• লকডাউন ও গ্রামের মেয়েরা


    0    297

    September 11, 2020

     

    আমফানের কয়েকদিন পরের ঘটনা। লকডাউন ওঠার পর সবেমাত্র গাড়িঘোড়া চলতে শুরু করেছে। পিয়ালির বাড়ি থেকে গেছিলাম বিজয়নগর — সুন্দরবনের বালি দ্বীপে বিজয়নগর গ্রামে এতকালের বাস আমার। বালিতে আমাদের বাড়ি ঘরদোর, আশেপাশের সবাই ঝড়ের পর কী অবস্থায় আছে এসব না দেখলে শান্তি পাচ্ছিলাম না। তবে গিয়ে মনে হল চেনা মানুষ, আত্মীয় প্রতিবেশীদের এমন অবস্থা দেখলে শান্তির চেয়ে অশান্তিই বাড়ে বোধহয়।

    জেঠিমার মুখেই শুনলাম, ম্যানগ্রোভের সঙ্গে কাঁকড়া পাওয়ার একটা যোগ রয়েছে। ঝড়ে নানা জায়গায় প্রচুর ম্যানগ্রোভ ভেঙে গিয়েছে বা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাই যারা নদীতে ‘সুৎ’ ফেলে কাঁকড়া ধরেন, সেখানে আর কাঁকড়া পাচ্ছেন না। শুধু কাঁকড়া কেন, সবরকম মাছের ব্যবসাই বেহাল এখন।

    যেমন আমার এক পাতানো জেঠিমা, বয়স ৮৫। একা থাকেন মেয়ের সাথে। গৃহহিংসার শিকার মেয়ে স্বামী-সংসার ছেড়ে মায়ের কুঁড়েতে টিকে থাকার লড়াই করছে গত বেশ কয়েক বছর ধরে। রোজগার বলতে কাঁকড়া বিক্রির পয়সা। এখানে অনেক মেয়েই নদীতে কাঁকড়া, চিংড়ি, অন্যান্য মাছ এইসব ধরে কিছু খাওয়ার জন্য রাখেন আর কিছু বেচে দেন সাপ্তাহিক বাজারে। তাতে যা আসে সেই দিয়ে পেট চলে তাঁদের। কিন্তু লকডাউন আর আমফান দুয়ের প্রকোপেই মেয়েদের এই মাছ বিক্রি প্রায় বন্ধ। জেঠিমার মুখেই শুনলাম, ম্যানগ্রোভের সঙ্গে কাঁকড়া পাওয়ার একটা যোগ রয়েছে। ঝড়ে নানা জায়গায় প্রচুর ম্যানগ্রোভ ভেঙে গিয়েছে বা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাই যারা নদীতে ‘সুৎ’ (স্থানীয় ভাষায় সুতো থেকে সুৎ) ফেলে কাঁকড়া ধরেন, সেখানে আর কাঁকড়া পাচ্ছেন না। শুধু কাঁকড়া কেন, সবরকম মাছের ব্যবসাই বেহাল এখন। এই জেঠিমারই এক ছেলের বউ, কথা হচ্ছিল তার সাথেও। স্বামীর সাথে সে যায় নৌকো নিয়ে জঙ্গলের ভেতরের দিকে, মাছ-কাঁকড়া ধরে আনে। কিন্তু লকডাউনের বাজারে সে পাট চুকেছে। প্রথমে পারমিশন ছিল না। তারপর যখন অনুমতি মিলল, দেখা গেল ঝড়ে ভেঙে গেছে নৌকো। সারানোর সংস্থানটুকু নেই তাদের। কেউ কেউ যদিবা সেটা পেরেছে, শেষ অবধি মাছেরই দাম পায়নি। কারণ এইসব চিংড়ি-কাঁকড়া মূলত চড়া দামে রপ্তানি হয় বিদেশের বাজারে। এই পরিস্থিতিতে সেসব এখন পুরোপুরি বন্ধ। স্থানীয় মানুষও টাকার টানাটানির মধ্যে দামী মাছ কিনে খেতে পারছেন না। ফলে আতান্তরে পড়েছে এই মেয়েরা। নিজের উদ্যোগে কেউ হয়ত গয়না বন্ধক রেখে, কেউ বা সেলফ হেল্প গ্রুপ থেকে টাকা ধার করে, কেউ আরো কয়েকজনের সাথে শেয়ারে শুরু করেছিল মাছের ব্যবসা। এমনিতে ভালো দামও পাচ্ছিল সুন্দরবনের নদীর চিংড়ি-কাঁকড়া। কিন্তু ব্যবসা মার খেয়ে এখন পথে বসেছে তারা। পাশাপাশি বেশ কয়েকটা ঘরের মেয়েদের মুখেই এই এক কথা। সংসার চলছে না একদিকে, তার ওপরে ধারাদেনার বোঝা।

    এই ছবিটা যে শুধু এই বালির কথা তা নয়। করোনা আর লকডাউন ঘিরে জীবিকাক্ষেত্রে মেয়েদের সমস্যার চরিত্রগুলো কাজ অনুযায়ী বদলেছে মাত্র। আসল ছবিটা একই। পিয়ালিতে দেখেছি বহু মেয়ের জীবিকা হাঁস মুরগি পালা। এরা ‘বন্ধন লোন’ বলে একরকম লোন নিয়ে মুরগির চাষ করে। বাড়ির সাথেই লাগোয়া কিছুটা জায়গায় মুরগি থাকার ঘর বানিয়ে নিয়ে চলছিল এই ব্যবসা। আগেও দেখেছি করতে, কিনেও খেয়েছি কখনো। কিন্তু করোনার সাথে সাথে করোনাকে ঘিরে সত্যি-মিথ্যে নানান জল্পনা যখন পাক দিয়ে উঠতে লাগল, মুরগি বিক্রি একেবারে বন্ধ হয়ে গেল এই মেয়েদের। মুরগির মাংস নিয়ে গুজবের জেরে দাম কমে গেল হু-হু করে। তারপর শেষ কোপটা দিল আমফান। যেখানে মানুষের বাঁচার উপায় ছিল না, হাঁস-মুরগি তো মরবেই, ধরেই নিয়েছিল সকলে। মুরগির নড়বড়ে ঘর উড়ে গেল ঝড়ের মুখে। ওষুধ আর খাবারের যোগানের অভাবে প্রচুর মুরগি মারাও গেল। ফলে এইমুহুর্তে লড়াইটা শুধু প্রতিদিনের পেট চালানোর নয়, কেউ জানেনা কীভাবে লোন শোধ করবে তারা।

    মুরগির মাংস নিয়ে গুজবের জেরে দাম কমে গেল হু-হু করে। তারপর শেষ কোপটা দিল আমফান। যেখানে মানুষের বাঁচার উপায় ছিল না, হাঁস-মুরগি তো মরবেই, ধরেই নিয়েছিল সকলে।

    চম্পাহাটি গার্লস হাই স্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্রী সুলেখার (নাম পরিবর্তিত) মা-ও নিয়েছিলেন বন্ধন লোন, এই লকডাউনের মধ্যেই। ব্যাগ কারখানায় কাজ করে সংসারের গুরুভাগ দায়িত্ব সামলাতেন তিনি। স্বামী মাঝে মধ্যে ভ্যান চালিয়ে, বা অন্য কিছু করে দুপয়সা আনলেও তাতে সংসার আর ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা চালানো দুষ্কর ছিল। তার উপরে ছিল স্বামীর অকথ্য অত্যাচার, মারধোর। শেষ পর্যন্ত এক বাড়ির মধ্যেই ছেলেমেয়ে নিয়ে আলাদা হয়ে গেলেন সুলেখার মা মিনু সরদার (নাম পরিবর্তিত)। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু হঠাৎ লকডাউনে তালা পড়ে গেল কারখানায়। উপায় না দেখে বন্ধন লোন নিয়ে স্বামীর হাতে সেই টাকা তুলে দিলেন সংসার খরচ হিসেবে। কিন্তু খুব অল্প সময়েই তাঁর স্বামী সব টাকা শেষ করে ফেলেছেন। এইমুহুর্তে খাওয়া-পরা, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ ছাড়াও মিনুর উপরেই এসে পড়েছে লোন শোধের দায়। বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে সুলেখাদের পড়াশোনা।   

    মেয়েদের রোজগারের আরেকটা বড় জায়গা চাষবাস। সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা থেকে মূলত বাড়ির পুরুষেরা বাইরে কাজে যান এবং মেয়েরা কখনো ভাগে কখনো বা বাড়ির লাগোয়া চিলতে জমিতেই ধান, সব্জি, দানাশস্য বোনেন৷ লকডাউনে সবজি বিক্রি মার খাচ্ছিলই। তার সাথে আমফানের ফলে পাকা ধান, অন্যান্য শস্য সবই তছনছ হয়ে যায়।

    লকডাউনের এই বছরে তুলনামূলকভাবে বীজ ধানের দামও অনেক বেশি৷ অন্যান্য বছরের তুলনায় কেজি প্রতি প্রায় ৩০ থেকে ৪০ টাকা দাম বেড়েছে। তাছাড়া সার আর ওষুধের দামও বেড়েছে৷ উভয় সংকটের এই পরিস্থিতিতে প্রাণপণে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সুন্দরবনের মেয়েরা।

    যাঁরা ঋণ করে ভাগে চাষ করেছিলেন, ঋণ পরিশোধের চিন্তা তাঁদের শুধু এই বছরের ক্ষয়ক্ষতি দিয়েই বিচার করলে চলবে না। যে সব এলাকাতে নদী বাঁধ ভেঙে জল ঢুকেছে, সেখানে আগামী দু-এক বছর কোনও চাষ হবে না৷ যেখানে বাঁধ ভাঙেনি, সেখানে এর মধ্যেই ধান চাষের জন্য বীজতলা ফেলা হয়েছে৷ কিন্তু লকডাউনের এই বছরে তুলনামূলকভাবে বীজ ধানের দামও অনেক বেশি৷ অন্যান্য বছরের তুলনায় কেজি প্রতি প্রায় ৩০ থেকে ৪০ টাকা দাম বেড়েছে। তাছাড়া সার আর ওষুধের দামও বেড়েছে৷ উভয় সংকটের এই পরিস্থিতিতে প্রাণপণে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সুন্দরবনের মেয়েরা।

    এ তো গেল গ্রামাঞ্চলের কথা। শহরতলি এলাকাগুলোতেও শ্রমজীবি মেয়েদের দুর্দশার নজির ছড়িয়ে রয়েছে। কাজের ধরন আলাদা, কিন্তু পরিস্থিতির শিকার এই মেয়েরাও। বেশিরভাগ মেয়েরাই লোকাল ট্রেনে যাতায়াত করে কলকাতায় গৃহ-পরিচারিকা বা রাঁধুনি হিসেবে, কেউ বা গেঞ্জি কারখানা, ব্যাগ কারখানায় কাজ করত৷ গোটা পরিবার তাকিয়ে থাকত এই রোজগারের দিকে। লকডাউনে ট্রেন বন্ধ, বন্ধ কারখানাগুলোও। ফলে গত কয়েকমাস কাজও বন্ধ এঁদের৷ বাড়ির আশেপাশে ছোট জায়গায় নিজেদের কোনোমতে চলে যাওয়ার মত সব্জি চাষ করেছিলেন কেউ কেউ, তাও আমফানের ফলে নষ্ট৷ এখন শুধু ত্রাণ বা অনুদানের আশায় বসে থাকা, একবেলা না খেয়ে, কখনও আধপেটা খেয়ে বাচ্চার মুখে খাবার তুলে দেওয়া, এটাই পরিস্থিতি বেশিরভাগ পরিবারে। এরকম চলতে থাকলে আরও বেশি করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে কি এঁদের?

    পরিবার-সমাজের বিধিনিষেধ কিম্বা অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তাদের স্বনির্ভর হয়ে ওঠার লড়াই লকডাউন আর আমফানের পরপর ধাক্কায় এখন ধসে পড়ার মুখে।

    লকডাউনে কাজ হারিয়েছে পুরুষ মেয়ে সকলেই, কিন্তু সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বোধহয় মেয়েদের। পরিবার-সমাজের বিধিনিষেধ কিম্বা অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তাদের স্বনির্ভর হয়ে ওঠার লড়াই লকডাউন আর আমফানের পরপর ধাক্কায় এখন ধসে পড়ার মুখে। গ্রামের মধ্যেই নানা জীবিকার সংস্থান করে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার মুখ দেখেছিল তারা। কিন্তু জীবনধারণের সব উপায়গুলোই একে একে কেড়ে নিল লকডাউন আর আমফান। আর চিরকালের মতই সেই ব্যর্থতার দায়ও একাই বয়ে নিয়ে চলতে হচ্ছে মেয়েদের। পেটে খাবার নেই, ধারদেনায় জর্জরিত, অভুক্ত শিশু ও পরিবার, তার উপরে রয়েছে অভাবের তাড়নায় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া পারিবারিক অশান্তি, মারধোর, অত্যাচার। পায়ের তলার মাটি ফিরে পেতে আবার নতুন করে লড়াই শুরু করতে পারবে তো সুন্দরবনের মেয়েরা?

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics