দাঙ্গা বিষয়ে একটি অপ্রকাশিত (বা অপ্রকাশযোগ্য) রচনা
1 477তখন সম্ভবত কলেজে পড়ি। আজকাল সনতারিখ মনে পড়ে না বয়েস হবার কারণে। খালি ঘটনা মনে আসে টুকরো টুকরো। যতটা পারি জুড়ে নিই। সম্ভবত কলেজের প্রথম দিকে। দাঙ্গা হয়েছিল হিন্দু মুসলমান। বোধহয় ১৯৬৪। আমরা যে পাড়াটায় থাকতাম নাম কাজীপাড়া রোড। নাম শুনলেই আন্দাজ হয় মুসলমান এলাকা। পুরোটা নয়। হিন্দু মুসলমান মিশিয়ে। পাশেই পর্ণশ্রী পল্লী। পূর্ব বাংলা থেকে আসা উদ্বাস্তুদের প্লট পেয়ে কলোনী বানানো। সবার না হলেও অনেকেই দেশ ছেড়ে আসার জন্য মুসলমানদের দায়ি করতেন। মনে মনে রাগ পুষে রাখতেন। এরই মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি। আমি, আমার বয়সী অনেকে পার্টি আওতায়। মিছিলে হাঁটি, মিটিঙে দাঁড়াই, পোস্টার লাগানোয়, দেওয়াল লেখায় থাকি। দাঙ্গার খবর পেয়েই পার্টি ক্যাডারদের জড়ো করলো। আমরা মুসলমান মানুষজনদের নিয়ে এসে রাখলাম ইস্কুল বাড়িতে। তাদের খাওয়াদাওয়া, খাবার জল, বিছানার ব্যবস্থা করা। বাড়ি বাড়ি ঘুরে টাকা আর খাবারদাবার নিয়ে আসা। এসব ছিলই।
আর একটা কাজ ছিল মুসলমান বাসিন্দাদের বাড়ি পাহারা দেওয়া, বিশেষভাবে রাতে। হিন্দু দাঙ্গাকারীরা যাতে পুড়িয়ে দিতে, ভেঙ্গে দিতে, লুঠ করতে না পারে। সারা রাত বাড়ি ঘিরে, পাড়া ঘুরে পাহারা দেওয়া, হাতে লাঠি, আর এটা সেটা ওটা অস্ত্রশস্ত্র। রাতে ঘুরতে ঘুরতে কথা বলতে বলতে নিজেদের খুব বলবান মনে হত। শারীরিক, মানসিক এবং তাত্ত্বিক। যতটুকু তত্ত্ব জানতাম সেটুকুতেই। তবে এটা বুঝেছিলাম শরীরটা বেশ একটা বড় ব্যাপার। আমাদের মধ্যে অনেকেই ব্রতচারি করা, ফুটবল খেলা, স্পোর্টস করা, ব্যায়ামাগারে যাওয়া। আর একটা বিষয় কাজ করত দায়িত্ববোধ। হাসপাতালে বন্ধুর আত্মীয়দের জন্য রাত জাগা, শ্মশানে মরা পোড়াতে যাওয়া, অনুষ্ঠান বাড়িতে পরিবেশন করা, বন্যাত্রাণে যাওয়া এমন সব কাজে একসাথে হওয়া। দাঙ্গা হতে না দেওয়া এমন সব কাজের মতনই। এর রাজনীতিক দিকটা খুব যে তখন একটা মাথায় ঢুকে গিয়েছিল, এখন মনে পড়ে না। কিন্তু দাঙ্গা করতে দেওয়া যাবে না, দাঙ্গা আটকাতে হবে, এটা একটা দায়িত্বের ব্যাপার, সেটি মাথায় ঢুকে গিয়েছিল।
পরে যখন পাড়ার মুসলমান মানুষজনের একটি দল পাড়া ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে গেলেন, বাড়ি জমি হিন্দুদের কাছে বিক্রি করে দিলেন, হয়তো কম দামে, সেটা আগে জানতে পারিনি, জানলেও এটা যে আটকাবার বিষয়, সেটাও যে একটা রাজনীতিক কাজ সেটা তখন সেভাবে মাথায় আসেনি। পরে জেনেছি তাঁরা চলে গিয়েছিলেন আরও বড় মুসলমান অঞ্চলে, আরও নিশ্চিন্তের আশ্রয়ে। দাঙ্গা আটকানোতে যে দাঙ্গা বন্ধ করে দেওয়া হয় না সেটা তখন বুঝিনি। আমার থাকা ঘোরাফেরা, আড্ডা রাজনিতির বড় এলাকাটা মিশ্র অঞ্চল। নানা ভাষার, নানা ধর্মবিশ্বাসের, নানা কাজের মানুষজন।
একবার সংঘাত হয় পাঞ্জাবীদের সাথে বাঙালিদের। আমায় বেশ কয়েকটি এলাকায় বন্ধু ছিল, ঠেক ছিল, খানিকটা রাজনীতি করার কারণে। একটি ঠেকের নাম কিংবা বদনাম ছিল মস্তানির জন্য। পাঞ্জাবীরা আমাদের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করেন। আমরা যারা পাঞ্জাবীদের আক্রমণ করবে বলেছিল, তাদের সাথে দেখা করে দাঙ্গা থামিয়ে দিয়েছিলাম। আমাদের কথার পিছনে কাজ করেছিল আমাদের ‘শরীর’, আমাদের ‘শারীরিক ক্ষমতা’, যা আমাদের রাজনীতিক ভাবনার পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।
পরে আমি বাড়ি বদলে পাড়া বদলে চলে আসি যে এলাকায় সেটি মুসলমান বাসিন্দাপ্রধান অঞ্চলের পাশে। টালিগঞ্জ ফাঁড়ি-ঘড়িঘর-প্রিন্স রহিমুদ্দিন লেন-শান্তিপল্লী। আমার বাড়ি যাওয়াআসার বাসস্টপটিতে যেতে গেলে মুসলমান মানুষজনের বসতি, গলি দিয়ে চলাচল। তখন কেয়া আর আমি দুজনেই দেরি করে বাড়ি ফিরি। রাতের রান্নার বদলে গলির দোকান থেকে অসাধারণ বিফ কাবাব আর পরোটা। আমার যতটুকু পোশাক বানান, মাস্টারজী। আমাদের বিস্কুট আর গরম পাউরুটির বেকারি, এমন কতশত কাজে আমার হাত বাড়ানো পা চালানো ৩২ গলির দুপাশে। দুদণ্ড দাঁড়িয়ে কথা, হাসি বিনিময়। আমি ক্রিকেট ম্যাচের টিকিট দিতাম, ওরা সিনেমার। আমি এটা ওরা সেটা। তারপর দাঙ্গা। বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে দেওয়া। মুসলমান বসতি আক্রমণ। আমরা পাড়ার হিন্দুরা চট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। পুরো বস্তিটা ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সারা রাত। পিছনে মজুদ প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র। যারা আসবে তারা তো খালি হাতে আসবে না। আমরা কেন খালি হাতে। আসলে একটা পাল্টা বানাতে হয়। যেমন পাল্টা ‘কথা’। তেমনি পাল্টা ‘শরীর’। আমি ছোট্ট খাট্টো রোগা প্যাংলা। আমিও পাল্টা শরীর হয়ে যাই। হতে হয়। বসতি আক্রান্ত হয়নি। যারা আক্রমণ করতে পারতো, তারা খবর পেয়ে গিয়েছিল। ‘শরীরের খবর’। যারা এমনিতে মস্তান বলে এলাকায় পরিচিত, সেদিন তারা নেতৃত্ব দিয়েছিল মুসলমানদের বাঁচাতে, শারীরিকভাবে। শুধুই কি শারীরিক? এমন প্রশ্ন এখন করছি তখন করিনি। এই বসতিটার শেষপ্রান্তে কয়েক ঘর হিজড়া থাকতেন। তারাও আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন সেদিন। তাত্ত্বিকরা ‘সংখ্যালঘুদের জোট’-এর তত্ত্ব খুঁজতে পারেন। ‘হিজড়া’রা যেমন শারীরিকভাবে হেনস্থা হন, তেমনি শারীরিক রুখে দাঁড়ান।
শরীরের জোর দেওয়া এই লেখাটির বিপদ ক্রমশ বাড়াচ্ছি। শুদ্ধ রাজনীতিক জোরের লোকজন বেজায় খচে যাচ্ছেন। এই বুড়ো বয়সে আমার আর ভয়টা কিসের।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
আপনার লেখাটা পড়ে একটা কথা মনে এল। বেহালায় সম্ভবত ওই দাঙ্গার সময়ে কিছু বাঙালি মুসলমান পরিবার মেটিয়াবুরুজে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। কিছু মানুষ আর ফিরে যায়নি। এস এ ফারুকি রোড (চালু পুরোনো নাম আকড়া রোড)-এর ওপর হাজিরতনে একটা পাড়া আছে, বেহালাপাড়া। বেহালা থেকে আসা মানুষের পরিচয়ে পাড়ার নাম।