বছর শেষের দোরগোড়ায় এসে
0 132বছর শেষ হতে চলল, নতুন বছরের পিকনিক, সার্কাস, উল্লাস এবং সিজনস গ্রিটিংস-এর হুল্লোড় শুরু। রঙবেরঙের কার্ড আর সাজসরঞ্জাম, বেলুন আর ফিতের মধ্যে হিসেব চলতেই থাকে, এ বছরটায় কী পেলাম কী না পাওয়া রইল।
খুব কঠিন এই খতিয়ান নেওয়া। যত দিন যায় তত মনে হয় কিছুই পালটাচ্ছে না। যত আশাবাদী হয়ে বলি সব ভাল, সব শান্তিকল্যাণ হবে এইবার, আবারো একটা আধটা ধাক্কায় পড়ে যাই নিরাশার ঘোলা জলে।
যেমন বছর শেষের দোরগোড়ায় এসে, একটা ছোট্ট মেয়ের ফ্রকে রক্তের দাগ লাগল। জ্বরের ঘোরে, ট্রমায়, ভয়ের থরথর কাঁপনে সে মেয়ে ঢুকে গেল এক অন্ধকারের দিনকালে। ঠিক কয়েক মাস আগে কীর্তন গায়ক নরপিশাচ বিকৃতরুচি সনাতন ঠাকুর একটা আড়াই বছরের শিশুর ওপর যৌন নির্যাতন শুধু চালায়নি, তার শরীরে সাতটি বড় সূচ বিঁধিয়ে রেখেছিল দিনের পর দিন। সে শিশুর মৃত্যুর আগে পরে সামাজিক মাধ্যমের প্রতিক্রিয়ার কথাটা মনে পড়ছে আজ। কিন্তু সেদিনের সে ঘটনা ইতিমধ্যেই মাথা থেকে ঝরে পড়ে গেছে সীমিত স্মৃতির জনগণের। এমনকি তারও আগে সেই বারো সালের ডিসেম্বরের আরো এক ভয়াবহ ধর্ষণকান্ডের স্মৃতি ও পরবর্তী প্রতিবাদ-চীৎকারের স্মৃতিও পানসে। নির্ভয়ার পরে আরো কত কত মেয়েকে যে ধর্ষিত হয়ে খুন হতে হয়েছে, গোণাগুনতি নেই।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার পথ একবার উন্মুক্ত হয়ে গেলে, তীব্র এবং চূড়ান্ত কিছু কথা বলে ফেলতে পারলে যে তড়িৎমোক্ষণ ঘটে, তাতে সাময়িক শান্তি পাই আমরা, পাবলিক নামাঙ্কিতরা। দীর্ঘস্থায়ী কোনো কাজ তাতে হয় কি? রাণিকুঠির জিডি বিড়লা ইস্কুলে দুই ফিজিকাল এডুকেশনের শিক্ষকের চার বছরের শিশু এক ছাত্রীর ওপর নির্যাতনের প্রতিক্রিয়া গত কয়েকদিনে একটা ঢেউয়ের মত উঠে, আছড়ে পড়েছে আমাদের চেতনায়। আবারো গান কবিতা বিতর্ক দোষারোপ শাপশাপান্তের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে একটা সত্য বা তথ্য, আমাদের সমাজে এ ঘটনা নতুন নয়, এ ঘটনা চারিদিকে চোখ মেললেই দেখা যাবে। বহুধাবিভক্ত ভাবনাচিন্তার সূত্র। কখনও প্রাইভেট স্কুলগুলোর দায়দায়িত্বহীনতার কথা উঠছে, কখনো বা উঠছে বাবামা কোন মুখে ছোট ছোট ফুলের মত মেয়েগুলিকে ইস্কুলে পাঠাবেন, কাদের ভরসায়, সেকথাও। জানা গেছে তিন বছর আগেও এমন অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিল সেই স্কুলেই। জানা যাচ্ছে যে স্কুল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে তারপরও কোনো প্রতিকার ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি, করিডোরে বা বাথরুমের সামনে বসেনি সিসিটিভি, ছোটদের জন্য নেই আয়া।
এইবার, এ লড়াই শুরু হতেই দেখা গেল, কাছেই বেহালায়, এমপি বিড়লা স্কুলে, আরো এক শিশুকন্যা নির্যাতিত হয়েও বিচার পায়নি, তিন মাস আগের ঘটনা সেটা। কিন্তু সে ঘটনাও তো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পরিসংখ্যান বলছে সারা ভারতের ৫৩% শিশু, কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার। আর শুধু কন্যাশিশু নয়। বালিকাদের প্রায় সমান সংখ্যক বালকও নির্যাতিত হয় কখনো না কখনো। শিশুরা কতটা আদৌ সংরক্ষিত ইশকুলের মত একটা চৌহদ্দিতে, সে প্রশ্নও তো উঠে গেছে কিছুদিন আগে উত্তর ভারতের হরিয়ানায়, গুরগাওঁ-এর রায়ান পাবলিক স্কুলে এক বালকের খুনের ঘটনায়।
এক্ষেত্রে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে যা যা চাইছি তা তো মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া। যেমন কেউ কেউ বলবেন লিঙ্গচ্ছেদ চাই, কেউ বলবেন গণপিটুনি। এগুলি আবেগের প্রতিফলন কিন্তু কোনো গণতান্ত্রিক দেশ যেখানে যেকোনো অপরাধের বিচার আইনি পথেই হয়, সে পথ যত দীর্ঘসূত্রীই হোক, সেদেশের বাসিন্দা আমরা জোর দিয়ে চাইতে সত্যিই পারি না গণধোলাই অথবা সর্বসমক্ষে পাথর ছুঁড়ে অপরাধীকে মারার কথা।
যা যা চাইতে পারি তেমন একটা উইশলিস্ট করি বরং।সবাইকে, জনে জনে, বিজ্ঞাপিত করে জানানো হোক, পকসো-র কথা।যা আমরা অনেকেই জানি না। বেশিদিন নয়, এই তো, ২০১২তেই আইনে পরিণত হয়েছে পকসো -” প্রোটেকশন অফ চিলড্রেন এগেন্সট সেক্সুয়াল অফেন্সেস”। আইনটি নতুন বলেই এখনো অনেকেরই জানা পর্যন্ত নেই এই আইনের পরিধি ও প্রয়োগ। অথচ এ আইন আনাই হয়েছিল আগেকার ইন্ডিয়ান পিনাল কোড বা ভারতীয় দন্ডবিধির কিছু সীমাবদ্ধতাকে মাথায় রেখে। একটা সীমাবদ্ধতা অবশ্যই ছিল এই, যে, দন্ডবিধির যে সব ধারায় বিচার চাওয়া যেত সেগুলো বেশিরভাগই শিশুকন্যাদের জন্য প্রযোজ্য এবং চিরাচরিত ধর্ষণের সংজ্ঞার ওপর প্রতিষ্ঠিত। নতুন আইনে, শিশুপুত্রদেরও অত্যাচারিত শিশুর আওতায় আনা হয়েছে আর যৌন নির্যাতনের সংজ্ঞার আওতায় নানাধরণের বিকৃতকাম ব্যবহারকে আনা হয়েছে।
পকসো-র নাগালে যেকোনো অভিযোগের বিচারপ্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা হোক। যাতে মানুষ রিপোর্ট করতে ভয় না পান, নির্যাতিতের পরিবার এগিয়ে আসেন বিচার নিতে, চাইতে। ইস্কুল হোক বা যেকোনো পাবলিক প্লেস, যেমন পার্ক বা ময়দান বা বাজার-শপিংমল-সিনেমা হল-অডিটোরিয়াম... কোথাও কোনো অন্ধকার টয়লেট এরিয়া, করিডোর বা হলঘরের বাতি নেভার পরবর্তী নির্জনতা... সেখানে যদি কিছু ঘটে, তাকে অস্বীকার যেন না করি। আসলে এসব ক্ষেত্রে,
ডিনায়াল বা অস্বীকার আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। স্কুলের নাম খারাপ হবে তাই প্রিন্সিপাল বললেন, বাচ্চাটা বোধহয় মিথ্যে বলেছে, প্রমাণ দেখান।সংস্থার নাম খারাপ হবে তাই সিইও বললেন, ওটা ছোট ঘটনা। রাজ্যের নাম খারাপ হবে তাই সর্বোচ্চ ব্যক্তি বললেন, এসব দুষ্টুমি, ছেলেপিলেরা করেই থাকে। এই অস্বীকার বা ডিনায়ালের আবহ থেকে কবে আমরা বেরোব? কবে আমরা সহমর্মিতা, সহানুভূতির সঙ্গে সেই নির্যাতিতর দিক থেকে বিষয়টা দেখতে পারব? নিজেদের অক্ষমতা ঔদাসিন্য বা দোষ ঢেকে দিতে, কবে আমরা চোখ বুজে বিষয় টানা দেখার চেষ্টা থেকে অব্যাহতি পাব। অন্ধ হলে প্রলয় যে বন্ধ থাকে না একথা ভাবা খুব জরুরি। এই ডিনায়াল যেমন কর্তৃপক্ষ স্থানীয়দের হতে পারে, তেমনই হতে পারে আবার বাবা-মায়েদেরও। তাঁরা যদি হাত-পা ভাঙা বা যেকোনো অ্যাক্সিডেন্টের সঙ্গে যৌন হেনস্থাকে এক করে দেখিয়ে তাকে লঘু করে ফেলেন সেটাও একধরণের অস্বীকার। কিছু ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং দরকার পেশাদার মনস্তাত্ত্বিকের হাতে। নইলে আজীবন ক্ষত বহন করে শিশুটিও বিকৃত হয়ে যেতে পারে। অন্য দিকে শিশুর সঙ্গে কিছু ঘটলেই, শিশুটিকে বকাঝকা , মারধোর, বা “কেন অন্ধকার কোণায় গেছিলি?“ অথবা “ইশকুলে গেলে বাথরুম চেপে থাকবি তবু বাথরুমে যাবি না” বলা কত বড় ভুল, যে কারণে কিছু ঘটলেও, বাচ্চারা অনেক কিছু বাবা-মায়ের ভয়েই চেপে যেতে চায়, যতক্ষণ না ফ্রকে রক্তের ছোপ পড়ে, ভাবতে হবে। বাচ্চারা মা-বাবাকে অনেক যৌন হেনস্থার কথা বলেই না হয়ত। বিখ্যাত অভিনেত্রী-নেত্রী যখন বলেন, ধর্ষিতা কেন রাতের অটোতে বাকি তিনজন পুরুষ দেখেও সেটায় চড়ার মত ভুল করেছিল (অটো বা বাস বা রাস্তায় নিরাপত্তার দায়িত্ব না নিয়ে সরাসরি নির্যাতিতকে দায়ী করলেই ঝামেলা চুকে যায় যে!), তখন যা ঘটে সেও এই একই মুদ্রার অন্য পিঠ। ভিক্টিম ব্লেমিং।
২
একইসঙ্গে ২০১৭ আমাকে দিয়েছিল মি টু ক্যাম্পেন। অসাধারণ এক সুযোগ, সবার সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়ার। ১৫ অক্টোবর ২০১৭ রাত থেকে হ্যাশট্যাগ মি টু ক্যাম্পেন উত্তর আমেরিকার বুকে আছড়ে পড়ল। যৌন হয়রানির শিকার বা ভিক্টিমদের অন্তরাল থেকে বের হয়ে এসে আত্মস্বীকারোক্তি। মেয়েরা নীরবতা ভেঙে দিয়ে বলছেন, আমিও! আমারো ঘটেছে যৌন হেনস্থা।
লুকিয়ে রাখা একটি বিষয়। চূড়ান্ত গোপনীয় , লজ্জাকর বিষয় বলে বিচার্য। যেমন, যা থেকে সূত্রপাত এই স্বীকারোক্তির, সেই ঘটনাগুলো। বিভিন্ন অভিনেত্রীর সঙ্গে হলিউডের প্রযোজক হার্ভে ওয়াইনস্টাইনের গত ত্রিশ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে করে চলা নির্লজ্জ যৌন আগ্রাসন। সগর্বে, প্রকাশ্যে, যা তিনি করেছেন যেকোনো উঠতি বা প্রতিষ্ঠা আকাঙ্ক্ষী মহিলার সঙ্গেই। ডেকে নেওয়া তাদের নিজস্ব হোটেলের ঘরে। কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রতিদান হিসেবে তাদের শয্যাসঙ্গিনী হতে বলা। অবাঞ্ছিতভাবে স্পর্শ করা। ইত্যাদি ইত্যাদি।
শুধু একমাত্রিক নয় এই অভিজ্ঞতা। জীবন তো নানা অভিজ্ঞতার সমষ্টি। ভাল ও খারাপ। তার ভেতরে বেছে বেছে , একটি মানুষ, যখন সে ঘটনাচক্রে এক মেয়েমানুষও, নানা দৃশ্য-শ্রাব্য-স্পর্শযোগ্য উপাদানের ভেতরে, জমা হয়ে উঠতে দেখে না কি, কোনো কোনো চূড়ান্ত অবমাননাকর কিছু অভিজ্ঞতাকেও? একটি মেয়ে সন্তান তার ছোট থেকে বড় হবার পুরো পথটা এধরণের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আসতে থাকে, প্রায়শই।
শুধু মিথ্যার খোলশ থাকে বাইরে। থাকে ঢাকা চাপার আবরণ। বলা হয়, আসলে কিছু ঘটেনা। আমাদের মেয়েরা সব ভাল। আমাদের পরিবারে সব মেয়েরা সংরক্ষিত প্রাণী। আমাদের ছেলেরাও অপাপবিদ্ধ। যৌন হেনস্থা? সেটা আবার কী? খায় না মাথায় মাখে? এসব কিছুই নেই। হয়না।
মি টু , হ্যাশট্যাগ ক্যাম্পেন। ষোলই অক্টোবর সকালে ঘুম থেকে উঠে, নিজের টুইটার বা ফেসবুক খুলে, অনেকেই চেনা অচেনা মহিলাদের আত্মঘোষণা, মি টু! দেখে ভাবছেন, কী হল ব্যাপারটা? সেই থেকে হুলুস্থুল পড়ে গেছে । না শুধু মার্কিন মুলুকে নয়। গোটা পৃথিবীর সমস্ত নেট-স্বাবলম্বী মহিলা (সেটা গোটা দুনিয়ার মেয়েদের কত শতাংশ, জানা নেই), ভাইরাল পথে নেমে এসেছেন। প্রায়। বলেছেন, আমিও যৌন হেনস্থার শিকার। আমিও অন্য, হেনস্থা হওয়া মেয়েদের পাশে।
গোটা ব্যাপারটাই কিন্তু ঘটছে নেটে। অর্থাৎ ভার্চুয়াল জগতে। সত্যি সত্যি পথে নামেনি কেউ। শুধু নিজের কথা খুলে লিখছে। এই প্রথম। আপত্তি, অস্বীকার, ডিনায়াল, মুখ ফেরানো, নীরবতা, কুঁকড়ে ঘরে বসে থাকা... এসবের থেকে উল্টোদিকে ঘুরে গিয়ে, যেন এই প্রথম ভাষা পেয়েছে এত এত মেয়ের, মহিলার, তরুণীর, প্রৌঢ়ার, যুবতীর ক্ষতবিক্ষত হৃদয়। নিজেকে প্রকাশ করতে চেয়েছে, হ্যাশট্যাগ মি টুতে। আমাকে কখনো না কখনো, বা একাধিকবার, যৌনলালসার শিকার হতে হয়েছে। এটুকু জানান দিতে পেরে, মনে হয়েছে, বেঁচে গেলাম এতদিনের নীরবতার অত্যাচার থেকে।
টুইটারে প্রথম এই ক্যাম্পেন শুরু করলেন, শ্বেতাঙ্গিনী মার্কিন অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানো। বললেন, তাঁর এক বন্ধুর কথা ধার করে। “If all the women who have been sexually assaulted wrote ‘Me too.’ as a status, we might give people a sense of the magnitude of the problem.”
মিলানো আরো বললেন, “If you’ve been sexually harassed or assaulted write ‘me too’ as a reply to this tweet.”
এই বিপদ, এই অন্যায়, লালসার এই থাবা কতটা বিস্তৃত, তা বোঝাতেই, এই ক্যাম্পেন। কত জন ভিক্টিম আসলে গোপনে রাখেন নিজেদের গল্প, সমস্যার কথা, তা জানান দিতেই শয়ে শয়ে মানবীর ঝাঁপিয়ে পড়া এই ভাইরাল ক্যাম্পেনে।
হ্যাঁ, যখন দশ বা বারো বছর বয়সে প্রথম একটা অসাধারণ নৃত্যানুষ্ঠান দেখে, কোনো অতি উচ্চমানের প্রেক্ষাগৃহের পেছনদিকের একাচোরা লেডিজ টয়লেটে একলা চলে গেছিলাম, আর পাশের অন্ধকার গলি থেকে একটা পুরুষ নামক প্রাণী হঠাত বেরিয়ে এসে ছুঁয়ে দিয়েছিল আমার বুক, বা জড়িয়ে ধরেছিল আমায় অকস্মাৎ, আমি হতভম্ব, প্রস্তরবৎ স্থাণু, ন যযৌ ন তস্থৌ... লোকটা চলে যাবার পর হু হু করে ধেয়ে এসেছিল ভয়-ঘেন্না-লজ্জা, ছুট্টে বেরিয়ে এসে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, কিন্তু কী এক অজানিতের আশঙ্কা কন্ঠরোধ করেছিল আমার। কিচ্ছু বলিনি মাকে। মা যদি ভাবে আমি এত অদ্ভুত কেন, আমি এত ক্যাবলা কেন। আসলে আমারই বোধ হয় কোন খুঁত, আমিই বোধ হয় সম্পূর্ণ আলাদা সবার থেকে, একা ও অকেজো, উদ্ভট। তাই আমার সঙ্গে এসব ঘটে।
আসলে যখন মেয়েটি ছোট, মেয়েটি যখন জানে না তার সঙ্গে এটা কী ঘটছে। কারণ তার কোন শরীর বোধ তখনো জাগেনি। নিজেকে সে নারী শরীর বলে চেনেই না।
একটা নোংরা স্পর্শ, অচেনা ও অপ্রত্যাশিত, ছোট মেয়েকে হতবাক করে দেয়। আর এটারই সুযোগ নেয় ওই লোকটা। যেভাবে, প্রফেশনাল হতে আসা মেয়েকে হঠাত টেনে বাথরুমে নিয়ে বাথটাবে ফেলে দেওয়া, তাকে এতটাই অবাক ও বিস্রস্ত করে দিতে পারে যে সে কোনমতে পালিয়ে এসেও এ জঘন্য অভিজ্ঞতাটি বলতেই পারে না।
এই সব নোংরা স্পর্শের অনেকটা ভাগ আমি পেয়েছি। অন্য অনেকের মতই।
পাঁচ বছর বয়সে কোন কাজের লোক বা বয়সে অনেক বড় তুতো দাদা “একটা মজার খেলা খেলবি, আয় আয়!” বলেছে, বা কোন পিতৃস্থানীয় বা পিতামহস্থানীয় কোলে বসিয়ে নিতে চেয়েছিল। সাত বছর বয়সে, রাস্তার ভিখিরি পয়সা চাওয়ার অছিলায় ছুঁয়ে গেছিল। দশ বছরে প্রেক্ষাগৃহের পেছনের গলির অচেনা লোকের জড়িয়ে ধরা, বারো বছরে পুজোর ছুটির ট্রেনে বাঙ্কে হঠাৎ ধেয়ে আসা পাশের সিটের কাকুর হাত... এইসবই অন্য অনেকের মত আমার জীবনের এক একটা জ্বলজ্বলে মাইলস্টোন।
পাড়ার মাস্তানদের “বালাম পিচকারি হায় তু নে মুঝে মারি” গেয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি তো অনেক পরের মাইলস্টোন, যখন স্কুল পেরিয়ে কলেজের দিকে যাত্রা।
এইসব মাইলস্টোন দিয়ে দিয়ে এ পোড়া বাংলার, এ পোড়া ভারতের, এ জ্বলা দক্ষিণ এশিয়ার, এ তপ্ত পৃথিবীর কোন মেয়ের নিজেকে মেয়ে হিসেবে চিনতে শেখা, আর নীরবতার অন্তরালে সে সব ঢাকতে শেখা, কারণ কেউ বলে দেয়নি (আজকের শিশুকে যা শেখানোর তোড়জোড় খুব) কোনটা গুড টাচ কোনটা ব্যাড টাচ, বলে দেয়নি এমন হলেই বলতে হয় বাবা মাকে, চিনিয়ে দিতে হয় নোংরা হাতের মালিককে... কেউ বলেনি, আমি তোমার পাশে আছি, বলেনি, এটা সবার সঙ্গেই হতে পারে, তুমি একা নও, তুমি আলাদা কিছু নও। কুঁকড়ে, গুটিয়ে নিজেকে ঢেকে ফেলতে চেয়েছে শিশু-কিশোরী-বালিকাটি... আর ক্রমশ বড় হয়ে উঠেছে নিজের শরীরকে ঘৃণা করতে করতে... নিজেকে ঘৃণা করতে করতে। নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবতে ভাবতে।
আজ মি টু ক্যাম্পেন এসে সবার মুখে একটা ভাষা দিচ্ছে। আবার বোকার মত আশাবাদী হব। যেভাবে, লেখিকা অ্যানি প্রুলস্ক বলেন, আমরা এখনো গল্পের শেষ পাতায় চাই হারানো শাবক খুঁজে পাবে তার মাকে, সব পাখি ঘরে ফিরবে, ফুরাবে এ জীবনের সব লেনদেন। অসম্পূর্ণ কিছু থাকবে না।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply