যুক্তি তক্কো অঙ্ক: লীলাবতীর কন্যারা
1 385‘মাথাখানা অঙ্কে ঠাসা ছিল। বাস্তবিক এমনি অঙ্কের মাথা আমি আর কোন মেয়ের দেখিনি, যদিও আমি নিজে অঙ্কে একশ’র মধ্যে একশ পেতাম।’
হচ্ছে পটদিদির কথা। ভারতের প্রথম মহিলা অঙ্ক গ্র্যাজুয়েট। নাম স্নেহলতা মৈত্র। আনুমানিক জন্মসাল ১৮৮৩। সংসারের দুঃখ তাঁর গায়ে লাগত না। নিজের হাতে তৈরি এক কল্পনার জগতে ছিল তাঁর বিচরণ। যে জগতের বুনিয়াদ অঙ্ক দিয়ে তৈরি।
স্বয়ং লীলা মজুমদারকেও যখন মেয়েদের অঙ্কের মাথা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করতে হয় তখন আর সমাজকে দুষে লাভ কী?
মনে না পড়ে পারে না লীলাবতীকে। ভারতীয় গণিতবিদ দ্বিতীয় ভাস্কর রচিত গ্রন্থ সিদ্ধান্ত শিরোমণি, যার একটি অধ্যায়ের নাম 'লীলাবতী'। লীলাবতী কে? এই নিয়েও তো প্রহেলিকা। সে কি ভাস্করের বিধবা হয়ে পিতৃগৃহে ফিরে আসা কন্যা যাকে তিনি ভুলিয়ে রাখার জন্য অঙ্ক শেখান নাকি সে তাঁর স্ত্রী? নাকি সে এক কাল্পনিক চরিত্র? এমন মনে হবার কারণ? কারণ কিছু সম্বোধন। কথোপকথনের ছলে অঙ্ক শেখাবার আঙ্গিকে রচিত এই গ্রন্থে কোথাও ‘বৎসে’ কোথাও ‘কান্তে’ কোথাও আবার ‘অয়ি বালে লীলাবতী’ লেখা। ব্যস। লীলাবতী অমনি কাল্পনিক। ভাবতেই কি আরাম! মেয়েরা যে অঙ্ক পারে এটা মেনে নিতে কি যে অস্বস্তি!
অথচ কি সরস ভাবেই না অঙ্ক শিখিয়েছিলেন লীলাবতী। একটি অঙ্ক তুলে দিচ্ছি-
‘whilst making love a necklace broke.
A row of pearls mislaid.
One sixth fell to the floor.
One fifth upon the bed.
The young woman saved one third of them.
One tenth were caught by her lover.
If six pearls remained upon the string
How many pearls were there altogether?’
(মূল সংস্কৃত থেকে অনুবাদ - T. Colbrooke)
লীলাবতী শাস্ত্রের শেষটিও কত সুন্দর!‘Joy and happiness is indeed ever increasing in this word for those who have Lilavati clasped to their throats, decorated as the members are with neat reduction of fractions, multiplications and involution, pure and perfect as are the solutions and tasteful as in the speech which is exemplified’
ইতিহাস লীলাবতীকে যতই উড়িয়ে দিতে চাক, ২০০৮ সালে ইন্ডিয়ান একাডেমী অফ সায়েন্স (ব্যাঙ্গালুরু) থেকে রোহিনী গোড়বলে ও রাম রামাস্বামী সম্পাদিত মহিলা বিজ্ঞানীদের যে জীবনীগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে তার নাম লীলাবতী’স ডটারস। অর্থাৎ ১১৫০ থেকে ২০০৮ মানে ৮৫৮ বছর লেগে গেল লীলাবতীর স্বীকৃতি পেতে।অবশ্য ভারতবর্ষে নারী বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞান মঞ্চে প্রবেশাধিকারই পায় না তা আবার স্বীকৃতি! লীলাবতীর মেয়েদের জীবন জুড়েই বঞ্চনা আর অবিচার। স্বয়ং সি. ভি. রমন রাজেশ্বরী চ্যাটার্জিকে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সে কাজ করার সুযোগই দেননি, বারবার ফিরিয়ে দিয়েছেন কমলা সোহনিকেও। যদিও শেষরক্ষা হয়নি। রাজেশ্বরী ঐ আই.আই.এস.সি.-এরই প্রথম মহিলা শিক্ষক হয়ে রমনকে সমুচিত জবাব দিয়েছেন। কমলা প্রকাশ্যে বলেছেন ‘বড় মাপের বিজ্ঞানী হলে কি হবে রমণের মনটা সংর্কীণ’ – উদাহরণ এখানেই থামছে না। ই.কে. জানকী আম্মালকে কোয়েম্বাটুরের ‘সুগারকেন ব্রিডিং ইন্সটিটিউট’ ছেড়ে লন্ডন চলে যেতে হয়েছিল পুরুষ সহকর্মীদের কটু মন্তব্য আর অসহযোগিতার জন্য। স্বামী স্ত্রী এক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে পারবে না, এই মনগড়া অজুহাতে চাকরি দেওয়া হয়নি দর্শনা রঙ্গনাথনকে। কলকাতায় ডাক্তারি পড়তে দেওয়া হয়নি আলেন ডি. আব্রু আর অবলা দাশকে (পরে ইনিই লেডি অবলা বসু। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর স্ত্রী।) এঁরা ১৮৮২ সালে মাদ্রাজ চলে গিয়েছিলেন ডাক্তারি পড়তে।
মেয়েরা যে অঙ্কে কাঁচা এই ধারণাটা প্রায় মিথের মতো নির্মাণ করা হয়েছে বহু যত্নে, বহু কাল ধরে। তাই শিবনাথ শাস্ত্রী যখন মেয়েদের জ্যামিতি, মেটাফিজিক্স এইসব পড়াতে চান এই যুক্তি দেখিয়ে যে ‘এ সকল না পড়াইলে প্রকৃত চিন্তাশক্তি ফুটিবে না’ তখন কেশবচন্দ্র সেন প্রবল আপত্তি জানিয়ে বলেন, ‘এসকল পড়াইয়া কি হইবে? মেয়েরা আবার জ্যামিতি পড়িয়া কি করিবে? তদপেক্ষা এলিমেন্ট্রি প্রিন্সিপাল অব সায়েন্স মুখে মুখে শেখাও।’
বুদ্ধিপ্রধান নয়, মেয়েদের চাই হৃদয়প্রধান শিক্ষা, যা তাদের বেশি বেশি মেয়ে করে তুলবে – এ ব্যাপারে রুশো থেকে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সবাই একমত।
রুশো যেখানে বলেছিলেন, ‘নারীর সমস্ত শিক্ষা হবে পুরুষের আপেক্ষিক। তাদের খুশি করা, তাদের কাছে উপকারী হওয়া, তাদের কাছে প্রিয় ও সম্মানিত হওয়া – শিশুকালেই তাদের এসব শেখাতে হবে। এ ছাড়া যে শিক্ষাই নারীদের দেওয়া হোক না কেন তা তাদের বা আমাদের জন্য সুখের হবে না।’
সেখানে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা বলেছিল, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপ্রণালী স্ত্রীলোকগণের পক্ষে কোন ক্রমেই উন্নতিকর ও শুভফলপ্রদ নহে’ কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ‘বুদ্ধিপ্রধান শিক্ষা হৃদয়প্রধান শিক্ষা নহে, অতএব ঐ প্রকার শিক্ষা স্ত্রীজাতির পক্ষে উপযুক্ত শিক্ষা নহে।’এই ধারণাটা এমন সুকৌশলে মনে গেঁথে দেওয়া হয়েছিল যে মেয়েরাও তা বিশ্বাস করত বিনা ভাবনায়। তাই হয়তো ‘দুই বোন’ উপন্যাসের শশাঙ্ক যখন শ্যালিকা উর্মিকে এঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িঙের সরঞ্জাম কিনে দেন, উর্মি মেতে ওঠে তাই নিয়ে, ঠিক মেনে নিতে পারে না তার দিদি শর্মিলা। সে না বলে পারে না ‘আচ্ছা উর্মি, তোর কি ঐ সব আঁকাজোকা, আঁক কষা, ট্রেস করা সত্যিই ভাল লাগে?’
উর্মির ভাল লাগত। সবকিছু। ‘সায়েন্সে যেমন তার মন, সাহিত্যে তার চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। প্রেসিডেন্সি কলেজে বিদেশ থেকে এসেছে ফিজিক্সের ব্যাখ্যাকর্তা, সে সভাতেও সে উপস্থিত’।
আমাদের মনে পড়তে পারে সরলাদেবী চৌধুরানীকে, যে জেদ করে দাদাদের সঙ্গে ফিজিক্স পড়তে গিয়েছিল। কিন্তু জেদ আর প্রকৃত বিজ্ঞানমনস্কতা এক নয়। তাই উর্মি কিংবা সরলা কিংবা অবলা দাশ কেউ নিজের মনকে চিনে নিতে পারেননি যা পেরেছিলেন পটদিদি। শুধু বি.এ. ক্লাসের ছেলেমেয়েদের অঙ্ক শেখানো নয়, তাঁর মাথায় কিলবিল করত নানা উদ্ভাবনী বুদ্ধি। একবার তাঁর সন্দেহ হল তিনি কি তিনিই না কি তাঁর ছোট বোন বুড়ু? সন্দেহের নিরসন ঘটল হাতেনাতে পরখ করে,
‘সঙ্গে সঙ্গে ট্রিগনোমেট্রির বইখানা নামিয়ে খুব খটমট দেখে একটা বুদ্ধির অঙ্ক কষে ফেললাম। তারপর যেই না পাতা উলটে দেখলাম একদম ঠিক হয়েছে, কোথাও এতটুকু খুঁত নেই, তখন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। না, ও অঙ্ক কষা বুড়ুর কর্ম নয়। তাহলে আমি নিশ্চয় আমিই।’
আমরাও হাঁপ ছেড়ে বাঁচি এই আত্মপ্রত্যয়ে। এই পটদিদি লীলাবতীর কন্যা না হয়ে যান না!
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
এখানেই শেষ? নাকি ধারাবাহিক হবে? এতে তো অনেক কথা বাকি রয়ে গেল!