্গির ওপর পাঞ্জাবি (ছেঁড়াটা ও বুঝতে পারে না, চেক কাটা অংশকে ছেঁড়া বলেই চালাই আমি।) পরে কেঁদে কেঁদে রাস্তায় গান গাইতে হচ্ছে!!!

    মেয়ের মনে একটু দাগ কাটে

     - ওর বাবা মা কোথায় গেল?

     - মা তো নেই, বাবাও দেখেনি, আহ্লাদ দিয়েছে খালি—তাই তো বিগড়ে গেছে। এবার বুঝতে পারছিস তো আমি কেন তোকে মাঝে মাঝে বকি?

     - কিন্তু ও স্কুলে যেত না? ওর বাবা ভর্তি করেনি?

     - করেছে নিশ্চয়ই, কিন্তু ওর তো মন নেই পড়াশুনোয়। এই সারাক্ষণ টিভি দেখত, ফিল্ম দেখত, সারাক্ষণ এই সব প্রেম প্রেম করে এখন দেখ কী হাল!

    এসব বলতে বলতেই গান তো শেষ হয়ে গেছে! রঘু ঘুমন্ত পূজার কপালে চুমু খেয়ে যত্ন করে গায়ে চাদর টেনে দিয়ে সেই চাদরের ওপর এক চিলতে চিরকূটে নিজের ভালোবাসার কথা জানিয়ে, সে টাকা আনতে যাচ্ছে, জলদি ফিরবে বলে হাওয়া। আর ওদিকে সকালে গাড়ি নেই দেখে গেস্ট হাউসের মালিক আর মালকিন জোরে ধাক্কা দিয়ে পূজাকে ওঠায়, বেচারী ধড়মড়িয়ে উঠতে গিয়ে চাদর সমেত চিরকুট মাটিতে ফেলে দরজা খোলে। তারপর কি অপমান, কি অপমান! ওর কাছে তো টাকা নেই। রাতেও টাকা দিতে পারেনি ওরা বুকিং-এর সময়। মালিক দয়া করে আর বিশ্বাস করে থাকতে দিয়েছেন। এবার টাকাও নেই, ছেলেটিও নেই...আর বিশ্বাস করা যায়! গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হল মেয়েটাকে। সব্বার সামনে, সেই লুঙ্গী আর পাঞ্জাবি পরে কাঁদতে কাঁদতে মেয়ে রাস্তা দিয়ে দৌড়য় বাবাকে ফোন করতে।

    মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। মেয়ে জানায়, 

     - সত্যি মা, কি অবস্থা দেখ!

     - বোঝ তাহলে ! যাকগে বাদ দে, তুই পড়াশুনো মন দিয়ে করিস কিন্তু। এরকম সারাক্ষণ প্রেম প্রেম করিস না।

     - উফ্‌ মা, থামবে?!!! এসব প্রেম-ট্রেম এসব কি? আমি বিয়েই করব না !

    এই রে, পলিটিক্যালি কারেক্ট হতে যাওয়ার কি যন্ত্রণা! বিয়ে আবার এসে গেল কি করে?  গম্ভীর মুখে জানাই,

     - না প্রেম করলেই যে বিয়ে করতেই হবে তার মানে নেই...মানে সব কিছুরই সময় আছে...কিন্তু, এসব বেশি না ভাবাই ভাল। চল উঠে পড়।

    ***

    তখন আমি ক্লাস নাইন। এই সিনেমাটি এল অধুনালুপ্ত আলোছায়া সিনেমা হলে। তখনো শাহরুখ আসেনি আসরে। আমিরেই নিবেদিত প্রাণ। সব মিলিয়ে সাড়ে তিনবার দেখেছিলাম। কোনো একটা ছবি এতবার দেখা আমার সেই প্রথম। ‘সাড়ে’-টা কোনো একবার আর্ধেক দেখেছিলাম তখন প্রচলিত, বাড়িতে ভিডিও ভাড়া করে এনে দেখার কোনো একটা আসরে। কিন্তু হায় রে! আমাকে কেউ চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়নি যে লুঙ্গি পাঞ্জাবি পরে রাস্তায় কেঁদে কেঁদে গান গাওয়ার মধ্যে ভালোবাসার থেকে চাপটাই বেশি! নাহ ওভাবে রাস্তায় কেঁদে কেঁদে গাইতে হয়নি বটে, কিন্তু নিজে হিসেবি ছিলাম না কোনোদিনই, তাই এইসব প্রেম-ট্রেমের পাল্লায় পড়ে জীবনটা...যাকগে...এই সব অপ্রাসঙ্গিক কথা বাদ দিই না হয়। প্রসঙ্গত মনে পড়ল সেই মোবাইল, ফেসবুক ইত্যাদিবিহীন যুগে মূলত গার্লস আর বয়েজ বাংলা মাধ্যমে স্কুলে পড়া ছেলে মেয়েদের কাছে এক পলকের একটু দেখা, একটুকু ছোঁওয়া লাগার স্বর্গ ছিল কোচিং ক্লাস গুলি। মুখে মুখে যেগুলো প্রচলিত ছিল ‘কোচিন’ নামে। স বাবুর কোচিন, অ বাবুর কোচিন, ক স্যারের কোচিন, ট দার কোচিন—এভাবেই পরিচিত ছিল এসব স্বর্গ। না অ ম্যাডাম বা ত দিদির কোচিং ক্লাস সেভাবে ছিল না বোধ হয়। অন্তত আমার মনে পড়ছে না। থাকলেও হাতে গোনা দু’-একটা। তো সেখানে কোথাও সাধারণত মাটিতে শতরঞ্জি বিছিয়ে বা কোথাও চেয়ার এবং শতরঞ্জি মিলিয়ে মিশিয়ে বসার ব্যবস্থা থাকত। তো কিছু কিছু ছাপ্পামারা যুগল থাকত যাদের প্রেম কাহিনী সবার জানা এবং তারা অবধারিত ভাবেই এসে যেখানে মেয়েদের বৃত্ত শেষ হয়ে ছেলেদের বৃত্ত শুরু হচ্ছে বা উল্টোটা—সেখানেই বসত। অথবা মুখোমুখি এমনভাবে যেখানে স্যারের চোখ এড়িয়ে চোখাচোখিটা নির্ভয়ে করা যাবে। চিঠি বা চিরকুট চালাচালিও এভাবেই চলত। সরাসরি অথবা বন্ধুদের মাধ্যমে। ওটাই ছিল একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম। অথবা রাস্তায় বা কোনো দোকানে রাখা এক টাকার কয়েন ফেলে করা ফোন বুথের ফোন। ল্যান্ডলাইন অনেক বাড়িতে ছিল না এবং থাকলেও চাপ ছিল বেশি। একবার আমার এক বন্ধুকে ফোন করতে গিয়ে (তার প্রেমের দৌত্য করছিলাম) অনেকবার ফোন করছি, ওর বাবা ধরছেন এবং হ্যালো হ্যালো করছেন, আমি হ্যালো হ্যালো করছি বন্ধু আছে কিনা জিজ্ঞেস করছি, কিন্তু তিনি কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না। যাই হোক শেষমেশ দোকানের ভদ্রলোক দেখিয়ে দিলেন যে আমি একটাকার কয়েনটা হাতে ধরেই হ্যালো হ্যালো করে চলেছি!!! তারপর, কয়েন ফেলে যখন কাটা লাইন জোড়া লাগল, তখন কাকিমা ধরেছেন ফোন। বন্ধু বাড়ি নেই। কিন্তু পরে শুনি কাকু কাকিমাকে বলেছেন, বাবুর কোনো মেয়ে বন্ধু ফোন করেছে না? আমার গলা শুনেই কেটে দিচ্ছে! যদিও আমি তার অনেকদিনের বন্ধু এবং গুষ্টিসুদ্ধ সকলেই আমাকে চেনেন!

    এরকম খুচরো কেস আমরা অনেকেই অল্প বিস্তর খেয়েছি!

    তো অ বাবুর ওই সন্ধ্যেবেলার ক্লাসে অনেক সময় লোডশেডিং হয়ে যেত। স্যার মোমবাতি এনে রাখতেন। কোনো কারণে বাইরে গেলেই কারোর না কারোর হ্যাপি বার্থডে হত। মোমবাতি নিভে যেত। স্যার আবার এসে মোমবাতি জ্বালাবেন, বেশ কিছুটা সময় পড়া বন্ধ বলে আমাদের মজা আর তারপর… বড়জোর ৫০ সেকেন্ডের অন্ধকার কেটে আবার মোমবাতি জ্বলে ওঠার পর দলবৃত্তের মুখে ইচ্ছাকৃত বসা যুগলদের দিকে সবাই একবার আড়চোখে দেখে নিতে ভুলত না! তবে এই মজাটা বেশিদিন চলেনি। কারণ তারপর তো এমার্জেন্সি লাইট এসে গেল! আলো চলে গেলেই স্যারের পাশে থাকা এমার্জেন্সি লাইটের খুট এবং আলো… গেল…!

    আড়চোখে তাকানোর প্রসঙ্গে আবার মনে পড়ল, তখন ইলেভেন বা টুয়েলভে পড়ি। এক যুগলের বিশেষ করে মেয়েটির বাড়িতে ভয়ানক অশান্তি। মেয়েটির বাড়ি থেকে অন্য জায়গায় বিয়ের ঠিক করে ফেলল প্রায়। হঠাৎ শুনি তারা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে মন্দিরে। সে কি উত্তেজনা ক্লাসে! ছেলের বাড়িতে মেনে নিয়েছিল। তারপর ক্রমে মেয়ের বাড়িতেও মেনে নিল। মেয়েটি সিঁদুর, শাখাঁ পরে এল কোচিং ক্লাসে। সেও এক ঘটনা। এবং এর কিছুদিন পরেই মেয়েটির শরীর একদিন খারাপ ছিল। ক্লাসের মধ্যেই একবার উঠে গেল, 'ওয়াক' করে এল। ব্যস! অমনি সবার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে মুচকি হাসি আর চোখের কোণে বিশেষ সমঝদারি ইশারা…আবার কী? পালিয়ে গিয়ে বিয়ে, তারপরেই অবধারিত পরিণতি বমি?...এর পরেও যদি না বুঝতে পারি তাহলে বৃথাই এতদিন হিন্দি, বাংলা সিনেমা দেখলাম! আর আমাদের মায়েরা আমাদের সঙ্গে বসে এসব সিনেমা দেখতও না আর আমার মত মেয়েকে সাবধান তো করতই না!!! অতএব দুয়ে দুয়ে চার… আর সে বেচারি একে শরীর খারাপ, তার ওপরে সবার অমন চাউনি এবং মুখ তাকাতাকি করা!!! লজ্জায় লাল হয়ে বারবার বলতে লাগল যে আজে বাজে খাবার খাওয়ার জন্যই হজমের গোলমাল ইত্যাদি! যাই হোক পরে জানা গেল সত্যিই নিরামিষ ফুচকা, আলুকাবলি এবং কিছু ভাজাভুজি ক’দিন ধরে নন স্টপ খাওয়ার ফলেই বমি হয়েছিল বেচারির!

    আবার এরকম আলোচনাও অনেক হত যে লোকজন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারত না যে কোনো একটি মেয়ে কী করে একটি ‘বোকা’ ছেলের প্রেমে পড়ে এবং তারপরেও এতদিন ধরে সেই প্রেম চালিয়ে যায়? আবার উলটোটাও হত! উভয় ক্ষেত্রেই সাধারণত চেহারা এবং বিশ্বস্ততা মোটামুটি ‘কমন ফ্যাক্টর’ ছিল। তাছাড়া কে কোন স্কুলে বা পড়াশুনোয় কে কেমন এগুলোও প্রেমে পড়ার ক্ষেত্রে বিচার্য ছিল। এই হিসেবের বাইরে গেলেই লোকজন ভেবে পেত না যে অন্য আর কী ‘ফ্যাক্টর’ কাজ করছে!

    আমি অনেক ছোট থেকেই ক্যাম্পে যাই, বা অন্যান্য এক্সপোজারও বেশি ফলে, বালিকা বিদ্যালয়ে পড়লেও, আমার কাছে ‘কোচিন’ প্রথম খোলা জানলা এমনটা ছিল না। আমার দুজন স্টেডি ছেলে বন্ধু ছিল। যারা ভালো বন্ধুই ছিল এবং ফলে আমার চাপটা কম ছিল। অন্যদের অনেক চাপ হত মানে এই ‘কোচিন’-এর অন্যান্যদের মধ্যে ফিসফাস চলত যে কার সঙ্গে আমার ‘আছে’ এবং কে শুধুই বন্ধু… এবং আমরা তিনজন যথেচ্ছ মজা পেতাম এ থেকে।

    অবশেষে নিজে প্রেমে পড়লাম যখন, তখন অবশ্য ধপাস করেই পড়লাম এবং সেই কালশিটে এখনও রয়ে গেল! কিন্তু সব মিলিয়ে ‘কোচিন’-এর প্রেম একটি রঙিন অধ্যায় ছিল সেই সময়ে। যেটা বলার, তা হল এই যে হিসেবের মধ্যে কিন্তু আরও অনেক কিছুই ছিল যেমন—এক যুগল বেশ অনেকদিন ধরে একসঙ্গে আছে। শুনলাম যে প অনেক দিন ধরে ‘লাইন মেরে’ অবশেষে মেয়েটিকে ‘পেয়েছে’। তবে সেই মেয়েটি, স, শর্ত  দিয়েছে যে ‘যদি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার না হতে পার তাহলে আমাকে পাচ্ছ না’। এবং প তাতেই রাজী এবং মন দিয়ে পড়াশুনো করছে। অনেকে আবার জানাত যে এই প্রেমগুলোতে পড়াশুনো নষ্ট হয় না, বরং জীবন তৈরী হয়! শুনে কিরকম টেরিয়ে গেছিলাম যেন! জানিনা প ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে পেরেছিল কি না তবে স-কে ‘পায়নি’ এটা জানলাম যখন বেশ কয়েক বছর আগে এক বিয়েবাড়িতে বর এবং ছেলে সহ স-এর সঙ্গে দেখা হল। বরটি প নয়। এবং বর কী করে সেটাও জানা হয়নি অবশ্য। এমনকি আসলে কে যে কাকে ‘পেল না’ সেটাও জানা নেই । কিন্তু সেই বছর ১৬ বয়সে, অমন শর্তসাপেক্ষ প্রেমটি এমনই অদ্ভুত লেগেছিল যে এতবছর পরে স-কে দেখে প্রথমে সেটাই মনে পড়ল! অতএব হিসেব করে প্রেম করা মোটেই আজকের বিষয় নয় শুধু!

    মুশকিল হচ্ছে, আমার প্রথম প্রেমটাকে ঠিক ‘কোচিনের প্রেম’ বলা যাবে কিনা জানি না তবে শুরুটা…ইয়ে…ওই ‘কোচিন’-এই। যার জের এখনও টানতে হচ্ছে এবং মাঝে আবার একদিন এই দিল হ্যায় কি মানতা নেহি টিভিতে দেখাচ্ছে দেখে যেই না মনের ভুলে মেয়েকে বললাম, ‘জানিস তো মাম্মা, আমি না এই ফিল্মটা সাড়ে তিনবার দেখেছি!’

    অমনি তিনি এমন একটা চাউনি দিলেন আমাকে, যে মনে পড়ে গেল সেই ছেঁড়া লুঙ্গি পাঞ্জাবির গপ্পোটাও আমিই দিয়েছি তাকে! অতএব ম্যানেজ করতে থাকি…

     - ওই জন্যই তো তোকে বলি, আমাদের সময়ে সব সিনেমায় খালি এই প্রেম আর প্রেম! আর এইসব ভুলভাল জিনিস দেখাত আর আমাদের বয়স কম তো তখন, আমাদেরও ভালো লাগত! এই যে দেখ, আমি, আগুপিছু না ভেবে বাবার মত একটা ছেলেকে বিয়ে করে ফেললাম… দেখছিস তো আমার অবস্থা!

    ব্যস! এরপর কি আর কোন সাবধানবাণী দাঁড়ায়! মেয়ে হেসে, চেঁচিয়ে, ‘কি বাবা খারাপ? তোমার অবস্থা এইরকম?’ এইসব বলে হৈ চৈ শুরু করে দেয়।

    কবে একদিন কোনো একটা অনুষ্ঠানের ফাঁকে কোনো সিরিয়ালের বিজ্ঞাপনে কে কাকে বলছে ‘আমি ওর আবার বিয়ে দেবো’—এসব দেখছিল। আমাকে দেখেই বলল, ‘কি অদ্ভুত না মা! একবার বিয়ে হয়ে গেছে, বলছে আবার বিয়ে দেবে! একবার বিয়ে হলে আবার বিয়ে করা যায় না কি?’ সিরিয়ালের গল্পটা আবার অন্য। সেটা ওর দাদা-দিদার সঙ্গে বেশি চলে এবং আমার প্রবল আপত্তির কথাটাও তাদের সবার জানা ফলে সেই নিয়েও অনেক মজার গল্প রয়েছে। কিন্তু আপাতত আমি আবার আমার জ্ঞানদা মায়ের ভূমিকায় নেমে বলি যে, ‘কে বলেছে একবার বিয়ে করলে আর বিয়ে করা যাবে না? ডিভোর্স করে নিশ্চয়ই আবার বিয়ে করা যায়। একজনকে একবার বিয়ে করেছে বলেই সারাজীবন তার সঙ্গেই থাকতে হবে এরকম কোনো মানে নেই মাম্মা! এসব একদম মাথায় ঢোকাবে না এখন থেকে! একবার বিয়ে করলেই আর বিয়ে করা যাবে না?! যত্তসব বাজে জিনিস!’

    উত্তর এল,

     - এত রেগে যাচ্ছ কেন? কি! তোমার কি আরেকটা বিয়ে করার ইচ্ছে হয়েছে নাকি?

    পাশের ঘর থেকে বাবার হাসি ভেসে এল। ফুলটসে ওভার বাউণ্ডারি না মারলে চলে?!!!

     - একদম ঠিক বলেছিস। বল তো মাকে আরেকটা বিয়ে করতে।

    মেয়ে - তুমিও আরেকটা বিয়ে কর বাবা।

    বাবা - পাগল? আর নয় বাবা!

    মেয়ে - কেন? তুমিও আরেকটা বিয়ে কর, মাও আরেকটা বিয়ে করুক।

    আমি - দারুণ বলেছিস! তাহলে তুই ঠিক করে ফেল কার কাছে থাকবি?

    মেয়ে - কেন তোমাদের দুজনের কাছেই থাকব।

    আমি - কি করে? আমি তো আরেকটা বিয়ে করে তার সঙ্গে থাকব। বাবাও তো আরেকটা বিয়ে করে তার সঙ্গে থাকবে। তোর তো ভালই হবে, আরেক সেট বাবা-মা পাবি…কি বল?

    মেয়ে - অ্যাঁ? না না ছেড়ে দাও, তোমাদের বিয়ে করতে হবে না।

    আবার কখনও আমাদের ঝামেলা হলে এবং সে সময় ওর পক্ষপাতিত্ব আমার তরফে হলে সোজা পরামর্শ দেয়, ‘মা বাবাকে ডিভোর্স করে দাও তো। তুমি সিঙ্গল মাদার হয়ে যাও!’ কোনো টেলিফিল্মে সিঙ্গল মাদার কথাটা দেখেছে এবং শুনেছে, তাছাড়া ঈলীনা মাসি তো ‘সিঙ্গল মাদার’, কাজেই ও জানে বিষয়টা হল বাবাকে বাদ দিয়ে বাচ্চাকে নিয়ে মায়ের একা থাকা! কাজেই এহেন মেয়েকে আমি বেশ সমঝে চলি!

    কিন্তু এই লেখা তো সিঙ্গল মাদার নিয়ে বা বিয়ে নিয়ে নয়, এই লেখা প্রেম নিয়ে। মেয়েকে জানতে হবে যে প্রেমের পরিণতি সবসময় মোটেও বিয়ে নয়। এটা মেয়েকে হয়তো আমার বোঝানোর দরকার নেই, ও নিজেই বুঝে নেবে। কিন্তু আমি কর্তব্য করে চলি। মেয়েকে সমানেই বলি, ‘এক সঙ্গে থাকাটাই ভালো, বিয়ে করার দরকার নেই… মানে তোর ইচ্ছে না হলে বিয়ে করিস না বুঝলি?’

    আমরা একসঙ্গে টিভিতে পুরনো দিনের ছবিতে শাহরুখ, সলমন, আমির, কাজল, মাধুরী, পূজা—সবার সিনেমার অংশবিশেষ দেখি এবং আমাদের রানিং কমেন্টারি চলতে থাকে যে এরা পড়াশুনো করছে কি? ছেলে বা মেয়েটা কাজ কি করে? শুধুই গান গেয়ে বেড়ায়? অনেকেই আমাকে বলে ‘এগুলো খুব বাজে করছ’… বলুক ভাই… এ-ত-অ বছর পরে আমিও এখন হিসেবি। প্রেমিক ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে পারলে তবেই আমি প্রেমিকা—এমন হিসেব আজও পোষাবে না কিন্তু প্রেমে পড়াটাই জীবনের সব আর ওই প্রেমে পড়া মানেই নিজেকে ভুলে যাওয়াটাই কর্তব্য—এমন ভুলভাল মেসেজের সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রেমালাপের মেসেজগুলো একটু বাজিয়ে যাতে নিতে পারে সেই কারণে মেয়ের সঙ্গে আলাপচারিতা চালিয়ে যেতে থাকি আমি। ওদের জীবনে অনেক এক্সপোজার আছে,আসবে—‘কোচিন’-এর বদলে থাকবে ‘টিউশ্যন’ , চিরকুটের বদলে হোয়াটসঅ্যাপ, আরও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া। আমার মেয়ে আমার মত ‘ট্যালা’ হবে না সে কথা এখনই হলফ করে বলা যায়। তবু, আমার কাজ আমি করে যাই… 

    ম্যায়নে প্যায়ার কিয়া ফিল্মে ‘কবুতর যা যা’ গানে তাই আমরা সলমন আর ভাগ্যশ্রীর পায়রা নিয়ে প্রথম প্রেমের প্রথম চিঠি পাঠানোর আদিখ্যেতা দেখার সঙ্গে সঙ্গে সমান মনোযোগ দিয়ে এটাও আবিষ্কার করি যে একটা পায়রাকে নিয়ে এতক্ষণ ধরে ওরা গান করছে কিন্তু পায়রাটা একবারও বকম বকম করছে না! মেয়ে জানায়, পায়রাটা একবারও ‘পটি’ করছে না!

    তারপর আমরা হেসে গড়িয়ে পড়ি আর হাই-ফাইভ করি। আমার ‘কোচিং ক্লাস’ এর নিঃশর্ত প্রেম অনেক পথ পেরিয়ে এসে অন্যরূপে জারি রাখে জীবনের সঙ্গে মরমিয়া প্রেমালাপ ।

     
     



    Tags
     



    Comments (4)
    • Khub bhalo laglo Moupia di…tomar aamar chhotobela ta praye kachha kachhiee, tai smiriti gulou ek ee rokom…..khub sohojei chole gelam, phele asa sei somoy tay. Ajkal byastotar ajuhate to sei smiriti gulo hatrateo bhule jachhi….tomar jonno kichhukkhoner jonno se sujog millo. Eto sabolil tomar lekhoni, je mone holo bose golpo korchhi…..anek anek dhonnobad….aro anek anek lekha…porar apekkhay roilam

      • Aami age kheyal korini kyano ke Jane message gulo jani na, onek somoi “junk” e chole jai. aj hothat email clear korte Gide choke porlo. Thank You Basabdutta. Eto sundor motamot pore mon bhalo hoye gyalo. Thanks again

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics