দশের প্রেমে দেশদ্রোহী
1 156গত মাসে আমেরিকা থেকে আমাদের বন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে আসেন এক ইহুদী ধর্মাবলম্বী অধ্যাপক। জুলাই মাসের ১১ তারিখ দুপুরবেলা কাজের ফাঁকে বেরিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় লাগোয়া মাঠে রোদ পোহাতে। এখানে গ্রীষ্মকালে কেউ বাড়িতে বসে থাকেনা দিনের বেলায়। তো যাইহোক, মাথায় ইহুদী টুপি 'কিপা' পরিহিত সেই অধ্যাপককে রোদ পোহাতে দেখে এক যুবকের মাথায় রক্ত চেপে বসে। সটান লাথি মেরে মাথার কিপা মাঠে গড়াগড়ি খায়। পঞ্চাশোর্ধ্ব অধ্যাপকের বুকে চেপে বসে কয়েক ঘা লাগাতেও পেছপা হয় না বছর কুড়ির সেই যুবক। তার মুখে তখন একই বাণী, "জার্মানিতে ইহুদীদের কোনো জায়গা নেই। মনে নেই তোর বাপ-দাদাদের কীভাবে মারলাম?"
কোনোমতে আশেপাশের মানুষের সাহায্য নিয়ে নিজেকে ছাড়াতে সক্ষম হন অধ্যাপক। পুলিশকে ফোন করেন। পুলিশ এসে আরেক গোল বাধায়। মাথার কিপা আর যুবককে দেখে পুলিশ ভাবে বোধহয় উগ্র-ইহুদী ব্যক্তি প্যালেস্তিনীয় কাউকে মারছে। বলা নেই, কওয়া নেই, উলটে এক দল পুলিশ বেচারি অধ্যাপককেই মাটিতে ফেলে আবার আরেক রাউন্ড ধস্তাধস্তি। ততক্ষণে আসল আসামি ভিড় ঠেলে হাওয়া। পরে জানা গেলো, ছেলেটি অতি ডানপন্থী নব্য-নাৎসি মনোভাবাপন্ন এবং নানা রকম মাদকে আসক্ত।
যতক্ষণে পুলিশ বুঝে উঠতে পারল আসলে কেসটা কী, ততক্ষণে জল অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। এতটাই গড়িয়েছে যে আজ ভরদুপুরে, মাঝসপ্তাহে কাজের পাহাড় পেরিয়ে প্রায় গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধেক মানুষ জড়ো হয়েছিল প্রতিবাদ করতে। গতকালই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর সমস্ত কর্মচারীদের আহ্বান জানান এই প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা বর্ণবাদকে ঠেকাতে। আমিও গিয়েছিলাম আমার সহকর্মী এবং পিএইচডি সুপারভাইজার কারমেনের সাথে। ভেবেছিলাম বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলতে বাংলার শাড়ি-টিপ পরে বাংলায় লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে যাব। কিন্ত আঠাশ ডিগ্রীর ঠা-ঠা রোদ্দুরে ঘেমে নেয়ে তা আর আমার অলস বদনে কুলোয়নি।
তবুও, জমায়েতে ভিড়লাম যেভাবেই হোক না কেন। কিন্তু জমায়েতে পা রাখতেই মনটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেল। ওমা! এই জমায়েতে তো কেউ গলা উঁচিয়ে স্লোগান দেয়না, কারো গায়ের ঘাম অনৈতিক শ্রমের কথায় ঝরে না। এই জমায়েতে সবাই চুপ। ব্যস্ত শহরকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে প্রচুর মানুষ কেবল ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন।
একে একে বক্তৃতা শুরু হলো। গর্ব করার কিছু নেই তাও বলি, বন শহরের মেয়র আধা-ভারতীয়, নাম অশোক শ্রীধরন। খুব সুন্দর গুছিয়ে কথা বললেন আজ (যদিও একবার ইংরেজিতে বক্তব্য রাখার সময় ভুল করে “আমরা রেসিজমের পক্ষে নই”-এর বদলে “আমরা রেসিজমের বিপক্ষে নই” বলে ফেলেছিলেন)। কিন্তু আমার চোখ পড়ে ছিল দুটি মানুষের দিকে।প্রথমটি একজন অন্তঃসত্ত্বা নারী, যার কোলে আরেকটি বাচ্চা খেলছিল। ভরদুপুরের মারাত্মক রোদ্দুরে দেড়খানা বাচ্চা কোলে তিনি এসেছিলেন আজকের সমাবেশে। পোশাক-আশাকে খুব একটা সচ্ছল মনে হয়নি আমার তাঁকে। তবুও এত গরমের মধ্যেও গোটা সভায় সবার কথা দাঁড়িয়ে শুনলেন। মাঝে মাঝে হাততালি দিলেন। এবং গোটা সময়টা একহাতে বাচ্চা আর আরেক হাতে একটি প্ল্যাকার্ড ধরে রইলেন। প্ল্যাকার্ডের বাণীর বঙ্গানুবাদ করলে অর্থ দাঁড়ায় “সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমিও”।
দ্বিতীয়জন এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ। যিনি তার দ্বিগুণ উচ্চতার দু দু’খানা পতাকা নিয়ে এসেছিলেন জমায়েতে। একটি জার্মানির, দ্বিতীয়টি ইজরায়েলের। আমার ঠিক পেছনেই তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। ফলত, টিভি চ্যানেলের রিপোর্টারের দল যখন তাঁর সাথে কথা বলতে আসে, সমস্ত কথোপকথন ছিল আমার কানের নাগালের মধ্যেই। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, “এই দুটি পতাকা দিয়ে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন? জার্মানি ও ইজরায়েল রাষ্ট্রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা?” প্রশ্ন করতেই খ্যাঁক করে উঠলেন ভদ্রলোক। “পতাকা মানেই রাষ্ট্র এই চিন্তা সঠিক চিন্তা নয়। রাষ্ট্র তো ঠুনকো। আসল হচ্ছে মানুষ। রাষ্ট্রের সম্মানের জন্য পতাকা উঁচু করিনা আমরা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের মধ্যে কোনও ভেদ না থাকুক, সবার দেশে সবাই আসুক, এটাই আমরা চাই- Was ich sagen will ist, dass die Nation wichtig ist, der Staat kommt danach!”
ভদ্রলোকের হাতে পতপত করে উড়তে থাকা দুটো পতাকা দেখে বুকের ভেতরটা কেমন জানি মোচড় দিয়ে ওঠে আমার। সত্যিই তো, সারা জীবন ইস্কুলে শিখে এসেছি জাতি-দেশ-রাষ্ট্রের আলাদা আলাদা সংজ্ঞা। তবুও দিন শেষে সানিয়া মির্জা ম্যাচ হারলে শোয়েব মালিককে খিস্তি করি। রাজাকারকে গালি দিতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলি নূর জাহান, ফরিদা খানমকেও। তাঁদের আমরা বীরাঙ্গনা বলিনা। তাঁদের গলায় আমরা রাষ্ট্র খুঁজি, সীমানাহীন মানুষের শিল্পকে দেখতেই পাইনা। ইহুদী অধ্যাপকের সাথে ঘটা চরম অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে যে এতকিছু ভেবে লিখে ফেলব, সত্যিই ভাবিনি। কিন্ত তবুও তারপর থেকে কেবলই মনে পড়ছে আরো একটা লোকের কথা।
২০১৫ সালের মার্চ মাস। ঢাকায় উদীচী আয়োজিত গণসঙ্গীত উৎসবে আমি আর বাবা আমন্ত্রিত। অনুষ্ঠানের শুরুতে সমবেত কন্ঠে জাতীয় সঙ্গীত। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...’ সবাই গাইছে, সাথে আমরাও গলা মেলাচ্ছি। হঠাৎ বাবা দেখালো ডানদিকে রাস্তার ধারে দাঁড়ানো একটি রিক্সাচালককে। মাঝরাস্তায় রিক্সা থামিয়ে আস্তে আস্তে মঞ্চের দিকে এগিয়ে এলো সে। তারপর বুকে হাত, চোখ লাল-সবুজ পতাকার দিকে অনড়। আর গলায় কোন এক অজানা ভালোবাসা নিয়ে সে গেয়ে চলেছে, “মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়নজলে ভাসি...”
লিখতে বসে ভাবলাম, প্রতিমাসে তো ব্লগে কেবল হতাশার কথাই বলি। এযাত্রা নাহয় আশার গল্পই শোনালাম। আর আশার গল্প লিখতে বসলে যে সমস্ত স্মৃতিরা ভিড় করে, সবই কেন জানি না আজকালকার ভাষায় কিঞ্চিৎ রাষ্ট্রবিরুদ্ধ, “অ্যান্টি-ন্যাশনাল”। ইজরায়েল, বাংলাদেশ, ভারত, জার্মানি থেকে পাকিস্তান, আমেরিকা, চীন, যুক্তরাজ্য— একটি রাষ্ট্রব্যবস্থাও তো তেমন পাতে দেওয়ার যোগ্য নয়। কিন্তু আমি সত্যিই এখনও বিশ্বাস করি, এই অন্ধকারে টর্চ মারলেই দেখতে পাবো হাতেগোনা কিছু মানুষদের যারা এখনও পতাকা বললে মানুষ বোঝে আর বন্দেমাতরম বললে বোঝে দেশ রাগ। সেই আশাতেই আজ আমি রাষ্ট্রদ্রোহী।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
পতাকা বলতে মানুষ বোঝে……….আচ্ছা ঠিক আছে; না হয় মেনেই নিলাম। যদিও রাষ্ট্রবিহীন মানুষ কিন্তু হয় না, হওয়া বোধ হয় বাঞ্ছনীয় ও নয় । কোনও মানুষ সজ্ঞানে রাষ্ট্রবিহীন হতে চাইবে বলে মনে হয় না। মানুষ ছাড়াও রাষ্ট্র অলীক কল্পনা। আর রাষ্ট্রবিহীন মানুষ কিন্তু বিপজ্জনক ও হতে পারে; যেমন পাকিস্তানের প্রাক্তন সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ কথিত সেই stateless actor (সেই পাকিস্তানী সন্ত্রাসবাদীরা, যারা মুম্বইতে গণহত্যা চালিয়েছিল )। সে যাই হোক ; একটি কথা একেবারেই বুঝলাম না; বন্দেমাতরম বলতে দেশ রাগ বোঝে, এটা বলে ঠিক কি বুঝিয়েছেন আপনি দয়া করে ব্যাখ্যা করলে খুশি হবো। ধন্যবাদ।