• অনলাইন শিক্ষায় এত সমস্যা কেন?


    0    287

    July 2, 2020

     

    বিশ্বজুড়ে করোনার প্রেক্ষিতে নানা রচনার অনুবাদ নিয়ে আমাদের অনুবাদ সিরিজের সপ্তম কিস্তি ৬ই জুন ২০২০ ইকোনমিক এন্ড পলিটিকাল উইকলি (EPW, Vol LV, No 23) প্রকাশিত সৌম্যজিৎ ভট্টাচার্য-র-এর প্রবন্ধ 'What Is So Wrong with Online Teaching?'। এখানে প্রকাশিত বাংলা অনুবাদটি করেছেন সর্বজয়া ভট্টাচার্য।

    কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং বহু উৎসাহী শিক্ষক হঠাৎ জুম-এর অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠলেন—মনে হল যেন এই অসাধারণ স্থিতাবস্থার একটা সমাধান শেষ অব্দি পাওয়া গেছে।

    কোভিড-১৯ অতিমারীর ফলে ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেদিন থেকে ক্লাস বন্ধ হয়েছে, সেদিন থেকেই ‘জুম’ জাতীয় প্ল্যাটফর্মে অনলাইন ক্লাস নেওয়ার বিষয়টা চর্চার কেন্দ্রে চলে এসেছে। প্রথম দিকে আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে নির্দেশিকা পেয়েছিলাম তার ভাষায় ছিল ধোঁয়াশা এবং সতর্কতা। বলা হয়েছিল, ই-রিসোর্সের যোগান দেওয়া এবং ক্লাসের সময় অনুযায়ী অনলাইন থাকা বাঞ্ছনীয়। ক্রমশ এই বয়ান পাল্টাতে আরম্ভ করল – স্পষ্ট কোনও নির্দেশ না এলেও বুঝিয়ে দেওয়া হল যে এবার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অনলাইন ক্লাস নিতে হবে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং বহু উৎসাহী শিক্ষক হঠাৎ জুম-এর অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠলেন—মনে হল যেন এই অসাধারণ স্থিতাবস্থার একটা সমাধান শেষ অব্দি পাওয়া গেছে। ভারত সরকার জুম নিয়ে যে সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন তা এই অত্যাশ্চর্য প্রযুক্তির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারত বটে, কিন্তু বাস্তবে তা হল না – সরকারের ক্ষেত্রেও না, উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রেও না। সতর্কবার্তার ফলস্বরূপ এক প্ল্যাটফর্মের বদলে অন্য প্ল্যাটফর্মের কথা ভাবা হল মাত্র, যেন অন্য কোথাও ডেটা চুরি যাওয়ার ভয় থাকতেই পারে না!

    মাধ্যম এবং অ্যাকসেস

    কিন্তু ডেটা বা তথ্য চুরি যাওয়ার ভয়টা আসল বিষয় নয়। প্রধান সমস্যা হল অনলাইনে পড়ানোর মাধ্যম এবং সেটার অ্যাকসেস পাওয়া। প্রথমে অ্যাকসেস নিয়ে ভাবা যাক। অ্যাকসেস-এর অর্থ শুধু ইন্টারনেট থাকা নয়। যে ধরনের মোবাইল ফোন বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী ব্যবহার করে, তা ক্লাস করার জন্য খুব সুবিধেজনক মাধ্যম নয়—এই ক্ষেত্রে ল্যাপটপ থাকলে সুবিধে বেশি। ফোনের ছোট স্ক্রিনের দিকে টানা এক-দু’ঘন্টা তাকিয়ে থেকে মনোযোগ দিয়ে লেকচার শোনা খুবই দুষ্কর। হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় কোভিড-১৯ বিপর্যয়ের ঠিক পর পর একটি সার্ভে করে, যাতে দেখা যায় যে কেবলমাত্র ৫০% পড়ুয়াদের ল্যাপটপ ব্যবহার করার সুবিধে রয়েছে, খুব বেশি হলে ৪৫% মোটামুটি ভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছে এবং সর্বোপরি ১৮%-এর কাছে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগই নেই (UoH Herald 2020)। একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তব চেহারা হল এই।

    একটা ক্লাসরুমের আবহকে অনুকরণ করতে পড়ুয়ার কাছে শুধু একটা যন্ত্র আর ইন্টারনেট কানেকশন থাকলেই যথেষ্ট হয় না, তাদের চারপাশের পরিসরটাও গুরুত্বপূর্ণ।

    গ্রাম এবং মফস্বলে, যেখানে আমাদের বহু ছাত্রছাত্রী লকডাউনের মধ্যে রয়েছে, সে সব অঞ্চলে তো বটেই, ইন্টারনেটের স্পিড এবং তার ওঠানামা নিয়ে বড় শহরগুলিতেও অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছে। লকডাউনে বাড়ির মধ্যে এমন অনেক জায়গাই রয়েছে যেখানে সিগনাল ততটা জোরালো নয়। এছাড়া অনেক পড়ুয়ার কাছেই আনলিমিটেড ওয়াই-ফাই নেই, এবং ডেটা প্যাক সীমিত। একদিনে অনেকগুলো ক্লাস করতে যে পরিমাণ ডেটা প্রয়োজন তা অনেক পড়ুয়ার সাধ্যের বাইরে। আমরা জানি স্বাভাবিক সময়েও বহু পড়ুয়া বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তার ধারে গিয়ে ইন্টারনেট বা ফ্রি ওয়াই-ফাই পাওয়ার চেষ্টা করে—কিন্তু এমন বিড়ম্বনার সম্ভাবনার পথও বন্ধ হয়ে গেছে এই লকডাউন পরিস্থিতিতে। 

    অতএব আগ্রহ থাকলেও, প্রয়োজনীয় কাঠামোর অভাবে, অনেক ছাত্রছাত্রী অনলাইন পড়াশোনায় অংশ নিতে অসক্ষম। বৃহত্তর পরিসরে সক্ষমতার এই প্রাসঙ্গিক বিষয়টি হয়ত কম আলোচিত। একটা ক্লাসরুমের আবহকে অনুকরণ করতে পড়ুয়ার কাছে শুধু একটা যন্ত্র আর ইন্টারনেট কানেকশন থাকলেই যথেষ্ট হয় না, তাদের চারপাশের পরিসরটাও গুরুত্বপূর্ণ। অন্ততপক্ষে যা প্রয়োজন তা হল একটা শান্ত, নিরিবিলি জায়গা যেখানে অন্যদের উপস্থিতি কোনও বিঘ্ন ঘটাবে না। আমরা নিশ্চিত জানি যে এমনকী আমাদের দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রছাত্রীদের বাড়িতেও এই পরিবেশ নেই।  তারা অনেকেই হয়তো একটা ছোট বাড়িতে থাকে যেখানে এই ধরণের নির্জন পরিসর পাওয়া বাস্তবে অসম্ভব। বিষয়টা শুধু তাদের ব্যক্তিগত পরিসর নয়, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ব্যক্তিগত পরিসরও বটে। এছাড়া, বাড়িতে যদি দুজন পড়ুয়া থাকে, তাহলে একই সঙ্গে দুজনের জন্য এরকম জায়গা তৈরি করতে হতে পারে। শহুরে মধ্যবিত্ত ফ্ল্যাটবাড়িতেও এই কাজ কঠিন হতে পারে, অর্থনৈতিক ভাবে কম স্বচ্ছল পরিবারের কথা তো বাদই দিলাম। কোনো ছোট বাড়িতে কয়েক ঘন্টার অনলাইন ক্লাসের অর্থ এই দাঁড়াতে পারে যে বাড়ির বাকি সবাই ক্লাসের সময় অনুযায়ী তাদের কাজের রুটিন তৈরি করল এবং সেই সময়টুকু যথাসম্ভব নীরবতা বজায় রাখার চেষ্টা করল।

    এতে বিশেষ করে অবিচার হয় বাড়ির মেয়েদের ওপর – ছাত্রী কিংবা অন্য কোনও মহিলা সদস্য। বাড়ির কাজের অসম বন্টনের কারণে বেশির ভাগ দায়িত্ব এসে পড়ে মেয়েদেরই কাঁধে এবং অনেক সময় এই লকডাউনের মধ্যে ছাত্রীদের বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে হয়। কাজেই নির্ধারিত সময়ে অনলাইন ক্লাসে সে যোগ দিতে না-ই পারতে পারে কারণ তখন সে এমন কোনো বাড়ির কাজে ব্যস্ত যা অন্য সময়ে করাই যাবে না। অন্য পরিস্থিতিতে, বাড়িতে স্থান সংকুলানের মধ্যে জোর করে তৈরী করা একটি নিজস্ব নিরিবিলি জায়গার অর্থ হতে পারে যে ছাত্র বা ছাত্রীর মা-কে তাঁর নিজের কাজের সময়ের এবং গৃহকর্মের রুটিনের নিঃশব্দ রদবদল ঘটাতে হবে।

    আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রের প্রশাসক এবং অনেক উদ্যমী অধ্যাপক নিঃসন্দেহে যাঁদের অভিপ্রায় সৎ – তাঁরাও যে বাড়ির অবস্থার কথা ধর্তব্যের মধ্যেই আনছেন না, তা আমাদের লিঙ্গ-ভিত্তিক ব্যবহারের একটি গভীরতর চিহ্ন। ঘরের পরিসর সবসময়ে গৌণ—তা একান্ত আশ্রয় হতে পারে, রূপক অর্থে আবার বাস্তবেও (হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার চেষ্টা যার উদাহরণ)—কিন্তু প্রাধান্য দিতে হবে উৎপাদনের পরিসরকেই, কাজ এবং উৎপাদনশীলতাকে। যখন এই কাজের পরিসর কোনোভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন সেই “অবশিষ্ট” ঘরোয়া পরিসরই তার অনুকরণে উৎপাদনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে । মেয়েলি গৃহকর্মের জগতকে সবসময় তথাকথিত ‘নৈর্ব্যক্তিক’ পুরুষালি কাজের ‘উৎপাদনক্ষম’ জগতের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। কাজের জগত কখনো গৃহের পরিসরের জন্য নিজেকে পাল্টাবে না; এইরকম উল্টোভাবনা তো প্রায় পাপই বটে—সে আপনি যত অসুবিধের মধ্যেই থাকুন না কেন।

    এপ্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় হল আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি এই লকডাউন আর সামাজিক দূরত্ব আসলে রয়েছে কেন। এটি একটি অভূতপূর্ব অতিমারী। অনেকের ক্ষেত্রেই এরকম সময় মানসিক চাপ এবং উৎকন্ঠা বেড়ে যেতে পারে; বাড়িতে থাকা মানেই ছুটি কাটানো নয়। বাড়িতে কারো সংক্রমণ হয়ে থাকতে পারে; আপনি নিজে কোয়ারান্টাইনে থাকতে পারেন। এছাড়াও পরিবারের কোনও সদস্য যদি অন্য কোনও রোগে আক্রান্ত হন বা অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে তাঁরা আরও চাপের মধ্যে থাকবেন; সাধারণ ভাবে আপৎকালীন অবস্থায় আগে যত সহজে ডাক্তারের কাছে বা হাসপাতালে যাওয়া যেত, এখন আর তা নয়। যদি আশা করা হয় যে এই পরিস্থিতিতে পড়ুয়ারা সবাই নির্বিঘ্নে অনলাইন ক্লাসে যোগ দিতে পারবে তাহলে যে অবস্থা এই প্রেক্ষাপটকে তৈরি করেছে তাকেই অস্বীকার করা হবে।

    গুণগত ফারাক

    আমাকে অনেক শুভানুধ্যায়ী বলেছেন যে আমি এই নিয়ে একটু বেশীই চিন্তা করছি। যুক্তিটা হল – অন্যান্য সময়েও কি পড়ুয়ারা ক্লাস মিস্‌ বা বাঙ্ক করে না, সব সময় কি ক্লাসে সবাই উপস্থিত থাকে? আসলে কিন্তু এই দুটো পরিস্থিতির মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে এবং এই ফারাকটি গুণগত। প্রথমত, স্বাভাবিক অবস্থায় ক্লাসে না আসাটা একজন পড়ুয়ার নিজস্ব সিদ্ধান্ত; দ্বিতীয়ত, অ্যাকসেস না থাকার ফলে অনলাইন ক্লাসে যোগ না দিতে পারাটা তার ‘চয়েস’ নয়। যে হয়তো একেবারেই অনুপস্থিত থাকতে চায় না, সে বাধ্যত উপস্থিত থাকতে পারছে না।

    একজন ছাত্র বা ছাত্রীর বেছে নেওয়া এবং তার অধিকারের দিকটার বাইরেও আরেকটি গুণগত দিক আছে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরে এই সুযোগ রয়েছে যে পড়ুয়ারা তাদের বিভিন্ন পারিবারিক প্রেক্ষিত থেকে এসে ক্লাসরুমের সমসত্ত্ব পরিসরে একত্রিত হতে পারে।

    ক্লাসরুমের পরিসরের অন্তর্নিহিত অসাম্যের কথা মাথায় রেখে এবং তাকে রোমান্টিসাইজ না করেও বলা যেতে পারে যে ক্লাসরুমে পড়ুয়ারা তাদের বাড়ির বিশেষ বাধা-বিঘ্নকে কাটিয়ে এখানে একধরণের আনুষ্ঠানিক সাম্যের জায়গায় আসতে পারে। অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া পড়ুয়ারা, যারা বাড়িতে নিজেদের একটি নির্জন জায়গা পায় না, তাদের ক্ষেত্রে এই পরিবেশের পার্থক্যটা অবশ্যই অনেক বেশি এবং এরাই কিন্তু বিশেষ করে অনলাইন ক্লাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কাজেই তারা দু’দিক থেকেই ধাক্কা খাচ্ছে। যেসমস্ত পড়ুয়াকে লেখাপড়ার জন্য (লাইব্রেরিতে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটানো) বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বেশি নির্ভর করতে হয়, তাদের ক্ষেত্রে অনলাইন লেখাপড়ার সুযোগ না থাকলে দুদিক থেকেই তারা বঞ্চিত হবে। অনলাইন লেখাপড়ার মধ্যে যে গভীর অসাম্য রয়েছে তা যে অধ্যাপক এবং প্রশাসকরা স্বীকার করতে চাইছেন না তা আশ্চর্য তো বটেই কিন্তু একই সঙ্গে হয়তো তা শিক্ষাক্ষেত্রে শ্রেণি এবং জাতপাতের প্রশ্নে আমাদের গভীর পক্ষপাতেরই পরিচায়ক।

    লেখাপড়ার পরিসর হওয়ার জন্য ভার্চুয়াল স্পেস কি স্বয়ংসম্পূর্ণ?

    এবার ফেরা যাক অনলাইন পড়ানোর পদ্ধতির প্রসঙ্গে। তা কি কখনো ক্লাসরুমে উপস্থিত থেকে পড়ানোর পদ্ধতির বিকল্প হতে পারে বা তাকে ছাপিয়ে যেতে পারে? এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে যদিও অনেকেই মনে করছেন যে অনলাইন পড়াশোনা একটি সাময়িক প্রক্রিয়া এবং এই জাতীয় আশঙ্কা নেহাতই অমূলক। এর কারণ হল, বিগত বেশ কিছু বছর ধরে যাঁরা ভারতবর্ষে শিক্ষা নিয়ে পরিকল্পনা করেন, তাঁরা কিন্তু অনলাইনে পড়ানোকে এই দেশে উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যত বলে জাহির করেছেন। মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক, ইউজিসি, এবং নীতি আয়োগের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা বিভিন্ন জায়গায় অনলাইনে পড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছেন এবং তার সংস্থানের কথাও বলেছেন (বিজনেস ওয়ার্ল্ড ২০২০)। ভারতে উচ্চশিক্ষায় মোট ভর্তির অনুপাত বাড়ানোর জন্যেও বারবার অনলাইন পড়াশোনার কথা বলা হয়েছে (মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক ২০১৯)। এই অতিমারী, অন্যান্য ক্ষেত্রের মত শিক্ষাক্ষেত্রেও এমন সব নীতি প্রণয়ন করার সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে যা স্বাভাবিক সময়ে করা কঠিন হয় (ইউজিসি ২০২০)। ইউজিসি’র চেয়ারম্যান সম্প্রতি অনলাইন শিক্ষার সমর্থনে বলেছেন, “এই কোভিড-১৯-এর সময়ে এবং পরবর্তী ক্ষেত্রেও আমরা একটা পরিস্থিতি দেখছি যেখানে অনলাইন শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। দেশের মোট ভর্তির অনুপাত বাড়ানোর জন্য এটা প্রয়োজনীয়” (নিউজ১৮ ইন্ডিয়া ২০২০)।

    এইভাবে প্রণয়ন করা হলে, ভবিষ্যতে অনলাইন শিক্ষা ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় পরিকাঠামোর একটি স্থায়ী অংশ হয়ে উঠতে পারে। সর্বতোভাবে অ্যাকসেস এবং বিশেষত এই অভূতপূর্ব সংকটকালে উপযোগিতা বাদ দিয়েও অনলাইন শিক্ষার কার্যকারিতা নিয়ে আলাদা আলোচনা হওয়া উচিত।

    লেখাপড়ার পরিসর হওয়ার জন্য ভার্চুয়াল স্পেস কি স্বয়ংসম্পূর্ণ? নিঃসন্দেহে এমন অনেক অনলাইন কোর্স রয়েছে যেগুলি কৌতুহলোদ্দীপক এবং উপকারী। পড়ুয়া এবং সাধারণ মানুষ এগুলি অ্যাকসেস করতে পারেন এবং এগুলি থেকে শিক্ষা লাভ করতে পারেন। কিন্তু এই ধরণের অনলাইন কোর্সের সঙ্গে যদি ফিজিকাল স্পেসে পড়ানোকে এক ভাবা হয় তাহলে তা শিক্ষা নিয়ে যেকোনো অর্থপূর্ণ আলোচনার পক্ষে—বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ভারতের বঞ্চিত মানুষের কাছে যে বিপুল পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে আসে—সেই প্রেক্ষিতে ক্ষতিকারক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিকাল স্পেস এবং বিশেষ করে তার ক্লাসরুম শুধুমাত্র জ্ঞান আদান-প্রদানের জায়গা নয় যা সহজেই অন্যান্য আদান-প্রদানের মাধ্যম ব্যবহার করে অনুকরণ করা যেতে পারে।

    আমাদের শিক্ষা ‘বিশারদ’দের মধ্যে অনেকেই এরকম একটা মত পোষণ করেন বলে মনে হয়। কিছু অসুবিধে আছে যা খালি চোখেই দেখা যায় – যেমন ল্যাবরেটরি-ভিত্তিক লেখাপড়া। এখন ভার্চুয়াল ল্যাবের সম্ভাবনার কথা আমরা শুনতে পাচ্ছি। এগুলো অলীক কল্পনা যার কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই, এবং যাঁরা এই ভার্চুয়াল ল্যাবের কথা বলছেন তাঁরা অনেকে জানেনই না আসলে ল্যাবরটরিতে কী হয়। রসায়নের এক্সপেরিমেন্টও  কি ভার্চুয়াল হবে? কোনও কেমিক্যালে হাত না দিয়েই হবে গবেষণা? এ তো গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলে কোনোদিন হাত না দিয়ে স্টিমিউলেটারে গাড়ি চালানো শেখার মত! তবে এসব পরিকাঠামোগত দিক বাদ দিলেও আরও মৌলিক একটি প্রশ্ন থেকে যায় – অনেকের জন্যই ক্লাসরুম হল আমূল পরিবর্তনের একটি পরিসর। ক্লাসরুম এক বিকল্প সামাজিকতা তৈরির ক্ষমতা রাখে; অনেক ক্ষেত্রে এটি দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের আঁতুড়ঘর; সমাজপ্রদত্ত চেতনার বন্ধন উত্তরণের পরিসর হয়ে উঠতে পারে ক্লাসরুম—বিশেষ করে যদি শিক্ষক সচেতনভাবে সেই দিকে পড়ুয়াদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে যত্নশীল হন। এ সেই পরিসর যা সযত্নলালনে হয়ে উঠতে পারে এমন জায়গা যা মানুষকে নিজের মতপ্রকাশ ও প্রশ্ন করার শিক্ষা দেয়।

    যারা পিছিয়ে আছে, লাভ শুধু তাদের ক্ষেত্রেই নয়। যারা সমাজের উচ্চতর শ্রেণি থেকে এসেছে তারাও সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে আসা তাদের সহপাঠীদের মধ্যে দিয়ে একটি বৃহত্তর সমাজকে চিনতে শেখে। সুতরাং ক্লাসরুম শুধু লেখাপড়া শেখায় না—ভাগ করে নিতে শেখায়, প্রশ্ন করতে শেখায়, হাসতে শেখায়, ব্যক্তিমানুষের মধ্যে গভীর আন্তঃসম্পর্ক গড়ে তুলতে শেখায়। এই সমস্ত কিছুই অনলাইন পড়ানোর ভার্চুয়াল স্পেসে ভীষণ ভাবে অনুপস্থিত। যদি বা একই হাসিঠাট্টা সেখানেও অনুকৃত হয়  এবং প্রশ্ন-উত্তরের পরিসরও রাখা হয়, তা সত্ত্বেও সেখানে সম্পর্কগুলি ক্ষণস্থায়ী, ফিজিকাল স্পেসের মত মজবুত আর টেঁকসই নয়। 

    অতএব উপরের সবকটা যুক্তিসূত্রগুলো এক জায়গায় আনলে দেখা যাবে অনলাইন শিক্ষাকে নিয়মিত লেখাপড়ার উপযুক্ত পরিসর ভেবে নেওয়ার গলদটা কোথায়। অতিমারীর প্রেক্ষিতেও শিক্ষার বিকল্প পথ হিসেবে অনলাইন লেখাপড়াকে বেছে নেওয়াটা সমাধান নয়, বরং আরো বেশি সমস্যাজনক।

    তথ্যসূত্র

    বিজনেস ওয়ার্লড (২০২০): “We in the Government Are a Facilitator of Online Learning in India: NITI Aayog CEO,” 10 September, http://bweducation.businessworld.in/article/We-In-The-Govern-ment-Are-A-Facilitator-Of-Online-Learning-In-India-NITI-Aayog-CEO-/10-09-2019-175873/.

    মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক (২০১৯): “Draft National Education Policy 2019,” https://mhrd.gov.in/sites/upload_fi les/mhrd/fi les/Draft_NEP_2019_EN_Revised.pdf.

    নিউজ১৮ ইন্ডিয়া (২০২০): “Online Education a Contingency Measure during Covid-19 Lockdown and Not Long-term Strategy, Say Experts,” 17 April, https://www.news18.com/news/india/online-education-a-contingency-measure-during-cov-id-19-lockdown-and-not-long-term-strategy-say-experts 2581297.html.

    নিউজ১৮ ইন্ডিয়া (২০২০) ইউজিসি (২০২০): “Let Covid Not Stop You from Learning,” University Grants Commission, https://www.ugc.ac.in/pdfnews/1573010_On-Line-Learning---ICT-initiatives-of-MHRD-and-UGC.pdf.

    হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় হেরাল্ড (২০২০): “Proposal for Online Classes Elicits Mixed Responses from UoH Students: Survey,” http://herald.uohyd.ac.in/proposal-for-online-classes-elicits-mixed-responses-from-uoh-students-survey.

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics