এক মেয়েলি ছেলের স্কুলবেলা ২
0 230পালবাজারের মোড়ে পান্না দা’র চায়ের দোকানের উল্টো দিক দিয়ে যে রাস্তাটা সোজা চলে গেছে নিউ ল্যান্ডের দিকে, সেই রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলে বাঁ হাতে একটা মেসবাড়ি। এই মেসবাড়ি না থাকলে, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও শুভঙ্করের সাথে আমার হয়তো আলাপ হত না কোনোদিন। কারণ শুভঙ্কর ‘ইভনিং’-এর ছাত্র। এই সন্ধ্যেবেলার ছেলে-মেয়েদের সাথে দিনের বেলা ক্লাস করা ছেলে-মেয়েদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একটা দূরত্ব থেকে যায়। সেই দূরত্বের মধ্যে মিশে থাকে কিছুটা অবহেলা। কিছুটা অবজ্ঞা। বা সে সব যদি নাও বা থাকে, নিছক সময়ের ব্যবধানেই আর যোগাযোগ অথবা বন্ধুত্ব তৈরি হয় না খুব একটা।
দূরত্ব জিনিসটা শুভঙ্করের কাছে খুব একটা অচেনা নয়। কোচবিহার থেকে কলকাতায় এসেছিল শুভঙ্কর এম এ পড়তে। সেটা একরকমের দূরত্ব। এই যে কলকাতা আর বোলপুরের মধ্যে দিন কাটছে ওর – ছবি এঁকে আর ছবি আঁকার ক্লাস নিয়ে, সেটাও একরকমের দূরত্ব। তবে আরো একরকমের দূরত্বকে অতিক্রম করার কাজ শুভঙ্করকে করে চলতে হয় অবিরাম। এই যে সেদিন, ফার্স্ট ইয়ারের এক ছেলে, সে শুভঙ্করকে দেখছে মাস তিনেক, কিন্তু সেদিনই জানতে পেরেছে যে শুভঙ্কর ‘গে’, সে শুভঙ্করকে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছে, “মেয়েদের একদম ভালো লাগে না তোমার?” মালদার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা এই ছেলেটির সঙ্গে শুভঙ্করের কি কোনো দূরত্ব তৈরি হয়েছে এর ফলে? হয়নি। বরং শুভঙ্করের কথায়, ও বেশ মজাই পেয়েছে। আরো মজা পেয়েছে, কারণ প্রথম বর্ষের এই ছেলেটি কিন্তু শুভঙ্করের দিকে অবহেলা অথবা অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকায়নি। অন্য আর পাঁচটা খবরের মত শুভঙ্করের সম্পর্কে এই তথ্যটি গ্রহণ করেছে সে। কিন্তু সব সময় তা হয় না। শুভঙ্করকে জিজ্ঞেস করছিলাম, ওর বন্ধুরা জানতে পেরে কীভাবে রিয়্যাক্ট করেছে। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কিছুটা পিছিয়েই যেতে হল শুভঙ্করকে। পিছিয়ে যেতে হল এমন একটা সময়ে, যখন ও নিজে সচেতন ভাবে আড়াল করে রেখেছে ওর আইডেন্টিটি। “অভিনয়” করে গেছে। এর ফলে নিজের মধ্যে কোনো দূরত্ব তৈরি হয় না কি? দূরত্ব তৈরি হয় না কি আরো পাঁচজনের সাথেও?
কোচবিহারের সরকারি স্কুলে পড়ত শুভঙ্কর। ও নিজেই বলছে যে ক্লাসে ওর বেশি বন্ধু ছিল না। ও চিরকালই একটু চাপা স্বভাবের। তাই অনেকের সাথে মিশতেও পারত না। আবার ছোটবেলা থেকে এটাও বুঝতে পারত যে ক্লাসের অন্য ছেলেদের মত ও নয়। মানে, ‘ছেলে’ হয়ে ওঠার প্রকল্পে ও নিজেকে ঠিক মানিয়েও নিতে পারছে না। তার ওপর ক্লাসের অন্য এক ছেলের কথা বলার ভঙ্গি নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি শুনে আরো খানিকটা গুটিয়ে গেছিল শুভঙ্কর। আর সচেতন দূরত্ব বজায় রেখেছিল ওই বিশেষ ছেলেটির সাথে। ‘হোমো’। এই শব্দটার কথা বলছিল শুভঙ্কর। যে তক্মাকে এড়িয়ে চলাই শ্রেয় বলে মনে হয়েছিল কোচবিহারের এক কিশোরের, যে নিজে তখনো নিজের যৌনতা সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন নয়।
খেলাধুলোতে যথেষ্ট আগ্রহ ছিল না শুভঙ্করের। ভালবাসত ছবি আঁকতে। আবৃত্তি করতে। নাটকে আগ্রহ ছিল। কিন্তু অনেক সময় এই সব পছন্দের জিনিসের থেকেও দূরেই থাকতে হত। কারণ এগুলো ‘মেয়েলি’। এখন কী মনে হয়, জিজ্ঞেস করি ওকে, যে ছেলেদের স্কুলে সেলাই, ছবি আঁকা, গানের ক্লাস চালু হলে কোনো সুবিধে হত? শুভঙ্করের মতে, হওয়ার সম্ভাবনা তো নিশ্চয়ই থাকত। আর ওর পক্ষেও এসবে অংশগ্রহণ করা আরো সহজ হত। তবে শুধু তো স্কুল নয়। পাড়াতে, বাড়িতেও অনবরত গা বাঁচিয়ে চলা। কী থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে সেটা না জেনেও নাচ করা ছেড়ে দিল শুভঙ্কর, যদিও ঘরে গান চালিয়ে দিয়ে নাচ করা ছিল ওর সময় কাটানোর প্রিয় উপায়গুলোর মধ্যে একটা।
কয়েক মাস আগে আমাদের অনেকের সাথে পরিচয় ঘটেছে হ্যানা গ্যাট্সবির। হ্যানা গ্যাট্সবির থেকে শুভঙ্করের দূরত্ব কত হাজার মাইল? কিন্তু কী অদ্ভুত সমাপতন! ‘ন্যানেট’-এ হ্যানা বলছেন যে তাঁর ‘মানুষদের’ সাথে তাঁর প্রথম পরিচয় ঘটে টিভির মাধ্যমে। তাঁর ছোট্ট শহরে ছোট্ট টিভির পর্দায় তিনি প্রথম যাঁদের দেখেন, তাঁদের সাথে নিজেকে মেলাতে পারেননি হ্যানা। শুভঙ্কর বলল, ও প্রথম সমকামিতা সম্পর্কে জানতে পারে টিভি দেখে। বাড়িতে তখন কেউ নেই। আর সেটা এমন এক বয়স যখন বাড়িতে কেউ না থাকলে টিভি খুলে তাড়াতাড়ি দেখে নিতে হয় নিষিদ্ধ প্রোগ্রাম। চ্যানেল ঘোরাতে গিয়েই ব্যাপারটা চোখে পড়ে শুভঙ্করের। যদিও তখনো নিজের সাথে ও কোনো মিল খুঁজে পায়নি টিভির আলোচ্য বিষয়ের।
স্কুলের বাইরে ছেলে-মেয়েদের মেলামেশার একটা কেন্দ্রস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছিল (এখনো দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চয়ই) কোচিং ক্লাস। ছেলেদের আর মেয়েদের আলাদা আলাদা স্কুলের সংখ্যা যেখানে বেশি, সেখানে তো বিশেষ করে। এইরকম কোনো একটা ক্লাসে শুভঙ্কর নাকি একবার একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে হেসেছিল। এমনিই। দেখা হলে যেমন হাসে মানুষ একে অন্যের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু মেয়েটির বন্ধুরা ক্লাসের পর এসে শুভঙ্করকে জিজ্ঞেস করে মেয়েটিকে ওর পছন্দ কিনা। “আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম!” বলল শুভঙ্কর। বলল যে বয়ঃসন্ধির কিছু পরে, এই সময়টা থেকে, ও বুঝতে শুরু করে যে মেয়েদের প্রতি ওর কোনো ‘বিশেষ’ আকর্ষণ নেই। এদিকে আশেপাশে ছেলে-বন্ধুরা মেয়েদের প্রেমে পড়তে শুরু করছে। কয়েকজন প্রেম করছেও। শুভঙ্কর বুঝতে পারছে, এই আলোচনায় তার কোনো জায়গা নেই। তার কোনো গল্প নেই। দূরে সরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। হয় ওদের থেকে। নয় নিজের থেকে। কারণ ততদিনে ক্লাসেরই এক ছেলেকে ভালো লাগতে শুরু করেছে ওর। অথচ বলার মত কেউ নেই। কাকে বলবে? কী বলবে? স্কুলে? বাড়িতে? পাড়ায়? কোথাও বলার জায়গা ছিল না।
যেমন বলতে পারেনি শুভঙ্কর আজ অব্দি আর কাউকেই যে এক পাড়াতুতো দাদাকে ভালোবেসেছিল ও। বলতে পারেনি যে সেই পাড়াতুতো দাদার সাথে শারীরিক সম্পর্ক ছিল ওর। বলতে পারেনি যে এখন ও জানে, সেই সম্পর্কের মধ্যে ভালোবাসা ছিল না। ছিল শুধু ব্যবহৃত হওয়া। কিন্তু কাউকে বলার ছিল না। শুভঙ্করের অনুমতি নিয়েই ওর এই কথাটা লিখলাম এইখানে। আমি লিখছি বটে, কিন্তু এতদিনে, বলছে তো আসলে ও-ই।
ওর স্কুলের দু’জন বন্ধু এখন ওর সমকামিতার কথা জানে। তাদের মধ্যে একজন প্রথমে মেনে নিতে চায়নি ব্যাপারটা। বিশ্বাস করতে চায়নি। যেন কোনো খারাপ খবর দেওয়া হয়েছে তাকে! কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা আরো সহজ ভাবে গ্রহণ করেছে ওর কথা। মালদার ছেলেটির মত সহজাত সারল্যে, অথবা অর্জিত সংবেদনশীলতায়।
কিন্তু কোচবিহারে আজ, এই ২০১৯ সালে, যে কিশোর বন্ধ করে দিচ্ছে নাচ, লুকিয়ে ফেলছে রং পেন্সিল, গোপন করছে ভালোবাসা – তার সাথে ৩৭৭ বাতিল হয়ে যাওয়ার দূরত্ব থেকে যাবে, বলছে শুভঙ্কর। বলছে, কেউ জানতে পারবে না। অথবা ভুল জানবে। ‘হোমো’ শব্দটাকে গালাগাল হিসেবে চিনতে শিখবে। শিখবে ঘৃণা আর অভিনয়।
আমাদের প্রাইড ওয়াক ওর রাস্তায় পৌঁছতে পারবে না?
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply