অন্য 'পথের পাঁচালি'
2 292হাতে রঙের বালতি l রাস্তা থেকে কাটাধান মাঠে নেমে বাড়ির পথ ধরলো দুর্গা l জমিতে হাঁটু সমান নাড়ার মধ্যে ধান বাঁধছে যারা তারা ওর চেনা l
"ও দুর্গা, ক-ডা হাত - পা আঁকা হুলো ?"
ভোট আসছে , হস্তপদ চিহ্নের সমর্থক কাকার দেয়াল লিখনে দুর্গা রঙের বালতি বাহক l
কয়টা হাত -পা চিহ্ন আঁকা হল, হিসেব কষা শেষ হবার আগেই কাকার হাঁক, "শোন্ মা, এটটু শোন্ .."
কাকার ডাকে অথই আদর থাকে যা সম্ভবত কোথাও পায়নি দুর্গা l সম্বোধনের ঐ সুরটুকু কী যেন একটা সম্বল l
কুচকুচে কালো এক মেয়ে, দুর্গার বাবার দুঃস্বপ্নে এসে বলেছিল,"ভয় কী বাবা, আমি তো আছি" l তারপরেই জন্ম মেঘবরণ দুর্গার l মেয়ের নাম তাই 'কালী ' রাখাই মনস্থ করেছিলেন বাবা l 'মাকালী' , 'মেয়েকালী' হয়ে জন্মাল সে l দুর্গার অসীম কৃতজ্ঞতা মায়ের কাছে l তীব্র দোটানায় তার নামটা অন্তত 'কালী' থেকে ওইটুকু সরলো বলে l ফরসা মায়ের কোলে, সে কালো মেয়ে l জনে জনে এসে দায়িত্ব নিয়ে বলতে লাগলে , "কোল বেমানান মেয়ে" l মা বলতো, রেগেমেগেই বলতো , " আমার মেয়ে কালো তো তোমাদের কী ?" মায়ের যন্ত্রণা দুর্গা বোঝে l সমস্ত সংসারের কাছে সে "চিড়নদাঁতী , ঢ্যাঙা, হোঁচকপালী, আধমদ্দা- কাঠমেদী" l তার উপর ঠোঁট দুটো তার, মোথন নাপতির বউয়ের মতো l
দাদারা তাকে খেপায়," তোর বিয়ে হবে গোড়া ফোট্কের সঙ্গে" l সঙ্গে সঙ্গে যোগ করে যায় অন্যজন, " নয়তো হ্যালহিলে গোবিন্দর সঙ্গে l হি হি হি, হ্যা, হ্যা হ্যা" lঅশ্লীল লাগে হাসিটা l দুর্গা মোথোন নাপিত, ফটিক বা গোবিন্দকে চেনে না l কিন্তু ওদের উচ্চারণে , অসংস্কৃত শ্বাসাঘাতে গা রি-রি করে ওর l ঘিনঘিন করে l ওদের হাসিতে মনে আগুন লাগে l গায়ে ওঠে জোঁক l কিন্তু কী করবে সে ? সেও কি অভিশাপ দেবে ? না না, পিসিমার মতো হবে না সে l হলই বা পিসিমার মতো পেত্নীকালো l বহুবার শুনেছে সে, "বংশের ধারা নদীর স্রোত একই দিকে বয় l " সে কি পিসিমার মতো হয়ে যাচ্ছে, উগ্রচণ্ডা , জিভেবিষ ? কী অভিশাপ দেবে সে জানে না কিন্তু দিতে ইচ্ছে করে সত্যি তারও l খুব খুব খুব l তার খুব ইচ্ছে করে ওটাই- ওই অভিশাপ দেওয়াটাই l আর অন্য কীই বা পারে সে ? নিজেকে ফর্সা, বেঁটে, পটলচেরা চোখ, নাকি ওসবের নেই তোয়াক্কা সোনার আংটি ছেলে করতে পারবে ? বোন বুলির মত সুন্দর হলে -? তবে....? সেও কী আর এমন হাতিঘোড়া হত ? বুলিকে তো ওরা "খড়ম পেয়ে" বলে l বাড়ির বউ গুলো বরং সুন্দর.. পাড়ার সব কর্তাদের এক রা.. "বেন দিলে বুড়ি" এমন মেয়ে তারা আনবে না, তাই মেয়ের মা বা তিন-চার বার বিয়োনো মেয়ের দিদি দেখেই বউ আনে বাড়িতে l দুর্গার তখন মনে হয় মা কে দেখে যদিও বা পাত্র পক্ষ তাকে পছন্দ করে, তাকে দেখে করবে কেন ? জয়ী মায়ের চেয়ে কালো কাঠ কাঠ পিসিমাকে তখন আপন লাগে তার l
শুধু কাকা যখন কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ায়, আর সুর করে ছড়া কাটে,
"পুটু নাচে কোনখানে/শতদলের মাঝখানে / সেখানে পুটু কী করে / চুল ঝাড়ে আর ফুল পাড়ে / " সুরটা যেন শেষ হয়না...ফুল তোলা শেষ হয় না...শতদলের মাঝখানে নাচ শেষ হয় না....তখন সব অন্যরকম লাগে l
অথবা তাকে বোকা় বানিয়ে , কাকা বাইরে যাবে বলে যখন আদর করে, বলে, " পুটু, পুটুরাণি, সোন্না-আ মা আমার " তখন কেমন ভেঙে ভেঙে জল জল, মুক্তি মুক্তি লাগে তার..
কাকা ডাকছে l পিছন ফেরে দুর্গা lবাড়ি ফিরতে দুপুর হয় তার l ক্লান্ত দুর্গা মাটির দাওয়ায় বসে দেওয়ালে হেলান দিয়ে l সামনে উঠোন l গোল হয়ে সাতভাইএর ঘর , আইমরা ঘর ,দলজি ঘর টেঁকি ঘর, রান্না ঘর আর বড় ঘর মানে ঠাকুরদার ঘর l মাঝখানে ছোটখাঁটো স্টেডিয়ামের মতো উঠোন l তার একপাশে ধানের গোলা l সবকটা ঘর একনজরে চোখে পড়ে l একটু জল পেলে ভালো হত দুর্গার কিন্তু উল্টো দিকের রান্নাঘর অনেকটা পথ l
সাদা থানপরা পিসিমা রোদে ধান ওল্টাতে ওল্টাতে আজও বলছে, "তুই তোর বড় ব্যাটার রক্ত খাবি "l রাতে যে তার হাঁসের ডিম চুরি গেছে আজও l
গোলার ছায়ায় বসেছিল জ্যেঠিমা l বললে , "ঠাকুরঝি, তুমি এই না কদিন আগে তারকেশ্বরে ওর জন্যি পুজো দে আ-লে"l
দু্র্গার পিসিমা, সব ভাইপো-ভাইঝি দের অসুখে আপ্রাণ সেবা করে , আদর দেয়, অসুখে মানত করে, তিনদিন খালিপায়ে হেঁটে তারকেশ্বরে মানতপুজো দেয়, আবার অভিশাপও দেয় তাদের বাবা-মায়ের উপর রাগ হলে l দুর্গা যখন দুধের শিশু তখন তার বাবাকেও বলেছিল " তোর মাইয়ে, এই খালি হাত নাড়িয়ে, আমার মতো ফিরে আ-লো বুলে "l
কথাটা মনে হতেই দুর্গার নিজের পায়ের দিকে চোখ পড়ল, সেই এক ভুল করে বসে আছে সে l এক পায়ের আঙুলের উপর অন্য পায়ের আঙুল l ছিঃ ছিঃ ! পা সরিয়ে নিল সে তাড়াতাড়ি l বুকের কাছে পা জড়ো করে বসলেই, এক পায়ের পাতা আর এক পায়ের উপর যাবেই তার l সবসময় l এক্কেবারে সবসময় l
" পায়ের উপর পা দিয়ে যেই নারী বসে/ ছয়মাসের মধ্যে তার সিঁথির সিঁদুর খসে " l সে কি জানে না সেকথা ?
ছিঃ ছিঃ !পিসিমার অভিশাপ যদি ফলে ? ভয় তার হয়ই l সে ঘরে ঢুকে আয়না নিয়ে অসময়ে চুল বাঁধতে বসে l মাঝবরাবর সিঁথি করে l দাঁতে দড়ি ধরে কষে l আয়নায় ভালো করে দেখে l আগেও দেখেছে অনেকবার l নাহ, তার এক দিকের চুল ভারই একটু l কাউকে বলেনি সে l সবাই যে জানে-
"সিঁথির দুপার একদিক ভার
সিঁথির সিঁদুর খসবেই তার l"
পিসিমার অভিশাপ নয় কেবল এ তবে ! এ তার নিয়তি l দীর্ঘশ্বাস আরো দীর্ঘতর হয় l রোজকার মতো বাম দিকে সিঁথি করে চুল আঁচড়ে আবার বাইরে আসে সে l
পিসিমার উপর রাগ হয় না তার l মায়া হয় l তার জীবনটাও হয়তো অমনি হতে যাচ্ছে l
পিসিমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল হারান সর্দ্দার l সর্দ্দার, ছিঃ ! পিসিমা যে বিধবা , ছিঃ ! গল্পটা শুনেছে সে কাকীমাদের ফিসফিসানি থেকে lবড়জ্যাঠামশাই-এর চার সন্তানের পর জেঠিমা মারা গেলে বড়দির বয়সী জেঠিমা আসলো l ঠাকুরদা বলছিল দিন কয়েক আগে, "ছোট ছেলেকে আর অজাতের ঘরে কিছুতেই বে দ্যাবো না l স্বজাতের হাতের ভাত খাবো মরার আগে l " দুর্গার মায়েরা অজাত, ধুলেপুরে l বাইজপুরে মেয়ে চাই তার l কতটা দূরের জাত ধুলেপুরে বাইজপুরেরা ? ছোটকাকীমা একদিন জাত্যাভিমানের কথার উত্তর দিয়ে ফেলেছিল l ঠাকুমা ছড়া কেটে বলেছিলো," 'টাকা দে কিনে আনলাম বাঁদী' তার মুখি এত কোতা ?" কাকীমার কী হল সেদিন, বলেছিল," টাকা দে তুমি কিনুনি আমাগো , আমাগো বাবা-মা কিনেছে তোমাগো ছাবালেগো "l
তিনমাথা ঠাকুমার লাঠি ধরা পায়ের স্পিড তখন দেখার মতো l ঠাকুরদার সন্তানদের বড়গুলি মেয়ে l কনেপণ নিয়ে বিয়ে দিয়েছিলেন তাদের দুর্গার ঠাকুরদা l সেজপিসি গলায় দড়ি দিয়ে মরার পরও দুর্গার বালক বাবা কনেপণের টাকা নিতে সে বাড়ি গেছে বার কয়েক l বাবার মুখেই শুনেছে দুর্গা l সময় বদলালো মেয়েদের বিয়ের পরেই l দান বদলালো l ঠাকুরদার ছেলেগুলি ছোট l তাদের বিয়েতে কিন্তু বরপণ না দিয়ে কনেপণ নিয়েছিলেন ঠাকুরদা l কী অপার ক্ষণজন্মা দুর্গার ঠাকুরদা, এবং তার ছেলেগুলো l
দুর্গার শুধু মনে হয়, বারো বছরে বিধবা পিসিমাটার যদি বিয়ে হত l পিসিমা যদি একটা রান্নাঘরের দায়িত্ব পেত ! রান্নাঘর পেলে পিসিমা যেন অন্নপূর্ণার মতো l অসুস্থ গিন্নিদের সংসারে পিসিমাকে দেখেছে সে l কী দারুণ কোমল , মধুর লাগে তাকে l সাদাথান কাপড়েও তাকে মালক্ষী মালক্ষী লাগে l না , না, কেমন জগদ্ধাত্রীর মতো ঐশ্বর্যময়ী lজল চাই একটু দুর্গার l ধানের গোলা পেরিয়ে রান্নাঘরে চললো সে l গোলার আড়ালে জ্যেঠিমাকে দেখতে পেল এবার l কিছুটা চাল,একটা ওল, পাঁচটা দশটাকার নোট সামনে পেতে অপরাধীর মতো বসে l খুড়তুতো জ্যাঠা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলছে ঠাকুরদাকে," ওরা জোর কুরে ধুরে মার থানে তুললো, ছাবালের মাথায় হাত দে কিরে কোরালো, কী করবো কাকা ? তোমার কোথা শুনে আমরা সবাই এতদিন এক জাগায় ভোট দিছি l কী করবো কাকা ?"
আগের রাতেও কালীর থানে নিয়ে ক-জনের ভোট পেতে লাঙল-তারার দল কিরে মানে প্রতিজ্ঞা করিয়েছে l হাত-পা চিহ্ন আঁকার সময় এসব আলোচনা সে শুনেছে l
জ্যেঠিমা বললো, "বললাম, হাত-পায় ভোট না দিলি হাঁটপো কেমমায় ? কাজ করবো কেমমায় ? শুনলো না বুললো, লাঙল-চাঁদে ভোট না দিলি চাষ করবা কেমমায় ?, আলো পাবা কোনযায় ? কিরে না করলি নামতি দেলো না কাকা "
হাত-পা তে ভোট না দিলে যদি হাঁটতে আর কাজ করতে না পারে, লাঙল-তারায় ভোট দিলে যদি চাষ করতে না পারে, আলো না পায়, বড় হয়ে লক্ষ্মী চিহ্নে ভোট দেবে দুর্গা..নিজেই দেওয়ালে দেওয়ালে লক্ষ্মী আঁকবে l
দুর্গা রান্নাঘরের দিকে এগোলো l
রান্নাঘরে ঢুকে অবাক হল সে l পেঁয়াজ রসুন কাটা হচ্ছে অনেকটা l মানে মাংস হবে দুপুরে l কিন্তু আনন্দটা দানা পেকে উঠতেই প্রশ্ন এল - কার হাঁস ? কার ? নাকি মুরগী ? কোথায় কাটা হচ্ছে ? সে জল খাওয়া ফেলে দৌড় লাগালো গোয়ালের পাশে মাঠটার দিকে l ঠিক l লোক জড় হয়েছে ওদিকে l কিন্তু রেখা এত কাঁদছে কেন ? ধরে রাখা যাচ্ছে না l তবে কি রেখার মুরগী ?
" সুন্দরী ? "
রেখাকে ধরে রাখা ভোলা বললে, "ওর ভাই " ভোলার দুচোখ ভেসে যাচ্ছে জলে l দুর্গার বুক ভেঙে যাচ্ছে, কাঁদবে না সে কাঁদবে না, এক্ষুণি তবে ওরা হাসবে সেই অশ্লীল হাসি l ওটা সহ্য করার চেয়ে দুর্গার কান্না চাপা সহজ l রেখার কালুকে কাটছে ওরা l রেখার ছোট ভাইটা জন্মানোর দুদিন পর জন্ম হয়েছিল "কালুর " l কালুর মা প্রসবের পর মারা গেল l নিজের আতুরের সময় বিয়োনো ছাগলটার যত্ন নিতে পারেনি রেখার মা l কালু তখন রেখার মায়ের দুধ টেনে বড় হল l তারপর দুটো বছর কালু রেখার ভাই l দুকোলে দুটিকে নিয়ে দিন কেটেছে তার l বছর দেড়েক আগে যখন খাসি করা হল কালুকে তখনই রেখা এরকম আছাড়ি-পিছাড়ি কান্নায় জেনেছিল কালুর পরিণতি l আরও বেশি আগলে রাখছিল কালুকে l বুকভাঙা ব্যর্থ শঙ্কিত আদর দিচ্ছিল বেশি করে করে lসবাই খেতে বসেছে l ২০ টাকা কেজি দরে কেজিকয়েক মাংস বিক্রি হয়ে গেছে l কুড়ি টাকা --একদিনের জনমজুরিও কুড়ি টাকা l কাল অঙ্ক করতে গিয়ে কাকা বলছিলো l খেতে বসেছে সবাই l
রেখা কেঁদেই চলেছে, ভোলা বসেছে পাশে l জ্যাঠতুতো খুড়তুতো দাদারা ভ্যাঙাচ্ছে আর বলছে ,"দেখ রেখা, কেমন গন্ধ উঠেচে, যা খাবো না.. হদ্দ খাবা খাবো, ধুরে তুলতি পারবি তো রেখা !"
রেখার কান্না বাড়ে l তার পাতে মাংস দিয়ে মাখায় জ্যেঠিমা, বলে "অনেক কাজ মা, খেয়ে নে.. আর তো কিছু রান্না হয়নি l" রেখার মুখে গুজে দেয় একটুকরো , রেখা মুখ নিচু করে l ভোলা থালা রেখে উঠে যায়, বমি আসে তার, কিন্তু জানতে দেওয়া যাবে না l সে খালপাড়ে খড়ের ঘেরা জায়গায় লুকোয় কিন্তু আশঙ্কা ব্যর্থ হয় না.. পরিষ্কার শুনতে পায় দাদারা বলছে,"ভোলাটা মেনিমুখো, "
যোগ করছে অন্যজন, "ওডা মরদ না মাগী" l সরল সাধাসিধে ঠাম্মা ফোকলা হেসে বলে, " ধোন কআটে খাসি কুরে দে ওরে" l
রেখা ঢোঁক গিললো l অমনি
"সেই তো সেই খালি , তবে কেন নাঙের কান্না কাঁদলি l"
আরও একটা বিকৃত মন্তব্য শুনলো , হজম করলো দুর্গা l
দুর্গা কী করবে? অসহ্য ওদের উচ্চারণের ঢঙ l দুর্গা নীরবে খেয়েই নিল l জিভে অপূর্ব স্বাদ l চোখের সামনে দুটো পা তুলে শিং বাঁকিয়ে আদর আদর খেলতে এগিয়ে এল কালু l দুর্গা চোখ নামালো l বুঝতে চেষ্টা করে কী হচ্ছে রেখার ?**
"চোখ খোল ধীরে ধীরে "
চোখ খুলছে সবাই l দূর্বার দিকে চোখ যায় দুর্গার l মিস্টি আবদারের ঢঙে দাবী করতে ওস্তাদ কেবলহাসা মেয়েটা l
"দিদিভাই আর একটু , প্লিজ "
প্রায় সমবেত আব্দার, " সিলেবাস তো শেষ দিদিভাই "l
সত্যি তো সিলেবাস শেষ lদুর্গা বলে," বল কী করবি আজ l"
"চোখ বন্ধ রাখবো l"
"সেই যে সেই খেলাটা ?"
"চিরকুট"
"আমি সুন্দর কিনা "
" না না গল্প "
"সম্মোহন "
"সেটা আবার কী ?"
প্রশ্নটা করে ফেললেও দুর্বা জানে কী বলতে চাইছে মেয়েরা l কিন্তু সে তো সত্যি সম্মোহন জানে না...মেয়েরা আবার তা মানেও না..বায়না ধেয়ে আসে একের পর এক l ওরা কেউ চাইছে চিরকুটে প্রশ্ন লিখে সমাধান l কেউ চাইছে বন্ধ চোখে খেলা l কেউ নির্দিষ্ট করে আরও একবার জানতে চায় যে সে সুন্দর....
ঐ খেলাটা যতবার খেলেছে মেয়েরা ততবার দেখেছে দুর্গা, বন্ধ চোখে আকুল কাঁদছে মেয়েগুলো l বুঝতে পারে দুর্গা, ফাঁকা দাঁত, খ্যাদা নাক, কালো,রোগা, লম্বা, মোটার যন্ত্রণা পেরিয়ে ওরা "শতদলে মাঝখানে" বসাতে পারছে নিজেদের l তার মানে চল্লিশ বছর পরেও শিশুমনে একইরকম আছে সুন্দর কুৎসিৎ এর ধারণা l দুর্গার বুঝতে বড্ড দেরী হয়ে গিয়েছিল..
দুর্গা ভাবতেই পারতো না কুৎসিৎ তাকে, কেউ ভালোবাসতে পারে l বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল l
দুর্গা ওদের চেতনাতে আর আবর্জনা ভরতে দেবে না l ভ্র-প্লাক, স্ট্রেট হেয়ার, শাড়ির ছোট্ট পিন , ফেয়ার এন্ড লাভলি মন পেরিয়ে ওরা আত্মবিশ্বাসী, সরল, জিজ্ঞাসু, মরমী এবং সুন্দরের ঔজ্বল্য নিয়ে বাঁচুক....দুর্গা বললে, "ঐ আমি সুন্দর কিনা " খেলাটা তো তোমরা সবাই জানো ? "
সবাই মাথা নাড়ে l
"তবে ?"
"তবে চিরকুট l"
দূর্বা বললে, "আমি সুন্দর " ঐ খেলাটার মতো একটা খেলা শিখিয়ে দিন দিদিভাই.."দুর্গা বললে, "আচ্ছা বেশ তোমরা আগে চিরকূট লেখো l মনে আছে তো নিজের নাম থাকবে না চিরকুটে l হাতের লেখাটা কার যেন চেনা না যায় l আর প্রশ্ন থাক বা না থাক, দিতে হবে ভাজকরা চিরকুট l আর জানোই তো খেলাগুলোতে শেষ পর্যন্ত কোন হারজিত নেই..তুমি সৎ থাকলে আর একশভাগ মন দিয়ে খেললে তুমিই আনন্দ পাবে, তাইতো ? l"
দুর্গা এই ক্লাসগুলোতে ছোট বেলায় ফিরে যায় l প্রশ্ন, সংকোচ আর অভিমানে গুমরে থাকা মন, কী জ্বালাতেই না ফেলতো l এই খেলার নিয়মে ওরা মেলতে পারবে নিজেদের..
"তাহলে সবাই রেডি "
"সরে বস্, সরে বস্ " বলে ছড়িয়ে বসলো মেয়েরা l পরস্পরকে ছুঁয়ে থাকলে জমে না খেলা..সবাই সরে সরে যায় l
চিরকূট লিখে ফেলে সবাই l সব্বাই জমা দিয়ে দেয় l বেশিরভাগ সাদা কাগজ l দুর্গা কয়েকটা চিরকুট বেছে নেয় l
"এগুলোর উত্তর দিই ?"
"হ্যাঁ হ্যাঁ "উদগ্রীব হয়ে ওঠে মেয়েরা l
"বেশ, চোখ বন্ধ, আমার প্রশ্নের উত্তরে কেবল হাত তুলবে সবাই l "
সবাই চোখ বন্ধ করে l মিনিট খানেকের নীরবতা l
"বল কে কে মনে কর, তোমার বিয়ে হবে যার সঙ্গে সে তোমার চেয়ে বয়সে ছোটও হতে পারে ?"
হাত ওঠে একটি , সংখাটা লিখে রাখে দুর্গা l
"বল কে কে মনে কর, তোমার বিয়ে হবে যার সঙ্গে সে তোমার চেয়ে কম শিক্ষিত হতেও পারে ?"
এবারে ৮ টি হাত উঠলো l
নিজের চেয়ে নিচু জাতে বিয়ে করতে রাজি ৫ জন l নিজের চেয়ে কম বেতনের ছেলেকে বিয়ে করতে চাইলো ৬ জন l বড় সংসারে যেতে রাজি ৩ জন l ঘর জামাই এ রাজি নয় কেউ l চাকরী না পেয়ে বিয়ে নয় তাতে হাত ৯ জনের l নিজের থেকে বেঁটে, কম শক্তিমানকে বিয়ে করতে রাজি নয় কেউ l
"জিন্স পরতে ভালো লাগে কার ?" হাত উঠলো ৫৭ , ৫৮ জনের মধ্যে l "ছেলেরা শাড়ি, দুল, গয়না পরলে কেমন লাগে ?"
না, কোন হাত নেই l
সংখ্যাগুলো বোর্ডে লিখল দুর্গা l
নির্দেশ পেয়ে ধীরে ধীরে চোখ খুললো সবাই l
দুর্গা এবার প্রশ্ন করে, "কিন্তু কেন হাত তুলতে পারলে না সবগুলোতে ?"
সবাই চুপ l উত্তরটা যেন জানা, কিন্তু ঠিক বলতে পারছে না তারা l
দুর্গা সাহায্য করে," তবে বলতে পারি কি যে তেমন হলে তোমরা তাকে সম্মান করতে পারবে না ? "
মেয়েদের যুক্তিযুক্ত লাগে কথাটা l যেন কোন দিকে যাচ্ছে বিষয়টা বুঝে উঠতে পারছে না তারা l তবু চোখ, মুখ, মাথার অভিব্যক্তিতে সম্মতি ধরা পড়ে l
"তাহলে সব কিছুতে নূন্যতম থাকা মেয়েদের ছেলেরা সম্মান করবে কেমন করে ? কী আছে ওদের কাছে মেয়েদের সম্মান করার মতো ? আইন তৈরী করে কি তা অর্জন করা যাবে ? ওরাই বা কেবল ভাতকাপড়ের দায়িত্ব নেবে কেন ? ওরা কমনীয় করে সাজতে চাইলে যদি হাসি পায় তোমাদের, তবে তোমাদের পছন্দে ওরা 'রাফ এন্ড টাফ' হওয়া শিখছে l আমরা বরং মার খাওয়ার অভ্যাসটা আর একটু প্র্যাকটিস করি l "
ভোলার মুখটা মনে পড়ছে দুর্গার lদুর্গার হাতে চিরকূট
তাতে প্রশ্ন , মেয়েদেরই কেন শ্বশুরবাড়িতে যেতে হয় ? কেন অত্যাচার হয় মেয়েদের উপর ? কেন তা মেনে নেবে মেয়েরা ? কেন ছেলে চায় বাবা মায়েরা ?ঘণ্টা পড়ে গেল l পরের চিরকূটগুলো অন্যদিন আলোচনা করা যাবে l দুর্গার হাতে এখন অন্য রঙের বালতি l দু্র্গার হাতে এখন অনেক দেওয়াল l তাকে অনেক জগদ্ধাত্রীর ছবি আঁকতে হবে l
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Vison valo akta lekha. khb prasanggik .