সুন্দরবন অঞ্চলের নারী প্রগতি, নারীর ক্ষমতায়ন ও বীণা কাঞ্জিলাল
3 620নারীর আত্মনির্ভরতা, সবল ও সচেতন অস্তিত্বের বিকাশ যদি নারী প্রগতি ও নারীর ক্ষমতায়নের মূল লক্ষ্য হয়ে থাকে—তবে বীণা কাঞ্জিলালকে(১৯৩৫-১৯৯৭)স্বাধীনতা-উত্তর সুন্দরবন অঞ্চলে নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী প্রগতি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ বলা যেতে পারে৷
স্বাধীনতার আগে সুন্দরবন অঞ্চলের গ্রাম-উন্নয়ন, শিক্ষাবিস্তার, নারী ও শিশুশিক্ষা, নারী প্রগতি, দারিদ্র্য-দূরীকরণ, জনস্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে ঔপনিবেশিক শাসকরা তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। [আশ্চর্যরকম ব্যতিক্রম ছিল স্যর ড্যানিয়েল হ্যামিলটনের (১৮৬০-১৯৩৯) কিছু প্রকল্প এবং তাঁর পল্লিচিন্তা ও সমবায় ভাবনার কয়েকটি দিক৷] স্বাধীনতার পরবর্তী দু-দশকেও সুন্দরবন অঞ্চলের চিত্রটা বিশেষ বদলায়নি৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) পল্লি-উন্নয়ন ভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী পান্নালাল দাশগুপ্ত ও জয়প্রকাশ নারায়ণ (১৯০২-১৯৭৯) ‘টেগোর সোসাইটি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ পরবর্তী পাঁচ দশক ধরে পূর্বভারতের তিনটি রাজ্যে (পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড) এই সংগঠন গ্রাম-উন্নয়নের বহুবিধ কাজ করে চলেছে৷ উক্ত সংগঠনের পশ্চিমবঙ্গের তিনটি শাখা(রাঙাবেলিয়া প্রজেক্ট, সাগর প্রজেক্ট, হিঙ্গলগঞ্জ প্রজেক্ট)-র হাত ধরে ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে সুন্দরবন অঞ্চলের গ্রাম-উন্নয়ন, দারিদ্র্য-দূরীকরণ, জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষাবিস্তারের পুরানো চিত্রটিও৷ সক্রিয় বামপন্থী রাজনীতি থেকে সরে এসে ততদিনে গ্রাম-উন্নয়নের লক্ষ্যে শ্রীতুষার কাঞ্জিলাল (জন্ম. ১৯৩৫)হয়ে উঠেছিলেন ‘টেগোর সোসাইটি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট’-এর কর্ণধার৷ এই সংগঠনের অন্যতম প্রধান ইউনিট হল ‘মহিলা সমিতি৷’
সুন্দরবন অঞ্চলের মহিলাদের আত্মনির্ভরতা, লিঙ্গবৈষম্য, পণপ্রথার বিলোপসাধন, বধূ-নির্যাতন ও নিরক্ষরতা দূরীকরণের লক্ষ্যে বীণা কাঞ্জিলাল ১৯৭৬ সালে ‘রাঙাবেলিয়া মহিলা সমিতি’ গঠন করেছিলেন৷ নারীবাদ-জেন্ডার-ক্ষমতায়ন নিয়ে কোনো রকম তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের দিকে না গিয়ে বীণা দিদিমণি সুন্দরবনের প্রান্তিক অঞ্চল থেকে শত শত নির্যাতিতা মহিলা, বিধবা, ব্যাঘ্র-বিধবা ও নিরক্ষর মহিলাদের হাতে-কলমে কাজ শিখিয়ে মাথা উঁচু করে মানুষের মতো বাঁচতে শিখিয়ে ছিলেন৷
এই বিষয় নিয়ে পড়াশুনো ও তথ্যসংগ্রহের কাজে রাঙাবেলিয়াতে গিয়ে ‘মহিলা সমিতি’র বর্তমান সম্পাদিকা শ্রীমতী প্রতিমা মিশ্রের সঙ্গে যখন কথা বলি, তখন সতত বিনয়ে তিনি বলেছিলেন “বীণা কাঞ্জিলাল সুন্দরবনের সবার দিদিমণি নন, উনি অনেক মেয়েদের মা৷” (৩১ আগস্ট ২০১৭, প্রতিমা মিশ্রের সঙ্গে কথোপকথন)৷ ‘মহিলা সমিতি’র বর্তমান কার্যকরী সমিতির অন্যান্য সদস্যা যারা উপস্থিত ছিলেন, তারাও সকলে সে কথা স্বীকার করেছিলেন৷ গৌরীদি, লক্ষ্মীদি, রীনাদি, সাবিত্রীদি, সুশীলাদি, প্রতিমাদি, পার্বতীদিরা সেদিন সম্মিলিত ভাবে জানিয়েছিলেন—তারা যে আজ স্ব-নির্ভরশীল হতে পেরেছেন, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন, নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়েই কাজ করতে পারছেন—এ সবই তারা পেয়েছিলেন বীণা দিদিমণির কাছ থেকে৷ এটা বাস্তব যে, কালান্তরে বীণা কাঞ্জিলাল হয়ে উঠেছিলেন এদের অনেকেরই সত্যিকারের মা৷ মহাশ্বেতা দেবী সে জন্যেই হয়তো লিখেছিলেন:
“সে কিন্তু এক বিশাল সংসারের অধীশ্বরী৷ শুধু তো নিজের স্বামী সন্তান নিয়ে তার সংসার ছিল না৷ রাঙাবেলিয়াতে তার মস্ত বড় সংসার৷ সেটাও বীণা বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়েই গড়েছিল৷”
(সূত্র: ‘সব শূন্য স্থান পূর্ণ করা যাবে না’—মহাশ্বেতা দেবী, স্মরণে, মে ১৯৯৭, পৃ. ১৭)
উল্লেখ্য বীণা কাঞ্জিলালের মৃত্যুর পর ‘রাঙাবেলিয়া মহিলা সমিতি’র সভানেত্রী হিসেবে মহাশ্বেতা দেবী কিছুকাল (১৯৯৭-২০০৯) ‘টেগোর সোসাইটি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট’ সংক্ষেপে টি. এস. আর. ডি-র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷
ছাত্র আন্দোলন ও জেল-জীবনের দিনগুলি
বীণা সেন চৌধুরী ছিলেন বর্ধমানের হরিসভা বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী৷ এইট-নাইনে পড়ার সময় থেকেই বীণা কমিউনিস্ট আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন৷ তখন থেকেই সাম্যবাদের ভাবাদর্শে দীক্ষিত হয়ে বিনয় চৌধুরী, হরেকৃষ্ণ কোঙার প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সান্নিধ্যে আসেন৷ বর্ধমান শহর জুড়ে তখন বাস্তুহারা আন্দোলন, দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলন চলছে—পাঁচের দশকের উত্তাল সময় ও কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র আন্দোলনের সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের যুগে বীণা ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন অগ্নিবর্ষিণী বক্তা, ভাল পোস্টার লিখিয়ে থেকে অকুতোভয় ছাত্রী সংগঠক৷
শ্রীমতী শিবরাণী মুখোপাধ্যায় (সভানেত্রী) ও সামসুন্নেমা বিবি (সম্পাদিকা), বিভা কোঙার, রেবা মল্লিক, জ্যোৎস্না সেনগুপ্ত, লীনা সেন, রাবিয়া, মোকসেদা প্রমুখ বামপন্থী নারীদের প্রচেষ্টায় বর্ধমান জেলায় গড়ে উঠেছিল ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’৷ সে সময় মণিকুন্তলা সেন সাংগঠনিক কাজে বেশ কয়েকবার বর্ধমানে গিয়েছিলেন৷ বন্যা কবলিত গ্রামে রিলিফ বন্টন থেকে কালোবাজারি ও মজুতদারির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলাই ছিল ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’র অন্যতম কাজ৷ কিশোরী বীণা সেই সংগঠনের হয়ে কাজ করতেন৷ পরবর্তীকালে ‘রাঙাবেলিয়া মহিলা সমিতি’ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বর্ধমান ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’র মডেল ও ভাবাদর্শ বিশেষ ভাবে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল৷
বর্ধমানের কুণ্ডুপুকুরের পাড়ে বঙ্কিম সেনচৌধুরীর বাড়িটিই ছিল বামপন্থী ভাবাদর্শের একটি কেন্দ্র৷ বর্ধমানের তরুণ কমরেডরা সেখানে নতুন কর্মপন্থা ঠিক করার জন্য, অথবা আড্ডা, তর্কের জন্য প্রায়ই সমবেত হতেন—তার মধ্যে ছিলেন কবি তরুণ সান্যাল, তুষার কাঞ্জিলাল, সৈয়দ আলী ইমাম, নীলকৃষ্ণ সেন, নারায়ণ রায়, দেবাশিষ সেনগুপ্ত, মহাতাবউ্দ্দীন প্রমুখ৷ এদের সকলেই ছিলেন তরুণ কমিউনিস্ট ছাত্রদের ‘সেল’ সদস্য৷ ব্যতিক্রম তুষার কাঞ্জিলাল, তিনি ছিলেন রাজ কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, আর. এস. পি.র ছাত্র-সংগঠন ‘প্রগ্রেসিভ স্টুডেন্টস ইউনিয়নে’র ছাত্র-নেতা৷ ততদিনে বীণা হয়ে উঠেছেন ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের নেত্রী এবং বর্ধমান মহিলা কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদিকা৷
১৯৪৮ সালের ২৬ মার্চ কমিউনিস্ট পার্টি পুনরায় বে-আইনি ঘোষিত হয়েছিল৷ বিনয় চৌধুরী, হরেকৃষ্ণ কোঙার, সুবোধ চৌধুরীরা তখন আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়েছিলেন৷ ১৯৪৯ সালে বর্ধমানের কৃষ্ণসায়রের পাড়ে একটি বাড়িতে পার্টির গোপন মিটিং-এর সময় পুলিশি অভিযান চলেছিল৷ হরেকৃষ্ণ কোঙার পালাতে সক্ষম হলেও বীণা সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন৷ সে সময় তাঁকে কিছুদিন কারাবাস করতে হয়েছিল৷
১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে ছাত্র-ফেডারেশন বে-আইনি ঘোষিত হলে—বর্ধমানের তরুণ ছাত্রনেতারা নানাবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন৷ রাস্তার মোড়ে মোড়ে সভা, রবীন্দ্র জন্ম-উৎসব, নজরুল জন্ম-জয়ন্তী পালন প্রভৃতি৷ সে সময় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্মদিন পালন করাও ছিল বে-আইনি৷ সেরকমই একটি সভার উদ্যোগ নেওয়াতে ১৯৫০ সালের জুন মাসে তরুণ সান্যাল ও বীণা সেনচৌধুরী সহ চোদ্দ জন ছাত্রনেতা গ্রেপ্তার হন৷
বক্সা ক্যাম্প থেকে প্যারোলে এসে ১৯৫২-র সাধারণ নির্বাচনে বিনয় চৌধুরী বর্ধমান থেকে এবং আত্মগোপন অবস্থায় সুবোধ চৌধুরী কাটোয়া থেকে দাঁড়ান এবং জয়লাভ করেন৷ বর্ধমানের রাজাকে হারিয়ে বিনয় চৌধুরীর জেতানোর কাজে বীণা ছিলেন প্রথম সারির কর্মী৷ ছাত্র আন্দোলন থেকে পার্টির রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বীণার অকুতোভয় উপস্থিতি ও ঐকান্তিকতা প্রসঙ্গে বিনয় চৌধুরী লিখেছিলেন:
“পার্টি ১৯৪৮ সালে ২৬শে মার্চ বে-আইনি হয়৷ আমাদের অনেকে গ্রেপ্তার হয়৷ আমি, হরেকৃষ্ণ কোঙার, সুবোধ চৌধুরী প্রভৃতি আত্মগোপন করি৷ ১৯৪৯ সালে কৃষ্ণসায়রের পাড়ে, দমকলের কাছাকাছি একটা বাড়িতে পার্টির গোপন মিটিং হচ্ছিল৷ ওই মিটিং-এ হরেকৃষ্ণ গোপনে এসেছিল৷ পুলিশ কোনও সূত্রে হয়ত খবর পেয়ে বাড়ি ঘিরে ফেলে৷ হরেকৃষ্ণ কোনরকমে পালিয়ে যায়, বীণা সমেত অন্যরা গ্রেপ্তার হয়৷ এদের কিছুদিন কারাবাস করতে হয়৷
১৯৫২ সালে বক্সা ক্যাম্প থেকে প্যারোলে এসে আমি নির্বাচনে দাঁড়াই৷ তারপর আবার প্রকাশ্যে কাজে যুক্ত হই৷ ১৯৫২ সালে আমি বর্ধমান থেকে এবং সুবোধ চৌধুরী কাটোয়া থেকে (আত্মগোপন অবস্থায়) নির্বাচনে জিতি৷ এরপর প্রতিবছর শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন মাসে খাদ্য আন্দোলন করতে হত প্রধানত দুঃস্থদের জন্য G.R. এবং কর্মহীনদের জন্য T.R.-এর দাবিতে ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য দাবি৷ এই খাদ্য আন্দোলনে ৩/৪ মাস করে জেল খাটতে হত৷ বীণাকে ২/৩ বার জেলে এই সূত্রে যেতে হয়েছে৷ এছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে হরতাল ডাকা হলে—তা সফল করতে আমাদের পিকেটিং করতে হত৷ আমার মনে আছে, ১৯৫৩ অথবা ১৯৫৪ সালে কার্জন গেটের কাছে D.S.P.-র Jeep গাড়ি আমাদের আটকাতে হয়েছিল৷ বীণাও অন্যদের সঙ্গে এখানে ছিল৷ Tear Gas ছোঁড়া হয়৷ আমি সকলের সাথে Jeep-এর সামনে বসে থাকায় সকলের সাহস বাড়ে৷ ইতিমধ্যে D.M, S.P এই খবর পান, তাঁরা বুঝলেন এখানে জেদাজেদি করলে ভয়ানক অবস্থা হতে পারে৷ কারণ তখন প্রায় ১০০০ এর ওপর মানুষ জড়ো হয়ে গেছে৷ D.M-এর নির্দেশে Jeep ঘুরিয়ে নিয়ে D.S.P ফিরে যান৷ সকলে জয়ের আনন্দে স্লোগান দিতে থাকে৷ রেল ধর্মঘটের সময়ে রেল কর্মচারীদের স্ত্রী-রা কালনা রোডের ক্রশিং-এর কাছে শুয়ে পড়েন৷ খবর পেয়ে আমি যাই, বীণা, রেবা লাহিড়ী প্রভৃতি আমার সাথে যায়৷ সেখানেও শেষ পর্যন্ত রেল চালাতে পারেনি৷ পরে, মেয়েদের ও আমাকে গ্রেপ্তার করে৷ এই ধরনের বহু ঘটনার ভিতর দিয়ে, বীণার সাহস ও ঐকান্তিকতার পরিচয় বার বার পেয়েছি৷”
(সূত্র: ‘বীণা কাঞ্জিলাল স্মরণে’—বিনয় চৌধুরী, স্মরণে, মে ১৯৯৭ পৃ. ১৪)
প্রাথমিক পরিচয়ে বীণা সেনচৌধুরী ছিলেন অত্যন্ত সক্রিয় বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী৷ বাম আন্দোলনের সূত্র ধরেই তরুণ ছাত্রনেতা শ্রীতুষার কাঞ্জিলালের সঙ্গে তাঁর পরিচয়৷ ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৬০ তাঁদের বিবাহ হয়৷ বিয়ের পরে বীণা সেনচৌধুরী হয়ে গেলেন বীণা কাঞ্জিলাল- এনামেই তাঁর সর্বাধিক পরিচিতি। ১৯৬৭ সালের ১ জানুয়ারি তুষারবাবু রাঙাবেলিয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেন৷ বীণা কাঞ্জিলাল তখন নাকতলা হাইস্কুলের শিক্ষিকা৷ কয়েক মাস পরে নাগরিক জীবনের সমস্ত স্বাচ্ছন্দ্যকে উপেক্ষা করে দুই কন্যা এক পুত্রকে নিয়ে রাঙাবেলিয়া চলে আসেন৷ মনে রাখতে হবে ’৬৭-র রাস্তাহীন, বিদ্যুৎহীন, নলকূপহীন, হাটবাজার-হাসপাতালহীন রাঙাবেলিয়া তখন অজ-পাড়াগাঁ৷ ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের পয়লা জুলাই বীণা কাঞ্জিলাল শিক্ষিকা হিসেবে রাঙাবেলিয়া হাইস্কুলে যোগদান করেন৷ ১৯৬৭-১৯৮৪ দীর্ঘ সতেরো বছর তিনি সেখানে শিক্ষকতা করেন৷ ‘রাঙাবেলিয়া মহিলা সমিতি’কে কেন্দ্র করে এই কালপর্বে সুন্দরবনের প্রান্তিক মহিলাদের নিয়ে বীণা কাঞ্জিলাল নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী প্রগতি আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন৷
‘মহিলা সমিতি’ ও তার বহুমুখী কর্মপরিকল্পনা
‘টেগোর সোসাইটি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট’ সার্বিক গ্রামোন্নয়নের লক্ষ্যে আজ যে সাফল্য অর্জন করেছে, সেই কৃতিত্বের পিছনে বীণা কাঞ্জিলাল ও তাঁর উদ্যোগে গঠিত ‘রাঙাবেলিয়া মহিলা সমিতি’র ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ আমাদের পুরুষশাসিত সমাজে মহিলারা সবসময় অবহেলিত থেকে গেছে৷ মহিলাদের আত্মনির্ভরতার পাশাপাশি, তাদের সুপ্ত প্রতিভা এবং সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশের সুযোগ করে দেবার জন্য বীণা কাঞ্জিলাল তাদেরকে সংগঠিত করার কথা ভেবেছিলেন৷ নিজের সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পাশাপাশি প্রতিটি মহিলা যাতে লিঙ্গবৈষম্য, পণপ্রথা, বধূ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে—হাতে কলমে কাজ শেখানোর পাশাপাশি‘মহিলা সমিতি’ তাদেরকে সেই পাঠটাও দিয়েছিল৷
‘মহিলা সমিতি’র শুরুর শুরুটা আমরা জেনে নিতে পারি বীণা কাঞ্জিলালের লেখা তাঁরই একটি আত্মজীবনী মূলক গদ্য থেকে:
“পেশায় শিক্ষিকা ছিলাম৷ চৌদ্দজন পুরুষের মধ্যে একমাত্র মহিলা৷ সবার বৌদি৷ গাঁয়ের মা-বোনেরা আড়চোখে তাকাতেন৷ সামনে পড়লে ঘোমটা টেনে দিতেন৷ বোধহয় আমাকে আধা পুরুষ বলেই ভাবতেন৷
স্কুলে ছেলেমেয়ে এক সঙ্গে পড়ে৷ উঁচু ক্লাসের মেয়েগুলির মা হয়ে গেলাম, কিছু মেয়ে বড় কাছে চলে এল৷ আমার বাড়িই তাদের প্রায় খাওয়া থাকার জায়গা হয়ে গেল৷ ছোট বেলায় বিনয় চৌধুরী, হরেকৃষ্ণ কোঙার—এরা গুরু ছিলেন৷ পাগলামির বীজ মাথায় বুনে দিয়েছিলেন৷ মেয়েগুলিকে দেখে মনে হল এদের নিয়ে পাগলামি করা যায়৷ . . .
. . . মেয়ে বলেই গাঁয়ের বৌ-ঝিদের সঙ্গে ধীরে ধীরে আলাপ জমতে শুরু করল৷ আদিবাসী পাড়া থেকে মাঠ ভেঙে হাঁটছি৷ সঙ্গে দুই দেহরক্ষী কন্যা৷ বাচ্চা ছেলের চিৎকারে থমকে দাঁড়াতে হল৷ মা সন্তানকে মারছেন৷ ছেলের বয়স সাত কি আট৷ বুকের হাড় সবকটা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে৷ হাড় গুনে শতকিয়া শেখা যায়৷ ঝামেলাটা কি বুঝতে এগিয়ে গেলাম৷ ছেলেকে এক বাড়িতে রাখাল খাটতে রাখা হয়েছে৷ ছেলে কাল রাতে পালিয়ে এসেছে আর ওখানে যাবে না৷ তাই শাসন৷ ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ‘গরিবের ঘরে জন্মেছিস, তোকে তো খেটেই খেতে হবে৷’ ছেলেটি নিষ্পাপ—তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে জরিপ করে নিয়ে বলল, ‘খাটব না তো বলিনি৷ তবে ও বাড়িতে নয়৷ অন্য বাড়ি হলে খাটব৷ ও বাড়িতে পেটভরে খেতে দেয় না—মারে!’ মা চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘মিছে কথা সব৷ ও বাড়িতেই তোকে যেতে হবে৷’ উত্তরে শিশুটির মুখে অত্যাচারিত আহত পশুর রুখে দাঁড়াবার দুর্লভ ছবি দেখতে পেলাম৷ চিৎকার করে উঠল, ‘যেতে বলবেই তো ও বাড়িতে৷ আমাকে দিয়ে দু-বস্তা ধান আগাম দাদন নিয়ে খেয়ে বসে আছে যে?’ শহুরে জীবনে সন্তান নিয়ে অনেক আদিখ্যেতা দেখেছি৷ আজও দেখছি ছেলে জন্মাল না কি রাজপুত্র এল বোঝা মুশকিল৷ আব্দার দরকার হয় না, একটার জায়গায় দশটি না দেওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই৷ সন্তান ঘিরে সব মায়ের স্বপ্ন থাকে৷ শহরে মনে হয় সে স্বপ্ন বাহুল্যের চাপে চাপা পড়ে৷ আর এখানে দেখলাম—সম্পূর্ণ স্বপ্নহীন একজন মা শুধু দিনযাপনের, শুধু প্রাণধারণের গ্লানি সইতে—বইতে ক্লান্ত মা৷ স্নেহ-প্রীতি-স্বপ্নের জায়গা সেখানে নেই৷
মনে একটা প্রচণ্ড নাড়া খেলাম৷ এদের কি স্বপ্ন দেখানো সম্ভব?
(সূত্র: ‘আশ্রয়ের খোঁজে’: বীণা কাঞ্জিলাল, স্মরণে, মে ১৯৯৭, পৃষ্ঠা. ৪-৫)
রাঙাবেলিয়া, পাখিরালয় আর জটিরামপুর—রাঙাবেলিয়া দ্বীপের এই তিনটি গ্রামের মোট পঁয়ত্রিশ জন সদস্যা নিয়ে ‘মহিলা সমিতি’র কাজ শুরু হয়েছিল৷ বর্তমানে সুন্দরবন অঞ্চলের ৩০০টি গ্রামে মোট ৬০১১ জন সদস্যাদের নিয়ে ‘মহিলা সমিতি’র বহুমুখী কর্মপরিকল্পনা সম্প্রসারিত ও বাস্তবায়িত হয়ে চলেছে৷ গড়ে তোলা হয়েছে ‘রাঙাবেলিয়া মহিলা ইণ্ডাস্টি্রয়াল কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’৷সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা, দায়িত্ব বন্টন ও ট্রেনিং-এর মাধ্যমে ‘মহিলা সমিতি’র বিবিধ কর্মপরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করা হচ্ছে৷ ‘টেগোর সোসাইটি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট’, রাঙাবেলিয়া প্রজেক্ট ২০১৫-১৬ আর্থিক বছরের বাৎসরিক রিপোর্টে ‘মহিলা সমিতি’র ‘বিভাগীয় পদক্ষেপ’ হিসেবে এগারোটি বিষয়ের উল্লেখ দেখতে পাই:
১. ‘মহিলা সমিতি’র সদস্যাকরণ৷
২. স্বল্প সঞ্চয়ের দল (২২১টি) গঠন করে স্বনির্ভর করা৷
৩. বিভিন্ন বিষয়ে মহিলাদের সচেতনী সভার মাধ্যমে সচেতন করা৷
৪. দুঃস্থ ও স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাদের আত্মনির্ভরশীল করা৷
৫. শিক্ষার প্রসার ঘটানো৷
৬. ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, রোগ প্রতিরোধ, নিরাপদ মাতৃত্ব, শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নিরাপদ পানীয় জল, সামাজিক অর্থনৈতিক ও সুন্দরবনের মৌলিক সমস্যা বিষয়ে সচেতন করা৷
৭. পণপ্রথা, বধূ নির্যাতন, লিঙ্গ-বৈষম্য ও অন্যান্য সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগঠিত করা৷
৮. সমাজে মহিলাদের আইনি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া৷
৯. মহিলা সম্মেলন করা৷
১০. স্বনির্ভরশীল প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ৷
১১. সুন্দরবনের মধু সরবরাহ৷সংসারের সমস্ত কাজ করার পাশাপাশি সুন্দরবনের দ্বীপবাসী মহিলারা স্বামীর সঙ্গে খেত-খামারের কাজ, নদীতে বাগদা-র মীন ধরার কাজ—সব কিছুতেই পটু৷ বেঁচে থাকার তাগিদে সব রকমের কাজ তাদের শিখতে হয়েছে৷ ‘রাঙাবেলিয়া মহিলা সমিতি’ সুন্দরবন অঞ্চলের প্রান্তিক, পিছিয়ে পড়া সেইসব মহিলাদের জীবন সংগ্রামের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের‘বেঁচে থাকা’-কে আর একটু সহজ করে তুলতে চেয়েছে৷ একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে—বিগত একশ বছর ধরে সুন্দরবন অঞ্চলে রান্নার জ্বালানি হিসেবে খড় ও গাছের শুকনো ডাল-পাতা ব্যবহৃত হয়ে আসছে৷ বর্ষার সময় কাঠ ও ঘুঁটে৷ মাটির উনুনে সেইসব জ্বালানি ব্যবহার করে ভাত-তরকারি রান্নার সময় প্রচুর ধোঁয়া বেরুতে থাকে৷ সেইসব ধোঁয়ায় সুন্দরবন অঞ্চলের মা বোনেদের প্রাণ ওষ্ঠাগত৷ আগুন নিভে গেলে চোঙায় ফুঁ দিয়ে উনুনে ফের আগুন জ্বালাতে গেলে চোখের জ্বলুনি যায় বেড়ে৷ দীর্ঘদিন ধরে এই প্রক্রিয়া চলার ফলে সুন্দরবনের দ্বীপবাসী মহিলাদের দুটি চোখই খারাপ হয়ে যেত৷ নয়ের দশকের প্রথম থেকে ‘টেগোর সোসাইটি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট’ ও ‘রাঙাবেলিয়া মহিলা সমিতি’র উদ্যোগে সুন্দরবন অঞ্চলে মাটির উনুনের সঙ্গে পাইপ বসিয়ে ধোঁয়াকে রান্নাঘরের বাইরে বের করে দেবার একটি প্রকল্প শুরু হয়৷ জোড়া উনুনের মাঝখানে এই পাইপ বসানোর ফলে কালো ধোঁয়ার বেশিরভাগটাই চলে যেত রান্নাঘরের বাইরে৷ এর ফলে রান্নাঘরের চাল নোংরা হবার হাত থেকে যেমন বাঁচল, তেমনি মহিলারাও রক্ষা পেলেন বিষাক্ত ধোঁয়ার থেকে৷ সুন্দরবন অঞ্চলের দ্বীপভূমিতে প্রতিটি বাড়িতেই এই ব্যবস্থাটি রয়েছে৷ শেষ ২-৩ বছর সম্পন্ন গৃহস্থ বাড়িতে রান্নার গ্যাসের প্রচলন শুরু হলেও, পূর্বতন ব্যবস্থাটি প্রভূত কার্যকারী বলে এখন সমানভাবে গ্রহণীয়৷
‘সংস্কৃতি সংসদ’ আর বেঁচে থাকার গান
‘টেগোর সোসাইটি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট’-এর রাঙাবেলিয়া প্রজেক্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হল ‘সংস্কৃতি সংসদ’৷ বীণা কাঞ্জিলাল ছিলেন এই ‘সংস্কৃতি সংসদে’র উদ্যোক্তা৷ দ্বীপবাসী মানুষদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মানসিক ও আত্মিক বিকাশ ঘটানোর লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালে এই ‘সংস্কৃতি সংসদ’ গড়ে ওঠে৷ উপযুক্ত প্রশিক্ষকের অভাবে গান, আবৃত্তি, নৃত্য, নাটক শিক্ষার ব্যাপারে তেমন কোনো আগ্রহ সুন্দরবন অঞ্চলে ছিল না৷ তবে সুন্দরবনের লোকায়ত সংস্কৃতির ধারাটি প্রবহমান ছিল৷ বীণা কাঞ্জিলাল নিজে ছিলেন একজন দক্ষ গীতিকার৷ সুন্দরবনের জেলেজীবন, চাষীজীবন, জমির কথা, শিশু-কিশোরী ও নারীর অবস্থান নিয়ে গান লিখে বীণা কাঞ্জিলাল নিজেই সুর দিতেন৷ সুন্দরবনের আঞ্চলিক সংস্কৃতির পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা ও নিজের লেখা গান দিয়ে সুন্দরবন অঞ্চলের বিশেষত মেয়ে ও শিশুদের প্রশিক্ষিত করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন৷ ফলে লোকায়ত সংস্কৃতির চর্চার পাশাপাশি তাদের জীবনের সঙ্গে সম্পৃ্ক্ত গানের মধ্য দিয়ে দ্রুত সুন্দরবন অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটতে থাকে৷
“এই লাঙ্গল চালাই, এই কোদাল চালাই (২)
মাটিকে দেই প্রাণ,
এই লাঙ্গল ফলাতে গাই নয়াদিনের গান
ভাইরে নয়া দিনের গান৷
... ... ...
জলে ভিজে রোদে পুড়ি
বীজ ছড়াই মাঠে
আমার বাছারা যেন থাকে দুধে ভাতে
ভিজে মাটি মোদের সাথী
সন্ধ্যে সকাল কাটে
এই সোঁদা মাটির গন্ধে মোদের
নেচে ওঠে প্রাণ
এই লাঙ্গল ফলাতে গাই নয়াদিনের গান৷”(উদ্ধৃত গানটি‘সংসদের গানের ডায়েরি’ থেকে নেওয়া)
সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের যাপিত জীবনের সত্য বীণা কাঞ্চিলালের গানের সুরে এভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছিল৷ ধীরে ধীরে সে গান তাদের কাছে হয়ে উঠেছিলবেঁচে থাকার গান৷ সুন্দরবনের মাটির সুর আর গণসংগীতের সুর তখন মিলে গিয়েছিল একসুরে৷
“একটি ফসল নয় নয় নয়
নোনা মাটি কেঁদে কয়
তাইতো হয় পরাজয়
ক্ষুধার তরে মরণ হয়৷(ছেলে)জমি ছিল পরের হাতে
ফিরিয়ে পেলাম তাই
(মেয়ে)হারিয়ে যাওয়া মাকে পেয়ে
দুঃখ ভুলে যাই মোরা
দুঃখ ভুলে যাই৷
সার, ঔষধ, বীজ জলে
পূজা করি মাকে
ফুলে ফলে মাঠ ভরিয়ে
মা যে ডেকে কয়
নয় . . . নয় . . . নয় . . .
তাই সবাই মিলে ঠিক করেছি ভাই
দুটি ফসল এই জমিতে তুলতে মোরা চাই৷
প্রতিযোগীর মন্ত্র ভুলে যাই
(কোরাস) সহযোগীর শত্রু মাটি গর্জে ওঠে ভাই
(মেয়ে)দুটি নয়, তিনটি ফসল
এই জমিতে করবো সফল
(ছেলে)মাটি মা ডাক দিয়ে তাই কয়
নয় . . . নয় . . . নয় . . .
একটি ফসল . . . . . . নয় নয় নয়৷”আত্মপ্রত্যয়হীন সুন্দরবন অঞ্চলের প্রান্তিক চাষীভাইদের কাছে বীণা কাঞ্জিলালের কথা-সুরের এইসব যূথদল আক্ষরিক অর্থে হয়ে উঠেছিল—বেঁচে থাকার গান৷ পর্যাপ্ত মিষ্টি জলের অভাবে সুন্দরবনের সেচ ব্যবস্থা কোনোদিনই ভালো ছিল না—সাতের দশকে গানের মধ্যে দিয়ে বীণা কাঞ্জিলাল নুন সমৃদ্ধ সুন্দরবনের এক ফসলি জমিকে দু-ফসলি করতে পেরেছিলেন৷ স্যালোর সাহায্যে জল তুলে দ্বীপভূমির জমিতে চাষ-আবাদ করা যায় না৷ পুকুর, খাল, ডোবায় জমে থাকা বৃষ্টির জল দিয়ে বোরো ধানের চাষ করে দু-ফসল ঘরে তোলার স্বপ্ন সুন্দরবনের দ্বীপবাসী মানুষদেরকে বীণা কাঞ্জিলালই দেখিয়েছিলেন৷ জমিকে মাতৃরূপে কল্পনা ভারতীয় ঐতিহ্য প্রসূত৷ মাদারকাল্টের সেই ধারণাকে তিনি সুন্দরবনের দ্বীপবাসী কৃষকদের জীবনচর্যার মধ্যে সত্য করে তুলেছিলেন৷ গানের কথার দিকে দৃষ্টি ফেরালেই বোঝা যায়—মাকে (জমি) সুন্দরবনের কৃষকেরা নতুন করে ফিরে পেয়েছে, সব দুঃখ ভুলে মাকে তারা নতুন করে চিনেছে৷ এক জমি থেকে দুটি ফসল ঘরে তুলতে সেদিন থেকে তাই তারা বদ্ধপরিকর৷ গানের সুরে সব কৃষকেরা তখন সুর মেলায়৷ প্রত্যয়ী চাষীরা তখন দুটি ফসল নয়, এক জমিতে তিনটি ফসল চায়৷ আমন ধান উঠে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তারা জমিতে বুনে দেন খেসারী বীজ৷ বোরো ধান লাগানোর আগে খেসারী ডাল উঠে যায়৷ কৃষি বিপ্লবের আহ্বান এভাবেই হাজার সম্ভাবনা নিয়ে থেকে যায় কথা আর সুরের খোলসের মধ্যে৷ একটি গানের মধ্যে৷
ইন্টারন্যাশন্যাল সি-লেভেল থেকে সুন্দরবনের দ্বীপভূমিগুলি দেড় মিটার নীচে, দ্বীপগুলি লোনা জলের খাড়ি বেষ্ঠিত—ফলে মাটিতে নুনের ভাগ খুব বেশি৷ সেই লোনা মাটিতে বীণা কাঞ্জিলাল সোনা ফলানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন তাঁর গানের সুরে:
“কর্মগুণে সোনা পাবি
লোনা মাটিতে
দেখবি যদি আয়রে ও-মন
থাকরে ও-মন মাটিতে ঐ মাটিতে
মাটি ছেড়ে যাসনা ও-মন
চেয়ে দেখ তোর হারানো ধন
ছড়িয়ে আছে সকল স্বপন
মাটির ওই মাঝেতে৷”সে সময় এ গানের সুর হয়ে উঠেছিল সুন্দরবনবাসীর প্রাণের সুর৷ চাষী যখন ফিরেছে মাঠ থেকে, চাষী বৌয়ের হাত যখন একটু খালি—তখন বীণা কাঞ্জিলাল তাদের দিয়ে এগান অনুশীলন করিয়েছেন৷ দূর দূর গ্রামে এভাবে গড়ে উঠেছে গানের দল৷ পাড়া মিটিংয়ে, ‘মহিলা সমিতি’র অনুষ্ঠানে আবার কখনো বা ‘টেগোর সোসাইটি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্টে’র বার্ষিক অনুষ্ঠানে, কখনো বা দিল্লিতে তিনি সেই সব গ্রাম্য শিল্পীদের দিয়ে অনুষ্ঠান করিয়েছেন৷
সংগীত, অভিনয়, নৃত্য ও আবৃত্তির প্রশিক্ষণ দিয়ে বীণা কাঞ্জিলাল তাদেরকে নিয়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতেন৷ সুন্দরবনের বিভিন্ন ব্লকে, স্কুলে আয়োজিত সভায় বা বিচিত্রানুষ্ঠানে আবৃত্তি, নৃত্য, সংগীত, নাটক, মুকাভিনয়, তরজা, পাঁচালি, কড়চার মাধ্যমে কখনো পণপ্রথা, বধূ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে; কখনো লিঙ্গবৈষম্য, সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে; আবার কখনো বা এক ফসলি জমি থেকে দু-ফসল ঘরে তোলার জন-সচেতনতা প্রচারই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য৷ স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন দিল্লির ‘গান্ধী পিস ফাউণ্ডেশনে’ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার অধিকার, পেয়েছেন ‘পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি পুরস্কার’৷ সুন্দরবনের দ্বীপভূমির মহিলাদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলার পাশাপাশি বীণা কাঞ্জিলালের নেতৃত্বাধীন ‘মহিলা সমিতি’ ও ‘সংস্কৃতি সংসদ’ নারী, শিশু ও প্রান্তিক মানুষদের সাংস্কৃতিক শিক্ষার দ্বারকে উন্মুক্ত করে দিতে পেরেছিল, পেরেছিল তাদের জীবনের গানকে তাদের প্রাত্যহিক জীবনে পৌঁছে দিতে৷
‘মহিলা সমিতি’র সাম্প্রতিক অবস্থা
নারী প্রগতি, নারীর ক্ষমতায়ন ও আত্মনির্ভরতার লক্ষ্য নিয়ে বিগত একচল্লিশ বছর ধরে ‘রাঙাবেলিয়া মহিলা সমিতি’ কাজ করে চলেছে৷ বীণা কাঞ্জিলাল ও শ্রীতুষার কাঞ্জিলালের ছোটো মেয়ে শ্রীমতী তানিয়া দাস এখন ‘মহিলা সমিতি’র সভানেত্রী৷ ২০০০ সাল থেকে সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করে আসছেন শ্রীমতী প্রতিমা মিশ্র৷ কার্যকরী সমিতির অন্যান্য সদস্যারা হলেন—শ্রীমতী গৌরী খাটুয়া, শ্রীমতী লক্ষ্মী শাসমল, শ্রীমতী রীনা মণ্ডল, শ্রীমতী সাবিত্রী প্রধান, শ্রীমতী সুশীলা গায়েন, শ্রীমতী প্রতিমা শাসমল এবং শ্রীমতী পার্বতী শীট৷
আমাদের রাজ্যের ন’টি ব্লকে (গোসাবা, বাসন্তী, ক্যানিং-১, ক্যানিং-২, কুলতলী, সন্দেশখালি-১, সন্দেশখালি-২, হিঙ্গলগঞ্জ, সাগর) ‘মহিলা সমিতি’র সদস্যা সংখ্যা ৩০,০০০৷ গোসাবা ও বাসন্তী এই দুটি ব্লকেই সদস্যা সংখ্যা ১৫,০০০ হাজারের কিছু বেশি৷ সুনির্দিষ্ট সাংগঠনিক পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে সদস্যারাসারা বছর‘মহিলা সমিতি’র নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকেন৷ একটি সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে:
১. এপ্রিল ২০১৪ – মার্চ ২০১৫ বর্ষের কাজের খতিয়ান
ক. মহিলা দলের মিটিং– ৯০টি
খ. মহিলা সচেতনী সভা– ৬৯টি, উপকৃত– ৩৬০৯ জন
গ. আইন বিষয়ে প্রশিক্ষণ– ১টি, উপকৃত– ৭০ জন
ঘ. মহিলাদের অধিকার সংক্রান্ত মিটিং– ১১টি, উপকৃত– ৫০০ জন
ঙ. টেলারিং ট্রেনিং– ৩টি, উপকৃত– ১০ জন২. এপ্রিল ২০১৬ – মার্চ ২০১৭ বর্ষের কাজের খতিয়ান
ক. মহিলা দলের মিটিং– ৩৪টি
খ. মহিলা সচেতনী সভা– ৫৪টি, উপকৃত– ৩৪৩৪ জন
গ. মহিলাদের অধিকার সংক্রান্ত মিটিং– ১৩টি, উপকৃত– ৭২৮ জন
ঘ. গ্রামে কিশোরী-স্বাস্থ্য সংক্রান্ত মিটিং– ১৩টি, উপকৃত– ২২১ জন
ঙ. স্কুলে কিশোরী-স্বাস্থ্য সভা– ১৪টি, উপকৃত– ১০৬০ জন ছাত্রী(সূত্র: ‘টেগোর সোসাইটি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট’-এর বার্ষিক রিপোর্ট)
‘রাঙাবেলিয়া মহিলা সমিতি’র মধ্যে রয়েছে ‘উইমেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কো-অপারেটিভ সোসাইটি’ এবং ট্রেনিং কাম প্রোডাকশন সেন্টার৷ সেখানে টেলারিং বিভাগে ১২টি সেলাই মেশিন, নীটিং সেন্টারে ৯টি মেশিনে কাজ করা হচ্ছে৷ সমিতির মধ্যে প্রবেশ করলেই আপনি দেখতে পাবেন কোনো ঘরে চলছে মহিলাদের টেলারিং ট্রেনিং, কোনো ঘরে মহিলারা শিখছেন নীটিং অথবা উইভিং৷ আবার কোনো ঘরে চলছে ব্লক অথবা বাটিক প্রিন্টিং ট্রেনিং৷ ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল কো-অপারেটিভ সোসাইটি’তে আছে ২৫টি তাঁত৷ প্রান্তিক এই জনপদের দুঃস্থ মহিলারা প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ শিখে এখন প্রতি মাসে ২,৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত উপার্জন করছেন৷ কেউ কেউ কাজ করছেন স্বাধীনভাবে, আবার অনেকে যোগ দিয়েছেন ‘মহিলা সমিতি’র প্রোডাকশন সেন্টারে৷ ‘রাঙাবেলিয়া মহিলা সমিতি’, পাখিরালয় টাইগার মোড় ও সজনেখালি বিট অফিস—এই তিনটি বিক্রয় কেন্দ্র থেকে প্রোডাকশন সেন্টারে উৎপাদিত দ্রব্যাদি বিক্রি হয়৷ এছাড়া কলকাতা ও জেলা শহরের মেলায় ‘মহিলা সমিতি’ অংশগ্রহণ করে৷ শহরের বড়ো কোনো শোরুম বা প্রতিষ্ঠানের অর্ডার মাফিক মহিলা সমিতি তাদের হস্তশিল্প সাপ্লাই করে৷
‘মহিলা সমিতি’র সাম্প্রতিক অবস্থাটি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।
এক-আধটা কিংবদন্তী ও একটি ‘কবিতা’র পুনর্পাঠ
বন্দনা মাইতি৷ সুন্দরবন অঞ্চলের আরও দশটা প্রান্তিক মেয়ের থেকে তাকে হয়তো আলাদা করা যাবে না! যাবে নাকী? ১৯৬৭ সালে রাঙাবেলিয়া হাইস্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী ছিলেন বন্দনা৷ বীণা দিদিমণিকে নিয়ে তার একটা ছোট্ট লেখা আজ এতদিন পরেও আমাকে কাঁদিয়ে ছেড়েছে৷ সেই ব্যক্তিগত গদ্যে লিখেছিলেন তিনি:
“আমি যখন নবম শ্রেণীতে পড়ি তখন একদিন বাংলা প্রশ্নের উত্তর না পারায় ক্লাস রুমের দরজা বন্ধ করে দিদিমণি আমাকে মেরেছিলেন৷ সময়টা ছিল বাৎসরিক পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগে৷ এই ঘটনার এক সপ্তাহ পরে পরীক্ষার দিন স্কুলে গেলাম৷ প্রথম বেঞ্চে সিট পড়েছে৷ ভয়ে আমার বুক কাঁপছে৷ প্রশ্ন দেওয়ার পর দিদিমণি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন৷ সে বছর প্রথম হয়ে ছিলাম৷ . . .
. . . . . . দিদিমণি আমাকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমের দিকে জটিরামপুর, সর্দার পাড়ার মহিলাদের কাছে যান৷ তাঁরা কি করে সংসার চালান, তাঁদের আয়ের উৎস কি, এগুলি জানার পর গ্রামের মেয়েদের কাছ থেকে প্রস্তাব আসে—আমাদের পোষাক আমরা নিজেরাই বানিয়ে তার থেকে কিছু রোজগার করতে পারি৷ দিদিমণি সিদ্ধান্ত নিলেন একটা প্রোডাকশন সেন্টার খুলতে হবে৷ সেখানে গ্রামের গরিব পরিবারের মেয়েরা এসে কাজ করবে৷ ’৭৬ সালে কলেজের পড়া শেষ করে দিদিমণির ছাত্রী গৌরীদি, রীনা, সাবিত্রী, গঙ্গাদি, মলিনা, সবিতা, আমি এবং আরো অনেকে স্কুলে দোতলার একটা ছোট্ট ঘরে দিদিমণির সঙ্গে কাজ শুরু করি৷
. . . . . . দিদিমণি রোজই সকালে, কখনও দুপুরে ভাত, টিফিন খাইয়ে আমাকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামে বেরোতেন মেয়ে জোগাড় করার জন্য, যারা সেন্টারে এসে কাজ করতে পারবে৷ আমি প্রজেক্টের একজন কর্মী হিসেবে মাসিক ৫০ টাকা পেতাম৷ পরবর্তীকালে তা বেড়ে ১০০ টাকা হল৷ আমার পরিবার দিদিমণির কাছ থেকে অনেক সুযোগ পেয়েছে৷ আমার পিসিমাকেও ওনার বাড়িতে রেখে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন৷ আমরা কোনও অন্যায় করলে দিদিমণি শাসন করতেন৷ মেনে নিয়েছি৷ ‘শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে’৷’”
(সূত্র: ‘দিদিমণির সঙ্গে দিনগুলো’—বন্দনা মাইতি, স্মরণে, মে ১৯৯৭, পৃ. ৩১-৪০)
বয়সে আমার থেকে বড়, তাই বন্দনাদি বলব তাঁকে৷ তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়নি কিন্তু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তাঁকে৷ সুন্দরবন অঞ্চলের আরও দশটা মেয়ের থেকে তাঁর চেহারাটা আলাদা নয় যদিও,তবে গ্রীবাটা বেশ উঁচু করেই সমিতির সাইড ব্যাগ কাঁধে যেন হেঁটে যাচ্ছেন তিনি৷ ওই ছোট্ট লেখাটার মতো মাথা উঁচু করে বাঁচার জোরও তিনি পেয়েছিলেন তাঁর দিদিমণির কাছ থেকে৷
জটিরামপুরের মানুমণি সর্দার, গোলাপি সর্দার, সুশীলা সর্দার, দ্বিজবর, বিমলদের নিয়ে বীণা কাঞ্জিলাল নিজের লেখা গান, কবিতা বা নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করতেন৷ জেলে পাড়ায় গিয়ে জেলেদের ‘কড়চা’ রচনা করতেন৷ পাখিরালার শ্রীপতি কুমার দাস, প্রমথ বাউলিয়া, স্মৃতিকণ্ঠ রায়, লক্ষ্মী শাসমল, বীণা মণ্ডলদের তালিম দিয়ে মঞ্চস্থ করতেন নিজেরই রচনা ‘পণপ্রথার বিরুদ্ধে কড়চা’৷ এদেরকে নিয়ে কখনও পাড়ি দিয়েছেন কলকাতা, দিল্লি, আন্দামান, কখনো বা বাংলাদেশ৷ মনে রাখতে হবে সেই দলের অনেকেই সেবারই প্রথম কলকাতা দেখবে৷ দেখবে প্রথম রেলগাড়ি৷ রূপকথার সে এক আশ্চর্য সফর৷
টাকার অভাবে মেয়ের বিয়ে দিতে পারছেন না জটিরামপুর গ্রামের এক ক্ষুদ্রচাষী৷ ‘মহিলা সমিতি’ বা দিদিমণির কানে গেছে কথাটা৷ দক্ষিণ রাঙাবেলিয়া গ্রামের অমূল্য মণ্ডলের ছেলে ধরণি মণ্ডলকে রাজি করানো হয়েছিল৷ পণ না দিয়ে সমিতির পক্ষ থেকে ধুমধাম করে সেই মেয়েটির সঙ্গেধরণি মণ্ডলের বিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷
অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে গ্রামের মহিলারা স্বামীগৃহে মারধোর খেয়ে থানায় গেলে উল্টো ফল হয়, নির্যাতিত মহিলারা মহিলা সমিতিতে এসে যোগাযোগ করলে, সমিতির পক্ষ থেকে স্থানীয় পঞ্চায়েতের সঙ্গে কথা বলে অনেকবার সমাধান করার চেষ্টা হয়েছে৷ বর্তমান সম্পাদিকা প্রতিমা মিশ্র জানালেন, ‘মেয়েরাই কেবল আসে না, এখন ছেলেরা এসেও অভিযোগ জানায়৷’ যে বিষয়টা খেয়াল করার ডোমিস্টিক ভায়োলেন্স নিয়ে নারী-পুরুষ উভয়ের ভরসাস্থল ‘মহিলা সমিতি’৷
‘রাঙাবেলিয়া মহিলা সমিতি’র প্রথম থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সমস্ত মিটিং ও রেজ্যুলেশন বুক দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে৷ তা থেকে সমিতির অতীত, বর্তমানকে স্পষ্ট করে জানা যায়, জানা যায় মহিলা সমিতির বহুবিধ কাজের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের পদ্ধতিকে৷ কিন্তু যে ব্যাপারটা দেখে সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছি সেটা হল—বীণা কাঞ্জিলালের সভাপতিত্বে ২৫-০৭-১৯৭৮ তারিখে এবং বন্দনা মাইতির সভাপতিত্বে ১০-০৮-১৯৭৮ তারিখে ‘রাঙাবেলিয়া মহিলা সমিতি’র দুটি মিটিং অনুষ্ঠিত হয়েছিল৷ কার্যকরী সমিতির সদস্য ছাড়াও সেখানে সাধারণ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন৷ দুটি টিপসই দেখা যাচ্ছে৷ টিপসইগুলি যথাক্রমে মানুমণি সর্দার এবং যামিনী মাইতির৷ আশ্চর্য, পরের মিটিং-এ তারা উপস্থিত ছিলেন কিন্তু টিপ ছাপ দেননি৷ কাঁপা হাতে সই করেছিলেন৷ ছ’মাসের মধ্যে তারা সাক্ষর হয়ে উঠে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছিলেন৷ ‘মহিলা সমিতি’র অন্যান্য সদস্যদের মতো তারা তখন সই করে মিটিং-এ মতামত প্রকাশ করতেন৷
টি.এস.আর.ডি-তে এ পর্যন্ত যে সমস্ত বিশিষ্ট মানুষেরা পরিদর্শনে গিয়েছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—আর. ভেঙ্কটরামন (রাষ্ট্রপতি), বি. ডি. পাণ্ডে (রাজ্যপাল, প.ব.), ড. সৈয়দ নুরুল হাসান (রাজ্যপাল, প.ব.), গোপালকৃষ্ণ গান্ধী (রাজ্যপাল, প.ব.), সব্যসাচী মুখার্জি (প্রা্ক্তন প্রধান বিচারপতি) এবং অমিতাভ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মহাশ্বেতা দেবী, বাদল সরকার-এর মতো প্রমুখ লেখক, কবি, নাট্যকাররা৷ কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও একবার গিয়েছিলেন রাঙাবেলিয়া পরিদর্শনে৷ টি. এস. আর. ডি এবং ‘রাঙাবেলিয়া মহিলা সমিতি’র কর্মকাণ্ড কবিকে বিশেষভাবে স্পর্শ করেছিল৷ ফেরার সময় বিদ্যানদীতে লঞ্চ যখন ছাড়ছিল, লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে কথা প্রসঙ্গে তাপস গঙ্গোপাধ্যায়কে শক্তি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলেছিলেন:
“পদ্য, যাকে তোরা কবিতা বলিস, সেটা কী? আমি তো রাঙাবেলিয়া নামে একটা কবিতা পড়ে গেলাম, লেখক ওই দুই মাস্টার আর মাস্টারনি৷”
(সূত্র: ‘এক অসমাপ্ত বড় কবিতা’—তাপস গঙ্গোপাধ্যায়, স্মরণে, পৃ. ২৭-২৮)
হে পাঠক! আসুন আমরাও সেই কবিতাটা আবার নতুন করে পড়া শুরু করি৷
****
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
শ্রীতুষার কাঞ্জিলাল
শ্রীমতী তানিয়া দাস
শ্রীমতী প্রতিমা মিশ্র
শ্রীরবিন মণ্ডল
ও
‘রাঙাবেলিয়া মহিলা সমিতি’
‘টেগোর সোসাইটি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট’
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Comments (3)
-
-
লেখাটি পড়তে পড়তে কয়েকবারই থামতে হল।বিষ্ময়ে,আবেগে,মুগ্ধতায় আর কুন্ঠায়-লজ্জায়।চমকে গেছি ব্যাঘ্র-বিধবা শব্দবন্ধটির সামনে?ভাষা এখানে জীবন নির্বাহ করবার লড়াই এর খবর দিল।আমি ইতিহাস খুব কম জানি।কিন্তু রাঙাবেলিয়ার এই ইতিহাস,এই লড়াই,এই মানুষগুলির অক্লান্ত যাপন যে জানতামনা,সে অপরাধ আজ স্খালন হল সামান্য।কবিতাই বটে!! কবিতা ছাড়া একে আর কোনো সজ্ঞায় ধরাও যাবেনা হয়ত।আর সেই কবি? বীণা কাঞ্জিলাল!! রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কারুর কথা মনে করতে পারছিনা এমন বিপুল কর্মযজ্ঞ ঘটানোর সাহস ও নান্দনিক অনুভূতি দেখে।যেতে হবে আর একবার- সুন্দরবন।এসব নিজের চোখে দেখতে।শামিল হতে।মাথা নত করতে।স্যালুট জানাতে।
-
Extremely valuable piece of writing! Bina Kanjilal has remained hidden from history until now.
Leave a Reply
-
লেখার বুনঠে মুগ্ধতার শেষ নেই। এমন অনেক অবদান ছড়িয়ে আছে অতীতের পাতায়, আমাদের চেনা গণ্ডীর বাইরে, যাপিত জীবন প্রবাহে। মনে পড়ছে কৃষ্ণনগরে এক উমা ঘোষের অবদানের কথা।