• লকডাউনে মেয়েরা: পরিযায়ী শ্রমিক রিম্পা


    0    378

    July 21, 2020

     

    রিম্পা নবম পাশ। মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়া থেকে কাজের জন্য পাড়ি দিয়েছিল লুধিয়ানা। গ্রামের এক আত্মীয়ের মাধ্যমে কাজের সন্ধান। নাট-বোল্টু তৈরি করার কারখানায় প্রসেসিং-এর হেল্পার আর তৈরি হওয়া নাট-বোল্টু প্যাকেটস্থ করার কাজ। দিনে দুশো টাকা। কাজ শিখে নিতে বেশ কিছু সময় লেগেছিল তার। কিন্তু বুঝে নেওয়ার পর অভ্যস্ত হয়ে গেছিল। প্রথমত মেশিনে তোলার কাজে সামান্য অসুবিধা ছিল। তারপর রিম্পা তা আয়ত্ত করে নেয়। শিখে নেয় প্যাকেটিং এর কাজও। প্যাকেট ও তার মধ্যে ঢোকানোর জন্য দেওয়া নাট-বোল্টুর হিসেব খাতায় লিখে রেখে শেষ হত দিনের কাজ।

    "

    বেঁধে দেওয়া সামাজিক নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করে

    আগামী প্রজন্মের জন্য। 

    "

    রিম্পা বাল্যবিবাহের শিকার। নাইনে পড়ার সময় পাশের গ্রাম থেকে তার বিয়ের সম্বন্ধ আসে। পরিবারের আর্থিক সংস্থান না থাকায় রিম্পার পড়াও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছিল। মাঠে খাটা দাদারাও রাজি হয়ে যায় রিম্পার বিয়েতে। ফাইনাল পরীক্ষাটা আর দেওয়া হয় না। তারপরেই পর পর দুটি বাচ্চা। স্বামীর কোনও স্থায়ী কাজ নেই। তাই রিম্পা গ্রাম ছেড়ে বাইরে যাওয়ার সাহস করেছিল। ধীরে ধীরে ঘর হয়। নিজের সংসার গুছিয়ে তোলে রিম্পা। আসলে রিম্পার মত সচেতন ও পরিশ্রমী মেয়েদের পরিবার পড়াতে পারে না। অসময়ে বিয়ে হয়ে যায়। তবু বাচ্চার দায়িত্ব পেরিয়ে, পরিবারের বোঝা মাথায় নিয়ে হাসিমুখে এগিয়ে চলে তারা। পরিবারের অবস্থার কথা ভেবে আর্থিক সংস্থানের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। বেঁধে দেওয়া সামাজিক নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করে আগামী প্রজন্মের জন্য। এই সচেতনতা রিম্পার এসেছিল হাইস্কুলের মুখ দেখার জন্য। নিজের পড়াশুনা ছেড়ে দেওয়ার যন্ত্রণা তার মধ্যে আরও বেশি করে ছেলে-মেয়েদের স্কুলমুখী করার ভাবনা এনে দেয়। বাচ্চাদের ভালো রাখার তাগিদেই তাদের ফেলে রেখে সে পাড়ি দেয় অন্য রাজ্যে।  কারখানার কাজের পরিবেশ নিয়েও খুশি ছিল রিম্পা। মেয়েদের আলাদা ঘরে বসার ব্যবস্থা। বাথরুমও আলাদা। পাশেই ঘর ভাড়া নিয়ে থাকত রিম্পারা প্রায় ৩৪ জন মহিলা। সঙ্গে অনেকের স্বামী ও বাচ্চাও ছিল। ঘর ভাড়া দুহাজার থেকে পঁচিশশো টাকা। সকালে রান্না করে টিফিন নিয়ে বেরিয়ে যেত রিম্পা। তারপর ফিরে এসে আবার রান্না করা। কাজের মধ্যে ক্লান্তি নেই রিম্পার। বাড়িতে মায়ের কাছে ফেলে আসা দুই বাচ্চার দিকে চেয়ে অকাতর পরিশ্রমে চলছিল কাজ। ঈদে ওদের ভালো জামা-কাপড়ের জন্য টাকা জমাচ্ছিল রিম্পা।কিন্তু লকডাউন সব পরিকল্পনা লন্ডভন্ড করে দিল। নির্মমভাবে পরিহাস নেমে এল রিম্পাদের জীবনে। মার্চ মাসের বাইশ দিনের টাকা মিটিয়ে দিয়েছিল কারখানা থেকে। প্রাথমিকভাবে তাদের খাবারের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল কারখানার মালিক। সেখানেই গৃহবন্দি ছিল তারা। তারপর একবেলা করে খাবার জুটতে থাকে। তারপর সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। বিস্কুট ও জল খেয়ে কাটাতে হয় দিন কয়েক। প্রায় দুইমাস ঘর ভাড়া ও খাবার কিনে জমানো টাকা শেষ হয়ে যায়।

    "

    একটি মেয়ে ও একজন মা হয়েও

    পুরুষদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে কারখানায়

    — এইটি তার দুর্নামই বাড়িয়েছে।

    "

    লকডাউনের প্রথম পর্যায়েই আমার কাছে ফোনটা এসেছিল — রিম্পার দাবি, ঘরে ফেরার উপায় জানাতে হবে। কাছে পয়সা নেই। খাবারও নেই। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে একজায়গায় থাকা। হঠাৎ লকডাউন হয়ে যাওয়ায় আলাদা জায়গার বন্দোবস্ত করতে পারেনি রিম্পারা। ওর আকুতি  ছিল, ‘বাচ্চারা বাড়িতে কাঁদছে। আমাদের মেয়েদের বাড়ি নিয়ে চলুন’। বিডিও-র সঙ্গে যোগাযোগ করে ওদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করি। ওদের যোগাযোগের নাম্বারও দিই। কিন্তু সরকারিভাবে মহিলা শ্রমিকদের জন্য আলাদা করে ফেরানোর কোনও ব্যবস্থা ছিল না। তারপর ফেরার ব্যবস্থা হলেও গাড়ি ভাড়া জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। গ্রুপ লিডার মাথা পিছু তিন হাজার টাকা করে চায়। বাড়িতে গরু বন্ধক রেখে টাকার ব্যবস্থা করে রিম্পার পরিবার। কিন্তু সে টাকা পাঠানো ছিল খুব মুশকিল। তাই রিম্পা গ্রামে ফিরে টাকা মিটিয়ে দেওয়ার শর্তে গাড়িতে ওঠার সুযোগ পায়। প্রায় দেড়মাস লড়াই-এর পর গ্রামে ফেরে রিম্পারা।ফিরে এসে চৌদ্দ দিনের কোয়ারান্টাইন থাকতে হয়। তারপরেই দেখা করতে পারে বাচ্চাদের সঙ্গে। কিন্তু কোয়ারান্টাইন শেষ হতেই চিন্তায় পড়েছে রিম্পা। ঈদের খুশি তার নেই এবার। বাচ্চাদেরও নতুন জামা পরানো হয়নি। অবস্থা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ফেরার পথও নেই। এদিকে লুধিয়ানায় ঘরবন্দী চৌকি ও অন্যান্য জিনিসপত্র। বাড়ী ভাড়াও গুনতে হবে। আবার ফিরে না গেলে গ্রামে কোনও কাজ নেই।অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে গ্রামে এতকাল কপালে জুটেছে পদে পদে খোঁটা। মেশিনের সঙ্গে যুক্ত থাকার এই কাজের জন্য তাকে ‘মর্দা’ বলে বিদ্রূপ করা হয়েছে। কেননা তার কাজ ‘পুরুষদের কাজ’ বলেই পরিচিত। একটি মেয়ে ও একজন মা হয়েও পুরুষদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে কারখানায় — এইটি তার দুর্নামই বাড়িয়েছে। রিম্পার আত্মনির্ভরতা তাকে সুখ দিলেও শান্তি এনে দেয়নি।

    "

    একে বাইরে যাওয়ার সাহস,

    তার ওপর অন্যরকম কাজে জুড়ে যাওয়ার স্পর্ধা

    এদের ‘ডেঞ্জারাস’ ও ‘বাহির ঘুরা মেয়ে’ বলে চিহ্নিত করেছে।

    "

    গ্রামের একাধিক অভিবাসী মহিলা শ্রমিকের একই অবস্থা । প্রথমত এদের শ্রমিক  বলেই স্বীকার করা হয়না। এরা সকলেই কারও মা বা স্ত্রী এই পরিচয়ে ফিরে এসেছে। আর রিম্পারা ‘মর্দা’ হয়ে। একে বাইরে যাওয়ার সাহস, তার ওপর অন্যরকম কাজে জুড়ে যাওয়ার স্পর্ধা এদের ‘ডেঞ্জারাস’ ও ‘বাহির ঘুরা মেয়ে’ বলে চিহ্নিত করেছে। একদিকে ইনফরম্যাল সেক্টরে এদের কাজ বলে যেমন মহিলা শ্রমিকের পারিশ্রমিক ও নির্দিষ্ট শ্রম আইনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেছে, অন্যদিকে তেমনই এদের ব্রাত্য করেছে প্রতিবেশী ও পরিবারের আপনজনেরা। তার ওপর এখন বাতাসে রোগ বয়ে এনেছে তাই আইসোলেশনের মুখে পড়তে হয়েছে রিম্পাদের। প্রতিবেশী শুধু নয়, নিজের শ্বশুরবাড়ি থেকেও বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়েছে বেশ কিছুটা সময়।তবে রিম্পার স্বামী তাকে সমর্থন জুগিয়ে এসেছে বরাবর। প্রতিবেশীদের কথায় কান দেয় নি। রিম্পার কাছে এটিই একটি ভরসার জায়গা। তার স্বামী তার শিক্ষার মূল্য দেয়। তার পরিশ্রমের উপার্জিত অর্থকে সম্মান দেয়। লেখাপড়া না জানলেও স্বামীর কাছ থেকে এই সাপোর্ট তার সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার বড় উৎসাহ। এতদিন ধরে বাচ্চাদের যাবতীয় বিলাস একাই পূরণ করেছে সে। উৎসব ও পরিবারের নানা অনুষ্ঠানে সকলের আবদারও পূরণ করেছে। এই আম্ফানেও নিজের পরিবারকে কিছুটা হলেও বাঁচাতে পেরেছে রিম্পা। মাথার উপরে ছাদ তার অর্থেই মেরামত হয়। কিন্তু এবারে আটকে যাবে হয়ত সব। উপার্জনের অন্য পথ খুঁজে বের করতে মরিয়া রিম্পা। শাক-পাতা খাওয়া জীবনে সামান্য স্বচ্ছলতা এসেছিল। কিন্তু আবার সেই অনিশ্চয়তা আর অভাবের জীবন। সাহসের অভাব ছিল না। সুযোগের অভাব ছিল। সেটা হাতে এল অথচ রিম্পার জীবনে তা স্থায়ী হল না। খুব বুদ্ধিমত্তা ও সাহসের সঙ্গে ধরেছিল সে জীবনের দাঁড়। এগিয়ে যাচ্ছিল সামনের দিকেও। দেওয়াল তুলে দিল কোভিড। এখন ওপারে অনিশ্চয়তা। এপারে অভাব।
     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics