• যৌনতার কিছু অকথিত দিক : একটি আলোচনা


    1    631

    April 6, 2018

     

     
     
     

    ক'দিন আগে ভিনরাজ্যের অধিবাসী আমার এক তুতো ভাই ফোন করল বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে। সম্প্রতি ওদের সাড়ে নয় বছরের পুত্রের নানান অসংগতিপূর্ণ আচরণ ওদের যথেষ্ট বিচলিত করেছে।মায়ের তুলনায় বাবার সাথেই সে বালকের একটা খোলামেলা কথাবার্তা আদান-প্রদানের পরিসর আছে।তাতেই জানা গেছে-সে বন্ধুদের মারফত facts of life বা নারী-পুরুষের যৌন জীবনের প্রথম পাঠটি প্রাপ্ত হয়েছে।স্বভাবতই সে তার বাবাকে জানায় সে বিবাহ করতে অনিচ্ছুক কারণ সে মানব-শিশু জন্মের বা বলা ভালো নিজের এই পৃথিবীতে আগমনের ইতিবৃত্তটি জেনেছে।আর তাই পুনরায় আর কোনো মানুষের সাথে এই কাণ্ডটি ঘটাতে চায় না যাতে আবার কারুর জন্ম হয়।তার বাবা অবিচলিত ভাবেই বালকটিকে তার নিজের সিদ্ধান্ত সময়কালে নেবার স্বাধীনতা দিয়ে পুত্রকে আশ্বস্ত করেছেন।

    কথা হল—এই অনাসক্তি বা ঘৃণা আমাদের সকলেরই চেনা স্মৃতি। আমাদের শৈশব কৈশোরকাল ভাবলেই মনে পড়বে—জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ কাটিয়েছি যখন একাধারে পরিবার বা সমাজ-নির্মিত সংস্কার ও ট্যাবুজাত সভ্যতা, ভদ্রতা, শিষ্টাচারবোধকে চ্যালেঞ্জ করেছে সদ্য বন্ধুদের কাছে বা অন্য কোনো ঘটনা থেকে বা কোনোরকম অবাঞ্ছিত অভিজ্ঞতা থেকে লব্ধ যৌন-পাঠ, যার সাথে নিজের অস্তিত্ব এবং ছেলেবেলার সবচেয়ে অপরিহার্য আশ্রয়—মা ও বাবা জড়িয়ে! ঘেন্নায়, লজ্জায় আর বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণায় সর্বাঙ্গ কুঁকড়ে গেছে, অসহায় কান্নায় নিজেকেই নিজের সমব্যথী হতে হয়েছে।

    বছর দু’-তিনের মধ্যেই কিন্তু আবারও একটা ঝাঁকানী লাগবে দৃশ্যপটে। কৈশোর-শরীর ঘুম ভেঙে উপনীত হবে বয়ঃসন্ধির দোরগোড়ায়।এই শারীরিক পরিবর্তনের সাথে তার পূর্বলব্ধ অভিজ্ঞতার এবার একটা বোঝাপড়া তৈরী হবে ধীরে ধীরে যেটা তাকে মানব-জীবনের সুস্থ ও কাম্য যৌনতার দিকে ক্রমশঃ আগ্রহী করবে শুধুমাত্র তথ্যনির্ভরভাবে নয়, নিজের শারিরীক অনুভূতির নিরিখেও।যৌনতা যে শুধু নির্যাতন নয়,তা সুখকরও বটে—এ সত্যটা সে এবার অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানবে।

    আর তখনই বাঁধবে গন্ডগোল। ক্রমশঃ সে, মেয়েটি বা ছেলেটি বুঝতে থাকবে তার শরীর যা অনুভব করছে, যা বলছে, সমাজ বা রাষ্ট্র তাকে সেসব প্রকাশ বা চর্চা করার ছাড়পত্র দেয়নি, দেয় না। যৌনতাচর্চা আদতে অলিখিতভাবে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের অন্তর্গত। ফলে ঠিকঠাকভাবে নিজেকে আনন্দ দিতে সে শিখে নিতে থাকবে গোপনীয়তা অবলম্বন করা। স্কুল তাকে এ বিষয়ে কোনো পাঠ দেবে না। হয়ত দেবে না পরিবারও। এরপর আসবে মেয়েদের ও ছেলেদের বিবাহোপযোগী সাবালকত্বের আইনতঃ ধার্য বয়স যথাক্রমে ১৮ ও ২১ অথচ ভোটাধিকারের যোগ্যতা দু’ ক্ষেত্রেই আঠারোতে নির্ধারিত হবার গল্পটা। এমনকি সেখানে আসবে 'না' বলার অধিকারের প্রসঙ্গ যা বিয়ের দায়রা পর্যন্ত বিস্তৃত, এমনকি যা নাকি সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টও স্বীকৃতি দিল! কিন্তু 'হ্যাঁ' বলার অধিকার? সত্যিই কি সমাজ, বকলমে রাষ্ট্র তরুণ-তরুণীর যৌনতাকে মান্যতা দিয়ে তাদের 'হ্যাঁ' বলার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে? (সমাজে এখনও আপামর নারীদের অবস্থা যেরকম,তাতে পুরুষতন্ত্র সামাজিক 'হ্যাঁ' বা 'না' এর তোয়াক্কা না করে তার অধিকার কায়েম করছে নিরন্তর—সে প্রশ্নে এখন না হয় নাই গেলাম) দেয়নি বলে পরস্পরের মুখোমুখি হবে- পকসো আইন, কৈশোরের যৌনতা, সামাজিক দ্বিমেরুকরণ এবং আইনব্যবস্থা। দেখা যাবে, পরস্পরবিরোধী সামাজিক নিদান তৈরি হয়ে যাচ্ছে—‘নির্ভয়া’কান্ডের পর ফৌজদারি অপরাধের ন্যূনতম বয়স নামিয়ে আনা হচ্ছে ১৬ বছরে। অপরপক্ষে কৈশোরের যৌনতাকে অস্বীকার করা হচ্ছে পকসো আইনের আওতায়। ক্রমে দেশে সম্মান হত্যা বা অনার কিলিং-এর মতো ঘটনা থেকে শুরু করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝিল পাড় থেকে তরুণ-তরুণীদের একত্রে ব্যক্তিগত সময় কাটানোয় তাদের স্বঘোষিত ‘অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড’ কর্তৃক হেনস্থা হওয়া—এ সবই আদতে যে প্রশ্নটির সামনে আমাদের দাঁড় করাচ্ছে—আমরা কি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের প্রাপ্তবয়স্কতার মর্যাদা বা স্বীকৃতি দিতে এতটা অপ্রস্তুত? এটা কি প্রকারান্তরে আমাদেরই অপ্রাপ্তমনস্কতা প্রমাণ করেনা??

    কথাটা কেন এল বলি। গত ১৬-১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, যদুনাথ ভবন মিউজিয়াম অ্যান্ড রিসোর্স সেন্টারে নিরন্তর ট্রাস্ট ও এবং আলাপ-এর যৌথ উদ্যোগে Young People's Sexuality: Issues in Contemporary West Bengal এই শিরোনামে একটি সেমিনার ও আলোচনাসভা আয়োজিত হয়েছিল।আমরা যারা অংশগ্রহণকারী ছিলাম, আবারও ঋদ্ধ হলাম দু’ দিন ব্যাপী অত্যন্ত জরুরী, প্রাসঙ্গিক, যুক্তি-বলিষ্ঠ নানান আলোচনায় ও মতবিনিময়ে। এবারে যাঁরা বক্তা ছিলেন, তাঁরা পেশাগতভাবে নানান ক্ষেত্রে কাজ করেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যরা হলেন মানসিক স্বাস্থ্য আন্দোলন কর্মী রত্নাবলী রায়, নন্দিতা রায়, জয়া শর্মা, রুচিরা গোস্বামী, আইনজীবী কৌশিক গুপ্ত, ঈশান চক্রবর্তী, অর্চনা দ্বিবেদী, কোয়েল, পারমিতা চক্রবর্তী, অভিজিৎ রায় প্রমুখরা। এছাড়াও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন ছাত্রী এসেছিল ছাত্রছাত্রীদের প্রতিনিধি হিসেবে।

    আলোচনার মূল ক্ষেত্র কৈশোরের নজরদারি (Surveillance), নীতি পুলিশি (Moral Policing) এবং যৌনতা হলেও আলোচনা আরও নানান খাতে গভীরভাবে বয়ে গেছে যার মধ্যে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে প্রতিবন্ধী মানুষের যৌনতা। সে কথায় পরে আসছি।

    আই.আই.এম. লখনৌয়ের নন্দিতা রায়,  বর্তমান সময়ের সব থেকে জরুরি ও প্রাসঙ্গিক জায়গায় আলো ফেললেন। তা হল যুবসমাজ + ডিজায়ার বা কামনা + প্রযুক্তি।

    পরিসংখ্যান বলছে, কিশোর-কিশোরী বা আপামর তরুণ প্রজন্ম এই যে বুঁদ হয়ে আছে তাদের আপাত ব্যক্তিগত একটা ভার্চুয়াল দুনিয়ায়, (ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টিন্ডার, স্কাইপ, ইউটিউব ইত্যাদি ইত্যাদি হাজারো অ্যাপের মাধ্যমে) তার নানান কৌতুহল, অজানাকে জানার স্বাভাবিক আগ্রহ, তার যৌনচর্চা, এটার জন্য বাস্তবের (real) পৃথিবীতে ওদের ভাল-মন্দ বুঝে ও বুঝিয়ে দেবার নামে আদতে ওদের ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকে ওদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার জন্য এত আয়োজন যথা—নীতি পুলিশি, নজরদারির সুযোগ পেয়ে যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে, এবং এই নজরদারি জাতি, ধর্ম, বিত্ত, বৃত্তি, অঞ্চল, ভাষানির্বিশেষে দেশের তামাম কৈশোর ও তরুণ প্রজন্মের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ১৬-২৪ বছরের সবচেয়ে বেশী যাতায়াত এই ইন্টারনেট দুনিয়ায়। অথচ এই জায়গাটাও যে নজরদারির বাইরে না, নন্দিতা সেটাই বোঝালেন। খবরের রেড ফিড/ব্লু ফিডের উদাহরণ দিয়ে ইন্টারনেটের ব্যক্তির পছন্দভিত্তিক তহ্য সরবরাহ করার প্রক্রিয়া বোঝালেন। না জেনে আমরা কেমন সব স্বত্ত্ব বিকিয়ে দিচ্ছি গুগল, ইন্সটাগ্রামকে। মার্কেট-নির্মিত এই প্রযুক্তিনির্ভর যৌনতাতেও গভীর ভাবে আকৃষ্ট হচ্ছে এই প্রজন্ম। সামাজিক দ্বিমেরুকরণের চক্করে যে চাহিদাটা সে প্রকাশ করবারই ছাড়পত্র পায় না, সেটা সে অনায়াসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে পূরণ ও চর্চা করে ফেলছে। অথচ এই অধিকার না পাবার বিরুদ্ধে তার বাস্তব জীবনে সরব হবার কথা ছিল। কথা ছিল আরও অনেক অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। মার্কেটের এই নির্মাণগুলি শুধুমাত্র বিকিকিনির হাট বসানোর জন্য নয়। এটা সুচারু একটা রাজনীতি যা চূড়ান্ত সফলতার সাথে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী আগুন অর্থাত তামাম বিশ্বের নয়া প্রজন্মের সিংহভাগ মেধা, মনন, চিন্তন ও বিশ্লেষণ ক্ষমতাকে গ্রাস করে এই পরাবাস্তব নেট-জালের নানান প্রলোভনে জড়িয়ে বন্দী করে আদত বাস্তব পৃথিবীটাকে সম্পূর্ণ নিরাপদ করেছে বিশ্ব জুড়ে আর্থমাজিক, সাংস্কৃতিক, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ রাজনীতির আগ্রাসন চালিয়ে যাবার জন্য। অবশ্য এটাও অন্য আলোচনা।

    উপরোক্ত আলোচনায় আর যে বিষয়টি মনে গভীর রেখাপাত করল, সেটি হলো-প্রতিবন্ধী মানুষের যৌনতা। সমাজ এই মানুষদের যৌনতা বা কামনাকে স্বীকৃতি দেবার ক্ষেত্রে চিরকালই উদাসীন।বিশেষভাবে মনোরোগীদের। রত্নাবলী মনোরোগীদের ওয়ার্ডের যে ছোট ভিডিওটি দেখালেন, সেখানে একা মেয়েটির হিন্দী ছবির প্রেমের গানের সাথে নাচ স্পষ্ট করল প্রেমাষ্পদর প্রতি তার কামনা বা ডিজায়ার। এমনকি পুরুষকন্ঠের অন্তরায় তার শরীরী ভাষা যেন কাল্পনিক প্রেমিকের প্রতি তার অভিব্যক্তি ব্যক্ত করছিল! অর্থাৎ সে মনোরোগের যে স্তরেই থাকুক, সে যৌন প্রতিবন্ধী নয়। অথচ সে তার যৌনতার অধিকার পাবে কি পাবে না, তা আর এখন শুধুই ডাক্তারি প্রশ্ন নয়। এখানেই আসবে শ্রেণী, জাতি এবং ক্ষমতার আন্তঃসম্পর্কের প্রশ্ন। কারণ কোন্ মনোরোগী হিস্টেরিয়া আর কোন্ মনোরোগী ডিপ্রেশনের রোগী, তা ভীষণভাবে শ্রেণী, অর্থনীতি এবং মাঝে মাঝে জাতিনির্ভরও বটে।

    মনোরোগীরা সরকারী হাসপাতালে যে ওয়ার্ডে থাকেন, সেখানে বারোরকমের তালা-চাবি থাকে, থাকে সরু মোটা বড় ছোট 12 রকমের গ্রিল। তাঁরা প্রত্যেকে ঢোলা, একরঙা, আনকাট, ইউনিসেক্স জামা পরেন। কোথাও শরীরের আনন্দের অবকাশ নেই। অর্থাৎ কেন গ্রিল আর কেন সুখ বা প্লেজারের কোনো অবকাশ নেই—এই দু’টি প্রশ্নই এই জায়গায় এনে দাঁড় করায় যে—কীভাবে ক্ষমতা সেই যৌনতার সঙ্গে সম্পর্কিত।

    নজরদারি ভীষণভাবে আছে মানসিক রোগীদের হাসপাতালে। উপরোক্ত মনোরোগীটির নাচ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেখতে পেলে হয়ত ওর ওষুধের ডোজ বাড়ত, ওকে seclusion cell-এ রাখা হত, হয়ত হাতে-পায়ে দড়ি পরানো হত—এই বাড়াবাড়ি রকমের 'পাগলামী'র জন্য। মনোরোগীদের নিজের প্লেজার বা সুখ মানসিক হাসপাতালে বিকৃত বলে মনে করা হয় এবং তা ‘নিরাময়’-এর চেষ্টা করা হয়। ওঁরা সাজলে বিরূপ মন্তব্য, কম খাবার দেওয়া ইত্যাদি নানান পরিকাঠামোগত অত্যাচার তো খুব সহজেই চালানো হয়।

    আসলে ক্ষমতা, প্লেজারের অসম বন্টন-ব্যবস্থা কায়েম রেখে একটা হায়ারার্কি তৈরি করে যেখানে প্লেজারের নাগাল পাওয়া ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত। ঈশান চক্রবর্তীর কথায়, প্রতিবন্ধকতা শুধু লিফট বা র‍্যাম্পের বিষয় নয়। প্লেজারের নাগাল পাওয়াটা হল সবচেয়ে জরুরী শর্ত যেটা আলোচনাই হয় না!!

    রত্নাবলী এও বললেন,যেখানে মানসিক রোগীরা নিজের আবেগ, কামনা পর্যন্ত প্রকাশ করতে পারে না 'ইলেক্ট্রিক শক'-এর ভয়ে, সেখানে কি আদৌ তাদের সেরে ওঠা সম্ভব হবে?

    ওঁর আলোচনায় উঠে এল, মনোসামাজিক প্রতিবন্ধীরা বিষমকামী হবেন এটা ধরে নেওয়া হয়। তাই নির্দ্বিধায় একটা মহিলাদের ওয়ার্ডে ১২ জন মহিলা রোগী থাকেন বা উল্টোটা এবং তাঁরা পরস্পরকে স্টিম্যুলেট করে আনন্দ পান।

    এই রোগীদের যে ওষুধ দেওয়া হয়, ওদের জানবার উপায় বা অধিকার নেই যে এগুলি খেলে তাদের যৌনতার উপর গভীর প্রভাব পড়বে কি না। এখানে প্রতিবন্ধী আন্দোলনকর্মী ঈশান চক্রবর্তীর মন্তব্য অনুসারে বাস্তব অবস্থাটা হল, সরকারের দৃষ্টিভঙ্গীতে প্রতিবন্ধকতা একটা বড় সমস্যা। তাই তার সাথে যৌনতাকে আনাটাই ঝামেলা। তার মধ্যে যদি আবার যৌনতার অভিমুখ আনতে হয় তাহলে তো....!!

    এটি একটি মেরুকরণ যার একদিকে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, অন্যদিকে স্বাধীনতা ও আত্মনির্ধারণ।

    Margin within margin অর্থাৎ যৌনতার প্রান্তিকতা যখন মনোসামাজিক রোগীদের সাথে যুক্ত হয় তখন আর 'অসুখ হল-ওষুধ দিলাম-সেরে গেল' এই ছকে চিকিৎসাটা ফেলা যায় না। অথচ সমাজ, হাসপাতাল, সরকার কেউ এত দায় নিতে প্রস্তুত নয়। কতগুলো সুবিধাজনক বাইনারির মধ্যে ফেলে দিতে পারলে সামাজিক পরিকাঠামোটা খাড়া করা সোজা হয়।তাই সহজেই দেগে দেওয়া হয়—বিকল্প যৌনতার মানুষ প্রতিবন্ধী হতে পারে না বা উল্টোটাও। কিন্তু কেন??

    ঈশান নিজে একজন দৃশ্য প্রতিবন্ধী মানুষ বলে দায়িত্ব নিয়ে জানালেন প্রতিবন্ধকতার হায়ারার্কির মইয়ের একদম উপরে আছেন অন্ধরা। যে মানুষেরা আক্ষরিক অর্থে নির্বাক, মূক, তারা একদম নীচে। ভারতীয় সংবিধানে যাঁরা মানসিক ভারসাম্যহীন, তাঁদের নাগরিকত্ব স্বীকৃত নয়। যেন সেই মূক স্তব্ধতাকে ভেদ করে তার বাঙময় অন্তর অব্দি পৌঁছনোর কোনো দায় রাষ্ট্রের নেই।

    আর একটি কথা আলোচিত হল। যারা 'হাবা গোবা' বা মনোরোগী, তাদের অতিরিক্ত যৌন চাহিদা থাকে।এটিও একটি সামাজিক নির্মাণ। এই হাইপার-সেক্সুয়ালিটি নিয়ে কথা বলার সময় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে মনোসামাজিক রোগী ব্যাতিরেকে, অতিরেকে সকল মানুষের স্পর্শের প্রয়োজন আছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের 'স্পর্শক্ষুধা'-র যুক্তিতে এই হাইপার-সেক্সুয়ালিটি নস্যাৎ হয়ে যায়।আসলে ওই যে সেই ক্ষমতার গল্প। কে, কার নিরিখে, কোন্ অধিকারে, কার বেশী-কম ঠিক করবে? প্রতিবন্ধী (মনোসামাজিক নাও হতে পারে) রোগীর যৌন চাহিদার সামাজিক স্বীকৃতি? পাজামার আবার বুকপকেট!!

    কখনও একবার যদি ভেবে দেখি—আমি চোখে দেখি না, কানে শুনি না, আমার বোবা, অন্ধকার পৃথিবীটায় যে একাকীত্বের যন্ত্রণা, সেখানে আমি যদি আমার যৌনাঙ্গে হাত রেখে, নেড়ে-চেড়ে কোনোভাবে সুখ পাই, তাতে সভ্য নাগরিক জীবনে এত হাঙ্গামা হয়ে যায় কেন? অন্য মানুষের সাথে যোগস্থাপনের আকাঙ্খা তো মানুষের সহজাত। আমার কাছে অন্যকে স্পর্শ করা ছাড়া আর কোন্ ভাষা আছে কমিউনিকেট করার? অনেকে কি বেশী কথা বলেন না? সেটাও তো একরকমের ‘হাইপার’।

    রত্নাবলীর কাছে সীতামারির সেই মেয়েটির কথা শুনলাম যার বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যেকার যৌন অভিব্যক্তি বিকৃত বলে প্রমাণ হয়ে গেল এবং কাঁকের পাগলা গারদে পাঠানো হল। ওর যৌন চাহিদা, যৌন অভিব্যাক্তি ক্ষমতার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত 'নিয়ম' মানছে না।তাই ক্ষমতা স্থির করবে সুখ চাইবার অপরাধে তাকে কী শাস্তি পেতে হবে।

    এখানে বোধহয় আর একটি বিষয়ে কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আফ্রিকা, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির কোথাও কোথাও (ভারতের মুসলমান, মুম্বাইয়ের দাউদী-বোহরা সম্প্রদায়) মেয়েদের যোনীর উপরিভাগে অবস্থিত ছোট্ট ক্লিটোরিসটুকু অঙ্গচ্ছেদ করে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়, মানে বাধ্য করা হয় শুধুমাত্র যৌনসঙ্গমকালে সেই মেয়ে যেন যৌন মিলনের তীব্রতম সুখ আস্বাদন করতে না পারে। বলা বাহুল্য নিয়মটি পুরুষ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ সেই প্লেজারের ক্ষমতায়ন। একই গল্প।

    স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটির মতো সংগঠন বিকল্প যৌনতা নিয়ে পথে নামে। কাজ করে। নারী-আন্দোলনগুলির এই জাতীয় সংগঠনগুলি জোটবদ্ধ হোক। মানবাধিকার নিয়ে আরও বেশী বেশী কথা হোক। নানান স্তরে। দায়িত্ব যেমন সংগঠনের তেমনি একজন ব্যক্তিরও।

    আমরা যারা তথাকথিত শিক্ষিত, সুস্থ, অপ্রতিবন্ধী—এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হবার সময় আসেনি? এখনও?

     
     
     



    Tags
     



    1 Comment

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics