• 'তাহলে বাড়ির রান্না কে করবে?': ঘরের কাজ, মেয়েরা ও লকডাউন


    0    272

    August 7, 2020

     

    "

    শোকতাপ অগ্রাহ্য করে, নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন না নিয়ে,

    মেয়েরা ‘ঘরের কাজ’ করে যাবে

    "

    কিছুদিন আগেই রিষড়ার ঘটনায় দেখা গেল এক গৃহবধূর উপসর্গসহ কোভিড ধরা পড়ার পরও তার বাড়ির লোকজন মানে তার স্বামী, শ্বশুর ইত্যাদিরা তাকে কিছুতেই হাসপাতালের জন্য ছাড়তে চাইছিল না। ‘বাড়ির রান্না কে করবে’ এই কারণে! শেষপর্যন্ত ওই মহিলাকে চিকিৎসার জন্য প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে আসতে হয় বাড়ির লোকজনের কাছ থেকে। ঘটনাটা বাড়াবাড়ি রকমের গৃহ-হিংসার ঘটনাই। তবে সাধারণভাবে মেয়েদের স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবনাচিন্তাটা কিছুটা এইরকমই — মানে যতক্ষণ না সে একেবারে শুয়ে পড়ছে, অথবা পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে বা হয়তো মরেই যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে দিয়ে ঘরের কাজ করানো হবে। আজ থেকে শ’খানেক বছর আগেও মেয়েরা একবার বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি এলে তার বাপের বাড়ি যাওয়ার অনুমতি আদায়ের জন্য প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হত। এরকম অনেকেই আছে যারা সারা জীবনেও আর বাপের বাড়ি গিয়ে উঠতে পারেনি। মেয়েটি শ্বশুরবাড়িতে কেমন থাকত না থাকত সেটা তার বাপের বাড়ির লোক জানতে পারত না অথবা জানার চেষ্টাই করত না। মূলত বাচ্চা হওয়ার আগে আগে ও পরে, আঁতুড়ে থাকার সময়, ঘরের কাজ করা থেকে কিছুদিনের জন্য রেহাই পেত মেয়েরা। রক্তাল্পতা, বাত ইত্যাদি মেয়েদের খুব সাধারণ রোগ ছিল আর তার চিকিৎসাও ভালোভাবে হত না, অবহেলা ছিল। সমাজ থেকে শিক্ষা নিয়ে মেয়েরা নিজেরাও নিজেদের শরীরের অবহেলা করত।

    বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেও এমনভাবে নিয়মগুলো করা ছিল যাতে মেয়েরা ঘরের কাজ করা থেকে খুব কম সময়ের জন্য রেহাই পায়। হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে, বিয়ে হওয়া মেয়েরা বাবা-মা মারা গেলে তিন দিনে কাজ করে, তাও আবার শ্বশুরবাড়িতে। ছেলেটি কিন্তু তেরো দিন পরে করে। এক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, যাতে দ্রুত ঘরের স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করতে পারে তাই মেয়েটিকে বেশিদিন অশৌচ পালন করতে হয় না। বেচারি মেয়েটি মা-বাবা হারানোর শোক সামলানোর জন্যও একটু বেশিদিন ঘরের কাজ থেকে ছুটি পায় না! শোকতাপ অগ্রাহ্য করে, নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন না নিয়ে, মেয়েরা ‘ঘরের কাজ’ করে যাবে — মেয়েদের সম্পর্কে যে এখনও এইরকম ধারণাই সমাজে রয়েছে, তা রিষড়ার ঘটনাটা দেখিয়ে দিল।

    "

    শিল্প-বিপ্লবের পরপরই, অসম বেতন এবং একটি দুর্বিষহ কাজের পরিবেশ নিয়েই

    মেয়েরাও ছেলেদের মতো বাইরের কাজ করতে শুরু করে

    "

    আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে রয়েছে ছেলে-মেয়ের একটি সাবেকী শ্রম-বিভাজনের ওপর। মেয়েরা ঘরের কাজ করবে, ছেলেরা বাইরের কাজ করবে। এই বিভাজনের ওপর দাঁড়িয়েই পুরুষ-চরিত্র ও নারী-চরিত্র নির্মিত হয়। সমাজের যে লিঙ্গ-বৈষম্য নিয়ে এত প্রতিবাদ প্রতিরোধ ইত্যাদি হচ্ছে, তার মূল উৎস হচ্ছে কাজের এই ভাগ। ঘরের কাজ মানে রান্নাবান্না, ঘর-পরিষ্কার, বাচ্চার জন্ম দেওয়া ও বড় করা, বাড়ির অন্যান্য লোকেদের দেখভাল করা, বয়স্কদের যত্ন নেওয়া। বাইরের কাজ মানে রোজগার করা, যাতে রোজগেরে ব্যক্তিটি ও তার ঘরের লোকজন খেয়েপরে বাঁচতে পারে।   

    শিল্প-বিপ্লবের পরপরই, অসম বেতন এবং একটি দুর্বিষহ কাজের পরিবেশ নিয়েই মেয়েরাও ছেলেদের মতো বাইরের কাজ করতে শুরু করে। এতে তারা একটা পরিমাণ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পায়। কিন্তু ঘরের কাজ অবহেলিত হতে থাকে। বাচ্চা আর বয়স্করা যত্ন পায় না। শিশুমৃত্যুর হার বেড়ে যায়। নতুন শ্রমিক তৈরি হতে পারে না। মূলত সন্তান প্রতিপালনের জন্যই মেয়েদের আবারও ঘরে ঢোকার দরকার পড়ে। ছেলেদের জন্য চালু হয় পারিবারিক-মজুরি(family wage)।

    পারিবারিক-মজুরি কী? যে মজুরি একটি পরিবারের বেঁচেবর্তে থাকার জন্য যথেষ্ট। পারিবারিক-মজুরি চালু হওয়ার পরই দেখা গেল যে অধিকাংশ মেয়েরা আবারও ঘরে ঢুকে গেল । বাচ্চারা আবারও একটা পরিমাণ যত্ন পেতে থাকলো। শিশু-মৃত্যুর হার কমল। সুস্থ-সবল মানুষ তথা শ্রমিক তৈরি হওয়া নিশ্চিত হল। কিন্তু অধিকাংশ মেয়েরা আবারও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হারালো ।

    এরপর নারী-অধিকার আন্দোলন নানা পর্যায়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। ঘরে আটকা থাকা মেয়েরা কিছুটা বাইরে বেরোচ্ছে। সমাজে, প্রকাশ্যে তারা দৃশ্যমান হচ্ছে। কিছু ধর্মীয় আইন ছাড়া কাঠামোগতভাবে মেয়েরা এখন প্রায় কোথাওই ‘নিষিদ্ধ’ নয়। মেয়ে পাইলট, মেয়ে অভিযাত্রী, মেয়ে প্রধানমন্ত্রী, মেয়ে খেলোয়াড়... হেন কোনো জায়গা নেই যেখানে মেয়েরা নেই। তারপরেও প্রদীপের তলার আশ্চর্য এক অন্ধকারের মত রিষড়ার এই ঘটনাগুলো উঠে আসে।

    এই ধরনের অন্ধকার তৈরি হচ্ছে কারণ ছেলে ও মেয়ের কাজের যে প্রাচীন ভাগ ছিলো সমাজে সেই শিক্ষা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ এখনও সমাজে বিদ্যমান। সেজন্যই তৈরি হচ্ছে দ্বিগুণ চাপ — যে মেয়েরা রোজগার করছে তারা কর্মক্ষেত্রে নিজেদের সাফল্য সুরক্ষিত করার সাথে সাথেই পরিবারের মধ্যে, সংসারেও সাফল্য পেতে চাইছে। তার কারণ এখনও যেনবা তাদের মূল কাজের জায়গাটা রয়ে গিয়েছে ঘরেই। একটা নৈতিক চাপ তৈরি হচ্ছে মেয়েদের ওপর। যে মেয়েটি আজকের এই প্রবল বহির্মুখী টানের মধ্যেও গৃহবধূ হয়ে রয়ে গিয়েছে, তারও হয়েছে এক ভীষণ অপ্রস্তুত অবস্থা।  সমাজের অন্যান্য অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন মেয়েদের পাশে সে ডুবে যাচ্ছে পরিচয়হীনতার অন্ধকারে, মেয়েদের প্রাচীন পরিচয় তাকে আর বাঁচাতে পারছে না। দুক্ষেত্রেই কিন্তু সমস্যা সেই একই — ‘মেয়েদের আসল জায়গা ঘরে' এই আবহমান সিদ্ধান্ত দুধরনের মেয়েদেরই সমস্যায় ফেলছে।

    "

    ওনার স্বামী যদিও খুব ভালো তাও ঘরের কাজ তাঁর ধাতে নেই!

    তাই খুব কিছু করে উঠতে পারেন না।

    "

    লকডাউনের সময় বাড়িতে ঘরের কাজে সাহায্য করার জন্য যিনি আসেন, চালু কথায় যাকে বাড়ির ‘কাজের লোক’ বলা হয়, তিনি আসতে পারেননি।  ফলে ঘরের সমস্ত কাজ বাড়ির লোকেদেরই করতে হয়েছে। মূলত মেয়েদেরকেই এই কাজের বোঝাটা নিতে হয়েছে। খবরের কাগজ, গণমাধ্যম ইত্যাদি জায়গায় আমরা দেখেছি যে মেয়েদের ওপর এই সময় অসম্ভব কাজের চাপ পড়েছে। যে সব মেয়েদের ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ চলছিলো তাদের বাড়িতে বসে অফিসের কাজ করার পর ঘরের কাজ করতে হচ্ছিল। এরকম ঘটনাও খবরে এসেছে যে, বাড়িতে নয় ঘন্টা অফিসের কাজ করে তারপর ঘরের কাজ মানে রান্নাবান্না, বাসন ধোয়া, কাপড় কাচা, ঘর পরিষ্কার ইত্যাদি করতে হয়েছে — ওনার স্বামী যদিও খুব ভালো তাও ঘরের কাজ তাঁর ধাতে নেই! তাই খুব কিছু করে উঠতে পারেন না।

    ব্যক্তিগতভাবে এরকম কিছু মহিলাকে চিনি যারা লকডাউনে ঘর আর অফিস সামলাতে গিয়ে রোগা হয়ে গিয়েছেন। বাচ্চাদের পড়াশুনো চলেছে ঘরে।  অনলাইনে। সেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাচ্চার মায়ের দায়িত্ব। একটি স্কুলের এক শিক্ষিকা তো বলেই বসলেন যে, ‘এখন তো আনলকডাউন শুরু হয়েছে। বাবারা অফিসে যাচ্ছন। তাই মায়েরা বাচ্চাদের সাহায্য করবেন।’ তাই নিয়ে অভিভাবকদের পক্ষ থেকে চিঠিচাপাটিও হল। 

    একদিকে যেমন মেয়েদের ওপর চাপ বাড়ল, অন্যদিকে এই ঘরের কাজ ঘিরে প্রচুর চুটকি, মিম, হোয়াটস্যাপ মেসেজ ইত্যাদি তৈরি হল যেখানে ঘরের কাজ নিয়ে নানারকম মজা করা হল। সমাজে ঘরের কাজের মর্যাদা খুব নেই। কোনো গৃহবধূকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তিনি কী করেন, তাহলে তাদের পরিচিত উত্তর হল ‘আমি কিছু কাজ করি না। হাউস-ওয়াইফ’।  লকডাউনে একটা খুব চালু মিম তৈরি হল — যে আইটি ওয়ার্কার দিনে মাইক্রোসফট এক্সেল নিয়ে কাজ করছেন, তিনিই রাতে সার্ফ এক্সেল নিয়ে কাজ করছেন। এইধরনের মিমের মধ্য দিয়ে ঘরের কাজকে খাটো করার চেষ্টাও চলেছে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত দ্য ইকোনমিক সার্ভে ২০২০-এর তথ্য বলছে যে, ১৫-৫৯ বছরের ভারতীয় মহিলাদের ষাট শতাংশ পুরো সময় ঘরের কাজ করেন। ২০১৫ সালের আরো একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে যে, গড়ে একজন ভারতীয় মহিলা দিনে ছয় ঘন্টার কিছু কম সময় বাড়ির কাজের জন্য ব্যয় করেন, একজন ভারতীয় পুরুষের জন্য সেই সময়টা হল ৫১ মিনিট।   

     

    "

    লকডাউনের মধ্যে ঘরের কাজ নিয়ে প্রচুর কথাবার্তা হয়েছে

    যা এ বিষয়ে আশপাশের লোকজনের ঔদাসীন্য ও অজ্ঞতায়

    একটা পরিমাণ ধাক্কা দিয়েছে

    "

    বাংলা সিরিয়ালে সাধারণত সমসাময়িক ঘটনার ছোঁয়া দেখতে পাওয়া যায়।  কিছু বাংলা সিরিয়ালে লকডাউন বোঝানোর জন্য ছেলেদের প্রচুর বাড়ির কাজ করতে দেখানো হল। এরকমও শোনা গেল যে, বেশ কিছু ছেলে ঘরের কাজ করে দেখিয়ে দিলেন যে এই কাজটা তারা তাদের স্ত্রীদের থেকে ভালোভাবে করেন ও এমনকী অনেকে উপভোগও করেন। লকডাউনে যেহেতু টানা ঘরে থাকতে হয়েছে ফলে ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সবাই দেখেছে যে ঘরের কাজ আসলে কতটা। আগে বাইরের কাজের অজুহাতে ছেলেরা ঘরের কাজ এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ পেত। লকডাউন চলাকালীন সে সুযোগ হয়নি তাদের। অনেক বাড়িতেই ছেলেদেরকে ঘরের কাজে হাত লাগাতে হয়েছে। যদিও সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বউকে বা মাকে ‘সাহায্য’ হিসেবেই এসেছে, মানে ঘরের কাজের মূল দায়িত্বটা রয়ে গিয়েছে মেয়েটির হাতেই, তাও বাড়ির ছেলেটি যে ঘরের কাজে ঢুকেছে এটাই সামান্য আশার কথা।  লকডাউনে বাড়ি থেকে কাজের জায়গায় যাতায়াত করতে অসুবিধা হবে বলে এক জরুরি-পরিষেবার পুরুষ কর্মী কাজের জায়গার কাছেই বাড়ি ভাড়া নিয়ে একা থাকতে শুরু করার পর সে আস্তে আস্তে বুঝতে পারে ঘরের কাজ কী আর সেগুলো করতে ঠিক কতটা পরিশ্রম হয়। লকডাউনের মধ্যে ঘরের কাজ নিয়ে প্রচুর কথাবার্তা হয়েছে যা এ বিষয়ে আশপাশের লোকজনের ঔদাসীন্য ও অজ্ঞতায় একটা পরিমাণ ধাক্কা দিয়েছে।

    সবমিলিয়ে লকডাউনে ঘরের কাজ নিয়ে মানুষের ভাবনাচিন্তা একটা ইতিবাচক চেহারা নিয়েছে। শারীরিকভাবে ছেলে আর মেয়েদের নির্দিষ্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তৈরি ও সেই অনুযায়ী কাজের ভাগ যে ছাঁচে ঢালা, সেটাও ভেঙে যাওয়ার একটা জায়গা গড়ে উঠছে। এর ফলে শুধু যে মেয়েদের ওপর বোঝা কমার সম্ভাবনা তৈরি হল তাই নয়, ছেলে-মেয়ে-রূপান্তরকামী সবার জন্যই লিঙ্গ ও লিঙ্গের ভিত্তিতে কাজের বৈষম্য মুক্ত একটা পৃথিবী তৈরি হওয়ার ভিতটা কিছুটা জোরালো হল।

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics