এক ফ্যাসিস্ত আক্রমণের দিনলিপি
0 135ফারুকুল ইসলামের ওপর গণপ্রহারের ঘটনাটা ঘটেছিল ৩ এপ্রিল ২০১৪, বৃহস্পতিবার। এই ঘটনাকে এক ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে আমল না দেওয়া যেতে পারত। কিন্তু মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলে পরপর আরও কিছু ঘটে চলেছে যার আঁচ দৈহিকভাবে সকলের গায়ে এসে না পড়লেও মানসিকভাবে অন্তত এড়িয়ে চলার উপায় নেই। একবছর পর ২৬ মার্চ ২০১৫ বৃহস্পতিবার ফের আক্রান্ত হয়েছেন তালপুকুর আড়া হাই মাদ্রাসার হেডমাস্টার কাজি মাসুম আখতার। রাজাবাগান থানার আইসি-র উপস্থিতিতেই তাঁর মাথা ফাটিয়ে তাঁকে এলাকা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অনেক আগে ২০০৫ সালে পার্শ্ববর্তী মহেশতলা অঞ্চলে আকড়া ভাঙিপাড়ায় আকড়া হাই মাদ্রাসার শিক্ষক মহম্মদ মোরসালিনের বাড়ি ও আসবাবপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল নির্মমভাবে। সমস্ত ক্ষেত্রেই ইসলাম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছে। সেই সময় মোরসালিনের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল মহেশতলা-মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলের লিট্ল ম্যাগাজিন মঞ্চ ‘মাটির কেল্লা’। ঘটনার নিন্দা করে গণস্বাক্ষর করেছিলেন হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তিন শতাধিক স্থানীয় মানুষ। সমস্ত ঘটনাতেই আক্রান্ত ব্যক্তির পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছে এই অঞ্চলের মুসলমান সমাজভুক্ত প্রগতিশীল ও মুক্তমনা বুদ্ধিজীবীরা। তবে এবারে ফারুকুলের ঘটনায় স্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের প্রতিক্রিয়ার আরও কিছুটা বদল হয়েছে। মোরসালিনের পাশে যারা দাঁড়িয়েছিল, সেই ‘মাটির কেল্লা’ এবার ফারুকুলের নামে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করেছে এবং ফারুকুলের পাশে দাঁড়ানো ‘অন্যায়’ বলে মনে করেছে। পরিস্থিতির এই বদল স্থানীয় এবং ছোটো হলেও লক্ষ্যণীয়।
আমরা এখানে প্রথমে ফারুকুলের ঘটনার অব্যবহিত পর তাঁর নিজস্ব লেখা বিবরণ প্রকাশ করছি। সেই সময় তিনি ছিলেন প্রাণসংশয় এবং জবরদস্তি ও বাধ্যবাধকতার এক পরিবেশের মধ্যে বন্দি। অতএব তাঁর জবানবন্দিকে সেদিনকার পটভূমির সঙ্গে মিলিয়েই দেখতে হবে। আজকের দুই বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের বাস্তব প্রেক্ষিত থেকে এক বছর পর আমরা আক্রান্তের এই বিবরণ প্রকাশ করছি।
ফারুক-উল ইসলামের জবানবন্দি, ২৫ মে ২০১৪
৩ এপ্রিল ২০১৪ অনেকের মতো আমার কাছেও আসলে এক নতুন জন্মদিন। নিশ্চিত মৃত্যুর আকস্মিক আক্রমণ থেকে বেঁচে ফেরা যেমন অবিশ্বাস্য, তেমনই রোমহর্ষক। কৃতজ্ঞতা জানাই আক্রমণকারীদেরই একটি অংশকে। ধর্মীয় আবেগের উন্মাদনা যাদের মানবিক সত্ত্বাকে লুপ্ত করতে পারেনি। কৃতজ্ঞতা জানাই মসজিদ কর্তৃপক্ষকে, সেই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক যুক্তিসঙ্গত প্রবল ক্ষোভও তাদের অমানবিক করেনি। কৃতজ্ঞতা জানাই কলকাতা পুলিশকেও। তাদের পেশাদারিত্ব ও আন্তরিকতার প্রতি শ্রদ্ধা না জানিয়ে উপায় নেই। এই সকলের প্রতিই আমি কৃতজ্ঞ, কারণ এদের সহৃদয়তা ছাড়া আজ আমার বেঁচে থাকার কথা নয়। কৃতজ্ঞতা অবশ্যই পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে। তিনিই দিয়েছেন এ নতুন প্রাণ।
ঠিক কী ঘটেছিল?
২ এপ্রিল খুব সকালে বেরিয়ে গেছিলাম একটি বিশেষ কাজে। ৩টে নাগাদ বাড়ি ফিরে দেখলাম বাড়ির সামনে মৃদু জটলা। প্রথমে ভয় পেয়ে গেছিলাম। ভেবেছিলাম, আব্বা হয়তো হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ওপরে উঠে দেখলাম আব্বার ঘরেই পাড়ার কয়েকটি ছেলে। বুকের ভিতর ছ্যাঁৎ করে উঠল। আব্বাই অসুস্থ তাহলে। কিন্তু ভিতরে ঢুকে দেখলাম, তাঁকে একটা কাগজ পড়ানো হচ্ছে। আমি ওটা পড়ে চমকে উঠলাম। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। শুনলাম ওটা একটা পোস্ট হিসেবে আমার ফেসবুকে পাওয়া গেছে। এর পরিণাম বুঝতে সময় লাগেনি। পোস্টটা যে দেখেছে তার নাম মিঠু। ও ওটা দেখে ডাউনলোড করেছে আর ছাপিয়েছে। তৎক্ষণাৎ ওকে ডেকে পাঠালাম। কিন্তু সে আসতে রাজি হল না। এরপর আস্তে আস্তে ঘরের ভিতর ভিড় বাড়তে লাগল। পেট্রল পাম্পের পিছনের ঝংকারপাড়ার কয়েকজন ছাড়া এরা সবাই পাড়ার ছেলে। ওরা দাবি করল, এই মুহূর্তে আর একটা পোস্ট করে দুঃখপ্রকাশ করে ক্ষমা চাইতে হবে। আমি মেশিন খুললাম। কিন্তু ফেসবুকে পোস্টটা দেখতে পেলাম না। ততক্ষণে মিঠু নামে প্রতিবেশী ছেলেটি এসে গেছে। সম্ভবত ওই পোস্টটার প্রথম ও একমাত্র দর্শক। আমার ঘরে মেশিনের সামনে তখন ডাঃ হোসেনের কম্পাউন্ডার মোর্তাজা সহ পাড়ার বহু ছেলে। তাদের দাবি ন্যায্য। কিন্তু আমি পড়লাম বেকায়দায়। যেখানে পোস্টটাই নেই, সেখানে কীসের প্রেক্ষিতে আর একটা পোস্ট করে ক্ষমা চাইব? এদিকে ওদের ধারণা হচ্ছে যে আমি ইচ্ছে করেই ক্ষমা চাইছি না। অথবা পোস্টটা আমি ইচ্ছে করেই দেখাচ্ছি না। পরিস্থিতির চাপে পড়ে আমি delete করে দিলাম বলায় ওরা শান্ত হল। কোনো বিতর্কে না গিয়ে আমি ক্ষমাও চাইলাম। ওরা বলল, নিচে কয়েকজন বয়স্ক মানুষ আছেন, একবার তুমি তাঁদের কাছে এসে ক্ষমা চেয়ে নাও। রাস্তায় বাড়ির সামনে তখন কিছু লোক ছিল, সম্ভবত তারা পাড়ার লোক। আমি ওদের সবিনয়ে বললাম, ‘এই পরিস্থিতিতে প্রকাশ্য রাস্তায় গিয়ে ক্ষমা চাইতে যে দু’ মিনিট লাগবে, সেই দু’ মিনিটেই আরও বিশটা লোকের কাছে তা ছড়াবে। ওদের বলো, দয়া করে একটু ওপরে আসতে, আমি ক্ষমা চেয়ে নেব।’ ওরা বুঝল। কিন্তু কেউ আর এল না। পাড়ায় বহু ব্যাপারে লিডিং ভূমিকা নেয় সালাউদ্দিন, সন্ধ্যাবেলা ওকে আবার ডেকে পাঠালাম। ও বলল, ‘ঠিক আছে, বিষয়টা আমি দেখছি।’ পাড়ার আরও কয়েকজন এসে আশ্বস্ত করল, তারা ব্যাপারটা মিটিয়ে নেবে। কিন্তু আমি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম না ব্যাপারটা ঠিক কতদূর ছড়িয়েছে। কারণ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় অতীতে দেখেছি, এমন প্রচার কিন্তু অসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে দাবানলের মতো ছড়ায়।
পরদিন অর্থাৎ ৩ এপ্রিল সকাল ন’টা নাগাদ বাড়িতে এলেন বড়ো মসজিদের ইমাম জনাব শারাফাৎ সাহেব। সঙ্গে পাড়ার কয়েকজন বয়স্ক ব্যক্তি। আমরা তাঁদের ঘরে বসালাম। তিনি পোস্টটা সম্বন্ধে আমার বক্তব্য জানতে চাইলেন। পোস্টটা কার, কীভাবে করা হয়েছে, এসব নিয়ে কোনো বিতর্কে না গিয়ে আমি ব্যাপারটা যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত করলাম। আমি বললাম, ‘ওটা বার করবেন না। ওটা খুবই অস্বস্তিকর, আপনারা রাখুন। পোস্টটা আমার সরাসরি না করা হলেও এর সমস্ত দায় আমার। আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আপনারা যা শাস্তি দেবেন তা আমি মাথা পেতে নেব।’ তিনি বললেন, ‘মসজিদে গিয়ে আলোচনা করে আছরের নামাজের পর তিনি আমাকে জানাবেন।’ আমি তাঁকে আমার ফোন নাম্বার দিতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘ফোন নাম্বার লাগবে না। প্রয়োজন হলে লোক পাঠিয়ে ডেকে নেব।’ আমি অনেকটা আশ্বস্ত হলাম। তাঁর ডাকের অপেক্ষায় থাকলাম।
দুপুর আড়াইটে নাগাদ হঠাৎ বাড়ির বাইরে শুনলাম অনেক মানুষের হইচই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রচুর মানুষ ঘরের দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ল। ওরা রান্নাঘরের জানলা ভেঙে দেয়। কম্পিউটারের ঘরটা ভেঙে তছনছ করে। তারা কেউ আমাকে চেনে না। ওরা বলছে, ‘ফারুক কে?’, ‘ফারুক কে?’ আমিও তাদের ঠিক চিনতাম না। আমার মা আমাকে আগলে রাখতে চায়। কিন্তু ওদের ধাক্কায় মা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মায়ের হাত থেকে ছিনিয়ে আমার স্ত্রী-পুত্রের সামনেই মারতে মারতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল মসজিদে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমার পাড়ার লোক তখন বিহ্বল। তাদের পক্ষেও সেই মুহূর্তে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। খালি গা, রক্তাক্ত লুঙ্গি। মারাত্মক জখম আর আপাদমস্তক রক্তাক্ত অবস্থায় আমাকে আনা হল মসজিদে। পরে শুনেছি, এর মাঝে বিকেল চারটে নাগাদ একবার এবং সাড়ে দশটা-এগারোটা নাগাদ আর একবার আক্রমণকারীরা পাড়ায় এসেছিল। কিন্তু পাড়ার লোক জড়ো হয়ে তাদের আটকে দেয়, কোনো ভাঙচুর করতে দেয়নি।
কিছুক্ষণ পর বিকেল চারটে নাগাদ ওই মসজিদে এলেন প্রাক্তন বিধায়ক আব্দুল খালেক মোল্লা, ইমাম শারাফত সাহেব এবং আরও অনেকে। তাদের উপস্থিতিতে মসজিদের তিনতলায় বসে আমাকে দিয়ে একটা মুচলেকা লেখানো হল। তাতে আমি পুরো ঘটনার দায় স্বীকার করে নিয়ে আবারও ক্ষমা চাইলাম, তবে এবার লিখিতভাবে। মগরিবের নামাজের পর আনুমানিক বিকেল পাঁচটার পরে ওখানে এলেন আইনুল বারি সাহেব। তিনি একজন ইসলামিক স্কলার, বাড়ি গাজিপাড়ায়। ওঁকে সম্ভবত ডেকে আনা হয়েছিল। ওঁর উপস্থিতিতে আমার মুচলেকা মাইকে পড়ে শোনানো হল। এর পরে আইনুল বারি মাইকে বললেন, ও যে অপরাধ করেছে তা খুবই গর্হিত। ইসলামি শরিয়তের বিচারে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। সৌদি আরবে বা ইসলামি রাষ্ট্রে ওকে মেরে ফেলাই হত। এই ‘মেরে ফেলা’ কথাটা তিনি কয়েকবার উচ্চারণ করেন। শেষে তিনি বললেন, হজরত মহম্মদকে তৌহিদ করা হয়েছে। সুতরাং এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। যেহেতু এটা ভারতবর্ষ, তাই আমাদের গণতন্ত্রের প্রতি সম্মান জানানো উচিত।
আমার সঙ্গে আইনুল বারি সাহেবের কোনো বাক্য বিনিময় হয়নি। আমার মনে হয়েছিল, গণতন্ত্রের কথা বলে তিনি বলতে চেয়েছিলেন, আমাকে খুন করাটা ঠিক নয়। আমি ভীষণভাবে চেয়েছিলাম, আইনুল বারি সাহেবের সঙ্গে বা মৌলানা সাহেবের সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু আমাকে বলতে দেওয়া হয়নি। আসলে আমার নিরাপত্তার কারণেই ওরা সেটা চাইছিল না। তবে আমার মনে হয়, আমার কথা অন্তত মৌলানা সাহেব একটু শুনলে ভালো হত।
আমাকে মসজিদে কখনও তিনতলায়, কখনও চারতলায় রাখা হয়েছিল। আমার লুঙ্গিটা ছিঁড়ে গিয়েছিল, আমাকে একটা পুরোনো লুঙ্গি পরতে দেওয়া হয়েছিল। প্রচণ্ড রক্ত ঝরছিল, আমাকে বাথরুমে মুখ-হাত ধুতে দেওয়া হয়েছিল। মসজিদ প্রাঙ্গণে ভিড় উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল। আস্তে আস্তে পরিস্থিতি চলে গেল সমস্ত নিয়ন্ত্রণের বাইরে। রাত বাড়ার সাথে সাথে পুলিশ এল, পরে র্যাফও এল। উত্তেজনা তখন চরমে। তারপর পুলিশের হস্তক্ষেপে তারা আমাকে উদ্ধার করে লালবাজারে নিয়ে গিয়ে নিজেদের হেফাজতে রাখল। আমাকে নিয়ে যখন পুলিশ মসজিদ থেকে বেরিয়ে এল, বাইরে অন্ধকার। দূরে অনেক লোক রয়েছে এক ঝলক দেখেছিলাম। আর দেখেছিলাম পুলিশ আর র্যাফ রয়েছে। গাড়িতে তোলার পর আমাকে শুইয়ে দেওয়া হল, আমি আর কিছু দেখতে পাইনি।
মসজিদ কমিটির বেশিরভাগ খুবই ভালো ভূমিকা নেয়। আমি পানি চাইলে তারা কেউ এনে দেয়, আবার এক-আধজন আমার ওপর রেগে পানি পা দিয়ে ঠেলে ফেলে দেয়।
আমার বুকে, পেটে আর কোমরে আঘাত লেগেছিল। মারের ফলে মুখে প্রচণ্ড লেগেছিল, কেউ ইট মেরেছিল তাতে রগের কাছটায় এসে লেগে কেটে গিয়েছিল। জ্ঞান হারাইনি। আমি বুঝতে পারছিলাম, একবার আমি পড়ে গেলে ওদের মারে শেষ হয়ে যাব। তবে আমাকে যারা নিতে এসেছিল, তাদের মধ্যে আবার অনেকেই আমাকে বাঁচাতে বাঁচাতে নিয়ে গেছে, আগলেও রেখেছে। নাহলে আমি ওখানেই মারা পড়তাম। পরে শুনলাম, কিছুটা যাওয়ার পরে কেউ নাকি আমার গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে দিয়েছিল, জ্বালিয়ে দেবে বলে। আমি নিজে দেখিনি। তার আগে কেউ কেউ বলছিল, ‘তোর গর্দান কেটে দেব’, ‘তোকে মেরে ফেলে দেব’, ইত্যাদি। উল্টো কথা বলার লোকও হয়তো অনেকেই ছিল, কিন্তু তারা চুপ করে গিয়েছিল। যারা মেরেছে, বড় মসজিদতলার পাড়ার ছেলে কিছু ছিল। তাদেরই কেউ কেউ আমাকে বাঁচানোর চেষ্টাও করছিল। আমি নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত ছিলাম। ওই ভিড়ের মধ্যে কারো মুখ মনে রাখতে পারিনি।
যারা আমার বাড়িতে এল, তারা ভাঙচুর তো করলই, এসে জিজ্ঞেস করছে, ‘ফারুক কে? ফারুক কে?’ অর্থাৎ তারা ফারুককে চেনে না। তারা এ ঘর ও ঘর করে আমার কম্পিউটার টেবিলের কাছে এল। সেই টেবিলে একটা পেন-ড্রাইভে আমার দু-হাজার টাকা জড়ানো ছিল, সেটা নিয়ে নিল, আমার মোবাইলটা নিল। মারতে মারতে আমায় নিচে নামিয়ে আনার পর আমার গলার সোনার চেনটা ছিনিয়ে নিল। মসজিদের চারতলায় ছোট একটা ঘরে আমাকে রেখে দেওয়া হয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য, সেখানে তিন-চারটে অল্পবয়স্ক ছেলে জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার ডানহাতের আংটিটা খুলে নেওয়ার চেষ্টা করে। খুলছে না দেখে আমার গাল থেকে রক্ত নিয়ে আঙুলে লাগিয়ে ফের খোলার চেষ্টা করে। সবাই তখন নীচে। আমাকে পুলিশ উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার আধঘণ্টা আগে এই ঘটনাটা ঘটে। এই ছেলেরা কারা? এরা কি ইসলাম ধর্মের রক্ষার জন্য এসেছিল? যারা আমাকে মসজিদে নিয়ে যাওয়ার পর বিকেল চারটের সময় ফের পাড়ায় এসেছিল ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিতে, দোকান ভাঙচুর করতে, লুটপাট করতে, তারাই বা কারা? আমি তো তখন মসজিদে, তাহলে কেন এরা ঘুরে এসেছিল? এটা ভেবে দেখা দরকার।
ঘটনার পশ্চাদপট
এবার আসি কিছু অন্য প্রশ্নে। যে কাগজটা আমি সেদিন দেখলাম, সেটা একটা ফেসবুকের পোস্ট। মাত্র একজন ছাড়া কেউ এই পোস্টটা সরাসরি ফেসবুকে দেখেছে বলে দাবি করতে দেখিনি। অথচ সেটা এত দ্রুততার সঙ্গে ছড়িয়ে দাবানলের চেহারা নিল কী করে? এর নেপথ্যে কারা?
বছর চারেক আগে আমি আমার বাড়ির ঠিক সামনে একটা হলঘর আমার কাজের স্টুডিও তৈরি করার জন্য লিজ নিই। ওই বাড়ির মালিকের নাম জুবায়ের। বাড়িওয়ালার সঙ্গে পাঁচ বছরের চুক্তি হয়, কিন্তু সেটা ছিল মৌখিক। বহু ব্যয়ে সেই দোকানটা ডেকরেশন করতে হয়েছিল। কিন্তু পরের বছর থেকেই তিনি বিভিন্ন অজুহাতে ঘরটি ছেড়ে দিতে বললেন। প্রতি বছর লিজের অর্থের পরিমাণ বাড়িয়ে চার বছর কোনোক্রমে থেকে যাই। শেষ বছর তিনি বললেন, ওই ঘরে তিনি নিজেই একটা কম্পিউটার এমব্রয়ডারি মেশিন ফেলবেন। অগত্যা তাঁর প্রয়োজনের কথা ভেবে আমি ঘরটা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ২০১৩ সালের নভেম্বরের শেষে আমি ঘর খালি করে চাবি দিয়ে দিতে চাইলাম। সঙ্গে একটা অনুরোধ করেছিলাম, ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ঘণ্টাখানেকের জন্য চাবিটা একবার দিতে, সেই সময় ডেকরেশনের একটা অংশ খোলার জন্য যে মিস্ত্রি লাগবে তিনি আসতে পারবেন। বাড়িওয়ালা সরাসরি মুখের ওপর বললেন, একদিনের জন্য হলেও তাঁকে পুরো মাসের ভাড়া আট হাজার টাকা দিতে হবে। উপায়ান্তর না দেখে আমাকে তাতেই রাজি হতে হয়।
বাড়িওয়ালার এই মনোবৃত্তি দেখে আমার ভিতরে খুব রাগ হয়। সেই সময় এই ঘটনাটা আমি ফেসবুকে পোস্ট করি। তাতে অনেকে অনেকরকম মন্তব্যও করে। আমার বক্তব্য ছিল, এই ভদ্রলোক তো নামাজি পরহেজগার। তিনি কয়েক লাখ টাকা ব্যয় করে কুরবানিও করেন। বিশেষ কারণে তিনি ওই বছর হজে যেতে পারেননি। তাঁর এরকম ব্যবহার! এক ধার্মিক মানুষের এই আচরণ আমার কাছে কষ্টের ছিল। আমার ফ্রেন্ডলিস্টে নাম না থাকা সত্ত্বেও বাড়িওয়ালার ছেলে মিঠু পোস্টটা দেখেছিল। আমার পোস্টটা দেখে স্বাভাবিকভাবেই তার খারাপ লাগে এবং সে কিছুটা প্রতিশোধস্পৃহ হয়ে পড়ে। এটা আমায় বলেছিল বাড়িওয়ালার বড়ো ছেলে লালচাঁদ। লালচাঁদের বউয়ের ডেলিভারির সময়ে পয়সার দরকার পড়েছিল। আমি ওকে বারো হাজার টাকা ধার দিয়েছিলাম। ও পরে শোধ দেয়। আমার ওপর আক্রমণের ঘটনার দিন ৩ তারিখ সকালে লালচাঁদ আমাকে ফোন করে বলে, তুমি আব্বার নামে একটা পোস্ট করেছিলে ফেসবুকে। ওইজন্যই মিঠুর একটা রাগ ছিল।
যে বিতর্কিত পোস্টটা লিফলেট করে ছড়িয়ে আমাকে ঘরছাড়া করা হল, সেটা ডাউনলোড করে প্রিন্ট ও বিতরণ করে এই মিঠুই। ওদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক যথেষ্ট ভালোই ছিল। ও ইচ্ছে করলেই আমাকে বিতর্কিত পোস্টটা সম্পর্কে সচেতন করতে পারত। আমি নিঃসন্দেহে তা delete করতাম। কিন্তু মিঠু তা না করে চরম প্রতিশোধ নিল।
দ্বিতীয়ত, আমার নিকটতম প্রতিবেশীর ভূমিকা উল্লেখ করা দরকার। আমরা আমাদের শরিকি বাড়িটার তিনতলার বাসিন্দা। আমরা তিন ভাই। আমার অন্য দুই ভাই অন্যত্র বসবাস করে। এই বাড়িতে থাকতাম আমি, আমার অসুস্থ বাবা, মা, আমার স্ত্রী এবং নাবালক ছেলে। আমার প্রতিবেশীর বড়ো সমস্যা আমি, আমাকে কোনোভাবে তাড়াতে পারলেই আমাদের যৌথ বাড়ির একচ্ছত্র অংশীদারিত্ব তাঁরই। তিনি আমার জেঠিমা। তিনি কিছুদিন আগেই আমাকে হুমকি দিয়েছিলেন যে তিনি দেখে নেবেন। আমায় বলতেন, ‘আমি নামাজপাটিতে বসে তোর নামে দোয়া করছি। তোর ওপর আল্লার গজব পড়ে না!’ আমার জ্যাঠা ছিলেন নজরুল ইসলাম কাসেমি। তিনি ছিলেন যথেষ্ট পণ্ডিত, দেওবন্দ দারুল উলুম থেকে শিক্ষা পেয়েছিলেন এবং মনের দিক থেকে উদার ও মানবিক। ১৯৮৯ সালে তিনি মারা যান। আমাদের বাড়ির নিচে জেঠতুতো ভাই রওনাকুল ও নাদিমুল ইসলামের দোকান। ওই দোকানের প্রিন্টার ও জেরক্স মেশিনে লিফলেটটা কপি করা হয়, প্রথমে পঞ্চাশ কপি, তারপর আরও অনেক কপি।
বিতর্কিত পোস্টটা আমি লিখিনি। তাহলে নিশ্চয় প্রশ্ন উঠবে, আমার ফেসবুকে সেটা কীভাবে এল? কোনো এক বিশেষ সময়ে বিশেষ কারণে (?) আমার পাসওয়ার্ড দিয়েছিলাম সোহন অগ্নিবীর, এলিজা নিনো সহ আরও কয়েকজনকে। তারা কখনও এটার অপব্যবহার করবে না, এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। বাস্তবে তারা কখনও তা করেওনি। ধর্ম সহ রাজনীতি ও অন্যান্য বিষয়ে তারা আমার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য অনেক সময় inbox message করে এবং কখনও সরাসরি আমার profile–এ তারা কিছু পোস্ট করত। অনেক সময় বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন page–এ করা আমার মন্তব্য তারা রিপোর্টও করত। যেহেতু আমি দিনের অনেকটা সময়ই অনলাইন থাকতাম, আমার অগোচরে আমার ফেসবুকে তেমন কিছু ঘটত না। কিন্তু বিতর্কিত পোস্টটা কোনোভাবে আমার ফেসবুকে এসেছিল। তারই সূত্র ধরে আমার ও আমার পরিবারের ওপর এক নিষ্ঠুর আক্রমণ নেমে এসেছে। ভুল আমার হতে পারে। কিন্তু আমার আট বছরের শিশুপুত্রের কী অপরাধ? কী অপরাধ আমার পঙ্গু বাবার? আমার পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি মায়ের অপরাধ কী? আমার স্ত্রীয়েরই বা অপরাধ কী? কেন তারা আমাকে ছাড়া এক অসহায় জীবন কাটাচ্ছে?
----------------------
সম্পাদকের টীকা :
১। বিতর্কিত পোস্টটা আমিও পরে ফেসবুকে দেখতে পাইনি। তবে অনেকটা একই ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে একটা পোস্ট পরে নেটে পেয়েছিলাম, সেটা ছিল এরকম :
“ইসলাম বিশ্বাসীদের বহুল প্রচারিত ও প্রচলিত বিশ্বাস এই যে, বানু কুরাইজা খন্দকের যুদ্ধে কুরাইশদের সাহায্য করেছিলেন বলেই মুহাম্মদ তাদেরকে আক্রমণ ও খুন করেছিলেন। তাদের এই বিশ্বাস যে কী পরিমাণ ‘নির্লজ্জ ও মিথ্যা অপ-প্রচারণার ফসল’ তার সাক্ষী কুরান হাদিসের বর্ণনা। যে মুহাম্মদ শক্তি না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র তাঁর সাথে ভিন্নমতের কারণে নিজের নিকট আত্মীয়কে অভিশাপ দেন, ক্বাব, আবু-রাফি এবং সামান্য কবিতা লেখার অপরাধে ‘জননীকে’ করেন খুন। মক্কা বিজয়ের পর দশজন পুরুষ ও নারীকে (অপরাধ: দশ বছরেরও বেশি আগে তাঁরা তাঁকে ব্যঙ্গ করেছিলেন) যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই (এমনকী তা যদি ক্বাবার মধ্যেও হয়) খুন করার রায় দেন; সেই একই মুহাম্মদ তাঁর শত্রুপক্ষকে সাহায্যকারী বানু কুরাইজার ‘দুশমনি’ বেমালুম ভুলে গিয়ে বাসায় এসে ‘গোসল করতেছেন!’ এমনকী জিবরাইল এসে তাঁকে তা মনে করিয়ে দেওয়ার পরও বুঝতে না পেরে জিবরাইলকেই জিজ্ঞাসা করছেন, ‘কোথায় তাকে আক্রমণ করতে হবে!’ এ সব উদ্ভট বর্ণনার মাধ্যমে বানু কুরাইজাকে ‘দোষী সাব্যস্ত করার কসরত’ আরব্য উপন্যাসের গল্পকেও হার মানায়। বানু কুরাইজার অত্যন্ত করুণ এই ঘটনা মুহাম্মদের বহু বহু নিষ্ঠুরতার একটি। বানু কুরাইজার কোনো সদস্য মুহাম্মদ কিংবা মুসলমানদের কোনোরূপ আক্রমণ করেননি। They never attacked Muslims! সত্য হচ্ছে, বানু কুরাইজা হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ ‘সম্পত্তি-নারী-দাস’ দখল (৩৩।২৭)!”
২। ফেসবুকে পাওয়া প্রাসঙ্গিক একটা পোস্ট : “প্রাণে বেঁচে গেছে আমার এক ভারতীয় মুক্তমনা বন্ধু। মাসখানেক আগে হঠাৎ ইনবক্সে বলল যে, খুব ঝামেলায় পড়েছে। বলেই একাউন্ট বন্ধ করে দিল। সেদিন থেকেই মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল --- কেউ তাকে ধরে ফেলল না তো! আজ যোগাযোগ করেছে। "কেউ" নয় বরং কয়েক হাজার মৌলবাদী মুমীন বান্দা তার ঘর ঘেরাও করে তাকে ধরে ফেলেছে! বেদম প্রহার করেছে। পুলিশ এসে প্রাণে মরা থেকে বাঁচিয়েছে। এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বন্ধুটি স্বনামে ফেসবুকে মুক্তমনা পোস্টিং করত। মৌলবাদীরা তার পোস্টগুলো লিফলেটে ছাপিয়ে লোক খেপিয়ে তুলেছিল। পরে সবাই মিলে প্রাণে মারতে এসেছিল।
আমার অনেক নবীন বন্ধুই ফেসবুকে স্বনামে (রিয়েল আইডেন্টিটি) পোস্টিং করেন। আপনাদের জন্য আমি সমান শঙ্কিত। নাস্তিকতা বা মুক্তমনা ভাবাদর্শ কোনো বীরত্ব প্রকাশের মাধ্যম নয়। এটা নিজেকে জাহির করার বিষয় নয়। বিষয়টা হল জ্ঞান ও তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার। সেটা স্বনামে করা হল কি বেনামে --- তা আদৌ মুখ্য নয়; বিশেষত দেশে যখন প্রকাশ্যে মতামত প্রকাশের পরিবেশ তৈরি হয়নি, তখন তো মোটেই নয়! আমাদের আরও অনেক কাজ করতে হবে। বছরের পর বছর কাজ করে যেতে হবে। সেটা বেনামে হলেই বরং ভাল। কেউ কেউ হয়তো স্বনামে করে টিকে যাবেন বা গেছেন, তাঁদের কথা আলাদা। সবার পরিবেশ পরিস্থিতি এক নয়।
যারা নাস্তিকতার প্রচার প্রসারে লেখালেখি করছেন, আপনাদের প্রতি অনুরোধ বেনামে করুন। আমাদের দেশের পরিস্থিতি ভারতের চেয়ে অনেক খারাপ। এখানে পুলিশ আপনাকে বাঁচাতে আসবে না --- পারলে বরং মৌলবাদীদের সাথে হাত মিলিয়ে দু ঘা দিয়ে ছোয়াব কামানোর চেষ্টা করবে। সচেতন হোন। নিজের নিরাপত্তার ভার নিজে নিন। বোকামো করবেন না।
আমি ডুয়েল আইডেন্টিটি মেনটেইন করে চলি। সমাজে সংসারে আমি ‘কালচারাল মুসলিম’। ইনশাল্লাহ, সুবহানাল্লাহ, স্লামালেকুম বলে সমাজে চলাফেরা করি। কারণ, আমি জানি আমাকে মুক্তমনা হয়ে অনেক কাজ করতে হবে, বছরের পর বছর কাজ করতে হবে। যদি নিজেকে নিজেই বিপদাপন্ন করে ফেলি তো কাজ করব কীভাবে? এটা আমার স্ট্র্যাটেজি। যতদিন না আমরা প্রকাশ্যে মতামত প্রকাশের পরিবেশ তৈরি করতে পারছি, ততদিন আমি আমার স্ট্র্যাটেজিতে অটল থাকব। কে কী ভাবল, তাতে আমার কিছ্ছু আসে যায় না। কথা নয়, কাজ চাই --- কাজ।
ভালো থাকুন সবাই। নিরাপদ থাকুন। জয় হোক মুক্তমনের। ”
Elijah Neo, May 6, Facebook
মন্থন সাময়িকী পত্রিকার নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০১৪ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত। 'এখন আলাপ' ব্লগে সম্পাদকের অনুমতিক্রমে বানান ও ভাষা অপরিবর্তিত রেখে পুনঃপ্রকাশিত।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply