• 'Access Denied': শিক্ষাক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা


    0    124

    June 10, 2020

     

    বিশ্বজুড়ে করোনা অতিমারীর প্রেক্ষিতে নানা রচনার অনুবাদ নিয়ে আমাদের অনুবাদ সিরিজের ষষ্ঠ কিস্তি ২২ শে মে ২০২০ দ্য টেলিগ্রাফ প্রকাশিত স্যমন্তক দাস-এর প্রবন্ধ 'Access Denied: Education and the limitations of Modern Technology'। 'এখন আলাপ ব্লগ'-এ প্রকাশিত  বাংলা অনুবাদটি করেছেন সর্বজয়া ভট্টাচার্য।

    **

    তাহলে কি আমরা এই শিক্ষবর্ষকে ‘শূন্য বছর’ হিসেবে ঘোষণা করতে পারি,এবং ২০২০ সালের মে-জুন মাসে যাদের ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল তারা যাতে ২০২১ সালে পরীক্ষা দিতে পারে সেই ব্যবস্থা নিতে পারি? ... যদি গোটা দেশে ‘শূন্য বছর’ মেনে চলা হয় তাহলে সকলের ক্ষতির—অথবা অন্য দিক থেকে দেখলে লাভের—পরিমাণ হবে সমান।

    **

    এই কোভিড-১৯ অতিমারী যদি একটা কথা স্পষ্ট করে দিয়ে থাকে সেটা হল—দিল্লীর সিংহাসনে আসীন নেতাদের থেকে যে সাধারণ মানুষরা তাঁদের সেখানে বসিয়েছেন—সেই দুই দলের মধ্যে দূরত্ব ঠিক কতখানি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থালা বাসন বাজাতে বলা (ভারতবর্ষে বারান্দা-ওয়ালা বাড়ি ক’জনের আছে সেই সংখ্যাটা পেলে ভালো হয়), মাত্র চার ঘন্টার নোটিসে দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করা (যেন মহান নেতা যখন টিভিতে মার্চের ২৪ তারিখের রাতে তাঁর আবেগঘন ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন সব ভারতবাসী তাদের সুখী গৃহকোণে নিশ্চিন্তে বসে ছিল), এপ্রিলের ৫ তারিখ গোটা দেশকে অন্ধকার করে শুধু মোমবাতি আর প্রদীপের আলো জ্বালিয়ে রাখার বিপজ্জনক পরিকল্পনা (রাত নটায় ন মিনিট কর্মসূচি – যা শুনলেই উদ্ভট যত কুসংস্কারের গন্ধ পাওয়া যায়), লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের প্রতি চরম ঔদাসীন্য, অতিমারীকে মুসলমানদের চক্রান্ত বলে প্রমাণ করার চেষ্টা – তালিকাটি যন্ত্রণাদায়ক।

    আমি একটা বিদ্যুৎবিহীন ঘরে বসে টাইপ করছি – বাইরে সাইক্লোন আম্‌ফানের লেজ দাপাদাপি করছে। ইলেক্ট্রিকের তার ভয়ানক ফুলকির ফোয়ারা ছড়িয়ে ছিঁড়ে পড়ে গেছে, আমাদের হাউজিং কমপ্লেক্সের পঞ্চাশ বছরের একটি শিশির গাছ-সহ আরও অনেক অনেক গাছ উপড়ে গেছে, রাস্তার ধারের দোকানগুলোর টিনের ছাউনি উড়ে গেছে। শহরের যে অংশে আমি থাকি, সেই অংশ বিধ্বস্ত। বন্ধুদের থেকে পাওয়া খবরে জানা যাচ্ছে আরও দক্ষিণের দিকে (সুন্দরবনের কাছাকাছি) অবস্থা আরও খারাপ, এবং কয়েক ঘন্টা পরে সূর্য উঠলে কী ক্ষতি চোখে পড়বে এখন সেটা কেউ আন্দাজও করতে পারছে না। অথচ আমি কিন্তু তাও ল্যাপটপে খুটখাট করতে পারছি কারণ আধুনিক প্রযুক্তির নানা সুবিধে রয়েছে আমার হাতে – আছে একটা শক্তপোক্ত মেশিন, তার পিছন-দিকে আলো জ্বলা কিবোর্ড, আছে ব্যাটারি যা আরও কয়েক ঘন্টা মেশিনকে চালু রাখবে, আছে একটা মোবাইল ফোন যার ডেটা থেকে হটস্পট নিয়ে আমি ইন্টারনেটও ব্যবহার করতে পারছি, মাথার ওপরে এমন একটা ছাদ আছে যা ভেঙে পড়বে না – এগুলো হল সবথেকে প্রকট উদাহরণ। 

    এই জিনিসগুলির মধ্যে একটিও ভারতবর্ষের অধিকাংশ মানুষ অনায়াসে লাভ করতে পারেন না, তাই আমি যে আমার সহনাগরিকদের তুলনায় সাংঘাতিক সুবিধে উপভোগ করি, সেই বিষয়েও আমি অত্যন্ত সচেতন। তবে অদ্ভুতভাবে, এবং দুঃখজনকভাবে, আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ভার যে শক্তির হাতে, তাঁরা যেন দেখতেই পান না যে আমাদের – অর্থাৎ পড়ুয়াদের গাইড এবং উপদেষ্টাদের – যে সুযোগ-সুবিধে আছে, বেশির ভাগ পড়ুয়াদেরই তা নেই। লকডাউনের মধ্যে শিক্ষার সুবিধে পাওয়ার ক্ষেত্রে যে সমস্ত অসুবিধে পড়ুয়াদের হচ্ছে তার থেকে নিরাময়ের বিশল্যকরণী হিসেবে ‘অনলাইন’ ক্লাস এবং পরীক্ষাকে দাঁড় করানো হল এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

    অনলাইন ক্লাস নেওয়া এবং শিক্ষাক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক/ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করার মধ্যে একটা মূলগত ফারাক আছে। প্রথমটির ক্ষেত্রে পড়ুয়াকে একটি নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত থেকে বিশেষ সময়েই ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে হয়; দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে পড়ুয়ারা পড়ার উপকরণ ডাউনলোড করে নিয়ে নিজেদের সময় মত শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। যেখানে পড়ুয়াদের মধ্যেই রয়েছে বিরাট আর্থ-সামাজিক বিভেদ, সেখানে এই কথাটা সব সময় মনে রাখা প্রয়োজন। আরও বিশেষ করে আমি যেখানে চাকুরীরত সেইরকম সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তো বটেই। এরপর আমি আলোচনাটা শুধু উচ্চশিক্ষাতেই সীমাবদ্ধ রাখব কারণ স্কুল শিক্ষার সমস্যা নিয়ে আরেকটি স্বতন্ত্র আলোচনা প্রয়োজন।

    সৌভাগ্যবশত, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, আমাদের সমস্ত সমস্যার সমাধান হিসেবে প্রথমে ‘অনলাইন’ ক্লাসের জিগির তুললেও, এখন তা থেকে কিছুটা পিছু হটেছে, এবং কী ভাবে শিক্ষা-সংক্রান্ত কাজকর্ম চালানো হবে, পড়ুয়াদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন হবে, পরীক্ষা নেওয়া হবে, তার সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও অনেক সমস্যা থেকে যাচ্ছে। বহু সংখ্যক পড়ুয়া এখন বাড়িতে অথবা এমন কোথাও আটকা পড়েছে যেখানে তাদের কাছে তাদের ক্লাস নোট, বইপত্র কিংবা অন্যান্য উপকরণ (ডিজিটালই হোক বা অন্য) নেই যার সাহায্যে তারা লেখাপড়া করতে পারবে, পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হওয়া তো দূরের কথা। যদি বা তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া হয় যে পড়ুয়ার কাছে হাই স্পিড, স্টেব্‌ল ইন্টারনেট কানেক্‌শান রয়েছে, তাও এটা ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই যে সম্ভবত তার জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে দিতে পারে এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে সে প্রস্তুত। অন্য সমস্যার মধ্যে রয়েছে আমাদের প্রায় সমস্ত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানাভাব – যে ঘরগুলিতে ক্লাস হয় এবং পরীক্ষাও হয়, সেখানে যে কী করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা হবে তা এখনো কেউ ভেবে বের করতে পারেননি। যদি তাড়াতাড়ি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খুলেও যায়, ধরা যাক জুনের শেষে (যে হারে সংক্রমণ বাড়ছে তাতে এর সম্ভাবনা ক্ষীণ), তাহলেও পড়ুয়ারা যাতায়াত করবে কী করে? কারণ বাসে ট্রামে যাতায়াত করলে সংক্রমণের ভয় তো সেই থেকেই যাচ্ছে। আর হস্টেলের ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে যে একজনেরও যদি কোভিড-১৯ হয়, তাহলে সেই কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত হস্টেল বন্ধ হয়ে যাবে।

    হয়তো পাশ্চাত্যের মডেল অনুকরণ করার অথবা শুধুমাত্র সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে এগিয়ে থাকা মুষ্টিমেয় ক’জন ব্যবহার করতে পারবে এমন মডেলের অলীক কল্পনাকে পরিহার করে আমাদের গোটা বিষয়টাকে অন্য দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে দেখতে হবে। বাস্তবসম্মতভাবে দেখলে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু করার কথা তিন-চার মাসের আগে ভাবা সম্ভবই নয়। তারপরেও সম্ভবত অল্প সময়ের জন্য কয়েকবার লকডাউন করতে হবে, অন্তত অন্য দেশে এই জাতীয় প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরে সংক্রমণের বৃদ্ধির হার দেখে তাই মনে হয়। তাহলে কি আমরা এই শিক্ষবর্ষকে ‘শূন্য বছর’ হিসেবে ঘোষণা করতে পারি, এবং ২০২০ সালের মে-জুন মাসে যাদের ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল তারা যাতে ২০২১ সালে পরীক্ষা দিতে পারে সেই ব্যবস্থা নিতে পারি? এর উদাহরণ যে নেই তা কিন্তু নয়। নকশাল আন্দোলনের সময়ে পশ্চিমবঙ্গের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা এক বছর বা দু’বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই সময়ে দাঁড়িয়ে এরকম ভাবনা কি সত্যিই কষ্টকল্পিত, বিশেষ করে যখন কেউই জানে না যে কবে আমরা করোনার হাত থেকে মুক্তি পাব, বা আরও বাস্তবসম্মতভাবে দেখলে, তার সঙ্গে ঘর করতে শিখব? অনেকে এর প্রতিবাদ করে বলতে পারেন যে এর ফলে পড়ুয়াদের একটা বছর নষ্ট হবে এবং এদের মধ্যে যারা চাকরির প্রতিশ্রুতি পেয়েছে তারা সেই চাকরিতে যোগ দিতে পারবে না। কিন্তু ভাবী নিয়োগকারীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা সম্ভব, এবং যদি গোটা দেশে ‘শূন্য বছর’ মেনে চলা হয় তাহলে সকলের ক্ষতির—অথবা অন্য দিক থেকে দেখলে লাভের—পরিমাণ হবে সমান। যাই হোক না কেন, সুযোগ এবং সমতার দিক থেকে দেখলে, তাড়াহুড়ো করে শেষ সেমেস্টার পরীক্ষা পরিচালনা করে পড়ুয়াদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বের করে দিলে তা অর্থনৈতিক ভাবে অগ্রসর পড়ুয়াদেরই অনুকূল হবে, তাদের মতই প্রতিভাশালী কিন্তু তাদের থেকে গরীব পড়ুয়াদের জন্য নয় এবং সেদিক থেকে দেখলে শূন্য বছরের ধারণাই বেশি অর্থবহ বলে মনে হয়।

     

    মূল প্রবন্ধ: ২২ শে মে ২০২০ দ্য টেলিগ্রাফ প্রকাশিত স্যমন্তক দাস-এর প্রবন্ধ 'Access Denied: Education and the limitations of Modern Technology'।

    বাংলা অনুবাদ: সর্বজয়া ভট্টাচার্য।

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics