• শ্যাডো প্যানডেমিক: লকডাউন, মেয়েরা ও পারিবারিক নির্যাতন


    1    200

    July 30, 2020

     

    লকডাউন তখন মধ্যগগনে। সব বন্ধ। মানুষ মহামারীর ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। আমাদের (প্রসঙ্গত, আমি একজন সমাজকর্মী) যেসব পাড়ায় কাজ সেখানকার মানুষজন কাজ হারাচ্ছেন, রেশন পাচ্ছেন না, অসুস্থ হচ্ছেন, ইত্যাদি খবর নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন সময় এক সন্ধেতে হঠাৎ সীমার (নাম পরিবর্তিত) ফোন এল। ফিসফিস করে কী যেন বলছে সীমা। কী যে বলছে সীমা , কিছুই ছাই বুঝতে পারছি না। সীমা আমাদের শহরের একজন মহিলা ট্যাক্সি ড্রাইভার। লকডাউনের আগে পর্যন্ত সে সারা শহর দাপিয়ে গাড়ি চালিয়েছে। কলকাতার প্রথম মহিলা ট্যাক্সি ড্রাইভারদের মধ্যে একজন বলে তার নাম-ডাকও খুব। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার সাক্ষাৎকার বেরিয়েছে। এহেন সীমার ফিসফিসানি কেন?

    যেদিন থেকে সীমা পার্মানেন্ট লাইসেন্স পেয়ে গাড়ি চালানোর জন্য আইনী স্বীকৃ্তি লাভ করল, সেদিন থেকেই একটু একটু করে রমেনের রূপ বদলাতে শুরু করল। আর সীমা চাকরি পাবার পর তো রমেন অন্য মানুষ। শুরু হল সন্দেহ, নিত্য অশান্তি, মারধোর। 

    অনেক কষ্টে ওর কথা বুঝতে পারলাম। বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে ওর ট্যাক্সি থাকে। খানিকটা বনবাদাড় পেরিয়ে ওকে ওর গাড়ির গ্যারেজে পৌঁছোতে হয়। সীমা বলল, ও গাড়ির ভেতর বসে কথা বলছে। ঐ সন্ধেরাতে, শুনশান লকডাউনে, গ্রামের রাস্তায় সাপখোপের ভয়কে তুচ্ছ করে ও গাড়িতে এসেছে আমার সঙ্গে দুটো কথা বলে মন হালকা করার জন্য।

    ওর স্বামী রমেন (নাম পরিবর্তিত) তিন সন্তানের মা সীমার ওপর বেশ কিছুদিন ধরে মারধোর চালাচ্ছিল। সীমার স্বামী রমেনকে আমিও চিনি। সীমা যখন গাড়ি চালানোর ট্রেনিং-এ ভর্তি হয়, তখন রমেন দু-চারবার আমাদের অফিসে এসেছে। আপাত-ভদ্রলোক, কীর্তন গায়ক,কপালে চন্দনের তিলক আঁকা রমেন যে কারো গায়ে হাত তুলতে পারে, অভব্য আচরণ করতে পারে, ওর চেহারা দেখে কে বলবে! যতদিন সীমা ট্রেনিং করছিল, রমেন ঠিকঠাকই ছিল। সীমাকে ট্রেনিং-এ বাধা দেওয়া তো দূরের কথা, উৎসাহই দিত। কিন্ত  যেদিন থেকে সীমা পার্মানেন্ট লাইসেন্স পেয়ে গাড়ি চালানোর জন্য আইনী স্বীকৃ্তি লাভ করল, সেদিন থেকেই একটু একটু করে রমেনের রূপ বদলাতে শুরু করল। আর সীমা চাকরি পাবার পর তো রমেন অন্য মানুষ। শুরু হল সন্দেহ, নিত্য অশান্তি, মারধোর। সীমাকে কাজ থেকে বাড়ি ফেরার জন্য বাস, ট্রেন,তারপর বেশ খানিকটা হাঁটাপথ পেরোতে হয় । ট্রেনে বাসে দু-দশ মিনিট দেরী হলেই রমেনের সন্দেহের পারদ চড়তে থাকে। সারাদিনে হাজারবার ফোন করে সীমার গতিবিধির ওপর নজরদারী চলে। ট্যাক্সিতে প্যাসেঞ্জার থাকলে সীমা সাধারণত ফোন ধরতে পারে না। দুবার ফোনে না পেলেই রমেনের খিস্তির মেসেজ আসা শুরু হয়ে যায়। নিশ্চয়ই সীমা নাঙ করেছে, গাড়ি চালানোর নাম করে নাঙের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে। অথচ ওদের সংসার অনটনের। টাকার প্রয়োজন খুব। রমেনের কোনো নিয়মিত রোজগার নেই। কীর্তন গেয়ে আর ক’পয়সা হয়! সীমার রোজগারই সংসারের ভরসা। তবুও নিত্য সন্দেহ, নিত্য বাড়ি ফেরার পর স্বামীর দুর্ব্যবহার ও মার জোটে সীমার কপালে।

    সীমা একা নয়। মেয়েরা যখনই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে সফল হচ্ছেন, রোজগার এবং স্বীকৃ্তি পাচ্ছেন, তখনই তাদের ওপর পারিবারিক নির্যাতন বেড়ে যাচ্ছে। শুধু স্বামীর ঘরেই নয়, বাপ-দাদার ঘরেও মেয়েদের একই দুর্দশা। মেয়েদের অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণের সঙ্গে নির্যাতনের সম্পর্ক নিগূঢ়। আমাদের দেশে মেয়েদের কর্মী বাহিনীতে অংশগ্রহণ যে ক্রমশ কমছে, তার অন্যতম কারণ ঘরে-বাইরে নির্যাতন এবং গতিবিধির নিয়ন্ত্রণ, যা কিনা নির্যাতনেরই এক বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিত। অথচ মেয়েদের রোজগার কিন্তু বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারেই খরচ হয়। বহু তথাকথিত শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েদেরও মাস-মাইনে কড়ায় গন্ডায় তুলে দিতে হয় স্বামীর তথা পরিবারের মাথার হাতে। যদি কোনও মাসে রোজগেরে মেয়ে নিজের রোজগারের টাকায় নিজের জন্য একখানা শাড়ি কিনে ফেলেন, অপরাধবোধে তাকে ডবল দামের কিছু কিনতে হয় পরিবারের লোকজনের, বাচ্চা থাকলে বাচ্চার। মেয়েদের রোজগারের ওপর এই নিয়ন্ত্রণ যাতে অনায়াসে কায়েম থাকে সেজন্য তাদের ছোটবেলা থেকে তোতাপাখির মত শেখানো হয় যে, ‘ভাল মেয়ে’-র নিজের টাকা, নিজের জিনিসপত্র সামলানো উচিত নয়, ওগুলো স্বার্থপরতার লক্ষ্মণ। যে মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে এসে নিজের গয়না নিজে গোছায়, তাকে স্বার্থপর বৌ বলা হয়, ছোট মনের মেয়ে বলে মনে করা হয়। তাই মেয়েরা নিজেদের মূল্যবান জিনিসপত্র, এমনকী নিজের খেটে উপার্জন করা টাকার ওপরও অধিকার কায়েম করতে কুন্ঠিত বোধ করেন। কে আর সাধ করে স্বার্থপর, কুচুটে মেয়ের তকমা কুড়োতে চায়?

    লকডাউন শুরু হতে মেয়েদের ওপর পারিবারিক নির্যাতনের রিপোর্টেড অভিযোগ তিনগুণ বেড়ে গেছে। জাতিসঙ্ঘও পারিবারিক নির্যাতনকে ‘শ্যাডো প্যানডেমিক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। লকডাউনের কারণে নির্যাতনকারীর সঙ্গে ২৪ ঘন্টা এক ছাতের তলায় থাকার জন্য নির্যাতন আরও বেড়েছে।

    কিন্তু যে মেয়ে এই ছককে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিজের রোজগারের ওপর নিজের দাবী প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, সীমার মত প্রথা-ভাঙ্গা পেশায় নিজেকে সফল করতে চায়, মেয়েদের জন্য তথাকথিত ‘সেফ’ দশটা-পাঁচটার কাজ কিম্বা ঘরে বসে সামান্য রোজগারে সন্তুষ্ট না থেকে নিজের উচ্চাশা পূরণ করতে চায় — তার পায়ে সমাজ বেড়ি পড়ায়, তার কপালে জোটে টিটকিরি এবং নির্যাতন।

    এই লকডাউনে সে নির্যাতন আরও বেড়ে গেছে। আমাদের দেশে জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, লকডাউন শুরু হতে মেয়েদের ওপর পারিবারিক নির্যাতনের রিপোর্টেড অভিযোগ তিনগুণ বেড়ে গেছে। জাতিসঙ্ঘও পারিবারিক নির্যাতনকে ‘শ্যাডো প্যানডেমিক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। লকডাউনের কারণে নির্যাতনকারীর সঙ্গে ২৪ ঘন্টা এক ছাতের তলায় থাকার জন্য নির্যাতন আরও বেড়েছে। বাইরে কাজে যেত যে মেয়ে, সে অন্তত কাজের সময়টুকু মুক্তি পেত মারধোর কিম্বা অপমানজনক বাক্যবাণ থেকে। লকডাউন তার সেই মুক্তির উঠোনটুকুও কেড়ে নিয়েছে।

    লকডাউনে সীমার মত শ্রমজীবী মেয়েদের উপার্জন একেবারে বন্ধ। হাতে টাকা থাকলে নির্যাতন রুখে দেওয়ার যে সামান্য ক্ষমতাটুকুও থাকে লকডাউন সে ক্ষমতাটুকুও মেয়েদের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে। শুধু টাকার অভাবই নয়, কাজের সূত্রে বাইরে বেরোনোর ফলে বাইরের জগতের বন্ধু এবং সহকর্মীদের যে সমর্থন মেয়েদের জোটে, লকডাউনের কারণে সেটুকুও বন্ধ। ফোনে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা যায় হয়তো, কিন্তু যখন কাল কী খাব তার ঠিক নেই, তখন ফোন রিচার্জ করানোর টাকাই বা কোথায়? তাছাড়া অনেক পরিবারেই লকডাউনের সময় খরচ বাঁচানোর জন্য একটি পারিবারিক মোবাইল ফোন সবাই মিলে ব্যাবহার করছেন। সেক্ষেত্রে নির্যাতিতার দুঃখ অথবা সমস্যা আলোচনা করার জন্য ফোন পাওয়া দুষ্কর। আর যদিবা ফোন পাওয়াও যায়, ফোনে নিজের কথা বলবে কোথা থেকে মেয়েরা? গরীবের ঘরে আলাদা করে গোপন কথা বলার জায়গা নেই, আর মধ্যবিত্তের ঘরে  জায়গা থাকলেও মেয়েদের  প্রাইভেসির ধারণাটি আজও অনেক বাড়িতেই স্বীকৃ্ত নয়। তাই সীমাকে ভর সন্ধেবেলা সাপখোপের ভয় তুচ্ছ করে গাড়িতে বসে আমাকে ফোন করতে হয়।

    পারিবারিক নির্যাতনের শিকার যে মেয়ে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বাবা-মার কাছে চলে এসেছেন, তার রেশন কার্ড রয়ে গেছে শ্বশুরবাড়িতে এবং শ্বশুরবাড়ি এই সুযোগে মেয়েটিকে আরও অত্যাচারের পথ হিসেবে রেশন কার্ড আটকে রেখেছেন, বৌয়ের খাবার যাতে না জোটে।

    প্রশ্ন উঠতে পারে, এর সমাধান কী? তাহলে কি লকডাউনের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল? অবশ্যই না। লকডাউন না করলে কোভিড বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। লকডাউন রোগ প্রতিরোধে জরুরী। কিন্তু লকডাউনে সাধারণ মানুষের, মেয়েদের  কি হবে, সে কথা ভাবাও অতি জরুরী ছিল। যখন এক রাত্তিরের নোটিশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী লকডাউনের ঘোষণা করেন তখন নিশ্চয়ই ভাবা উচিত ছিল শ্রমজীবী মেয়েরা খাবেন কী? তাদের ঘরে ঘরে পর্যাপ্ত এবং পুষ্টিকর খাবার পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের রেশনের ঘোষণা করে দিলেই কাজ শেষ হয়ে যায় না, রেশন সকলের কাছে পৌঁছচ্ছে কিনা সেটা দেখাও সরকারের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার যে মেয়ে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বাবা-মার কাছে চলে এসেছেন, তার রেশন কার্ড রয়ে গেছে শ্বশুরবাড়িতে এবং শ্বশুরবাড়ি এই সুযোগে মেয়েটিকে আরও অত্যাচারের পথ হিসেবে রেশন কার্ড আটকে রেখেছেন, বৌয়ের খাবার যাতে না জোটে। এমনকী যে নির্যাতনের শিকার মেয়ে স্বামীর ঘরেও আছেন, তাকেও স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজন রেশন কার্ড না দিয়ে খাবার থেকে বঞ্চিত করেছে, এমন ঘটনারও অভাব নেই। এই সমস্ত মেয়েদের খাদ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করা সরকারের কাজ। থালা বাজানো কিম্বা ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের পরিকল্পনা না করে লকডাউনে নির্যাতিতা মেয়েদের সত্যিকারের সাহায্য কী ভাবে  করা যায় সেকথা ভাবার দায়িত্ব সরকারের। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মত এই মেয়েদের জন্য আলাদা থাকার ব্যবস্থা করা যায় কি না, প্রয়োজনীয় সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করা যায় কি না, আইনী সুবিধা এলাকায় এলাকায় পৌঁছানো যায় কী ভাবে, সেসব চিন্তা এবং পরিকল্পনার দায় রাষ্ট্রেরই নেওয়া দরকার। কল্যাণকামী রাষ্ট্রে যে কোনও জাতীয় বিপর্যয়ে মেয়েদের , বিশেষত বেকার, নির্যাতিতা মেয়ের সুরক্ষার দায় রাষ্ট্রের আবশ্যিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। যে কাজে আমাদের দুই সরকারেরই অবহেলা চোখে পড়ার মত।

     
     



    Tags
     



    1 Comment
    • চুমকিদি, এরকম একটা লেখা যে তোমার কলম থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে, সামাজিক প্রেক্ষিত তৈরি হয়ে সেকেন্ড বেল পড়ে গেছিল , সেটা মনেই হচ্ছিল। মনটা অগোছালো ভাবে দুঃখিত, ক্রুদ্ধ, রক্তাক্ত, হচ্ছিল। তোমার স্পষ্ট কার্যকারণ ব্যাখ্যায় একটু শান্ত হল। এখন রাষ্ট্রের দিকে তাকাতেই হচ্ছে। human resource এর শর্তেও তো তার নজর দেবার কথা এদিকে। ‘অনদেখা’ তো সে করতে পারেনা ‘কতই’।

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics