রাস্তাঘাটে ভিনদেশি মেয়ে ও দেশি পুরুষ
0 361
দেশে দু’সপ্তাহ কাটিয়ে জার্মানি ফিরে এসে সবে তিনদিন একটু নিঃশ্বাস ফেললাম। ফেলেই আবার ছুট। এবারের গন্তব্য ডেনমার্ক, শহর অরহুস। এই শহরে আমি ২০১৫-২০১৬ কাটিয়েছি মাস্টার্স পড়ার সময়। ইউরোপে নিজহাতে আমার প্রথম সংসার গড়া সেখানেই। প্রায় তিন বছর পর বৃত্ত সম্পূর্ণ করবার মতই আমি ফিরে এলাম এখানে। একমাস থাকব। আমার গবেষণা বিষয়ক কিছু কাজের জন্যই এবারের অরহুস যাত্রা। স্বভাবতই, আমি প্রচণ্ড উত্তেজিত।
২০১৫-র সেপ্টেম্বরের একদিন প্রথম অরহুসে প্লেন থেকে নামার মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে আমার জীবন আমূল পালটে গিয়েছিল। অচেনা দেশে হাতে-কাঁধে-পিঠে ভারী ব্যাগের বোঝা টেনে হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে অসংখ্য প্রণাম জানিয়েছিলাম শেয়ালদা স্টেশনের মোটবাহকদের। কী অনায়াসে অন্যের বোঝা নিজের মাথায়-কাঁধে নিয়ে চলেন তাঁরা! আমাদের চেয়ে বহুগুণ দ্রুত তাঁদের পদক্ষেপণ। আর আমি! নিজের প্রয়োজনীয় যতটা ততটুকু বইতে গিয়েই নাজেহাল হয়ে পড়ছি। ছিঃ!
নিজের বোঝা নিজেই বওয়া
অরহুসে প্রথম সপ্তাহ কাটিয়েই বুঝলাম নিজের বোঝা না বইতে পারার লজ্জা কাটিয়ে উঠতে না পারলে বিষম বিপদ! এ দেশে কেউ অন্যের বোঝা বয়ে দেয়না। অত্যন্ত কাছের মানুষেরাও রেস্টুরেন্টে খাওয়া শেষে নিজের ভাগের বিলটুকুই মেটায়। এখানে ট্রেনে ওঠার লাইনে কোনো অল্পবয়েসী মেয়ের বা বৃদ্ধার ভারী সুটকেস বওয়ার দায় কোনো পুরুষত্বের ওপর বর্তায় না। এই দেশে সাহায্য চাইতে হয়। সাহায্যের ওপর আগাম অগ্রাধিকার দেখানো অভব্যতা। ইউরোপের এই বৈশিষ্ট্য আমায় আকৃষ্ট করেছিল তখন, কিন্তু আবার কিছুটা ভীতও হয়েছিলাম, অস্বীকার করব না। আমার বয়স তখন মাত্র ২৩, কীভাবে সব একা সামলাব? টাকা-পয়সা নাহয় স্কলারশিপ দিয়ে ম্যানেজ করা যাবে, কিন্ত অন্য সমস্ত বোঝা? এর আগে কখনো যে আমি একা থাকিনি! আমি তো অভ্যস্ত টেনে দেওয়া চেয়ার, খুলে দেওয়া দরজা, বয়ে দেওয়া ব্যাগে। কিন্ত আমি হারিনি। দাঁতে দাঁত চেপে লেগে রয়েছিলাম বলেই আজ প্রায় আড়াই বছর নিজের সংসার নিজেই গড়ছি।
এই আড়াই বছরে অনেক নতুন মানুষ আমার জীবনে জুড়েছে। কেউ সময়ের তালে ছিটকে পড়েছে, সেই জায়গায় এসে জুটেছে আরো অন্য কিছু মানুষ। কিন্তু এই এতগুলি মানুষের আসা-যাওয়ার মাঝেও প্রায় প্রতিটি মানুষের কাছে আমি নতুন কিছু শিখি। কয়েকজন এমনও থাকেন যাঁদের গল্প শুনে মাথা নত হয়ে আসে সম্মানে, আর ভিনদেশের মাটিতে আমি সাহস পাই নতুন করে স্বাধীন, স্বাবলম্বী, সাহসী হবার।
এক সপ্তাহ হল আবার ডেনমার্কের অরহুসে বাসা বেঁধেছি। তবে এবার আর আগের বারের মত সারা বছরের জন্য নয়। এবার হাতে সময় মাত্র এক মাস। এর মধ্যেই যা যা নস্টালজিয়া, যা যা পড়াশোনা সংক্রান্ত কাজকর্ম সবই সেরে ফেলতে হবে। তবুও তারই মধ্যে একটুখানি ফাঁক বের করে একটা শনিবার দেখে আমার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবীর সাথে আড্ডা জুড়লাম। নানা অরহুসেই থাকে। আমার সাথে সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ পড়ত। ২০১২ সালে আট মাস বেনারসে থেকেছে সে, হিন্দীও বলতে পারে বেশ ভালই। তো নানাকে বলছিলাম আমার এই স্বাবলম্বনের গল্প, কীভাবে এই দেশে এসে আমি শিখেছি নিজের দায়িত্ব নিতে। উত্তরে আকাশ-ফাটানো হাসি হাসল নানা। তারপর নিজের উপলব্ধির যা বর্ণনা দিল, শুনে আমি তো থ!
এই মাটিতে কার কত অধিকার !
ভারতে থাকাকালীন নানা প্রথম বুঝতে পারে যে পৃথিবীর এই প্রান্তে মেয়ে হয়ে রাস্তাঘাটে বেরোনো কখনো কখনো অপরাধতুল্য। গা না ঢেকে বেরোলে লোকে গায়ে হাত দেবেই এটাই যেন স্বাভাবিক। মেয়ের শরীর যেন তৈরীই হয়েছে সমাজের ছোঁয়ায় ভরে ওঠার জন্য। শুরুর দিকে নানা ভাবত এটা ভারতে সব মেয়েদেরই হয়ত নিত্যদিনের অভ্যেস, এতদিনে সবারই গা সয়ে গিয়েছে। কিন্ত ওর ক্ষেত্রে বিষয়টা যে কিছুটা আলাদা, তা বুঝতে খানিক সময় লেগেছিল ওর।
নানা উচ্চতায় পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। ধপধপে সাদা চামড়া, ব্লন্ড চুল আর কটা নীল চোখ— সব মিলিয়ে ডেনিশ চেহারার স্টিরিওটাইপের চরম উদাহরণ। এহেন চেহারার নানা অন্যান্য বিদেশি পর্যটকেদের মত ভারতে গিয়ে সালোয়ার-কামিজ বা কুর্তা পরা শুরু করে। তাতে রাস্তাঘাটে মানুষের মাথায় বিদেশিনীদের যথেচ্ছ গা দেখিয়ে ঘুরে বেড়ানোর ধারণাটা আপাতত খানিকটা ঠেকানো গেলেও সমস্যার শেষ হয় না। ধরুন কোনো ক্যাফে বা রেস্তোঁরায় অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবদের সাথে নানাও খাবার অর্ডার দিল। খাবার বয়ে নিয়ে এলো বেয়ারা। টেবিলে সব খাবার বেড়ে দিয়ে ঠিক যেই মূহুর্তে বেয়ারার চলে যাবার কথা, তার আগের মূহুর্তে টেবিলে রাখা নানার হাতে চিমটি কেটে দিল জোরে। শুধু তাই নয়, চিমটি কেটে চলে যাবার সময় সগৌরবে গোটা রেস্তোঁরাকে জানান দিয়ে যায় যে সাদা চামড়ায় চিমটি কাটতে একই রকম লাগে। আগেই বললাম, নানা ভালো হিন্দী জানে। গোটা ঘটনার কোনোকিছুই ওর কাছে অস্পষ্ট থাকেনা। খুব অল্পেই ও বুঝে যায়, এখানে ও শুধু নারী নয়। উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারত ওর সারা শরীরে দুর্লভ ক্ষমতা খুঁজতে চায়, সাদা চামড়ায় চিমটি কেটে বুঝিয়ে দিতে চায় এই মাটিতে কার কত অধিকার। চিমটি-কাটা হাত যেন নানার উদ্দেশ্যে ভেংচি কেটে বলে, “পশ্চিমী দুনিয়ার মেয়ে তো, শরীরে পুরুষের হাত পড়ার অভ্যেস নিশ্চয়ই আছে!”
''আমি আজ নারীবাদী ইন্ডিয়ার জন্যেই...''
নানার কথায়, ভারতবর্ষ থেকে ডেনমার্কে যখন ও ফিরে আসে, নানাবিধ মানসিক রোগে সে আক্রান্ত। পিটিএসডি (কোনো গুরুতর মানসিক আঘাতপরবর্তী একটি রোগ) ধরা পড়ে ওর। কিন্ত আস্তে আস্তে সেরে ওঠার পর মাথায় প্রচণ্ড জেদ চেপে যায়। পাঁচ বছর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ এর কোর্স শেষ করবার পর এখন সে ভর্তি হয়েছে আইটি বিষয়ক আরেকটি মাস্টার্স কোর্সে। ওর উদ্দেশ্য আইটি অর্থাৎ তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক কাজ করবে ও ভারতবর্ষ সহ অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশগুলিতে।
আমাদের দেশগুলি তথ্যপ্রযুক্তিতে শক্তিশালী হলেও এইসব ক্ষেত্রগুলিতে নারীরা সংখ্যার হিসেবে অনেকটাই পিছিয়ে। নানার স্বপ্ন ভারতবর্ষে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে মহিলাদের আরো আগ্রহী করে তোলা। যে দেশের মাটি নানাকে চরম হেনস্থা করেছিল, দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিল ওর ব্যক্তিসত্ত্বাকে, সেই দেশের মহিলাদের হাত শক্ত করতে চায় সে আজ। আজ নানার দ্বিতীয় মাস্টার্স প্রায় শেষের পথে। আগের তুলনায় আরো ভালো হিন্দী বলছে সে। খুব শীঘ্রই আবার ভারতবর্ষে যাচ্ছে নানা। এক সংস্থার হয়ে ৬ মাসের জন্য ভারতবর্ষের গ্রামে গ্রামে ঘুরে কাজ করবে ও।
খুব লজ্জিত হয়ে ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আবার যাবে ইন্ডিয়া? পারবে তুমি?”
উত্তরে নানা বলে, “অবশ্যই! ইন্ডিয়া না গেলে আমি কোনদিন আমি হয়ে উঠতাম না। আজকে যে আমি একজন নারীবাদী, ইন্ডিয়ার জন্যেই! ভবিষ্যতে আমার সন্তানদেরও আমি ইন্ডিয়া পাঠাব। আর কিছু না হোক, একজন মানুষের জন্য কতটা ন্যূনতম সম্মান বরাদ্দ থাকা উচিত, সেটা উপলব্ধি করতে পারার জন্য।”
আমার কিছুই বলার ছিল না আর।
এতদিন ভাবতাম, স্বাবলম্বী হতে গেলে সাহস রাখতে হয়। সেদিন শিখলাম, স্বাবলম্বী হতে গেলে আগে বুকের পাঁজর ভাঙতে হয়। চিরকাল অক্ষত হয়ে, গা বাঁচিয়ে চললে জীবনের লড়াইয়ের পাঠ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ওতে কাজ হয়না। আগে কয়েক ঘা খেতে হয় সর্বাঙ্গে। মননে-মগজে কালশিটে। মার খেতে খেতে একদম যখন মাটিতে ঠেকে যাবে নাক-মুখ, ঠিক সেই মূহুর্তে গায়ের ধুলো ঝেড়ে ওঠার ধক লালন করতে হবে বুকের ভেতর। নাহলে স্বাবলম্বনের গল্প বলিউডি আদেখলামো হয়েই থেকে যাবে, বাস্তবে তার নাগাল পাওয়া যাবেনা।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply