• 'ওনলি মি' না 'ফ্রেন্ডস'?


    0    286

    February 14, 2018

     

    শীতের আকাশটা কেমন ফ্যাকাশে সাদা। নীল আছে। তবে আলোর ঘষা খেয়ে খেয়ে এখন সাদাটে। ঠিক ফেসবুকের ব্যাকগ্রাউন্ড। তবে ফেসবুকের ব্যাকগ্রাউন্ডের আরো ঘন নীল আছে। মানুষের নাম। কালো লেখা আছে। লাল, হলুদ স্মাইলি আছে। আরো আছে রঙ বেরঙের ছবি।

    দুপুরের আকাশে এখন ওসব কিছু নেই। মেঘও না। আর ওর মধ্যেই এক কোণে লাল কী যেন একটা জ্বলে উঠল। একটা সংখ্যা। এক। আকাশ নয় ওটাতো ফেসবুকের প্রোফাইলটাই। মেসেজ এসেছে।

    মেসেজের নামটা দেখে আমি হতভম্ব হয়ে যাই। ‘আমাকে মনে পড়ে তোমার?’

    মেসেঞ্জার নয়, ওটা রাস্তা একটা। কুয়াশার মতো মেঘ ঢেকে দিয়েছে চারপাশ। আর তার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দু’জন। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। মেয়েটার গায়ে লাল কার্ডিগান, টাইট জিন্স। ছেলেটার কালো জ্যাকেট। সেও জিন্সেই। পাহাড়ি রাস্তাটা ঘন সবুজ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ঘুরে ঘুরে চলে গিয়েছে একটা খোলা জায়গায়। নীচের উপত্যকাটা দেখা যাচ্ছে না কুয়াশায়। দেখা যাচ্ছে না দূরের পাহাড়গুলোও।

    ছেলেটা দাঁড়ায়। মেয়েটার দিকে হঠাৎ ঘুরে প্রশ্ন করে, ‘যদি সম্পর্কটা ভেঙে যায় কোনওদিন? কী করবে?’

     - ‘হঠাৎ’

     - ‘বলো না, প্লিজ।’

    মেয়েটা কিছু বলে না। শুধু ছেলেটাকে কাছে টেনে নেয়। মোবাইলটা হাতে তুলে নিয়ে ছেলেটাকে নিয়ে সেলফি তোলে। তারপর ছবিটা দেখে দু’জনে। মেয়েটা আগে, ছেলেটা একটু পেছনে। আর বাকি সব গৌণ অস্পষ্টতায়।

    সেলফিটা ওরা আপলোড করে দেবে ফেসবুকেই। লাইক পাবে। কমেন্টও। এমন আরো সেলফি দেবে ওরা বেশ কয়েক বছর। দূর দূর শহরের আলাদা আলাদা জায়গায়। কখনও রেস্তোরাঁয়, কখনও বা অন্য কোথাও বেড়াতে গিয়ে। তারপর উঁচু-নীচু শহরের বাড়িগুলোর গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে সম্পর্কটা ছেঁড়া ঘুড়ির মত পাকসাট খেতে খেতে হারিয়ে যাবে কোনও এক গলিতে।

    ছবিগুলো থাকবে। ফেসবুকেই। হয়ত ফ্রেন্ডলিস্টেও থাকবে তারা কিছুদিন। কথা বলবে না মেসেঞ্জারে। কিন্তু থাকবে। ছেলেটা মেয়েটার প্রোফাইলটা দেখবে বার বার। মেয়েটাও হয়তো। তারপর একদিন হয়তো একদিন তাদের কেউ ফোন করে বসবে অন্যজনকে। হয়ত ছেলেটাই।

    মেয়েটা কাঁদবে। কিন্তু কান্নাটা চেপে রাখবে সে। কিছুতেই দেখাবে না আর। তারপর ছেলেটার ফোনটা কেটে দিয়ে ব্লক করে দেবে ফেসবুকে।

    ছেলেটা রেগে যাবে। হোয়াটসঅ্যাপে পারস্পরিক চ্যাটগুলো সে আগেই ডিলিট করেছিল। এইবার নম্বরটাও উড়িয়ে দেবে। মন খারাপ হবে তার খুব। বিষণ্ণতায় সেও ফেসবুক ডিঅ্যাক্টিভেট করে দেবে। তারপর আবার একদিন একটা ফেক প্রোফাইল খুলবে। আবার ভিজিট করবে প্রোফাইলটা। পুরোনো ছবিগুলো আর দেখতে পাবে না। হয় ওইগুলো ওনলি মি করা। নয়তো শুধু ফ্রেন্ডস।

    তারপর দীর্ঘ একটা সময় পেরিয়ে সে দেখবে মেয়েটা তাকে মেসেজ করেছে। ব্লকটা কখন তুলেছে সে জানেও না।

    কিন্তু এতদিনে সে বুঝে নিয়েছে সম্পর্ক আসলে পাহাড় চড়ার মতো। একবার ওপরে ওঠা হয়ে গেলে আর তার কোন উত্তাপ থাকে না। তাই মেসেজটার কোনো উত্তর দেবে না আর। কিংবা হয়তো মেসেজটাই আসবে না কোনোদিন। ছবিগুলো থেকে যাবে দু’জনের প্রোফাইলে। একা একা। আলাদা আলাদা। ওনলি মি করা।

    পৃথিবীর ২৪ ঘন্টায় একটা দিন থাকে আর একটা রাত। আলো আছে। আলো নেই। অন। অফ। দিনের আলোর কত তারতম্য আছে। রাতের অন্ধকারেরও। আর তাদের মধ্যিখানে আছে আলো আঁধারির অনেক পরত।

    ডিজিটালে দুটো মাত্র সংখ্যা। বাইনারি। এক আর শূন্য। একটা মানে হল পাওয়ার আছে। অন। আরেকটার মানে হল পাওয়ার নেই। অফ। দুটো সংখ্যা। দুটোই নিখুঁত, নিভাঁজ, নিটোল। তাদের মধ্যে কোনও তারতম্য নেই। একই রকম। হয় আছ নয় নেই।

    ডিজিটাল যুগে আমরা তাই সেলফি তুলি। যেখানে সেলফটাই প্রাধান্য পায়। আমি। বাকি সব কিছুই ক্রমশ গৌণ।

    এই ডিজিটাল যুগে মানুষ নিজেকে আসলে সংখ্যাই ভেবে বসেছে। তাও মোটে দুটো। এক আর শূন্য। আমি আছি। অন্য কিছু নেই। আর এই এক আর শূন্যের মাঝে বিরাট একটা ফাটল। সেই ফাটল দিয়ে আলো ঢোকে না। বরং সম্পর্কগুলো হারিয়ে যায় অন্ধকারে।

    দিন আর রাতের ক্রমান্বয় পরিবর্তন দেখতে দেখতে পৃথিবীর কত বয়স বেড়ে গেল। পৃথিবীর ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মানুষও কখন যেন একা আরো একা হয়ে গেল। এখন সে নিজেকেও ডিজিটাইজ করতে চাইছে অন্য মানুষের কাছে আসবে বলে। কিন্তু এক আর শূন্যের ফাঁদে আটকে থেকে। নিজেকেই শুধু অন করে রেখেছে সে। বাকি সব কিছুই অফ। আর প্রেম? প্রেম মানে যে পুরো পাওয়া এক আর পুরো না পাওয়া শূন্য নয় বরং আসলে হয়তো দুটোই একসঙ্গে কিংবা দুটোর মাঝে অন্য কিছু সেই কথাটা ভুলে গিয়েছে।

    তবু প্রেম আসে। প্রেম হয়। ডিজিটাল দিনগুলোতেও প্রেম বেঁচে থাকে। মানুষ যে আসলে মানুষকে খুব ভালোবাসে।

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics