আমাদের লড়াই চলছে চলবে
1 775
আমাদের লড়াই চলছে চলবে
আমার কোনোকালেই ভাইফোঁটা পছন্দ ছিল না। তবু ফি বছর নিয়ম করে রাখীপূর্ণিমার কুম্ভ মেলায় হারিয়ে যাওয়া যমজ ভাইয়ের মত ভাতৃদ্বিতীয়া কালীপূজোর দু’ দিন পর এসে হাজির হয়, আর আমার দিদির না জানি কী কারণে উচ্ছাসের শেষ থাকে না। কালীপূজোর পরদিন সন্ধ্যাবেলা মায়ের সাথে মিষ্টির দোকান থেকে ভিড় ঠেলে ডজনপ্রকারের মিষ্টি কেনা, ভাইফোঁটার দিন সকালে চন্দন বেটে, ধান-দুব্বো ইত্যাদি সহযোগে ফোঁটা দেওয়া, এবং তারপর একসাথে মিষ্টি খাওয়া। প্রসঙ্গত, আমার মামাদের সংখ্যাধিক্যের কারণে মায়েরও একটা উদ্যোগ থাকত। যদিও বিভিন্ন কারণে ছোটমামা ছাড়া বাকি মামারা ভাইফোঁটায় অনিয়মিত হয়ে গিয়েছিলেন, মাঝেমধ্যে আসতেন, নাহলে মা গিয়ে ফোঁটা দিয়ে আসত। ছোটমামার উৎসাহে কখনো ভাটা পড়েনি, এমনকি ২০০৭ সালে আত্মহত্যার পাঁচদিন আগেও মায়ের থেকে ফোঁটা নিয়ে গিয়েছিলেন। মা তারপর থেকে অন্য মামাদেরও ফোঁটা দেওয়া, বা মিষ্টি দিয়ে আসা বন্ধ করে দেয়।
জন্মের পর আমাকে যখন প্রথমবার হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে আসা হয়, তখন নাকি আমার তিন বছর দু’ মাসের দিদি কটমট করে তাকিয়েছিল একদৃষ্টে। কথাটা বলতেন পৌত্রস্নেহে বিহ্বল আমার ঠাকুমা, ফলত ঘটনার সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। যদিও তারপর ছোট্ট ভাইকে দোলনায় ঘুম পাড়ানো, আরেকটু বড় হলে স্নান করিয়ে টেরি কেটে চুল আঁচড়ে দেওয়া, মায়ের অনুকরণে কাক, চড়াইয়ের গল্প শুনিয়ে ভাত খাইয়ে দেওয়ার যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে, আমারও আবছা মনে আছে কিছু কিছু।
আমরা ছোট থেকেই মারামারি করতাম, খুব। যদিও বকুনির সিংহভাগ জুটত ওর কপালে। আমার মনে নেই, দিদি বলে একবার নাকি ঠাকুমার কাছে খুব বকুনি খেয়েছিল আমার আঁচড়ে দেওয়ার প্রত্যুত্তর দিতে গিয়ে। মা বাদে পরিবারে সবাই কমবেশি দিদিকে ছোটবেলায় নানাভাবে ভাতৃগর্বে গরবিনী হওয়ার পাঠ দিতেন, এবং ছোট্ট ভাইকে আঘাত করা—তা সে প্রত্যাঘাত হলেও—মহাপাপ, এই অপরাধবোধ তৈরি করার চেষ্টা করতেন। দিদি কতটা কি বুঝেছিল জানি না, কিন্তু আমাদের মারামারি বন্ধ হয়নি। বহু বছর পরেও।
এইভাবে কোনোমতে বড় হয়ে গেলাম দু’জনে। অভাবের সংসারে পিঠোপিঠি ভাইবোনেরা যেভাবে হয় আর কী! সবই ঠিক ছিল মোটামুটি, কিন্তু আমার কলেজ জীবনের একেবারে শুরুতেই বড়সড় আর্থিক অনটনে পড়ল পরিবার। বাবার চাকরি গেল, মা নতুন করে সেলাইয়ের কাজ করে কিছুদিন আপ্রাণ চেষ্টা করলেন, কিন্তু স্বাস্থ্যের অবনতি সেই চেষ্টাকে দীর্ঘস্থায়ী হতে দিল না। আমি আর দিদি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই অনেকটা বড় হয়ে গেলাম। যদিও টিউশন পড়িয়ে নিজের পড়াশুনার খরচ তোলা ছাড়া খুব বেশি কিছু করতে হয়নি তখন। আমি দিদির ছায়ায় ছিলাম, আর ওর সামনে ছিল গনগনে রোদ। ইচ্ছা এবং ভালো নম্বর থাকা সত্ত্বেও দিদির আর এমফিল করা হল না। দিদি চাকরি খোঁজা শুরু করল পরিবার টানার দায়ে, আর আমি টিউশন পড়ানোর পাশাপাশি থিয়েটার, রাজনীতি ও আরও যা যা ভালো লাগে—নানা বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও—চালিয়ে গেলাম।
ভাইফোঁটা আমাদের বাড়িতে এখনও হয়। মানে শুধু ফোঁটা দেওয়া বাদে সবটাই। দিদি সেজেগুজে গাল টিপে আদর করে মিষ্টি খেতে দেয়, আমিও ফিরতি কিছু দেওয়ার চেষ্টা করি। যমের দুয়ারে কাঁটা দেওয়ার মন্ত্র আওড়ানো অনেকদিন আগেই বন্ধ হয়ে গেছে, দিদি গোটা সংসারের ভার একার কাঁধে তুলে নেওয়ার আগেই। দিদি এই রক্ষাকর্ত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চেয়েছিল কিনা, জিজ্ঞেস করেনি কেউ। আমিও না। বরং সেটাই স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল সকলের কাছে। এই সুবিধাবাদই দৈনন্দিনতায় পরিণত হয়ে গেছে বাকি ৩৬৪ দিনের জন্য। দিদির হাত থেকে ফোঁটা না নিলেও দিদিকেই নিজের ঢালে পরিণত করেছি, কারণ ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র নীতার ‘শিল্পী’ ভাই শঙ্করের সাথে নিজেকে তুলনা করার মধ্যে একটা স্যাডিস্ট প্লেজারের ব্যাপার আছে, যা সত্যিই খুব লোভনীয়, এবং হাতছাড়া করা কঠিন।
ওদের হুকুমমতো 'ভাই' সাজিয়ে দিয়েছি
হইহই কান্ড। তোড়জোড় চলছে সকাল থেকে। আগের দিন বিকেলবেলাতে এসে ওরা মামাতো পিসতুতো তিন বোন—একটা নয়, একটা দশ, আর একজন একটু ছোট, ছয়, রীতিমত হুকুম করে গেছে। সক্কালবেলাতেই তাড়াতাতাড়ি দুধ খাইয়ে, হিসু-হাগু করিয়ে, কার্তিক মাসের হিম-ধরা সকালে আর চান-টান না করিয়ে গা-টা একটু মুছিয়ে পাউডার মাখিয়ে নীল জিন্সের একখানা বাবা-সুট, জুতো পরিয়ে ঠুংরিকে সেই হুকুমমতো 'ভাই' সাজিয়ে দিয়েছি যেমনটি ওরা বলেছিল। এক বছর দু' মাসের মেয়ে দিব্যি দিদিদের সাথে চলল হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে ওদের বাড়িতে—ভাইফোঁটা নিতে।
সেসব বছর কুড়ি আগেকার কথা। তখনও থাকতাম এপাড়ায়, তবে ভাড়াবাড়িতে। অনতিদূরেই ছিল আমাদের পাঠভবনের বাংলা শিক্ষক প্রয়াতা শ্রীমতী কৃষ্ণা হাজরার বাড়ি। আর সেই নয়-ছয়-দশ বছরের বীরাঙ্গনারা ছিল কৃষ্ণাদির ছেলে ও মেয়ের ঘরের নাতনি। ওদের বাড়িতে তখনও কোনো শিশুপুত্র জন্মায়নি। অথচ গোটা পাড়া মায় শহর-গ্রাম, জেলা-রাজ্য, ভিনরাজ্য অব্দি ভাইফোঁটা/ভাইদুজ-এ সরগরম, আনাজ-পাতি, ফল-মিষ্টি(বড়গুলোতে ভাইফোঁটা লেখা), মাছ-মাংস, চিংড়ি-ভেটকি নিয়ে বাজার একেবারে উহু-গরম-এলাহী ব্যাপার! তা সেই উত্তাপের ছিটে-ফোঁটাও ওদের বাড়িতে ঢুকছে না, এই বচ্ছরকার দিনের সেলিব্রিটি জ্যাঠা-কাকারা অনুপস্থিত বলে বড়দেরও সে দিকে নজর নেই, ওই তিন বোনের সহ্য হয়!নিজ বুদ্ধিতেই তাই ওরা এইরকম অভূতপূর্ব একটি আইডিয়া প্রসব করে বড়দের ঘোষণা দিয়েছিল—তোমরা বাড়িতে ধান-দুব্বো থেকে মাংসের ঝোল-ভাত অব্দি (ভাইফোঁটার সিলেবাসে যা যা আছে) তার সব ব্যবস্থা করো—আমরা এক্ষুনি ভাই নিয়ে আসছি।ঠুংরির ভাগ্যে অবশ্য শিকেটা একবারই ছিঁড়েছিল। কারন ফোঁটা দেবার জন্য এমন হন্যে অবস্থা দেখে দয়াপরবশ হয়েই বোধহয় ওদের মধ্যে যে বড়, তার মা, পাম্পুদি পরের বছরই ওদের তিন বোনকে মায় ঠুংরিকেও একটি আস্ত 'ভাই' উপহার দিয়েছিল!!সব সমস্যার সমাধান করে তারপর থেকে চিরাচরিত নিয়মে ভাইফোঁটা হতে থাকল। বিপ্লব আর দীর্ঘজীবি হল না।আমার নিজের আহামরি তেমন কোন স্মৃতি নেই ছোটবেলার ভাইফোঁটাকে ঘিরে। তার একটা প্রধান কারণ আমরা দু' বোন। আমাদের ভাই নেই। ছোটবেলায় বাবার কর্মসূত্রে তদানীন্তন বিহারের ছোটনাগপুর অঞ্চলে থাকতাম। সেখানে 'ভাইদুজ' ছিল বটে তবে তা নিয়ে 'দিওয়ালী'র মত মতন লাগেনি কোনোদিন। হয়ত মা-বাবার অনুৎসাহেই। বরং শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হবার পর বন্ধুদের কাছে বিষয়টির গুরুত্ব ও আবেদন জেনেছি। ভাঁইফোটার সাথে আর একটি স্মৃতি তাই অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে—তা হল ছুটি শেষ। হোস্টেল ফেরা। মাঝে যমদ্বিতীয়া বাদ দিয়ে তারপর দিন স্কুল খোলার রীতি এখনও পাঠভবনে ও পশ্চিমবঙ্গের সরকারী স্কুলে বহাল।হর্ষ-বিষাদ মেশানো একটা অব্যক্ত অনুভূতি নিয়ে ভাইফোঁটার দিন বিকেলবেলায় সেই দূর কয়লাখনি অঞ্চলের একটা ছোট স্টেশনের কু-ঝিকঝিক (পরে ডিজেল ইঞ্জিন এসেছে) রেলগাড়িতে চেপে বসতাম ছোট্ট বোনটাকে ফেলে রেখে, পরের দিন হোস্টেলে পৌঁছে যাতে গোছগাছের সময়টুকু পাওয়া যায়। যেই সঙ্গে যাক, পৌঁছে দিয়ে তখনই ফিরে পড়বে সে। হোস্টেলে ঢুকে বাক্স-প্যাঁটরা রেখে গোটানো বিছানাটা পেতে নিতে নিতে এসে পড়া বাকি বন্ধুদের জমাটি 'ভাইফোটা'র গল্প শুনতাম।ঠুংরি বড় হতে থেকেছে। বাড়ির জ্যাঠা-কাকা-পিসি মিলিয়ে ও একমাত্র বোন ওর তিন দাদা ও ভাইয়ের। কোনো পক্ষেরই উৎসাহ-উদ্দীপনার কমতি নেই বলে ওর ছোটবেলায় যদ্দিন না দাদারা চাকরি-বাকরি পেয়েছে, ঘটা করে ভাইফোঁটাকে কেন্দ্র করে মিলন-উৎসব পালন হয়েছে আমাদের বাড়িতে। ওর একমাত্র পিসির হাতে ওর বাবা, কাকা, জ্যাঠার ফোঁটা দেখতে ওর খুব আগ্রহ থাকত। সেই আগ্রহে সকাল সকাল চান করে পাড়ায় বেরিয়ে কারুর বাগান থেকে দুব্বো ঘাস তুলে এনে চন্দন পিঁড়িতে চন্দন বাঁটতে বসত। অনেক রান্না-বান্নার কাজ থাকত আমারও। প্রতিবার হয় না। সবার তিথি-নক্ষত্র, ছুটি-ছাটার চুলচেরা হিসেব ঠিকমত মিলে গেলে সেবছর-ভাঁইফোঁটা উৎসব জমে যায়।ভাইফোঁটাই কেন হয়, কেন বোন-ফোঁটা হয় না, এই তীব্র লিঙ্গ-বিভাজনসূচক প্রশ্নটির অনুভূতি আমার নিজে নিজে কোনদিন আসেনি। বরং যেহেতু এই উৎসব থেকে কিছুটা বঞ্চিত ছিলাম, ওটার প্রতি আগ্রহই থেকেছে। অনেক পরে, যত পরিণত হয়েছি, আরও নানান ক্ষেত্রে অসঙ্গতির মতন আমাদের সমাজে প্রোথিত পুরুষতন্ত্রটির স্বরূপ নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে চিনতে চিনতে কোনো একটা বোঝাপড়া ভেতরে হয়েই গেছে। এমনকি বোন-ফোঁটা বলে আস্ফালন করার ইচ্ছেও জাগেনি। একদিনের একটা বোন-ফোঁটা উৎসব যদি সমাজ কাল থেকে চালু করে দেয়, তাতে করে আদৌ কিছু হবে? নিরসন হবে কি সেই সব হাজার হাজার বছরের বকেয়া লিঙ্গ-বিভাজনকারী প্রশ্নগুলির যেগুলির আজও আমরা অসম উত্তর লিখে চলেছি?সবসময় চাইতাম আমার যেন একটা বোন হয়সব সময় চাইতাম আমার যাতে একটা বোন হয়। যদিও মামার মেয়ে, মানে তিতির, ছিলই, কিন্ত নিজের ঘরে মায়ের পেটের একটা বোন সব সময়েই চেয়ে এসেছি। কিন্ত ওই যে, যা চাইব তা কখনোই না পাওয়ার প্যাটার্ন। এবারেও হল তাই।
ঠাকুমার সংস্পর্শে একটু বেশিই উদ্বুদ্ধ হয়ে ছোটবেলায় আমি খানিক ভগবান-ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ছাতার মাথা বুঝতাম না ভগবান, ঠাকুর এঁরা কী প্রজাতির জিনিস। খায় না মাথায় দেয়। খালি এটুকু বুঝতাম যে বিশাল ক্ষমতাশালী। তো আশেপাশের মানুষ ছেড়ে আমি ভগবানকেই বেছে নিলাম আমার মুশকিল আসান করে দেবার জন্য। একটা ইয়া বড় চিঠি লিখেছিলাম। ইস্কুলে তখন সদ্য শিখেছি বাংলায় চিঠি লেখা। কায়দা করে ‘প্রাপক’ ও ‘প্রেরক’ লিখতেও ভুলিনি। তিন-চার পাতা লম্বা সেই চিঠিতে ছিল আমার সাত বছর বয়েসের নানা জীবনযন্ত্রণার কথা। যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিলাম ঠিক কী কী কারণে আমার একটা বোনের ভীষণ প্রয়োজন। প্যাঁচে পড়লাম যখন চিঠিটা পাঠাবার সময় এল। ভগবান কোথায় থাকে তা তো জানি না! পাম্মু তো ওসব বলেনি কিছু। অনেক ভেবে বের করলাম সবাই ভগবান বললেই আকাশের দিকে তাক করে। তার মানে নিশ্চয়ই ওখানেই তার বসত। ওপরে, অনেক দূরে কোথাও। আকাশেই পাঠাব চিঠি স্থির করলাম। পিসি বা পাম্মু কাকে পটিয়ে যে দুখানা গ্যাস বেলুন জোগাড় করেছিলাম, সেটা অবশ্য এখন আর মনে নেই। তবে গ্যাস বেলুনের সুতোয় সযত্নে বাঁধা আমার চিঠিটা যখন নারকেল গাছের পাতায় লেগে পট করে ফেটে গেল, সেই মুহূর্তের বুক চিনচিন ভুলতে পারি না এখনও। চুপসে যাওয়া বেলুনের মত, চুপসে যাওয়া আমি সেদিনই বুঝেছিলাম আমার চাহিদার পরিণতি।
১৯৯৯ সালের ৪ঠা জানুয়ারী মায়ের কোল আলো করে এল ডোডো। আমার সাত বছরের ছোট ভাই। তার আগের দু’দিন মাকে হাসপাতালে গিয়ে দেখে এসেছিলাম। দিব্যি ছিল মা। কোন সমস্যা নেই। ঠিক যেদিন আমি সন্ধ্যে নামার আগেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম, সেদিনই ভাই এসে হাজির। শুনেছি পিসি নাকি অনেক চেষ্টা করেছিল আমায় ডেকে তোলবার। আমি পাত্তাই দিইনি। ঘুমের সামনে আমি কোনদিনই কিছু পাত্তা দিই না।
ডোডো আর মা হাসপাতাল ছেড়ে বাড়ি এল। আমার মনে খুশি, কিন্ত তুলনায় অভিমানের পাল্লাই ভারী। প্রথমত, চাইলাম বোন আর হল ভাই। আর দ্বিতীয়ত, মা-বাবা-পিসি-পাম্মু-দাদ্দা সবার আদরে ভাগ বসানোর লোক সংখ্যা বাড়তে থাকায় কীভাবে খুশি হতে পারতাম, জানি না। কিন্ত অবাক হলাম দেখে যে শুধু আমি না, বাড়ির বাকি মানুষদের মধ্যেও কেমন একটা যেন শুকনো, অখুশি ভাব। আমিও তো ছোটই। অত বুঝি না। সুযোগ করে এটাই জানতে পারলাম যে আমার ভাইটা নাকি সবার ভাই-বোনেদের মত নয়। ও আলাদা। মনে আছে স্পষ্ট, এটা জানবার পর বেশ অনেকবার ডোডোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি আমি। কী নেই ওর বুঝতেই পারতাম না। ওই তো কেমন ছোট ছোট গোলাপি হাত-পায়ের আঙুল, মায়ের হাত পেলেই খামচে ধরে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা দুটো চোখ আর এক খাবলা ময়দার মত পুঁচকে একটা নাকওয়ালা আমার ভাইটার যে কী নেই সেটা এখনও আমার কাছে অপরিষ্কার।
ডোডোর ডাউন্স সিনড্রোম নামের একটা বিষয় আছে। অসুখ নয় মোটেও। বৈশিষ্টমাত্র। তার জন্যে সে আলাদা স্কুলে পড়ে, অন্যরকম আশ্চর্য সুন্দর সময় কাটায় এবং আমাদের জীবন আলো করে রাখে শুধুই তার অস্তিত্ব দিয়ে। কবে যে ডোডোকে এতটা মারাত্মকভাবে ভালোবেসে ফেলেছি, জানি না। ভাই-বোন হলেই যে ভালোবাসতে হবে তা আমি বিশ্বাস করি না। কিন্ত বিষয়টা হচ্ছে যে ডোডোকে না ভালোবেসে কেউ থাকতেই পারে না। আপাতদৃষ্টিতে মানুষ আমাদের সাথে প্রথম পরিচয়ের পর ভাইকে খানিক করুণার নজরে দেখে থাকেন এটা লক্ষ্য করেছি। এতদিনে তাতে আমি অভ্যস্ত। তার সাথে ধেয়ে আসা অসংখ্য বোকা বোকা প্রশ্নও তাই এখন আর নতুন লাগে না। আমি অবাক হই যখন দেখি ডোডোকে তাচ্ছিল্য করে যেই মানুষেরা, তাদেরও যখন ডোডো ভালোবাসতে কোন কার্পণ্য করে না। ও যে বুঝতে পারেনা, তা কিন্ত একদমই নয়। ডোডো সবই বোঝে। কখনো কখনো একটু বেশিই বোঝে।
২০১২-এর শেষটায় আমরা রাজস্থান বেড়াতে গিয়েছিলাম। যোধপুরে হোটেলে একদিন সকালে খাবার টেবিলে বসে আছি চারজন। রেস্টুরেন্টের দরজা ঠেলে এগিয়ে এল আরেকটি পরিবার। চারজন। অন্য একটি টেবিলে তারা আসনগ্রহণ করবার পরেই ডোডো আমার কনুই ধরে টানে। বলে,”দিদিয়া দেখ! দেখ! আমার মতন! আমার বন্ধু।” ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি সেই পরিবারেও একটা ছেলে। আমাদের অভ্যস্ত চোখ সহজেই চিনে নিল তার ডাউন্স সিনড্রোম। সেই পরিবারের সাথে এমনি খানিকক্ষণ গল্প করেছিলাম আমরা। ভারী মিষ্টি, মজার মানুষ। কিন্ত আমার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। ওই কনুই টেনে বলা দুটো বাক্য শেষ করে দিয়েছিল আমায়।
সেদিন বুঝেছিলাম নতুন করে যে আমার, আমাদের ভালোবাসায় আসলেই কিছু যায় আসে না। যতই আগলে রাখি, যতই ভিড়ের মাঝে মিশিয়ে দিতে চাই না কেন, ডোডোর ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা চোখে আমি আর সে কোনদিনও সমগোত্রীয় হব না। আমি তো ‘তার মতন’ হতেই পারলাম না।
সারাটা দুনিয়া জান-প্রাণ লড়িয়ে দিচ্ছে ডোডোকে, ডোডোদেরকে তাদের মতন করে তুলতে। মূলস্রোত বলে একটা শব্দ খুব শুনি আজকাল। আমরা সবাই মূলস্রোত। আর ডোডোদের জন্যে আজীবন শুধু নির্বাসন।
আমি বরং তার নির্বাসনেই ভাগ বসাব এখন থেকে। হাজার হোক, সাত বছরের ছোট ভাই আমার। সবেতেই জিততে দেওয়া যাবে না তাকে। কথা দিচ্ছি, ডোডো যতটা পারে, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি ভালোবাসব আমি। আর আমার ভাইফোঁটায় কে কার রক্ষী হবে, তা প্রধান নয়। আমার ভাইফোঁটায় থাকে ভালোবাসবার, সাম্যের অঙ্গীকার। যা ডোডোর জিনের বাড়তি ক্রোমোজমের মতই সত্য, অমোঘ। লিঙ্গপরিচয়ের অগ্রাধিকারের মত ভঙ্গুর নয়।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
ডোডোদের চেতন-জগতটা কোথা থেকে শুরু জানো শবনব? সম্ভবতঃ যেখানে আমাদেরটা শেষ হয়,সেখান থেকে।তোমার চ্যালেন্জে আমাদেরও শামিল কোরো।
সুদীপ,মেঘে-ঢাকা-তারা মনে এসেছে,আর দেখছি সে অনুসঙ্গ তোমার লেখার পরবর্তী পংক্তিতেই!
তোমাদের দুজনের অনুভূতি আমার অচেনা সরাসরি অভিজ্ঞতার নিরিখে।তাই অনুধাবন করছি পড়ে।