পুরুষমানুষ: দীপু
6 401(সম্পূর্ণ কাল্পনিক)
পুরুষ মানুষ। দীপুর মাথার মধ্যে কেন যেন একটা ছবি ভেসে ওঠে। বোধ হয় তিতাস একটি নদীর নাম ছবিতেই দেখেছিল। সেখানে বাংলাদেশের এক অভিনেত্রী, খুব সম্ভবত তাঁর নাম ছিল রোজি সামাদ, বলছেন, ‘আমার একটা পুরুষ দরকার’। নাকি এটা আদৌ তিতাস ছবির দৃশ্য নয়, ছোটবেলায় কাজের মাসির কাছে শোনা ফেলে আসা পূব বাংলার গল্প। কে জানে। তিতাস ছবিটা আর ভালো মনে পড়ে না। কোনও কিছুই আর ভালো মনে পড়ে না দীপুর। অবশ্য সত্তর পেরিয়ে আসা দীপেন্দ্র সরকারের হয়তো মনে পড়ার কথাও নয়। কিন্তু সেই ছবিতে দেখা দুটি মেয়ের মুখ আর শরীর আবছা আবছা মনে পড়ে, কবরী চৌধুরী আর রোজি সামাদ। যত দূর মনে পড়ে একজন কেমন ঘোমটা ঢাকা, লাজুক আর আরেক জন জেদী আর সটান। দুই মেয়ের যৌনতা কী আলাদা? পুরুষ হিসেবে কোন নারীকে বেশি কাম্য মনে হওয়ার কথা তার? যাকে ঘোমটা সরিয়ে, সমাজের আর মেয়েটির নিজের লালন করা লজ্জা পেরিয়ে কাছে টানতে হয়? এমন মনে হয় যে আদর ব্যাপারটা কেবল পুরুষের কাম্য? না কি যে মেয়ের মধ্যে একটা সহজ এগিয়ে আসা আছে। চাওয়া আর পাওয়ার স্বাভাবিক অধিকার আছে। যে শরীর দিতে আর চাইতে ভয় পায় না।
একেক জন পুরুষ বোধ হয় একেক রকম মেয়ে চায়। অথবা বিয়ের বাইরে যৌনতার জন্য এক রকম মেয়ে আর বিয়ের ভেতরে আরেক রকম লজ্জাবতী, মানে ‘আমি বহু সাধনায় প্রাণপণে চাই বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে’ টাইপের বৌ চায়? বৌয়ের যৌনতা সহজে পাওয়া গেলে কীরকম ভয় ভয় করে,যদি আবার পরের হাতে চলে যায়? সেই ভয়ও আছে তো। দীপু কী রকম মেয়ে চেয়েছিল? কি রকম বৌ? মনে হয় দ্বিতীয় রকমের। নাকি একেক সময় একেকরকম?
ক'দিন আগে একটা ছবি দেখতে গিয়েছিল দীপু। ছবিটার নাম ‘পিঙ্ক’। সবাই বলেছিল একটা জরুরি বিষয় নিয়ে ছবি। যৌনতার ক্ষেত্রে মেয়েদের ‘না’ বলার অধিকার। সত্যিই ছবিটা ভালো, দেখবার মত, মেয়ে তিনটে তো অসাধারণ অভিনয় করেছে। আর দেশের যা অবস্থা তাতে এই রকম বক্তব্য রাখার দরকারও নিশ্চয় খুব। যৌন অত্যাচারের খবর শুধু চার দিকে। শুধু একটা কথা দীপুর মনে হয়েছিল। কিন্তু সে তো ক্রিটিক নয়, পাড়ায় চায়ের দোকানের কোনও আড্ডাতেও সে যায় না। একলা বাড়িতে কাকেই বা আর বলবে? তাই কাউকেই আর বলা হয়নি। দীপুর মনে হয়েছিল, আচ্ছা মেয়েদের ‘না’ বলার অধিকার থাকাটা তো খুব জরুরি। সেটা সম্মান করা দরকার। কিন্তু আমাদের দেশে মেয়েদের ‘হ্যাঁ’ বলার অধিকারটা কি আছে? আর সেটাও কি সমান জরুরি নয়? নানান ক্ষেত্রে পুরুষের আগ্রাসনের সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েরা না বলতে পারে না সে তো অবশ্যই ঠিক, বা ছেলেরা মেয়েদের না বলার অধিকারকে স্বীকার করতে শেখেই নি। মেয়েদের যে নিজেদের মত থাকতে পারে সেটা শুনলেই হাঁ করে থাকে বা মারতে আসে। কিন্তু তার পাশাপাশি ‘হ্যাঁ’ বলতে পরে কটা মেয়ে? ক’জন পারে নিজের যৌনতার চাহিদা নিয়ে পরিস্কার ভাবে এগিয়ে আসতে? আর সেটা কেউ পারলেও তাকে কি আমরা বেহায়া বলে একঘরে করি না?
নিজের জীবনের দিকে তাকিয়ে দীপুর আজকাল মাঝে মাঝে মনে হয় যদি মেয়েদের হ্যাঁ বলবার, এগিয়ে আসার অধিকারটা আরেকটু বেশি থাকত, তাহলে হয়তো অনেক পুরুষের আর অনেক মেয়ের জীবনটা অনেক ভালো হত। অনেক কষ্ট বয়ে বেড়াতে হত না। ছোট বেলা থেকে ছেলেরা চাইবে আর মেয়েরা চাইবে না, ছেলেরা কাড়তে এগুবে, মেয়েরা দেবে না, বাধা দেবে বা পালাবে -- এ বড় ক্লান্তিকর এক ইতিহাস। দীপু শুনেছে ধর্ষণের সঙ্গে যৌনতার কোনও সম্পর্ক নেই, ধর্ষণ দমন, ক্ষমতার আলাদা গল্প। বিরাট তর্ক করার যোগ্যতা দীপুর নেই, শুধু ওর মনে হয়, সব ধর্ষণ এক নয়। খবরের কাগজে নিয়মিত প্রকাশিত অন্তত কিছু ঘটনার পেছনে ছেলেদের যৌনতা চাওয়া আর পাওয়ার হিসেব না মেলার গল্প কিছুটা থেকেই যায়। নিজের পুরুষ জীবনের গল্প থেকে ও জানে বিষয়টা বুভুক্ষা আর হিংস্রতার পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। এর পেছনে সমাজের আরও বড় হিংস্রতার গল্পও থেকে যায়। গাড়ি, বাড়ি কেড়ে নিয়ে ভোগ করা যেখানে শক্ত সেখানে হঠাৎ রাস্তার মোড়ে পাওয়া একজন মেয়ে অনেক সহজ শিকার। আর সে পুরোনো সমাজের গল্পই হোক বা নতুন বিজ্ঞাপনই হোক অধিকাংশ প্রচলিত কাহিনিতে তো মেয়েদের জিতে নিতে হয়। মেয়েরা যে আক্রান্ত হয়, কিন্তু সাধারণত: আক্রমণ করে না তার কতটা শারীরিক আর কতটা সামাজিক অভ্যাসবশত: তাও দীপুর জানা নেই।
আজকাল কিছু কিছু আঙিনায় ব্যাপারটা খানিক বদলেছে। মলে, মাল্টিপ্লেক্সে, চারপাশে ছেলেমেয়েরা হাত ধরে ঘুরে বেড়ায়। অল্প বয়সি সমাজের সঙ্গে দীপেন্দ্রনাথের যোগাযোগ ক্ষীণ, ওই -- ‘মাঝে মাঝে গেছি আমি ও পাড়ার প্রাঙ্গনের ধারে, ভিতরে প্রবেশ করি সে সাহস ছিল না একেবারে’ ধরণের। তবু চার পাশে যা দেখে তাতে মনে হয়, ওই যে একটা সিরিয়াল আছে, যেটা নেটফ্লিক্সে ও দেখে, যার নাম অরেঞ্জ ইজ দ্য নিউ ব্ল্যাক, তেমনি বিয়ের ক্ষেত্রে বোধ হয় বলা যায়, ‘অ্যারেঞ্জড ইজ দ্য নিউ লাভ’। একটা সময় ছিল যখন প্রেম মানে ছিল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। এখন কিন্তু অনেকের কাছেই প্রেম প্রাতিষ্ঠানিক বিয়ের একটা ধাপ মাত্র। সেখানে ছেলে মেয়েরা মা বাপের সামাজিক আদর্শ এতটাই আত্মস্থ করেছে যে ‘স্বাধীন’ ভাবে নিজেদের পাত্র বা পাত্রী তারা নিজেরাই বেছে নিতে পারে। জাত, রোজগার (বা রোজগারের সম্ভাবনা), চেহারা (যাতে সন্তান সুশ্রী হয়), দুই পক্ষের বাপ-মায়ের সম-সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থান (যাতে বেয়াই বেয়ান এক সঙ্গে শপিং বা বেড়ানো অ্যাফোর্ড করতে পারেন) ইত্যাদির ফিল্টার এমন ভাবে মনের মধ্যে গেঁথে দেওয়া গিয়েছে, যে বাইরে থেকে শাসনের আর কোনও দরকার নেই। বিয়ে যদি সেপিয়েনস নামক প্রজাতির প্রজননের প্রতিষ্ঠান হয়, তার তো খেপা মানুষ বা ‘খেপিয়েনস’ উৎপাদনের কোনও দায় নেই।
দীপুর শুধু মাঝে মাঝে মনে হয়, এই বিয়েগুলোতে আশ্লেষ হয়? ভালোবাসার মানুষ বাছাইয়ে এতোগুলো 'না’ পেরিয়ে (গরিব না, কালো না, বেঁটে না, সংখ্যালঘু না, আর্টস গ্র্যাজুয়েট না, কেরানি টাইপের চাকরি করা না, তিন বোনের দাদা বা দিদি না) যে ‘হ্যাঁ’ বলা তার হ্যাঁ-ত্ব কতটা ঘন, কতটা জাপটানো, কতটা কামড়ানো, কতটা ছটফটে, কতটা দম আটকানো, কতটা পাগল পাগল করা, কতটা সব-ভোলানো হতে পারে? না কি হওয়াটা আদৌ জরুরি নয়?
এত ঠুলি পরে যৌনতা এগোয় কি করে?আপাতত দীপেন্দ্রনাথের একলা ঘরে শুধু অন্ধকার আর মুখোমুখি বসিবার রোজি আহমেদ। অবশ্য বাস্তবের সেই রক্ত মাংসের অভিনেত্রী নন, তাঁর অভিনীত চরিত্রের আধ হারিয়ে যাওয়া আবছা কল্পনা। কিন্তু দীপুর বড় ভালো লাগে এই সময়গুলো। বেশ অন্ধকার আর গা ছমছম।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Comments (6)
-
-
রংগন, খুবই জরুরী কথা তুলেছো। ‘Right to say yes’ খুবই দরকারী অধিকার মেয়েদের জন্য এবং নারী আন্দোলনও বেশ কিছু বছর ধ’রে এবিষয়ে কথাবার্তা বলছে ।
বিয়ে নিয়ে তোমার কথাটি আমি পূর্ণ সমর্থন করেও একটি কথা বলতে চাই। প্রেমের বিয়ে আজকাল প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে মধ্যবিত্ত বাঙালির মধ্যে, একথা যেমন ঠিক, তেমনই এখনও কিন্তু বহু ছেলেমেয়ে প্রেমের জন্য পালাচ্ছে। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে এবং ভিন্ন ধর্মালম্বীর মধ্যে প্রেম হ’লে। Honour Killing, খাপ পঞ্চায়েতের বোলবোলাও একথা প্রমাণ করে। তাই না কি? -
মেয়েদের না বলার সাহস যেমন কম, ঠিক একইরকমভাবে হ্যাঁ বলার সাহস আরো কম..আমাদের সমাজ মেয়েদের বিয়েটাকেই বড়ো করে দেখে। যৌনতা বিষয়ে আমাদের সমাজের একটা ছুৎমারগতা আছে..আমাদের সমাজ ছেলেদের সব কাজকেই সমর্থন করে…মেয়েদের কাজকে নয়…
-
সে তো একেবারেই ঠিক। তবে আমার মনে হয় সমস্যাটা আর ও বড়। না বলার অধিকার সতীত্ব বিয়ে এই সব কিছুকে চ্যালেঞ্জ করে না। হ্যাঁ বলার অধিকার করে। আর আমি যতটুকু দেখেছি আমাদের বাংলার নারী আন্দোলন বিয়ে ইত্যাদির বাইরে বেরুতে পারেনি। কাজেই কে আর কি করবে?
-
Jouno icchar khetre meye der hnya bola ba egiye asha niye purush der ekhono baddo samasya. Boyeshko ebong biggo purush der beshi. Tara chot kore ei rakom nari k niye naitik mantyabyo korte dwidha koren na. Buddhimoti hole to kathai nei.
-
ja bolecho
-
Leave a Reply
-
দোলন যে কথাটা বলেছ, ঠিক। ওপর তলার আর নীচ তলার মেয়েদের ব্যবহারের মধ্যে একটা তফাৎ দেখা যাচ্ছে। আমি তো গবেষণা করিনি, নিজের অভিজ্ঞতা, দেখে ভাবা, এই নিয়ে লিখি। সেখানে আমার মনে হয়েছে, ওপরের দিকেও গত কুড়ি বছরে গল্পটা বদলেছে, অনেকটাই। আমি ১৯৯০-র দশকে দেখেছি, দামী কলেজের ছাত্রীদের মধ্যে বা চাকরি করতে আসা মেয়েদের মধ্যে একটা মরিয়া ভাব ছিল। বাড়ি থেকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার আগে যতটা পারা যায় স্বাধীনতা ভোগ করে নিতে হবে, তারপর তো আর মজা হবে না। এখন ওই মেয়েদের মধ্যে সেই মরিয়া ভাবটা চলে গিয়েছে। তার কারণ, এমন ও হতে পারে যে প্রেম ব্যাপারটা এমন কিছু নয়, এটাও তো অনেকটাই একটা তৈরি করা ধারণাই বটে। যৌনতা একটা বিনোদন যদি হয়, বাজারে আর ও অনেক বিনোদন আছে, তাই দিয়েই হয়ে যাবে। ছোটদের দেখে মনে হয় আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বাস্তব বোধ তৈরি হয়েছে, যেটা দেখে আমার একটু ভয় লাগে, মনে হয় আমাদের ব্যর্থতায় এ রকম হল। কিন্তু হয়তো সেটার কারণ নেই। গরিব মে্যেদের কাছে, প্রেমের সময়টাই একমাত্র আস্কারা পাওয়ার সময়, বিয়ের পরে তো মারধর শুরু হয়ে যাবে। প্রত্যাশাগুলো আলাদা তাই ব্যবহার আলাদা। তাই না?