• পুরনো সেই প্রেমের কথা


    3    691

    February 14, 2018

     

    একদম পিছিয়ে, আমার দিদা আর দাদুর কথায় আসি। ষোল বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল দিদুর। দাদু তখন, দশ বছরের বড়, মানে বছর ছাব্বিশের যুবা,অঙ্কশাস্ত্রে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট।  প্রবল পড়াশুনো করে চোখের বারোটা বেজেছে, গোল গোল চশমা আর বিদ্যেসাগরি চটি, ধুতি ও চাদরে সজ্জিত, ময়দানে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের মত বিশাল ব্যক্তিত্বের আড্ডায় যান, গোগ্রাসে গেলেন তাঁদের চিন্তাধারা… এই নবীন চিন্তাবিদ ও স্কলার নিজের ম্যাট্রিক পাশ স্ত্রীকে বেথুন কলেজে ভর্তি করে দিলেন প্রথমে আই এ ও পরে সংস্কৃতে বি এ পড়ার জন্য।

    সন্তান আনতে গুণে গুণে পাঁচ বছর দেরি করেছিলেন তিনি। ১৯১৯ এ বিবাহ, আর  ১৯২৪ এ প্রথম সন্তান। এর মধ্যে দিদুর পড়াশুনো হয়ে গেল। দিদু বলতেন, এম এ পড়ার সময়ে, পুরুষদের সঙ্গে এক ঘরে পড়তে হবে বলেই নাকি, দাদু ইচ্ছে করে সন্তানজন্মের দিকে ঠেলে দিয়ে এম এ পড়াটা ভেস্তে দিয়েছিলেন দিদুর!

    সে যুগে দাদু দিদুকে নিয়ে ট্রামে চেপে এদিক ওদিক যেতেন। থিয়েটার দেখতে বা রবি ঠাকুরের গান শুনতে। বক্তৃতা শুনতে কংগ্রেসের অধিবেশনে। ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। ঘরের মহিলারা সে সময়ে ট্রামে প্রায় চড়তেন না।

    এটা আমার সবচেয়ে কাছ থেকে দেখা প্রেম। সেযুগের প্রেম। যার ভ্যালিডিটি পিরিয়ড ছিল হীরক জয়ন্তী করা পঁচাত্তর বছর। নব্য মুক্তচিন্তার ধারকবাহক প্রেম।

     || ২ ||

    আমার মা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে গিয়েছিলেন। সহপাঠিনীদের সঙ্গে তাঁরা বসতেন এক দিকে। অন্য দিকে ছেলেরা। মেয়েরা অঙ্ক ক্লাসে সংখ্যালঘু। তাই তাঁদের দিকে তাকাত ছেলেরা বিপুল হতাশাময় কামনা নিয়ে। একদিন এক ছেলে বিরাট সাহসের কাজ করে বসল। মায়েদের কাঠের ডেস্কে রেখে দিল চিনি মাখানো ছোট্ট ছোট্ট মৌরি লজেন্স।

    মায়েরা সিটে এসে বসার সময়, সেটা দেখে, সব বুঝে, রাগী রাগী মুখ করে, শাড়ির আঁচল দিয়ে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।

    মায়ের জন্ম ১৯৩৫। আমার এক মামা, যাঁর জন্ম ১৯৪২ এ, তিনি কিন্তু পরিবারের প্রথম প্রেম করে বিয়ে করা ছেলে। তার ওপর আবার বেজাতে। মানে, মামা কায়স্থ কিন্তু মামি ব্রাহ্মণ ছিলেন। সে প্রেমের কাহিনি গল্পের বইয়ের মত। বন্ধুর বোনের সঙ্গে প্রেম করেছিলেন মামা। আমাদের ছোট্টবেলায় কিন্তু, স্পষ্ট মনে আছে, সে খবর আমরা প্রায় গুড়গুড়ে বয়স থেকেই জানতাম। মায়েদের আলোচনা থেকেই জেনেছিলাম নিশ্চিত। অর্থাৎ, প্রেমের গল্প শোনার অভ্যাস সে সময়েও শিশুদের ছিল, এখনকার শিশুদেরই শুধু দোষ দেওয়া হয় যে তারা সব জেনে ফেলেছে!

    তো সেই মামু মামির অভ্যাস ছিল গঙ্গার ধারে যাওয়া, দোতলা বাসের সামনের সিটে বসা, ট্রামে চেপে ঘুরতে থাকা। ট্রামই এক মাত্র যান যা ডিপো থেকে ডিপো গিয়ে আবার রওনা হয়ে যায়। এ এক অনন্ত গোলাকৃতি পথ। ট্রামের সামান্য কয়েক পয়সা ভাড়া দিয়েই এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা কলকাতার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত যাওয়া যায়, ট্রামের সিটে বসে বসে। কেউ নামিয়ে দেয় না।

    তাছাড়া ছিল চায়ের দোকান। হামেশাই যা বাংলা সিনেমার উপাদান। কত না ছবিতে দেখা গেল সেই কাটলেট চপ সাজানো, কাঁটাচামচ দেওয়া সাদা চিনেমাটির প্লেট, নুন মরিচের ডিবে আর লাল পর্দা ঢাকা চায়ের কেবিনের ছোট্ট ঘর। সেযুগে, নস্টালজিয়ার নিয়ম মেনে, ছেলে ও মেয়ে মুখোমুখি বসিবার আয়োজন সেটাই। সেটাই আসল উন্মেষস্থল রোম্যান্সের।  

    এইসব চা দোকানে বাঙালি ছেলেমেয়েরা বসবে। রমাপদ চৌধুরীর গল্পের ছেলেমেয়েরা বন্ধুত্ব থেকে প্রেমের দিকে যেতে যেতে নিজেদের, আজকের ভাষায় এক্সপ্লোর করবে। সুধীর মৈত্রর আঁকা ছবির মত সেই সব লম্বা বিনুনি শাড়ি পরিহিতা মেয়েরা আসবে, আর ছেলেদের গায়ে একটা আঙুল ছোঁয়ালেই অগ্ন্যুৎপাত হবে ছেলেটির ভেতরে।

    এইসব সময়ে কাকা মেসো পিশেমশাইরা থাকতেন ঝোপেঝাড়ে বাসে ট্রামে। কোনো পারিবারিক পরিচয় থাকলেই, ছেলেটি বা মেয়েটির সম্বন্ধে বাড়ি বয়ে দিয়ে আসতেন খবর। ছেলেটিকে কোন মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখা গেছে। “তোমার মাইয়াডারে দ্যাখলাম য্যান! ট্রামে বইস্যা কার না কার বাড়ির পোলার সঙ্গে কথা কয়!”

    অর্থাৎ এই সময়ের ছেলেমেয়েদের ভেতরে চাপা সন্ত্রাসের মত এই বুঝি কেউ দেখে ফেলল ব্যাপারটা কাজ করত। আনুষঙ্গিক হল সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে তুমুল চোপা, যার নাম আমাদের প্রজন্মে এসে হবে ঝাড়।

     || ৩ ||

    এর পর এল আমার প্রজন্ম। আমরা কলেজে পড়ছি যখন, রোজ রাত আটটায় কি সাতটায় বাড়ি ফিরে গল্প দিতাম জ্যামের। একটাও মা বিশ্বাস করতেন না। একবার কলেজ স্ট্রিটে বৃষ্টি হয়ে জল জমল। ভবানীপুরে সত্যি জ্যামে আটকে ন’টায় ফিরে মাকে বিশ্বাসই করাতে পারিনি, ভবানীপুরে একটুও বৃষ্টি হয়নি সেদিন।

    এসব তথাকথিত দুষ্টুমির সঙ্গে মাখা সন্দেশের মত ছিল আমাদের প্রেম। প্রেমে পড়া, প্রেম করা। এক তরফা প্রেম তখনো প্রচুর। কয়েকটা ঠিকঠাক লেগে গেলে দু’ তরফা হত। তার আবার নিয়ম ছিল। অলিখিত। তিন মাস ঘুরলে একটা চুমু।

    তখনো জীবনের প্রথম চুমু খাওয়ার জায়গা ছাতের ধার, ট্যাঙ্কের পেছনদিক। কিন্তু তার চেয়েও বেশি আসছে মেয়েবন্ধু ছেলেবন্ধুদের মেলামেশা। অ্যাসেক্সুয়ালের ভেতর যৌনতার চোরাটান, তবু যেন লুপ্ত নাশপাতির মত নির্বীজ ও নিষ্পাপ। ক্যান্টিনের বেঞ্চি ভাগাভাগি করে গায়ে গা ঠেকিয়ে বসার পর্ব। কিন্তু শরীরী নয় তবু। এক আধখানা কেচ্ছাকাহিনি ঘোরে বাতাসে। অমুককে অমুকের সঙ্গে সন্ধে অব্দি কলেজের পেছনে জলের ট্যাঙ্কের ওপরে দেখা যায় (যাকে ডিরোজিওর কবর বলে ডাকতাম আমরা)। তমুক অমুকের হোস্টেলে ঢুকে বিছানায় সেঁধিয়েছে। ‘শোয়া’ শব্দ কীভাবে জানি তখন থেকে আমাদের জবানিতে একটি সংকীর্ণতর অর্থে ব্যবহৃত হতে থাকবে।

    আমরা জানব নানারকমের বন্ধুত্ব, রঙ পালটানো হবে তারও। কিছু কিছু সম্পর্ককে প্রান্তিক সম্পর্ক নাম দিয়ে দাগিয়ে দেব। কিছু সম্পর্ক ফ্লপ, কিছু ঢপ। সরস্বতী পুজোর শ্যাম্পু চুল, হলদে শাড়ির সঙ্গে হলদে পাঞ্জাবির চোখে চোখে কথা। পুজো প্যান্ডেলে অঞ্জলি দিতে গিয়ে তাকাতাকি।

    বারান্দা বা ছাত থেকে ফেলা চিরকুট। অথবা কালো হোঁতকা টেলিফোনে ফোঁশ ফোঁশ নিঃশ্বাস ফেলা… এই হল পূর্বরাগ। তারপর কোচিং ক্লাস থেকে সঙ্গ ধরা প্রেম, রবীন্দ্রসদন-নন্দন থেকে পাশাপাশি বসা প্রেম, থার্টি সিক্স চৌরঙ্গি লেনের সেই প্রাইভেসি খোঁজা প্রেম পালটে গেছে। বন্ধুর ফাঁকা বাড়ি বা নিজেদের ফাঁকা বাড়িতে ‘প্রেম করা’ ইন থিং হয়েছে।

    তবে ততদিনে বোধ হয় ওই না ছোঁয়া, না ধরা, রোমান্স আর কলকাতায় নেই। জায়গাবদল করে চলে গেছে শ্রীরামপুরে, চন্দননগরে। ফুচকাওয়ালারা সেসব রোমান্স জানবে। জানবে সাইকেল স্ট্যান্ডরা।

    ততদিনে আমাদের সব ভালবাসার গল্প বইতে ঢুকে গিয়েছে। সিনেমায় ঢুকে গিয়েছে। আর এসে গিয়েছে অন্য এক প্রজন্ম। যে প্রজন্মে ছেলেরা আর মেয়েরা একসঙ্গে বসে ব্লু ফিল্ম দেখে।

    ডিজিটাল ডিভাইডের আগের সব প্রেমকে মনে হবে আজ সেপিয়া রঙে আঁকা। আমার বারো বছরের মেয়ে যখন ডিডিএলজে ( দিলওয়ালে দুলহনিয়া ইত্যাদি ইত্যাদি) তে, শাহরুখের সঙ্গে রাত কাটানো নিয়ে কাজলের জড়তার গপ্পো দেখে হেসে ফেলে বলবে, মা, নব্বই সালের পরেও এরকম গাধার মত বোকা বোকা প্রেমের গল্প বানান হত?  তখন বুঝি ডিজিটাল ডিভাইডের পরবর্তী প্রজন্মরা কেবল টিভির তেয়াত্তর চ্যানেল, বেওয়াচ, কার্টুনের যৌনতা, সব প্যাকেজ করা অবস্থায় অডিও ভিসুয়ালি পেয়ে গিয়েছে, তাই অদের কাছে প্রেম=যৌনতার সমীকরণে কোন আধো আধো কথা নেই। বাধো বাধো ভাব নেই।  

    এখন আমাদের ১৮-তে যা যা হত, সেগুলো ১৩-তে হয়। ১৫ বরাবর এসে ছেলেমেয়েরা এক্সপ্লোর করে ফেলে চুম্বন-আলিঙ্গন ইত্যাদি আমাদের ডিকশনারির অসভ্য শব্দ। আমাদের অশ্লীলের সংজ্ঞাগুলো সব পাল্টে গিয়ে এখন জলভাত হয়ে গেছে ছবির যুগে। যাবতীয় চিত্রায়ণে বিস্ময়বোধ হাওয়া। কেউ আর অবাক হয় না কোনকিছুতে।

    তবে এখন, এখনই কোনো এক পাড়ায় একটি মেয়ে একটি ছেলেকে একসঙ্গে গল্প করতে দেখে, পাড়ার লোক এসে ঠ্যাঙানি দেয়, কারণ সেটা নাকি ভদ্দরলোকের পাড়া, বেলেল্লাপনা নাকি সেখানে চলবে না।  খবরের কাগজে এই খবর পড়ে ভাবি, দেশটা আগু হইল না পাছু হইল!

     
     



    Tags
     



    Comments (3)

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics