• মেয়েটি বড্ড চালাক, হিন্দু ছেলে ভাগিয়ে এনেছে


    0    250

    December 26, 2020

     

    ধরেই নেওয়া হয়েছিল মুসলিম মেয়েটি বড্ড চালাক, হিন্দু ছেলে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে। একজন মহিলা মালিক বাড়ি ভাড়া দিতে চেয়েছিল। শর্ত ছিল একটি। মেয়েকে সিঁদুর পরতে হবে। স্বামী হিন্দু মানে স্ত্রীও হিন্দু।

    সালটা ১৯৯৯। এলাকা সন্তোষপুর। ধর্মের ঠেকাদারদের বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে এক ছাত্র দম্পতি। একজন কলা বিভাগে স্নাতকোত্তর চূড়ান্ত পরীক্ষায় বসেছে। অন্যজন এমবিবিএস-এর। বিয়ে করেই হোষ্টেল থেকে বাড়ি খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু বইয়ে তো সব লেখা থাকে না। বাইরের বাস্তব দেখে আক্কেল গুড়ুম দুজনের। সারাদিন হন্যে হয়ে ঘুরেই চলেছে। কিন্তু বাড়ি আর মেলে না। ভাড়া না পেয়ে নাকাল যুবক-যুবতী। তাদের কেউ বিশ্বাসই করে না। বিবাহিত সেটাই মানে না।। আবার কেউ কেউ নাম শুনে চোখ নাচিয়ে ‘না’ করে দেয়। আসল মুশকিলটা ছিল ইন্টারফেইথ ম্যারেজ নিয়ে। ধরেই নেওয়া হয়েছিল মুসলিম মেয়েটি বড্ড চালাক, হিন্দু ছেলে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে। একজন মহিলা মালিক বাড়ি ভাড়া দিতে চেয়েছিল। শর্ত ছিল একটি। মেয়েকে সিঁদুর পরতে হবে। স্বামী হিন্দু মানে স্ত্রীও হিন্দু। অবশেষে সব বিপ্লবের সূর্য পশ্চিমাকাশে ডুবিয়ে দুইজন ছেলে-মেয়ে বিবাহবন্ধনের সোনালি ডোরটাকে আঁকড়ে ধরেছিল।

    অন্য ধর্মে বিয়ের কারণে আত্মীয়স্বজন হতাশ ও নিরুৎসাহ হয়ে পড়ে। মন্তব্য আসে—মুসলিম সমাজে ছেলে নেই? অনেকে আবার বলে, কালো মেয়ের বিয়ে হবে না তাই । বাবা খুব সেকুলার মানুষ। মৌলালীতে রেজিষ্ট্রি হবে জেনে নিজেই হবু জামাই এর জন্য সুন্দর এক ঘড়ি কিনে পাঠিয়েছিলেন। মা-বাবা দুজনেই খুব খুশি হয়েছিলেন রামকৃষ্ণ মিশনে পড়া ভালো ছাত্র ও মেডিক্যাল স্টুডেন্টকে পরিবারে পেয়ে। ধর্ম নিয়ে আমাদের পারিবারিক ভাবনা ছিল অন্য। বিয়েতে ধর্মের কী ভূমিকা থাকতে পারে তা কখনও আলোচনাতেই আসেনি! বিবাহ দুটি ইন্ডিভিজ্যুয়ালের হয়। নিজেকে ভালো রাখার জন্য বিবাহ প্রতিষ্ঠান। ভালো না থাকলে বেরিয়ে যাওয়ার উপায়ও বিদ্যমান। জন্ম-জন্মান্তরের বাঁধন বা দুটি পরিবারের আত্মিক সম্পর্ক বা স্বামী সম্মানীয় এমন সব ভ্রমে আস্থা ছিল না আমার। বিয়েতে মুখ্য দুজন মানুষের চিন্তাভাবনা, টিকে থাকার মানসিকতা ও পারস্পরিক সম্মান। ধর্ম এক হোক বা আলাদা হোক তা দিয়ে কিছু নির্ধারিত হয় না। বিবাহ ও বিচ্ছেদে ধর্মের কোনও ভূমিকা থাকার কথা নয়। আমি জানতাম । বিশ্বাসও করতাম । তাই পাত্রের ধর্ম আমার কাছে খুব গৌণ বিষয় ছিল।

    এই বিষয়ে ‘আগের থেকে কমেছে’ বলে শব্দ হয় না। সভ্য সমাজের একটি মানুষ যদি তার পছন্দের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় শুধু ধর্মের কারণে, তবে সেটা সভ্যতার সামগ্রিক লজ্জা।

    কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া হয় ছেলের বাড়িতে। শোনামাত্র বাবা একমাত্র ছেলের শ্রাদ্ধ ঘোষণা করে দেয়। ত্যাজ্যপুত্র ও বাবার চোখে জীবন থেকে মুক্তি পাওয়া সদ্য ডাক্তারি পাশ করা ছেলে আশ্রয় নেয় অন্যত্র। সময় সব সংকট থেকে মুক্তি দেয়। কিন্তু সত্য কি আর সরলরেখায় চলে সবসময়? ছেলের বাড়ি থেকে খবর আসে পরিবারের মেয়েদের বিয়ে ভাঙছে। কারণ এক ছেলে মুসলিম মেয়ে বিয়ে করেছে। শুধু তাই নয়, এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায় ছেলের বাবাকে জল নিতে দেওয়া হবে না। মরে গেলে দেহ কাঁধে নেবে না গ্রামের কেউ। মুসলিম মেয়েকে তাই বৌ হিসেবে মেনে নেওয়া মানে এইরকম সামাজিক প্রতিরোধের মুখে পড়া। সেইজন্যই আপত্তি এত প্রবল। মুসলিম মেয়েকে ছেলের বৌ হিসেবে স্বীকার করে দিনে দিনে অপমানিত হয়ে মরার চেয়ে তো অস্বীকার করে রেহাই নেওয়ায় অনেক শান্তি!  

    পরের পর্ব আরও মর্মান্তিক। সেই ডাক্তার ছেলে কন্যা সন্তানের পিতা হল। পরের প্রজন্ম শ্মশানের মরা শিউলি গাছের মত নাম—গোত্রহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল। স্বীকৃতি দিল না বাবার পরিবার। মেয়ের আর পৈতৃক ভিটা দেখা হল না। কাউকে জানানোই গেল না এই ইন্টারফেইথ ম্যারেজের সামাজিক বিদ্রোহ থেকে এক ফুটফুটে সন্তানও জন্মেছে। সে কোন ধর্মের তা নিয়েও চলল জোর তরজা। অনেকে বলে দিল, বাবার ধর্মই মেয়ের ধর্ম। আবার ছেলের বাড়ি থেকে শোনা গেল মুসলিম ঘরে বড় হলে কন্যা কি আর হিন্দু থাকবে? সেও তো মুসলিম হয়ে গেল! ছেলের বাড়িতে তবে আর কোনও অধিকারই রইল না! আশ্চর্য মানুষের বিশ্বাস। আশ্চর্য অধিকারের সংজ্ঞা।

    ১৯৮১ সাল। বাইরে বেরোলে মা মাথায় সিঁদুর লাগাতেন। অমুসলিম এলাকায় নিজের স্বাছন্দ্য খুঁজতে এর চেয়ে বড় অস্ত্র কিছু ছিল না মায়ের হাতে। শুধু তাই নয়, আমাদের জল, মাসি-পিসি এমন কিছু শব্দ অনুশীলন করাতেন প্রতিদিন। আত্মীয়দের বারণ করতেন আমাদের সামনে যেন পানি, খালা-ফুফু না বলা হয়।

    ২০২০ সাল। এমবিবিএস-এর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী বাড়ি ভাড়া খুঁজতে গিয়ে হোঁচট খেল। দরজার বাইরে তাকে প্রশ্ন করা হল—‘মুসলিম’? না বলার পরেই কথা শুরু। ছাত্রীটি আমার পরের প্রজন্ম। আমাদের সন্তান।

    মা, আমি ও আমার মেয়ে প্রত্যেকেই ধর্মের কারণে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়েছি। শুধু জায়গা আলাদা। সময় আলাদা। অপমানের ভাষা আলাদা। দেখার লেন্সটা আলাদা। অনেকেই বলেছেন—‘কই না তো! আমরা তো  মুসলিমদের সঙ্গে মিশি, খাই!’ এই অবিশ্বাসটা আরও মারাত্মক। অস্বীকারটাও দায়িত্বহীন। সত্যটা সেই শাশ্বত। মানুষের মধ্যে তৈরি করা একটা ফাঁক আছে। মেরামত করা যায়নি। তাই তো বিভেদকামীদের এত শক্তি সময়ে ফুলেফেঁপে ওঠে। এই বিষয়ে ‘আগের থেকে কমেছে’ বলে শব্দ হয় না। সভ্য সমাজের একটি মানুষ যদি তার পছন্দের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় শুধু ধর্মের কারণে, তবে সেটা সভ্যতার সামগ্রিক লজ্জা। সেই লজ্জার দায় আমাদের সকলের হয়ত। পরপর তিনটি প্রজন্ম। টাইমমেশিনে বসে সমাজটার দিকে দেখলে প্রশ্ন আসে, সত্যি কি কিছু বদলেছে?

    রাষ্ট্রের আইনবিধি যদি দুই মানুষকে জুড়তে না পারে তবে ভাঙতে দেওয়ার ক্ষমতা কেন দেওয়া হবে ?   

    সেই একুশ বছরে নিয়ম ভাঙা মেয়েটি প্রায় দুই যুগ পেরিয়ে এসে দেখে ঈশান কোণে অশনি সংকেত। বিশ্বে কত কিছু বদলে গেছে। শুধু মানুষে মানুষে ঘৃণাটাই চাগিয়ে রাখা হয়েছে। জিনাত রেহেনা ইসলাম নামটি শুধু তাকে অস্বস্তিতে ফেলেছে তা নয়। দেখা হয়নি শ্বশুর বাড়ি। মেলেনি পছন্দের জায়গায় ফ্ল্যাট। ভাড়া নিতে গিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে খাদ্যতালিকা নিয়ে। নজরুল ইসলামের আত্মীয় নয় এ সাফাই দিতে হয়েছে হাজার বার। হোস্টেলে সরস্বতী পুজোর সময় ঠাকুর কেনার তালিকা থেকে নাম বাদ গেছে। পাড়ার খেলা থেকে বাদ পড়তে হয়েছে। পাড়ার সকলের সঙ্গে বসে টিভি দেখার অনুমতি মেলেনি। কিছু ক্ষেত্রে নেমন্তন্নও মেলেনি। এমনকী ছুঁয়ে দিলে স্নান করতে হবে এমনও শুনতে হয়েছে। এইরকম কিছু ঘটনার সাক্ষী সে হয়ে রয়েছে যা শুধু বুকের ক্ষতকে গভীর করে। টানা একবছর সিঁদুর পরে কাটানোর পর কলকাতা থেকে বাড়ি ফেরা। সিঁদুর আর খাদ্যতালিকায় ধর্মের খোঁজ শুরু করলে মানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় বিড়ম্বনা আর থাকতেই পারে না।

    ধর্ম কোনও ছায়া নয়। বাস্তব। মানুষের শক্তিশালী নির্মাণ। সুখে দুঃখে সর্বসংকটে মানুষকে ধারণ করার বদলে এভাবে ছুঁড়ে ফেলার অভিজ্ঞতা অর্জন খুব মর্মান্তিক। দরকার ছিল এই দুর্বল জায়গার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ। কিন্তু প্রকান্ডের সামনে সকলেই মাথা নিচু করে পালিয়ে আসতেই অভ্যস্ত ছিল। কেউ পাশে দাঁড়িয়েছে মনে পড়ে না। কেননা লড়াইটি সেই ডাক্তার ছেলের বাবার সঙ্গে নয়। ছিল এক প্রকাণ্ড ছাতার সঙ্গে। সেই ছাতাচ্যুত হতে কেউ সাহস করেনি। জীবন তবু এগিয়েছে। অনেকের কুঞ্চিত ভ্রূ, সন্দেহের চাহনি উপেক্ষা করে ভালোবাসা জিতেছে। একজন মানুষের আরেক মানুষের কাছে আসার শক্তিতে বাঁধ দেওয়া সত্যিই খুব কঠিন। বিবেকের ধর্মই মানবিকতার বড় সম্পদ। সেখানে ধর্মের হানাহানি শেষমেশ পরাস্ত সৈনিক। নিজেদের অস্তিত্ব সততার সঙ্গে বাঁচিয়ে রাখার ধর্মই জীবনের সবচেয়ে বড় ধর্ম। আর সেটা ‘সারনেম’ দেখে হয় না। হয়নি। হয়ত হবেও না। তবে রাষ্ট্র যদি বেড়ি পরায়, সামনের দিন খুব কঠিন! মানুষের শিক্ষা ও বোধকে অন্য খাতে বইয়ে দেওয়ার শক্তি রাষ্ট্র রাখে। সেখানে বিভাজনের দাগটা গাঢ় করা সহজ। তাই প্রয়োজন সতর্ক ও অনুসন্ধানী দৃষ্টির। মানুষের হাতে মানুষ হাত রাখবে। রাষ্ট্রের আইনবিধি যদি দুই মানুষকে জুড়তে না পারে তবে ভাঙতে দেওয়ার ক্ষমতা কেন দেওয়া হবে?    

                      

                       

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics