একদিন স্কুল থেকে ফিরে শুনলাম আমার বিয়ে
0 235শকুন্তলা মিদ্দে৷ মৈপীঠের বাসিন্দা এই গৃহবধুর জীবন নাটকের কাহিনীকেও হার মানায়৷ সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যে লড়াকু মানসিকতা থাকে তার বাস্তব উদাহরণ তিনি৷ আজও সেই লড়াই চলছে৷ আমরা তাঁর মেয়েবেলার কথা জানতে চাওয়াতে তিনি লিখে পাঠালেন সেই সুখ দুঃখ মেশা দিনগুলির কথা৷
আমার কাছে কেউ ছোটবেলার কথা জানতে চাইবে কখনো ভাবিনি৷ জানি না যেসব কথার কোনও গুরুত্ব আছে কিনা৷ তবু যখন জানতে চেয়েছেন তখন জানাচ্ছি৷
আমরা থাকতাম মৌপীঠের নগেনাবাদ গ্রামে৷ আমরা চার বোন, দুই ভাই৷ ছোট থেকে জেনে এসেছি আমাদের বড় দাদা কলকাতায় থাকে, দাদু দিদিমার সাথে, এখনো দাদা থাকে কলকাতাতেই আমাদের সে বাড়িতে ঢোকার উপায় নেই৷
আমার বাবা বালীগঞ্জে একটি লোহার কারখানায় কাজ করতেন৷ আমার ছোটবেলায় একদিন শুনলাম বাবার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে৷ বাবার হাতে খুব আঘাত লাগল৷ তারপর থেকে বাবার কাজ চলে গেল৷ সেই থেকে শুরু হল আমাদের কষ্টের দিন৷ দশ কাঠা মত জমি ছিল আমাদের৷ সেই জমিতে চাষ হত একবারই বছরে৷ যে বছর বর্ষার সময় বাঁধ ভাঙত সে বছর তাও হত না৷ একবার জল ঢুকলে কোনও কোনও সময় পরপর দু’-তিন বছর ধান হত না৷ নদীর কোলের জমি৷ বাঁধ ভাঙলে কিছু করার থাকত না৷ কোনো কোনো কোটালে বাঁধ উপচেও জল ঢুকত৷
আমার পড়াশোনা শুরু হয়েছিল নগেনাবাদ বাদা প্রাইমারী স্কুলে৷ ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা করতে আমার খুব ভালো লাগত৷ বাড়িতে খুব অভাব ছিল৷ দেখিয়ে দেওয়ার কেউ ছিল না৷ তবু আমি একা একাই পড়তাম৷ স্কুলে মাস্টারমশাইদের কাছে জেনে নিতাম৷ পড়তে আমার খুব ভালো লাগত৷ প্রাইমারী স্কুলের মাস্টারমশাইরা আমাকে খুব ভালোবাসতেন৷ ভালোভাবেই পাশ করতাম৷ প্রাইমারী স্কুল থেকে পাশ করার পর আমি আরও পড়ব বললাম৷
তখন আমাদের গ্রামে কোনও হাইস্কুল ছিল না৷ পাঁচ-ছয় মাইল দূরে ভুবনেশ্বরী জয়কৃষ্ণ হাইস্কুলে সবাই পড়তে যেত৷ বাড়ি থেকে বলল আর পড়তে হবে না৷ প্রতিদিন অতদূর যেতে হবে, তার ওপর খরচও আছে অনেক৷ আমার খুব মন খারাপ হত৷ খুব জেদ করতাম৷ কান্নাকাটি করতাম৷ সেই সময় প্রাইমারী স্কুলের মাস্টারমশাই চিত্তরঞ্জন দাস বাড়িতে এসে বাবাকে বললেন মেয়েটি যেন পড়া না বন্ধ করে৷ ওর পড়াশোনায় আগ্রহ আছে৷ অনেক কথাবার্তার পর আমি হাইস্কুলে ভর্তি হলাম, ক্লাস ফাইভে৷
সে যে আমার কি আনন্দ হল বলে বোঝাতে পারব না৷ বড় স্কুলের বড় বড় ঘর, অনেক ছেলে মেয়ে, অনেক মাস্টারমশাই—আমার খুব ভালো লাগত৷ আমি মন দিয়ে পড়া করতাম৷ এই স্কুলেও মাস্টারমশাইরা আমাকে খুব ভালোবাসতে লাগলেন৷ ক্লাসের পরীক্ষায় আমার রোল দুই তিনের মধ্যে থাকত৷
স্কুলের খরচ দিতে বাবার খুব অসুবিধা হত৷ আমি রবিবার করে লঙ্কা তুলতে যেতাম৷ এক কেজি লঙ্কা তুললে এক টাকা পাওয়া যেত৷ পঞ্চাশ কেজি মত লঙ্কা তুললে পঞ্চাশ টাকা পেতাম৷ ওই টাকা, পেন-পেন্সিল কিনতাম স্কুলের মাইনে দিতাম৷ পড়াশোনা দেখিয়ে দেওয়ার কেউ ছিল না৷ নিজে নিজেই পড়তাম৷ সবাই টিউশনি পড়তে যেত৷ আমার কোনও টিউশনি ছিল না৷ প্রাণপণ চেষ্টা করতাম নিজে নিজে পড়ে বোঝার৷ হাইস্কুলের মাস্টারমশাইরাও দেখিয়ে দিতেন৷ সাহায্য করতেন৷ বড় ইস্কুলে আমি ভালোই রেজাল্ট করতাম৷ শীতকালের দিনে বাড়ি ফিরতে সন্ধে হয়ে যেত৷ বাবা বকত, দাদা মারত। মাঝে মাঝে বলত, কাদের সাথে গল্প করে বাড়ি ফিরছিস এতক্ষণে? আমি ছুটির পরই ফিরে আসতাম, অতটা পথ হেঁটে ফিরতে হত৷ তাই দেরি হয়ে যেত, কেউ বুঝতে চাইত না৷ সবাই চাইত আমি পড়াশোনা বন্ধ করে দিই৷ পড়াশোনা করা দরকার সে কথা কেউ বুঝত না৷ গ্রামের লোকেরাও ভালো চোখে দেখত না৷ অনেকে সন্দেহ করত আমি সত্যিই ইস্কুলে ভালো রেজাল্ট করি কিনা৷ আমার যে সত্যিই দুই/চার রোল হচ্ছে সে কথাটা ঠিক কিনা দেখতে অনেকে স্কুলে খোঁজ নিত৷
আমি যখন সেভেনে পড়তাম তখন আমার মা মারা গেল৷ সংসার আরও ছন্নছাড়া হয়ে গেল৷ দাদার বিয়ে হয়ে গেছে তখন৷ বৌদি খুব খারাপ ব্যবহার করত৷ আমি স্কুলে পড়তে যাই বলে হিংসা করত৷ নানা খারাপ কথা বলত৷ কোনও কোনও দিন ভাতের হাঁড়িতে জল ঢেলে দিত—যাতে আমি খেতে না পাই৷
আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন একদিন স্কুল থেকে ফিরে শুনলাম আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে৷ শুনে খুব রাগ হল৷ খুব কান্নাকাটি করলাম৷ মন খারাপ হয়ে গেল৷ পাশে এক বন্ধুর বাড়িতে চলে গেলাম৷ বাবা সেখানে গিয়ে আমাকে বোঝাল৷ এই সংসারে খুব অভাব৷ বাবার পক্ষে সব কিছু চালানো সম্ভব হচ্ছে না৷ বাবাও খুব কাঁদছিল৷ বলেছিল এখানে থাকলে খেতে পাবি না৷ বৌদিও অত্যাচার করবে৷ বলেছিল আমি ছেলের বাড়িতে কথা দিয়ে এসেছি৷ শুনলাম ছেলেকে আশীর্বাদ করাও হয়ে গেছে৷
এইট থেকে নাইনে ওঠার বছরেই আমার বিয়ে হয়ে গেল৷ কি যে দুঃখ হয়েছিল বলে বোঝাতে পারব না৷ পরের বছরই মা হয়ে গেলাম৷ যে অভাবের জন্য বাবা বিয়ে দিল সে অভাব যে মিটে গেল তা কিন্তু নয়৷ কষ্টের দিন চলল, চলতেই থাকল৷
ছেলে মেয়ে বড় হওয়ার বহুদিন বাদে আবার পড়ার সুযোগ পেলাম৷ মুক্ত বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছি৷
এখন একটা শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে সামান্য চাকরী করি৷ সংসারে অভাব আজও আছে৷ ছেলেমেয়েদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালাচ্ছি৷ অবসর সময়ে কবিতা, নাটক, গল্প লিখি৷ এখানে যে ছোট পত্রিকা আছে সেখানে মাঝে মাঝে ছাপা হয়৷ অনেক বই পড়তে ইচ্ছে করে৷ সব সময় পাই না৷ ইচ্ছে থাকলেও সব সময় সাধ যে পূরণ হয় না সে কথা আমার থেকে ভালো আর কে জানে৷
[শুধু সুন্দরবন চর্চা, ১৫ জানুয়ারি ২০১৭ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত। বানান ও ভাষা অপরিবর্তিত রেখে পত্রিকার সম্পাদকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত।]
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply