জীবিকার সংকট ও সাধারণ মানুষের জীবন
0 180মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকেই সারা দেশে এবং একই সঙ্গে পৃথিবী জুড়ে আমরা করোনা ভাইরাস সংক্রমণের অতিমারীর প্রকোপ দেখছি৷ প্রথমে বড় শহর, তারপর ছোট জনপদ ও গ্রামাঞ্চলেও সংক্রমণের বিস্তার হয়ে চলেছে৷ সংক্রমিত মানুষের সংখ্যার হিসেবে বিশ্বে আমরা এখন দু-নম্বরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঠিক পরেই৷ প্রতিদিনের গড় মৃত্যুর হিসেবে আমরা পৃথিবীর শীর্ষে৷ ২৫শে মার্চ মাত্র চার ঘন্টার নোটিশে সারা দেশে যে লকডাউন জারি করা হল, চলল জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত৷ এই সময়ে দেশের গ্রামীণ অঞ্চলে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বিশেষ ছিল না৷ জেলাওয়ারী তথ্য বিশ্লেষণ করলে, কেবল শহরাঞ্চলে লকডাউন করাই এই পর্বে যথেষ্ট ছিল৷ তাতে প্রশাসনিক ব্যবস্থার উপর চাপ কম পড়ত৷ এবং জীবন জীবিকা অন্ততঃ কিছু পরিমাণে অব্যাহত চলতে পারত৷
যতদূর জানি, রাজ্যভিত্তিক তথ্যের উপর দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলেই বন্ধ হয়ে গেল গণপরিবহন ব্যবস্থা, শিল্প-বাণিজ্য, ছোট দোকান-পাট, গৃহ নির্মাণের কাজ, অফিস-কাছারি৷ যা যা বন্ধ হয়ে গেল, তার প্রত্যেকটিতে জড়িত ছিলেন প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষ কর্মীরা, যাঁরা পরিষেবা দেন৷ সারা দেশে বেড়ে গেল কর্মহীনতা এবং সাধারণ মানুষের জীবিকার সংকট ঘনীভূত হল৷ সবচেয়ে কঠিন হয়ে পড়ল বহিরাগত শ্রমিকদের জীবন, কারণ, কর্মহীন হবার সঙ্গে সঙ্গে এঁরা আশ্রয়হীনও হয়ে পড়লেন৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বস্তি ও লেবার কলোনীতে বাড়ির মালিকরা এঁদের ভাড়া মেটানোর জন্য জোর জবরদস্তি করতে লাগলেন, এবং সেই অবস্থায় ভাড়া মিটিয়ে নিজের নিজের জায়গায় থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ল শ্রমিকদের পক্ষে৷ অথচ পথে ১৪৪ ধারা জারী হয়ে গেছে৷ সংক্রমণ এড়াতে মানুষের ভিড় জমানোর উপর নিষেধাজ্ঞা৷ গণপরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দিশেহারা শ্রমিকরা ভিড় জমাচ্ছে বাস-স্টেশনে, চেষ্টা করছে সম্ভব-অসম্ভব নানা উপায়ে ঘরে ফেরার৷
লকডাউনের পর ৮০-১০০ দিন পর্যন্ত গণপরিবহন ব্যবস্থা ঘরে ফিরতে চাওয়া শ্রমিকদের জন্য চালু করতে না পারার ফলে যে মর্মান্তিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল, তা স্বাধীনতার পরবর্তী দেশভাগ সংকটের সময়ও দেখা যায়নি৷ একশো, পাঁচশো, হাজার কিলোমিটার পায়ে হেঁটে, সাইকেলে ও ঠাসাঠাসি বাস ও ট্রাকে ফিরতে গিয়ে কত জন শ্রমিক ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও ক্লান্তিতে প্রাণ হারিয়েছেন, তার পরিসংখ্যান সংসদেও সরকার দিতে পারেননি৷ কর্মহীন ক্ষুধার্ত মানুষ যাঁরা নিজ নিজ গ্রামে ফিরতে পেরেছিলেন, তাঁরা সেখানেও বেকারত্বের মুখোমুখি হলেন৷
সাধারণভাবে কর্মহীনতার সংকটকে অতিমারীর প্রভাব দিয়ে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা দেখেছি সরকারের কথায়৷ আমাদের বুঝতে হবে, ২০১৮ থেকেই দেশে অর্থনৈতিক মন্দা আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল৷ এপ্রিল ২০১৯ এই বেকারত্বের হার ছিল ৭.৬ শতাংশ৷ আগের দুই বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি৷ গ্রামীণ কর্মহীনতার ক্ষেত্রেও তাই৷ এপ্রিল ২০১৯-এ, তা ছিল ৭.৬ শতাংশ — গত দু’বছরের তুলনায় সর্বাধিক৷ ২০-২৪ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব বেড়েছিল ১৫%, ২০১৭-২০১৯ এর মধ্যে এই বয়সের যুবক-যুবতীরা দেশের শ্রমিক সংখ্যার ৪০ শতাংশ৷ এদের ৩২ শতাংশই ২০১৯-এর মাঝামাঝি কর্মহীন ছিল (State of India's Environment in Figures, 2019)।
সেণ্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (CMIE), নিউ দিল্লি-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যেও বেকারত্ব ২০১৭-র ১০.৩৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৮-তে হয়েছে ১৩.১৭ শতাংশ৷ এই বেকারত্বের একটা বড় কারণ উপযুক্ত দক্ষতার অভাব — ভারতে শ্রমজীবীদের মধ্যে ৫ শতাংশেরও কম দক্ষ। এই সংখ্যাটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫২ শতাংশ, ইংল্যাণ্ডে ৬৪ শতাংশ ও জার্মানিতে ৭৫ শতাংশ৷ গত আর্থিক বছরেই, অর্থাৎ ২০১৯-এ, জাতীয় উৎপাদনের বৃদ্ধি নেমে এসেছিল ৪.২ শতাংশে, গত বছরের পুরো সময়টা ধরেই এই হার কম ছিল৷ এর পিছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল বিনিয়োগের হার কমে যাওয়া৷ এপ্রিল ২০১৯-এ বিনিয়োগ কমেছে ৩ শতাংশ — প্রায় দু-দশক পর এই ধরনের হ্রাস ঘটল৷ একে বিপুল ঋণের বোঝা, তার ওপর কমতে থাকা বিনিয়োগ৷ সরকার নিজের ব্যয় বাড়িয়েও বিনিয়োগকে উজ্জীবিত করতে পারেনি৷ পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে (PLFS-2017-8) অনুযায়ী দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ, ৪২ কোটি শ্রমিকই অসংগঠিত ক্ষেত্রে৷ এদের মধ্যে ৬২ শতাংশ গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দা, ৮ শতাংশ শহরে৷ অবশ্যই গ্রামাঞ্চলে কৃষি ও অন্যান্য পরিসরে এত কাজের সুযোগ থাকেনা। তাই গ্রাম থেকে শহরে, রাজ্যের বাইরেও কাজ খুঁজতে যায় মানুষ৷
শিল্প, পর্যটন, হোটেল, বিনোদন, পরিবহন, নির্মাণ, ছোট ব্যবসা — এই সব ক্ষেত্রে সারা দেশে কাজ করেন সাড়ে নয় কোটির মতন মানুষ৷ দেশের ১/৩ ভাগ শ্রমজীবী কর্মহীন হয়েছিলেন লকডাউন পর্বের আরম্ভ থেকে৷ অসংগঠিত শ্রমিক, যাঁরা সংখ্যায় এবং শতাংশের হিসেবে সবচেয়ে বেশি, তাদের তো কোনও সুরক্ষাই ছিল না৷ শ্রম আইনগুলিতে ন্যূনতম মজুরি বা প্রভিডেণ্ট ফাণ্ডের ব্যবস্থা থাকলেও তার অনুপালনে সদিচ্ছার একান্ত অভাব সমস্ত শ্রম দফতরেই৷
সংক্ষেপে বলতে গেলে অতিমারী ঠেকানোর জন্য মার্চের মাঝামাঝি থেকে যে গৃহবন্দী অবস্থা চালু হল মানুষের, এবং অনেকেই সচেতনভাবে কমিয়ে দিলেন বাইরে আনাগোনা, তার ফলে সংকুচিত হয়ে গেল শারীরিকভাবে করা কাজের সুযোগ, মানুষের ঘরের ভিতর বা মুখোমুখি বসে কাজ, স্পর্শ বা সংযোগ ভিত্তিক কাজ — কুঁকড়ে গুটিয়ে ছোট হয়ে এক তৃতীয়াংশ হয়ে গেল একটি দেশের অর্থনীতি৷ কাজ ও আয়ের এমন সংকোচন এদেশ আগে কখনও দেখেনি৷
আনলক প্রক্রিয়া আরম্ভ হল জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে৷ ধীরে ধীরে খুলতে আরম্ভ করল অফিস-কাছারি, দোকান-পাট, শপিং মল৷ কিন্তু পরিবহন ব্যবস্থা বলতে কিছু অটো এবং ট্যাক্সি৷ লোকাল ট্রেনের মতন গণ-পরিবহন, যার উপর সাধারণ মানুষের নির্ভর, তা আজও চালু হয়নি৷ সাধারণ মানুষের কাজের জায়গায় যাওয়ার ব্যবস্থা অপ্রতুল৷ মানুষের হাতে টাকা, ক্রয়ক্ষমতা না থাকলে অত্যাবশ্যক পণ্য ছাড়া অন্য জিনিসের বাজারেও মন্দা৷ সর্বত্রই স্যানিটাইজার, মাক্স, সামাজিক দূরত্ববিধি, কোথাও স্যানিটাইজিং টানেল৷ শরীরের তাপমাত্রা নেবার পদ্ধতি চালু হয়ে গেছে সর্বত্র৷ স্বস্তিতে মেলামেশা করার পরিবেশ এ নয়৷ মার্চ থেকে মে মাসের শেষের মধ্যে ছোট ব্যবসাদার, দোকানের মালিকরা দোকান বন্ধ করে বসে থাকতে থাকতে নিঃশেষ করে ফেলেছেন তাঁদের অল্পস্বল্প পুঁজি৷ আবার যে নতুন করে কাঁচামাল কিনে ব্যবসা আরম্ভ করবেন, সে উদ্যম ও সামর্থ্য তাঁদের নেই৷ কর্মীরা অধিকাংশই ছাঁটাই৷ গৃহপরিচারক-পরিচারিকাদের বড় অংশই কর্মহীন৷ অনেকেই কাজে যাবার জন্য লোকাল ট্রেন বা বাসের উপর নির্ভরশীল ছিলেন৷ মার্চের পর তথাকথিত শিক্ষিত উচ্চবিত্তরাও তাঁদের মাইনে দিয়ে 'বসিয়ে' খাওয়ানোর উদারতা দেখাতে পারলেন না৷ গৃহপ্রত্যাগত শ্রমিকরা নিজ গ্রামে বেকার, যাঁরা ফিরতে পারেননি তাঁরা খাবারের জন্য বসে আছেন বড় শহরের লঙ্গরখানার লাইনে৷
অফিস-কাছারিতে যাঁরা কাজ করেন, সরকারি অফিসের অ্যাড হক, এবং বেসরকারি উদ্যোগের ছোটখাটো শিক্ষিত কর্মচারী অনেকেই কাজ হারিয়েছেন ইতিমধ্যে৷ যাকে 'হোয়াইট কলার' পেশাদারি কাজ বলা হয়, তার ক্ষেত্রে বৃদ্ধি ঘটে চলছিল ২০১৬ থেকেই৷ এখন দেখা যাচ্ছে এ বছরের মে থেকে অগাস্টের মধ্যে ৬৬ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছেন৷ এদের অধিকাংশই, CMIE-র বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়র, শিক্ষক, অ্যাকাউন্টান্ট, ডাক্তার ও ছোটখাট সংস্থার কর্মী৷ সফ্টওয়্যার ক্ষেত্রে মার্চ থেকেই সংস্পর্শ এড়াতে আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল ওয়র্ক ফ্রম হোম৷ কর্মীদের বারণই করা হয়েছিল অফিসে আসতে৷ লকডাউনের শেষে দেখা গেল বাড়ি থেকে কাজ করেও অনেকে কাজ হারিয়েছেন, কারণ যেখানেই কর্মীদের 'টার্গেট' দেওয়া হয়েছিল, মানব সংযোগের অভাবে তাঁরা সেগুলি পূর্ণ করে উঠতে পারেননি৷ অথচ ওয়র্ক ফ্রম হোমে, যাঁদের কাজ চলে যায়নি, তাঁদেরও বাধ্য করা হচ্ছে অন্ততঃ এক তৃতীয়াংশ সময় বেশি কাজ করতে৷ বাড়িতেই কাজ, অতএব ৯-৭টার দিন এখন ৮-১০টা রাত পর্যন্ত গড়াচ্ছে৷ এও এক শোষণ, অতিমারী উপলক্ষে৷ কর্মহীনতার সমস্যাকে জটিল ও কঠিন করে তুলেছে অতিমারী এবং তার মোকাবিলায় নিয়ে আসা লকডাউন৷
জাতীয় স্তরে সংখ্যার হিসেব নিলে সমস্যার বিস্তার বোঝা যায়, কিন্তু গ্রামগঞ্জে ছোট-বড় শহরে এই কর্মহীনতা কী ভাবে মানুষের প্রতিদিনের জীবনকে সংকটে ফেলেছে, তার জন্য পরিবার কেন্দ্রিক ছবিটি দেখা খুব জরুরি৷ দারিদ্র্যসীমার নিচে এখনও দেশের প্রায় ১৮-২০ শতাংশ মানুষ৷ মাসে আটশো টাকার উপর মাথাপিছু রোজগার হলে একজন দারিদ্র্যসীমাকে পার হয়েছেন বলা যায়৷ চারজনের একটি পরিবারের এই মাপকাঠি অনুযায়ী রোজগার সাড়ে তিন হাজার টাকার মতন হলে, তাদের দরিদ্র বলা যাবে না৷ এখন মূল্যবৃদ্ধির যা দর, তাতে সাড়ে তিন হাজার টাকায় একটি পরিবারের ক্রয়ক্ষমতা কী তা বোঝা কঠিন নয়৷ একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা নয়, সারা দেশে প্রতিদিনই লক্ষ হাজার মানুষ দারিদ্র্যসীমা পেরোচ্ছেন, আবার উপর থেকে নেমে চলে আসছেন কাল্পনিক এই রেখার তলায়৷
যে পরিবারের উপার্জন মাসে পাঁচ-ছ’হাজার টাকা, এবং যেখানে অন্তত দুজন সদস্য (ধরা যাক, একজন গৃহ পরিচারিকা, আর একজন সাইকেল রিক্সা চালক বা দিনমজুর), লকডাউন পর্বে তিন মাস কর্মহীন বসে আছেন — তাঁদের অবস্থা কী রকম? রেশন কার্ড যাঁদের আছে তাঁরা রেশন ফ্রীতে পেয়েছেন, পাবেন আরও তিন মাস (অনেকে স্লিপ দেখিয়ে রেশন তুলতে গিয়ে পার্টির কর্মকর্তাদের চাপে পড়েছেন)। খাদ্যতালিকা থেকে ডিম, মাংস, মাছ, ডাল, সোয়াবিন উধাও হয়ে যেতে বাধ্য এই অবস্থায়৷ শিশুদের জন্য দুধ, ডিম, ফল ইত্যাদি খুবই সতর্কভাবে, হয়তো সপ্তাহে দুবার কিনতেন এই সব পরিবার, এখন তাও বন্ধ৷ বেরিয়ে গিয়ে অন্য কাজ করার উপায় নেই, কারণ শুনসান শহরে বন্ধ দোকানপাট, মজুরির সমস্ত বিকল্প রাস্তাই৷ বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলা ও শিশুদের যে পুষ্টির ঘাটতি হচ্ছে, তা কী ভাবে পূরণ হবে? স্কুলে মিড ডে মিলের রান্না খাবার, অঙ্গনবাড়ির রান্না, সবই বন্ধ৷ রেশন তুলে বাড়িতে নিয়ে এলেও, তার ভাগ বড় পরিবারে ঠিক পুষ্টির প্রয়োজন অনুযায়ী হচ্ছে কিনা তা বলা কঠিন৷ বন্ধ হয়ে আছে টীকাকরণ৷ সদ্যোজাত ও ৬ মাস বয়সের কম শিশুরা এর ফলে অত্যন্ত অসুরক্ষিত অবস্থায় আছে৷ সংক্রমণ পর্ব শেষ হলে, টীকাকরণ আবার আরম্ভ হলে, এই সব বাদ পড়া শিশু অথবা গর্ভবতী মহিলার টীকাকরণের কাজ কবে হবে, এবং কত দিনে?
দারিদ্র্যসীমার উপর থেকে দেশের অন্তত ১০ শতাংশ মানুষ এই তিন চার মাসে নেমে আসছেন দরিদ্রতার ভিতর৷ লকডাউন পর্ব শেষ হলেও অনেকে এখনও ফিরে পাননি হৃত জীবিকা, অনেকে বাধ্য হয়েছেন কম মজুরি বা মাইনের বিকল্প জীবিকা গ্রহণ করতে৷ যে শ্রমিকরা গ্রামেগঞ্জে যথেষ্ট উপার্জনের সুযোগ না পেয়ে জুলাই মাস থেকে আবার ফিরতে আরম্ভ করেছেন সেই সব শহরে, যেখানে তাঁরা কাজ করে এসেছেন এ যাবৎ, তাঁদের অধিকাংশই বাধ্য হবেন কম মজুরিতে কাজ করতে৷ তার কারণ, যাঁরা কাজে লাগাবেন, সেই মালিক ও ঠিকাদাররা বুঝে গেছেন এদের নিরুপায় অবস্থার কথা৷ তাছাড়া গত কয়েক মাসে উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ সহ বেশ কয়েকটি রাজ্য শ্রম আইন সংস্কারের নামে অধ্যাদেশ পাশ করিয়ে শ্রম দিবসের দৈর্ঘ্য বাড়িয়েছে, শ্রমিক সুরক্ষা, ট্রেড ইউনিয়ন সংক্রান্ত কিছু আইনকে স্থগিত রাখার ব্যবস্থা করে নিয়েছে অতিমারীর নাম করে৷ অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য শ্রমিকের শোষণ অত্যাবশ্যক!
দরিদ্র, প্রান্তিক পরিবারের প্রয়োজন হিসেব করতে গিয়ে করোনা ভাইরাস জনিত চিকিৎসার খরচ ধরা হয়নি৷ অতিমারীর সময় সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ জাগিয়েছে আমাদের সরকারি জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবস্থা৷ জুলাই মাসের শেষ পর্যন্তও সারা দেশে সরকারি হাসপাতালে শয্যা পাওয়া দুষ্কর ছিল৷ সংক্রমণে ডাক্তার ও চিকিৎসা কর্মীরা অসুস্থ হওয়ায় বন্ধ করে দিতে হয়েছে বেশ কিছু হাসপাতালে৷ সেই অবস্থায় কর্মহীন, ভূমিহীন, আয় বন্ধ হয়ে যাওয়া মানুষ কী ভাবে, কোন সুদের হারে নিজের চিকিৎসার জন্য টাকা জোগাড় করেছেন, তার খোঁজ নিতে গেলে আর এক করুণ অনুসন্ধান কাহিনী হয়ে যাবে৷ বহু আত্মহত্যা ঘটে গেছে এই কয়েক মাসে, বিপন্ন মানুষের জীবনের ফাঁস থেকে বেরোবার চেষ্টায়৷
কর্মহীন, অতি সাধারণ, দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের জীবিকার কথা, বা জীবিকাহীনতার সমস্যার কথা সরকার কি ভাবছেন? সরকারের মনের ভাষা পড়া একটি কঠিন ও সূক্ষ্ম কাজ কারণ ব্যক্তি মানুষের মতন সরকারের বেদনার্ত মুখ কখনো দৃষ্টিগোচর হয়না৷ শেষ অধিবেশনের পর ছ মাস অতিক্রম করে সংসদ আরম্ভ হয়েছে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি৷ হ্রস্ব অধিবেশন৷ অধ্যাদেশগুলিকে আইনে পরিণত করার কাল৷ প্রশ্নোত্তর পর্ব নেই৷ তাই বহু প্রশ্ন অনুচ্চারিতই রয়ে যাবে৷
গ্রাম থেকেই জীবিকাহীন মানুষকে সাহায্যের হাত বাড়ানোর ব্যাপারটিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল সমাজমনস্ক মানুষের উদারতার উপর৷ যেন সরকারের এ বিষয়ে বিশেষ কিছু করার নেই৷ রেশন কার্ড গ্রামে ফেলে আসা যে শ্রমিকরা ক্ষুধার্ত, তাদের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করতে এগিয়ে এসেছেন কোথাও রাজ্য সরকার এবং সমাজসেবী সংস্থাগুলিও৷ এঁদের শহরের গৃহসমস্যা সমাধানের সুযোগ সরকারের হাতে ছিল, যদি ম্যুনিসিপালিটি পরিচালিত ডরমিটরি-র ব্যবস্থাকে স্মার্ট সিটি পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করা যেত ২০১৪-১৫ সালেই৷ যে সব বস্তি ও ঝুপড়িতে শ্রমিকরা থাকেন, তা হল এক বেআইনি ভাড়া আদায়ের সংগঠিত কালোবাজার৷ বাসস্থান যদি থাকত, অথবা, এই সব ঘর মালিকদের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে একটা সমঝোতায় আসা যেত, তবে রেশন কার্ডগুলিকেও মোবাইল নম্বরের মত সারা দেশে কার্যকর করা যেত৷ কেন্দ্রীয় সরকারের গোদামে খাদ্যশস্যের অভাব ছিল না৷ সেই খাদ্যশস্য অবশ্য বিনামূল্যে রাজ্য সরকারকে দিতে রাজি হয়নি কেন্দ্র৷ পশ্চিমবঙ্গ সহ বেশ কিছু রাজ্য বিনামূল্যে ন্যূনতম রেশন-এর ব্যবস্থা করে কয়েকমাস দরিদ্রকে নিরন্ন থাকতে দেয়নি৷ কয়েক কোটি শ্রমিক যাঁরা অন্য রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে পরিবহনের অভাবে ফিরতে পারছিলেন না, তাঁদের বিষয়ে করণীয় পদক্ষেপগুলি কী, তা নিয়ে কোনও প্রাঞ্জল সমাধান কেন্দ্রীয় সরকারের মুখে শোনা যায়নি৷
কিছুটা তৎপরতা ও উদ্যম দেখিয়েছে কেন্দ্রের গ্রামীণ উন্নয়ন বিভাগ৷ একমাত্র দৃশ্যমান ও প্রত্যক্ষ পদক্ষেপ হিসেবে ৪০,০০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত ব্যয় বরাদ্দ তারা করেছে MNREGA — যাকে আমরা চলতি কথায় ১০০ দিনের কাজ বলি — সেই খাতে৷ এতে গ্রামাঞ্চলে কাজ চালু করা গেছে, কিছুটা সুরাহা অবশ্যই হয়েছে, প্রত্যাগত শ্রমিকদের জন্য, পুরোটা নয়৷ কেন্দ্রীয় সরকারের হিসেবে দেখা যাচ্ছে, এপ্রিলে চালু হবার পর থেকে জুলাই পর্যন্ত MNREGA তে ১২৩ কোটি শ্রমদিবস উৎপন্ন হয়েছে৷ সারা বছরে যতদিন কাজ হয় এই প্রকল্পে, তার ৫০% হয়েছে এই তিন মাসে, গ্রামের দিন মজদুরদের জন্য এটা অবশ্যই ভালো খবর৷ ১৪ কোটি পরিবার ১০০ দিনের কাজের জন্য পঞ্জীকৃত হয়েছেন৷ ১০০ দিন কাজ চান ৪০-৫০ লক্ষের মত শ্রমিক৷ সরকার সব বহিরাগত, গ্রামে প্রত্যাগত শ্রমিকদের জন্য 'জব কার্ড' জারি করেছেন৷ মে মাসেই, গত বছরের তুলনায় কাজের চাহিদা বেড়েছিল ৭০ শতাংশ৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত বহিরাগত শ্রমিকদের সমস্যার পুরো সমাধান হল না৷ তাঁরা অগাস্ট মাস থেকেই আবার শহর অভিমুখে যাত্রা শুরু করলেন৷ কারণ তাঁদের পক্ষে MNREGA-র মজুরির দর কম৷ তাছাড়া এই যোজনার কিছু অন্তর্নিহিত সমস্যা আছে৷ বকেয়া মজুরি, দেরীতে মজুরি পৌঁছনো এবং মরশুমের আরম্ভে কাজের মজুরি না আসা৷ শ্রমিক যে ভিনদেশে কাজের জন্য যান, তার পিছনেও এই অসুবিধাগুলি৷ তা সত্ত্বেও গ্রামীণ উন্নয়ন বিভাগ যথেষ্ট সংবেদনশীলতা ও তৎপরতা দেখিয়েছে, এই লকডাউনের বিপর্যয়কালে৷
কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যে আর্থিক প্যাকেজ তিন দফায় ঘোষণা করলেন অর্থমন্ত্রী, তার ওজন বেশি হলেও, এই ২০ লক্ষ কোটি টাকা দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে কী ভাবে কাজে লাগবে, তার ব্যাখ্যা পাওয়া গেলনা৷ রাজ্যগুলিকে ঋণ দেওয়ার সীমা বাড়িয়ে দেওয়া হল ৩-৫ শতাংশ৷ অথচ যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশাকে এই অতিমারী চলাকালীন বিপর্যস্ত করেছিল, তার জন্য কোনও আর্থিক প্যাকেজ দেওয়া হল না৷ আর্থিক বন্টনে অসাম্য, যার মধ্যে আছে জিএসটি-র বাবদ প্রাপ্য অর্থেরও দাবী না মেটানো, এই নীতির ফলে রাজ্যগুলির আর্থিক ক্ষমতা ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে গত ছ মাসে৷ আর্থিক প্যাকেজের মধ্যে গরীব কল্যাণ যোজনা বাবদ যে ১.৭০ লক্ষ কোটি টাকা ছিল, তাতে দরিদ্র মহিলারা মাথাপিছু ৫০০ করে টাকা ও বিনামূল্যে গ্যাস সিলিণ্ডার পেয়েছেন, ফিরে আসা শ্রমিকরা পেয়েছেন টাকা, বয়স্কদের ১০০০ করে ভাতা ও চাষীদের ২০০০ করে দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা অতি সামান্য৷ দরকার ছিল অতিমারীর সময়ে চাহিদা বৃদ্ধি ও শ্রমদিবস সৃষ্টির মত কাজের জন্য বিশেষ নীতি৷
কিন্তু অর্থমন্ত্রীর বিশদ প্যাকেজে যোগান বৃদ্ধির উপরই গুরুত্ব বজায় থাকল৷ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে উজ্জীবিত করতে যে ৫০,০০০ কোটি ইক্যুয়িটি এবং ৩০,০০০ কোটি কোল্যাটেরাল ছাড়া লোনের যে আর্থিক প্রাবধানের কথা শুনলাম, সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়, তার বড় একটা অংশ পড়ে থাকবে ব্যবহৃত না হয়ে৷ কারণ সরকারি নির্দেশ যেমনই হোক, ব্যাঙ্কগুলির মানসিকতা বদলানো সম্ভব হবে না৷ ছোট ঋণ গ্রহীতারা এঁদের রাডার ক্ষেত্রের ভিতরেই আসেন না৷ এই প্যাকেজের ৮ লক্ষ কোটি টাকা আবার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের লিকুইডিটি সংক্রান্ত আর্থিক পরিকল্পনার অংশ৷ এই সব ঘোষণার প্রেস কনফারেন্স দেখলে মনে হত না যে দেশের বুকে প্রতিদিন যে কর্মহীনতা ও রোজগারহীন মানুষের হাহাকার জমা হচ্ছে, তা কেন্দ্রীয় সরকারের চিন্তা-ভাবনায় বিন্দুমাত্র ছায়া ফেলতে পারছে৷ এদেশ যেন মানুষের নয়, শাসকের৷
তা না হলে, অতিমারী সংক্রান্ত লকডাউনের পর ২ মাসেরও বেশি সময় এত বড় একটি দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থাকে ঘরে ফিরতে চাওয়া শ্রমিকদের কাজে কোনওভাবে ব্যবহার করা গেল না? এত নির্মম ঔদাস্য সরকারের যে অসংখ্য মানুষের দীর্ঘ পথ হাঁটা, ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত অবস্থায় মারা যাওয়া, ট্রেনে কাটা পড়া ঘুমন্ত অবস্থার ক্লান্তি — কিছুই তাদের চেতনাকে স্পর্শ করল না? এর চেয়ে বড় অমানবিকতা ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার উদাহরণ কী হতে পারে?
রাজ্য সরকারগুলিই বা কত তৎপর ছিলেন? শ্রম আইন পরিবর্তন করে শোষণমূলক অধ্যাদেশ তাঁরাই জারি করেছেন৷ ৩১,০০০ কোটি টাকা রাজ্যগুলির কাছে জমা ছিল 'কনস্ট্রাকশন সেস্' হিসেবে, তার মাত্র ৫০০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে৷ নির্মাণ শ্রমিকদের ১.৭৫ কোটি জন ১০০০-৬০০০ টাকা ব্যাঙ্কের খাতায় পেয়েছেন৷ বাকি টাকা পড়ে থাকার পিছনে রাজনৈতিক অভিসন্ধি ও দুর্নীতি অন্যতম কারণ৷ সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতা ঢাকার জন্য রাজ্য সরকারগুলিও এক পুলিশ-নিয়ন্ত্রিত অতিমারী ব্যবস্থার ভিতর ঢুকে বসে থাকলেন৷ জীবিকার ঝাঁপ এমনভাবে পড়ে গেল যে পঞ্চায়েত স্তরে পরিকল্পনার কোন অবকাশ থাকল না৷ অথচ এই সময়ে অনেক কাজ করা যেত — প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তা নিয়ে৷ অত্যাবশ্যক পণ্যের বাইরে অন্য পণ্য যেমন জামাকাপড়, কাগজপত্র, গৃহস্থালী জিনিস অনলাইনে বিক্রির বাজারটি বন্ধ রয়ে গেল জুন পর্যন্ত৷ বন্ধ রইল গ্রামীণ হাটগুলি, যেখানে ছোট চাষী ও আদিবাসীরা তাঁদের ফসল ও বনজ সম্পদ নিয়ে আসেন৷ বন্ধ রইল মহুয়া, কেন্দুপাতা ইত্যাদি সংগ্রহের কাজ৷ অথচ এপ্রিল-জুনের শেষ পর্যন্ত কিন্তু গ্রামাঞ্চলে সংক্রমণের হার বেশি ছিল না৷ প্রয়োজন ছিল একটি সুনির্দিষ্ট জীবিকাভিত্তিক নীতি ও পঞ্চায়েত স্তরে তাকে কার্যকরী করার৷
মূল্যবান তিনটি মাস নষ্ট হল, চরমে উঠল মানুষের দুর্দশা৷ গত বছর থেকে মন্দার মোকাবিলায় চাহিদা বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ করলে এ বছর সংকট এত গভীর হত না৷ আর পুরো ফেব্রুয়ারি মাস মার্কিন প্রেসিডেন্টের অভ্যর্থনার আয়োজনে ব্যয় না করলে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাও একটু সময় পেত অতিমারীর মোকাবিলা করার৷
সংখ্যাতত্ত্বে ফিরতে ইচ্ছে করেনা , তবু একটি জরুরী তথ্য দেওয়া উচিত মনে হল। এই লেখা যখন শেষ করছি, ভারত সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মার্চ-জুন ২০২০ তে গত বছরের তুলনীয় সময়ের তুলনায় ভারতের জাতীয় উৎপাদন নেমে এসেছে ২৩.৯ শতাংশ। এত ভয়াবহ সংকোচন এদেশের অর্থনীতি কখনও দেখেনি। নির্মাণ শিল্পে অবনমন ঘটেছে ৫০ শতাংশ। ব্যবসা, হোটেল, পর্যটনে ৪৭ শতাংশ। একমাত্র কৃষি ও সম্পর্কিত ক্ষেত্রে উৎপাদন বেড়েছে ৩.৪ শতাংশ। যে দেশে প্রভূত বৈষম্য সত্ত্বেও উৎপাদন বাড়লে এক-চতুর্থাংশ মানুষ দারিদ্র্য রেখার নীচে বা ঠিক উপরে থাকেন, সেখানে এই অবনমন কী ভয়ংকর পরিণতি নিয়ে আসছে এই সব ক্ষেত্রের উপর নির্ভরশীল মানুষের জীবনে, তা ভাবলে উদ্বেগের শেষ থাকেনা। দেশের ভার যাঁদের হাতে তাঁদের কাছ থেকে কোনও আশ্বাসবাণী বা সমাধানসূত্র সাধারণ মানুষ এখনও শুনতে পায়নি।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply