• অজানার আড়ালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উমারাণী ঘোষ সংগ্রহ


    0    150

    August 15, 2018

     

    রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,

    “মেহগিনির মঞ্চ জুড়ি
    পঞ্চ হাজার গ্রন্থ;
    সোনার জলে দাগ পড়ে না,
    খোলে না কেউ পাতা;
    অ-স্বাদিত মধু যেমন
    যূথী অনাঘ্রাতা।”

    (যথাস্থান, ক্ষণিকা )

    উনিশ শতকের চৌকাঠ পেরিয়ে বিশ শতকের দালান-কোঠায় দাঁড়িয়ে মেয়েদের সজাগ কলম কতটা সজাগ, কতটা জীবন্ত তাঁদের অতীত-কাহন, সমাজ-সংসারের অনেক বলা না-বলার বুনন কাঠিতে বোনা আত্মজীবনী, স্বরচিত কবিতা বা প্রবন্ধ, তাকে নতুন করে ব্যাখ্যায় তুলে ধরা আর বোঝার প্রয়োজন। সমাজ-ইতিহাসের অনেক বাঁক ঘুরে মেয়েদের লেখা আর চিন্তা কতটা শাণিত কুঠার, কতটাই বা সাবলীল, প্রতিদিন নিত্যনতুন ব্যাখ্যার মধ্যে দিয়ে সেই খোঁজ চলেছে, চলেছে বহু ভাবনার অলি-গলি পথ চলা। শতক জুড়ে যখন মানবীবিদ্যার পাঠ আর গবেষণায় কলেজ স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে নতুন ভাবনা আর প্রকল্প, তখনও অনেক লেখা আড়ালে থেকে গেছে, মরে গেছে অনেক ভাবনা। ঘরকন্না আর সমাজ-সংস্কৃতি-ইতিহাসের নতুন দ্যোতনা কালি-কলমে যে জীবন্ত দলিল হয়ে আছে তার জরুরি অন্বেষণ প্রয়োজন। অনেকটা সেই ভাবনার খোঁজে আজ থেকে বছর খানেক আগে সন্ধান পাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অনন্য আকর সংগ্রহ 'উমারাণী ঘোষ সংগ্রহ' (List of Books CU_Umarani Collection) । কিন্তু দেখলাম সেই সংগ্রহ কিছুটা যেন একঘরে হয়ে আছে। এই বিপুল সংগ্রহের নেই কোন প্রচার, না আছে প্রদর্শন।

    সুপ্রাচীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কী আজও কিছুটা কুঁকড়ে আছে তথাকথিত ভাবনার গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে? অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে নিজস্ব মানবীবিদ্যা চর্চার আন্তর্বিভাগ (Interdisciplinary School)। বিশালাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার আর তার বিপুল সংগ্রহের মাঝে আর কতকাল ‘বিশেষ সংগ্রহ’ (Special Collection) বা ‘উপহৃত সংগ্রহ’ (Gifted Documents)-র তকমা আঁটা হয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘পঞ্চ হাজার গ্রন্থ’ আর তার ‘খোলে না কেউ পাতা;/অ-স্বাদিত মধু যেমন/ যূথী অনাঘ্রাতা’ হয়ে পড়ে থাকবে দু-মলাটের বাঁধন ঘেরা গ্রন্থরাজি। যে উদ্দেশ্যে এই দান, তা নিছক দান সামগ্রী হয়েই শোভা বাড়াবে, থাকবে না তার সঠিক চর্চা আর পাঠ-উন্মোচন- এই ভাবনা ব্যথা দেয় আমাকে বা আমার মতো অনেককেই, যাঁরা কোন দিন জানতে পারল না কি অমোঘ টান সেই সব কালজীর্ণ বাদামী পাতার, জানতে পারল না কেন এই দান বা সংগ্রহ যাঁর নামে তাঁর পরিচয় বা অমূল্য এই দানের মুখ্য উদ্দেশ্য। আজ অনেক কিছু না পাওয়ার মাঝে অনেক পাওয়া নিয়ে এই সংগ্রহের মধ্যে থেকে উন্মোচিত হতে পারে অনেক চিন্তার বীজ। কারণ সে ইতিহাসে নিছক ইতি টানার দিন আসেনি এখনো, বরং এখান থেকেই শুরু হতে পারে নতুন পাঠ-উন্মোচন পর্ব। আসা যাক অতীতের কিছু লেখার নমুনায়, যেখানে পাঠক জানতে পারে কে উমারাণী, কি তার পরিচয়, কেনই বা এমন সংগ্রহ-নাম।

    আইসিএস গুরুসদয় দত্ত তাঁর স্ত্রী সরোজনলিনী দত্তের স্মৃতির উদ্দেশে গড়ে তোলেন ‘সরোজনলিনী নারী মঙ্গল সমিতি’। স্বামীর সঙ্গে সরোজনলিনীও আজীবন নারী ও শিশুর কল্যাণে জীবন কাটিয়েছিলেন। এই প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার আগে অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন জেলায় নারী-শিশু কল্যাণ ও শিক্ষায় নিয়োজিত দত্ত দম্পতির নিরলস প্রয়াস আজ অনেকটা ভুলে যাওয়া স্মৃতি। আর এই আড়ালে থাকা ইতিহাসের খোঁজে যখন আজ থেকে কিছু বছর আগে কিছু পুরনো পত্র-পত্রিকা দেখেছি তখন খুঁজে পেয়েছি অমূল্য সব তথ্য। আর সেই সব তথ্যের মধ্যে থেকেই জানতে পারি গুরুসদয় দত্তও চেয়েছিলেন তাঁর স্ত্রীর স্মৃতিবিজড়িত কলকাতার বালিগঞ্জস্থিত নারীমঙ্গল সমিতি ও তার শাখাতেও গড়ে উঠুক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উমা ঘোষ সংগ্রহের মতো এক অনন্য সংগ্রহ। সমিতির মুখপত্র ‘বঙ্গলক্ষী’ পত্রিকার পাতায় সে কথা লেখাও হয়। প্রথম থেকেই সরোজনলিনীর ভাবনা ও আদর্শে জারিত ভাবীকালের ‘সরোজনলিনী দত্ত নারীমঙ্গল সমিতি’র মুখপত্র ‘বঙ্গলক্ষ্মী’, তাঁর স্বামী আইসিএস গুরুসদয় দত্ত-র যে কতটা উৎসাহ ও প্রেরণা পায় সে প্রসঙ্গে জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ লিখেছেন:

    “......কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙ্গলার মহিলা লেখিকাদের পুস্তক সংগ্রহ ‘উমারাণী সংগ্রহ’ স্থাপিত হওয়ায় গুরুসদয় দত্ত ইচ্ছা প্রকাশ করেন: সরোজনলিনীর বাটী হইলে, আপনাকে এখানেও মহিলা লেখিকাদের পুস্তকের এক বিরাট গ্রন্থাগার করিতে হইবে- কারণ এই স্থানই বাঙ্গলার নারী উন্নতির প্রধান উৎস হইবে। এই যে প্রকাণ্ড হল হইল ইহার উপর বিরাট পুস্তকালয় হইবে। ‘বঙ্গলক্ষ্মী’র পরিবর্ত্তে যে সব পত্রিকা পান তাহা এই গ্রন্থগারকে পুষ্ট করিবে।” (জ্যোতিশচন্দ্র ঘোষ, ‘গুরুসদয় দত্তের কথা’, বঙ্গলক্ষ্মী, শ্রাবণ ১৩৪৮, পৃ: ৪৭৮-৪৭৯)

    অমূল্য এই আকর সংগ্রহের কথা ‘বঙ্গলক্ষী’র সম্পাদিকা হেমলতা দেবীর লেখনীতেও বাঙ্ময় হয়:

    কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুলায়তন পাঠাগার সংলগ্ন প্রকাণ্ড গ্রন্থশালা অনেকেই দেখেছেন। বৃহৎ ঘরটির আশেপাশে ছোট ছোট ঘরেও অনেক গ্রন্থ সংগ্রহ করে রাখা আছে। তারই একটি ঘরে নিরিবিলি একটি কোণে উমারাণী সংগ্রহের স্থান। স্বর্গীয়া উমারাণী ঘোষ ভবানীপুরের পদ্মপুকুর রোড নিবাসী শ্রীযুক্ত জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষের কন্যা। ১৩৪২ সালের ১৯শে আশ্বিন কুমারী উমারাণীর মৃত্যু হয়। কন্যাশোকে মুহ্যমান পিতা সান্ত্বনার পথ খুঁজে পান নাই। বেদনারহিত হৃদয়ে কন্যাস্মৃতির একটি নূতনতর ও সুন্দরতর পরিকল্পনা তাঁর মনে যোগায়। বাংলার মহিলা-রচিত গ্রন্থ সংগ্রহে তিনি প্রবৃত্ত হন, মা নাম অন্তরে জাগ্রত থেকে তাঁকে এই কাজে প্রবৃত্ত করায়। একশো বছরের ভিতর বাংলার যত মহিলা যত গ্রন্থ লিখেছেন তার অনেকগুলির তিনি সংগ্রহ করেছেন প্রাণপণ যত্নে এবং উমারাণী সংগ্রহ নাম দিয়ে সেগুলি বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থশালার অঙ্গ শোভিত করে সাজিয়ে দিয়েছেন।

    আরো একশ বছর পরে এই সংগ্রহের মূল্য দেশের নারী-সমাজের কাছে কত না বড় হয়ে দাঁড়াবে। বর্ত্তমান লেখিকারা কেউ তখন পৃথিবীতে থাকবেন না; অনেক গ্রন্থের অস্তিত্ব হয়ত সাধারণ স্থান থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে কিন্তু এই সংগ্রহে সেইসব গ্রন্থ ও গ্রন্থকর্ত্রীরা চিরজাগ্রত হয়ে থাকবেন। বাংলার সমস্ত নারীর তরফ্ থেকে এই শুভ সঙ্কল্পের জন্য আমরা কন্যাহারা পিতাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কাজটি সুসম্পন্ন হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস্‌চ্যান্সেলার শ্রীযুক্ত শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মহাশয় এটি অনুমোদন করে আমাদের ধন্যবাদার্হ হয়েছেন। আশাকরি নূতন নূতন গ্রন্থকর্ত্রী রচিত গ্রন্থ এই সংগ্রহে স্থান পেয়ে ভাবীকালে একে সুবৃহৎ সংগ্রহশালায় পরিণত করবে। (হেমলতা দেবী, সম্পাদিকার জল্পনা, বঙ্গলক্ষ্মী, শ্রাবণ ১৩৪৫, পৃ: ৫৭৭-৫৭৮)

    উনিশ শতকের সাময়িকপত্র, বিশেষ করে বঙ্গলক্ষীর সঙ্গে প্রবাসী পত্রিকার পাতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যবান উমা ঘোষ সংগ্রহ নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন আমাকে বিষয়টির প্রতি আকৃষ্ট করে। পাঠকের জ্ঞাতার্থে সেই টুকরো কথা ভাগ করে নিতে চাই, আর যার মধ্যে দিয়ে আমরা প্রবেশ করবো সেই কালপর্বে, যেখানে আর পাঁচটা শিক্ষা-সমাজ উদ্যোগের এমন প্রাঞ্জল উপমা চিনিয়ে দেবে এই সংগ্রহ-কথা -

    আমরা আহ্লাদের সহিত নিম্নমুদ্রিত আবেদন ও জ্ঞাপনীটি প্রকাশ করিতেছি।

    কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে বঙ্গরমণীদের লেখা প্রায় পাঁচশত পুস্তক পৃথক ভাবে ‘উমা ঘোষ সংগ্রহে’ রাখা হইয়াছে। তিন বৎসর পূর্ব্বে শ্রীযুক্ত জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ মহাশয় তাঁহার কন্যা উমারাণীর স্মৃতির জন্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় পাঁচ শত বঙ্গরমণী লিখিত পুস্তক প্রদান করিয়াছিলেন।

    কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ত্তৃপক্ষও বইগুলি ‘উমা ঘোষ সংগ্রহ’ রূপে পৃথক ভাবে সযত্নে রাখিয়া দেন। এক সঙ্গে মহিলাদের প্রণীত এত অধিক পুস্তকের এক স্থানে কোথাও সংগ্রহ নাই।

    শ্রীযুক্ত জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ মহাশয় তাঁহার কন্যার পঞ্চম বর্ষের স্মৃতি উপলক্ষে সম্প্রতি ২৬ খানি পুস্তক ‘উমা ঘোষ সংগ্রহে’ দান করিয়াছেন। ইহার মধ্যে ৭০ বৎসর পূর্ব্বে লিখিত কবি প্রসন্নময়ী দেবীর পুস্তকও আছে। এই সংগ্রহে অনেক লেখিকা তাঁহাদের রচিত পুস্তক প্রদান করিয়াছেন।

    মহিলা লেখিকারা যদি তাঁহাদের এক একখানি বই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাধ্যক্ষ মহাশয়ের নিকট এই ‘উমারাণী ঘোষ’ সংগ্রহের জন্য প্রদান করেন তাহা হইলে এই সংগ্রহের জন্য প্রদান করেন তাহা হইলে এই সংগ্রহটি পুষ্ট হয় এবং এই বিশ্বস্ত স্থানে মহিলাদের বহি থাকিলে গ্রন্থপঞ্জী করিবার সুবিধা হইবে।

    ঘোষ মহাশয়ের পিতৃস্নেহের প্রকাশ প্রশংসনীয় ও অনুকরণযোগ্য। সংগ্রহটির মুদ্রিত তালিকা প্রকাশিত হইলে, তাহাতে যে-সব বহি নাই, লেখিকারা, তাঁহাদের আত্মীয়েরা কিংবা প্রকাশকেরা সেগুলি বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে পারিবেন। (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘উমা ঘোষ’ পুস্তকসংগ্রহ, প্রবাসী, বিবিধ প্রসঙ্গ, অগ্রহায়ণ ১৩৪৭, পৃ: ২৬৩)

    আজ পুস্তক পাঠ বা বিপণন বা সংগ্রহ সব ক্ষেত্রেই যখন নতুন ভাবে ভাবার দিন এসেছে, তখন গ্রন্থাগার ভাবনা তার থেকে ব্যতিক্রমী কেন হবে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাঠকের কাছে নতুন বা পুরাতন কোন বইকে পৌঁছে দেওয়ার আজ নানা উদ্যোগ, তা কখনো ই-গ্রন্থাগার বা ডিজিটাল লাইব্রেরিতে রূপান্তরিত, অন্যদিকে সমাজ-মাধ্যম (Social Media) সজাগ বই এর কাছে পাঠক যাওয়ার আগেই পাঠকের কাছে বইকে নিয়ে যেতে, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা পারি না আলমারি-বন্দী রাখতে আমাদের ভাবনা, কারণ এই সেদিন যখন শুনি ব্যক্তিগত সংগ্রহ আর নতুন বই আর নতুন লেখালিখির জগতে মেয়েদের ভাবনা আর চর্চা কতটা জীবন্ত তার নতুন ভাবনা নিয়ে গবেষক ও সাধারণ পাঠকদের কাছে ‘মানুষীকথা’ পত্রিকা আর তাঁদের নতুন ‘বই-ঘর’ খুলে দিয়েছে তাদের দরজা, তখন অজান্তে এমন উদ্যোগ জানান দিচ্ছে ভাবীকালের কাছে তা আর নেহাত ‘জেনানা ফাটক’ নয়। এসো মুক্ত কর, খুলে দাও হাজার মনের দরজা, আসুক সুবাতাস।

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics