যারা গ্রহণ করেছে, তারাই আমাদের সমাজ
1 239রাহীর কথা
মনে পড়ে প্রত্যেক বছর পুজোর ছুটিতে মামাবাড়ি বেড়াতে যাবার কথা। তখনও বাঁকুড়ার দূর গাঁয়ে বিজলিবাতির চল নেই, কুপী ও লন্ঠনের আলোয় কাটত রাত। কখনও বা তাও নয় – বাড়ির উঠোনে ভরা চাঁদের আলোয় রাত জেগে খাটিয়ায় হেলান দিয়ে গপ্পো ছুটত বহু দূর। বড়দের কুদুম-রে-কুড়িৎ-কুড়িৎ-এর ধাঁধা-হেঁয়ালির খেলায় ছোটদের হাসির রোল উঠত। এ বিষয়ে সমীরদাদার ছিল অশেষ দক্ষতা। প্রতিনিয়ত তাঁর ঝুলি থেকে বেরিয়ে আসত হরেকরকম ধাঁধার ভোজ আর আমরা ছোটরা বেবাক বিস্ময়ে গোগ্রাসে গিলে ফেলতাম সব। একবার মামাবাড়ি গিয়ে জানতে পারলাম, সমীরদাদা আর সেখানে থাকে না। অনেক চেষ্টা করেও তাঁর খোঁজ পেলাম না কোথাও। বড়দের জিজ্ঞেস করতে বুঝলাম সকলেই তাঁর কথা বলতে নারাজ।
খ্রিস্টান পরিবারের মেয়ে মেরীকে সারি ধর্মাবলম্বী সমীরদাদা সঙ্গীরূপে গ্রহণ করলেও তা মানতে পারেনি সাঁওতাল পল্লীসমাজ। দাদার আর কোনদিন গ্রামে ফেরা হল না।
বেশ কিছু বছর পর আর একটু বড় হয়ে জানতে পারলাম যে মেরীবৌদিকে বিয়ে করবার কারণে দাদাকে গ্রাম ছাড়তে হয়েছে। খ্রিস্টান পরিবারের মেয়ে মেরীকে সারি ধর্মাবলম্বী সমীরদাদা সঙ্গীরূপে গ্রহণ করলেও তা মানতে পারেনি সাঁওতাল পল্লীসমাজ। দাদার আর কোনদিন গ্রামে ফেরা হল না। মেরীবৌদির চাকরি সূত্রে বর্ধমান শহর হয়ে উঠল তাঁদের নতুন ঠিকানা। শহরের সার্বজনীন পরিসরে ব্যক্তিপরিচিতি পেল একটি নতুন রূপ। তাঁদের দুজনের সংসারে ব্যক্তিগত ধর্মকে ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠল তাঁদের একে অপরকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নেওয়ার অঙ্গীকার।
এই সব অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই হলদিয়া উপনগরীতে আমার বেড়ে ওঠা। হলদিয়ার পরিসর ছোট হলেও ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানাবিধ মানুষ এখানে কাজের সন্ধানে একত্রিত হন। আর তাঁদের সাথে আসে তাঁদের পরিবারও – গড়ে ওঠে অনেক নতুন ধর্মনিরপেক্ষ সম্পর্ক। খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলের ক্যাম্পাস তখন আমাদের জীবনের কেন্দ্রস্থল। আমাদের হেডমাস্টার ফাদার জেকব, সিস্টার সিলিন, হিন্দির শিক্ষিকা মিস সরেন, অস্ট্রেলিয়ার রদরিক স্যার – এনাদের অনুপ্রেরণায় আমাদের বেড়ে ওঠা। তবে স্কুলে বড়দিনের উৎসব অথবা পাড়ার সরস্বতী পুজোয় সামিল হলেও, বাড়িতে বাহা, সহরায়, সাক্রাত – এই সব সাঁওতালি উৎসবের কথা মনে করিয়ে দেওয়া হতো। আর পাড়ার ক্লাবে গুরু গঙকে পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু-র জন্মবার্ষিকীও পালন করা হত নিয়মিত। এ হেন পরিবেশে বড় হয়ে ওঠার দরুন ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন ধারার সংস্কৃতির সাথে সম্বন্ধ স্থাপন করা সহজ হয়েছে। পরিবার থেকেও উৎসাহ দেওয়া হয়েছে প্রতিটি উৎসবে সামিল হবার।
মেয়েরা আবার সঙ্গী বাছবে কী! পড়াশুনো করে চাকরি পেলেও – সঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকার মেয়েদের নেই।
এহেন স্কুলজীবন হলদিয়াতে কাটলেও, উচ্চশিক্ষার সূত্রে কলকাতায় আসা। নতুন শহর, নতুন ঠিকানা, নতুন বন্ধুবান্ধবদের চেনা ও জানার উৎসাহ তখন তুঙ্গে। কলেজের হোস্টেলে এসে পরিচিত হই নানা বয়সের বন্ধুদের সাথে, জানতে পারি তাদের নানান সম্পর্কের অভিজ্ঞতা। লক্ষ্য করি সকলের মনেই একটি আশঙ্কা দানা বাঁধছে – তাদের মনোনীত সঙ্গী পরিবারে সমাদর পাবে কি না!
যেখানে আলোচ্য বিষয় সঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকার, সেখানে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যার সঙ্গী তারই নির্বাচন - এটাই খুব স্বাভাবিক, তাই না? আমার সঙ্গী, আমি ছাড়া কার বেছে নেওয়ার বা দেওয়ার অধিকার আছে? কিন্তু দুঃখের বিষয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের দেশে সঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকার থাকে না – বেছে দেওয়া হয়। বেছে দেবে কে? মা, বাবা, পরিবারের বয়স্করা, যারা মেয়ে বা ছেলের ভাল চান, তাঁরা সকলে। তাই বিয়ের বয়স হলেও, সঙ্গী বেছে নেওয়ার বয়স ছেলে বা মেয়ে কারোরই হয়ে ওঠে না। আসলে, বিয়ে ব্যাপারটায় দুই মানুষের থেকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় পরিবারের ‘কল্যাণ’ এর ওপর। কিন্তু সত্যি কি তাই? আমরা সকলেই কম বেশি জানি এই ‘পরিবারের কল্যাণ’-এর নামে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কত যে অসংখ্য অন্যায় হয়ে চলেছে, তার ইয়ত্তা নেই। এবং এই অত্যাচারের সম্মুখীন হয় বিশেষ করে মেয়েরা। বেথুন কলেজে ক্লাসের পড়ার বাইরেও আলাদা করে পরিচিত হই নারীশিক্ষার ইতিহাসের সাথে, জানতে পারি আমাদের দেশের সামাজিক অসাম্যের কথা। যেহেতু মেয়েরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এখনো পিছিয়ে, এখনো শিক্ষার সুযোগ, চাকরির সুযোগ বা কাজের জায়গায় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মাত্র – তাই তাঁদের অনেক সংগ্রামের সম্মুখীন হতে হয় প্রতিনিয়ত। তাছাড়া এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে, মেয়েরা আবার সঙ্গী বাছবে কী! পড়াশুনো করে চাকরি পেলেও – সঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকার মেয়েদের নেই।
ব্যক্তিগত জীবনে নিজের সঙ্গী নির্বাচন করতে গিয়ে কতবার এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে – সমধর্মীয় পেলে না কাউকে? অথচ এহেন প্রশ্নের জবাব দেয় কে! তাই পরিবারের খুব একটা উৎসাহ না থাকলেও পেয়েছি মাস্টারমশাইদের ভালবাসা, ব্যাঙ্গালোর থেকে ছুটে এসেছে স্কুলের বন্ধু সন্তোষ, এবং আমাদের ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশনে সাক্ষী থেকেছে আমার বোন জিহু, শান্তনুর মা-বাবা, বন্ধু সোনালি, নঈম ও বিত্তুরা।
‘Adiwasi Motivational Video’ নামক ইউটিউব চ্যানেল, যার একাধিক ভিডিওতে লোকশিক্ষা দেওয়া হচ্ছে যে কীভাবে সঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকার প্রয়োগ করে মেয়েরা ভুল পথে চালিত হচ্ছে।
সম্প্রতি ভিনধর্মীয় সঙ্গী নির্বাচন করায় সমাজে ‘জল ঘোলা’ করার অভিযোগে সামাজিক হেনস্থা হতে হয়েছে শুধুমাত্র মেয়ে বা ছেলেটিকে নয় - তার পরিবারের সদস্যদেরও। সাঁওতাল সমাজ, যতই সহনশীল এবং সংবেদনশীল বলে নিজেকে দাবী করুক না কেন, সর্বোপরি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। সঙ্গী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিবারের ওপর সামাজিক চাপ তৈরি করে মানসিক টানাপোড়েন। আমার পরিবারেও লক্ষ্য করেছি এই চাপা উদ্বেগ। সেই আতঙ্কের ছায়া মনে করিয়ে দেয় ছোটবেলার সেই সমীরদাদার কথা। মাঝখানে এই গণতান্ত্রিক দেশের ইতিহাসে তিরিশটা বছর পার হয়ে গেলেও পাল্টায়নি অনেক কিছুই। সাঁওতাল জীবনে ‘দিকু’ সঙ্গী নির্বাচনের ইতিহাস দেখলে জানা যায় ‘বীতলাহা’ নামক প্রথার কথা, যার বিশদ বিবরণ মিলবে ডব্লু জি আর্চার রচিত ট্রাইবাল ল অ্যান্ড জাস্টিস (১৯৮৪) গ্রন্থটিতে। এই ক্ষেত্রে মেয়ে বা ছেলে, যারা ভিনধর্মীয় মানুষকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে, তাদের শ্রাদ্ধ করার উদাহরণ দেখতে পাই। তাকে সমাজচ্যুত করা এবং পরিবারকে অপদস্থ করাই তার মূল উদ্দেশ্য। শুধু তাই নয়, দিকু সমাজকেও জানান দেওয়া – ‘আমাদের মেয়ে’কে কলঙ্কিত করবার খেসারৎ দিতে হবে। ইদানিংকালে দেখা যাচ্ছে যে এই রীতি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র মেয়েদের ওপর প্রযোজ্য। ইউটিউব এবং ফেসবুক হয়ে উঠেছে এই গোত্রীয় নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক বিচারের কেন্দ্রস্থল। গড়ে উঠেছে ‘Adiwasi Motivational Video’ নামক ইউটিউব চ্যানেল, যার একাধিক ভিডিওতে লোকশিক্ষা দেওয়া হচ্ছে যে কীভাবে সঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকার প্রয়োগ করে মেয়েরা ভুল পথে চালিত হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে উঠেছে ‘বীতলাহা’-র নতুন আখড়া।
অবশ্য এর সাথে মনে রাখতে হবে অসম সমাজব্যবস্থায় দীর্ঘ শতাব্দীর শোষণ এবং শোষিত হওয়ার ইতিহাস, লাঞ্ছিত হওয়ার ইতিহাস, অসম্মানিত হওয়ার ইতিহাস বিদ্যমান। এ ইতিহাস কারো অজানা নয়। দিকু সমাজে সাঁওতাল সম্বন্ধীয় ধারণা ও সাঁওতাল সমাজে দিকুদের অবস্থান বিস্তর সমস্যাযুক্ত। এরকমটা কেন? হয়ত নতুন প্রজন্ম ইতিহাসের বোঝায় ভারাক্রান্ত। হয়ত প্রান্তিক মানুষের পীড়া এখনও মূল স্রোতের কণ্ঠস্বরে চাপা পড়ে যাচ্ছে। এর দায় কার? অবশ্যই কিছুটা দায় সমাজের এবং সেই সমাজের প্রতিনিধিদের—যারা মেগাসিরিয়ালের বাহা চরিত্রকে ‘আদর্শ সাঁওতাল নারী’ রূপে তুলে ধরে, বা সাঁওতাল বলতে বার বার মনে করিয়ে দেয় ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র দুলিকে। এই এক ও অপর-এর বাঁধাধরা গতের ঘেরাটোপ যেদিন আমরা ভাঙতে পারব, সেদিন সঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকার যথার্থ ভাবে সক্রিয় হয়ে উঠবে।
শান্তনুর কথা
রাহীর সাথে আমার আলাপ হয় যোগমায়া দেবী কলেজের প্রফেসরস রুমে। আমি যোগমায়া দেবী কলেজে যোগদান করি ২০১০ সালের অগাস্ট মাসে, ইংরেজি বিভাগের আংশিক সময়ের শিক্ষক পদে। রাহী কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সাথে যুক্ত হয় ২০১৫ সালে, সহকারী অধ্যাপক পদে। যোগমায়া দেবী কলেজের প্রফেসরস রুমের প্রশস্ত পরিসরে, যেখানে করিবর্গা দেওয়া বিরাট জানালাগুলি খুলে দিলেই যতীন দাস পার্কের সবুজ মাঠ হাতছানি দিয়ে ডাকে, সহকর্মীদের নিত্য কলকলানিতে মনখারাপ টেঁকে না মুহূর্তমাত্র, একদিন সেইখানেই রাহী এসে উপস্থিত হল। অতঃপর ছাত্রী ভর্তির কার্যক্রমে, রিসার্চ কমিটির বৈঠকে, চায়ের ঠেকের আড্ডায় শুরু হল নিত্য আনাগোনা। সাহিত্য থেকে বিজ্ঞান, ডিকেন্স থেকে ডারউইন, বাংলা থেকে সাঁওতালি, ব্রাহ্মীলিপি থেকে অলচিকি – তখন চায়ের কাপে তুফান উঠল। ক্রমে ক্রমে আলাপের বিস্তার ঘটল গানের জলসায়, সরোবর বুক ক্লাব এর জমায়েতে, হাজরা রোড থেকে মিডলটন রো-এর দীর্ঘ পথচলায়।
দুজনেরই ব্যক্তিগত জীবনে তাই সারি ধরম ও হিন্দু প্রথার সাথে পরিচয় ঘটলেও, আমাদের মা-বাবার সংসারে ও আমাদের নাগরিক জীবনযাপনে ধর্মীয় আচার-বিচারের সার সত্য একটাই – পরব উদযাপনের ভোজ।
রাহী ও আমার আলাপচারিতার অনেকটা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আমাদের শৈশব, স্কুলের স্মৃতি, বেড়ে ওঠা ও নব্বইয়ের জীবনযাপন। রাহীর বড় হয়ে ওঠা হলদিয়া, লেখাপড়া সেণ্ট জেভিয়ার্স স্কুল, হলদিয়া। আর আমি যাকে বলে ‘বর্ন অ্যান্ড ব্রেড ইন কোলকাতা’! কিন্দেরগারতেন থেকে ক্লাস টুয়েলভ সেণ্ট থমাস বয়েজ স্কুল, খিদিরপুর। একে অপরকে চিনতে গিয়ে জানতে পারলাম যে মিশনারি স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের ভৌগোলিক দূরত্বকে অচিরেই মিটিয়ে ফেলেছে। তাই ঈশ্বর বলতে যীশু আর মন্ত্র বলতে “Our Father who art in heaven” - তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা। দুজনেরই ব্যক্তিগত জীবনে তাই সারি ধরম ও হিন্দু প্রথার সাথে পরিচয় ঘটলেও, আমাদের মা-বাবার সংসারে ও আমাদের নাগরিক জীবনযাপনে ধর্মীয় আচার-বিচারের সার সত্য একটাই – পরব উদযাপনের ভোজ। তাই সত্যনারায়ণের সিন্নি, দোলের মালপোয়া, বিজয়ার নিমকি-নাড়ু, সরস্বতীপুজোর খিচুড়ি-লাবড়া, কালীপুজোর নিরামিষ মাংস, ঈদের গোস্ত ও বড়দিনের কেক এবং রোষ্ট – এই হল আমার ধর্মীয় জীবনের ফিরিস্তি। সংস্কৃতির অনুষঙ্গ বাদ দিলে, সরকারি ফর্মে ‘রিলিজিয়ন’ বলতে যা লেখা হয় এ জীবনে তার লেশমাত্র খুঁজে পাওয়াটাই বিড়ম্বনা। অতএব আমাদের মেলামেশায় ও জীবনচর্চায় ধর্মাশ্রিত সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা, সঙ্গীত, সমাজনীতি, আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে বিস্তর আলোচনা হলেও ধর্ম বিষয়টি যে খাবারে নুন-এর পরিমাণের মত একান্ত ব্যক্তিগত নির্বাচন – এই বিষয়ে আমাদের জোট দুধ-আম জুটিকেও পাল্লা দিতে পারে।
তবে দুধে ছানা কাটবার উপক্রম হল যখন আমরা একে অপরের দোসর হয়ে বুঝলাম যে ইনসিওরেন্স-এর সার্টিফিকেটে ও ব্যাঙ্কের খাতায় স্রেফ বন্ধুগুণে নমিনি হওয়া যায় না। চটজলদি সমাধান হাজির হল – ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন। রাহীর তৎপরতাতেই পরিচিত হলাম দ্য স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট ১৯৫৪-র সাথে। এই বিশেষ বিবাহ আইন অনুসারে তথাকথিত আন্তঃজাতি এবং আন্তঃধর্ম বিবাহগুলিকে সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আরো বুঝলাম, এতদিন দেখা হলেই যে সব আত্মীয়স্বজনেরা গবেষণার খোঁজ করত, জানতে চাইত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার হালহকিকত – অকস্মাৎ দিকভ্রান্ত পথিকের মতো তাদের সকলের মনে তখন অন্তহীন জিজ্ঞাসার উদয় হল। যদিও সঙ্গীদের মধ্যে একে অপরকে করা প্রশ্ন এবং উত্তরের দায়বদ্ধতা একান্তই তাদের নিজেদের, কার জিজ্ঞাসা গুরুত্বের দাবী রাখে এবং কারটা নয় – এই বিভাজনটি গোড়াতেই গড়ে নিলে সঙ্গীদের পারস্পরিক বোঝাপড়া কায়েম থাকে। ততদিনে আরো ঘনিষ্ঠভাবে পরিচয় ঘটেছে মঞ্জুশ্রী ভট্টাচার্য ও বরকা সোরেন, অঞ্চিতা ঘটক ও রাজা মেনন, রোসিনা আহমেদ ও মনীষ মুকুল ঘোষদের সাথে। তাই অগ্রগণ্য বন্ধুদের সঞ্চিত অভিজ্ঞতার পথ বেয়ে শুরু হল আমাদের পথ চলা। যোগমায়া দেবী কলেজের আদরের দিদিরা কচিকাঁচা সহ হৈহৈ করে নিয়ে গেল ডেনমার্ক টাভার্নে, বিলিতি মেনু সহযোগে দিশি প্রথায় আইবুড়োভাত খাওয়াতে। পরম বন্ধু গূল্লূ এবং বীট্টূরা মিলে রাহীকে কিনে দিলো রেশমের শাড়ি, আমার জুটল সাফারি স্যুট।
সিদ্ধান্ত হল, আমাদের স্বল্প সঞ্চয়ের সামর্থ্যে বন্ধুদের জমায়েতে হবে আনন্দ উদযাপন। সোনালিদি ও অরুণাভদা এসে হাল ধরলেন। রাহী ও আমার মাস্টারমশাইরা নিলেন তদারকির ভার। আমাদের বন্ধু নিশা তামাং এলো বাখু পরে, সন্তোষের পরনে উঠল শেরওয়ানি, জিহু মেখলা-চাদর সেলাই করিয়ে নিয়ে এলো। সঞ্জনা ও শুভ্র যথাক্রমে ঠুমরী গেয়ে এবং গিটার বাজিয়ে সকলের মন জয় করে ফেলল। ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান ক্লাবের সদস্যরা আপ্যায়নের ত্রুটি রাখলেন না।
মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়ির মেয়ে চন্দনার সাথে মূলত কৃষিজীবী পরিবারের ছেলে উত্তমের বিবাহে খুব বড় বাধা হয়ে উঠেছিল শ্রেণিবৈষম্য। আমার দাদামশাই তদানীন্তন বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনের হোতা এবং সাংস্কৃতিক জগতের একনিষ্ঠ কর্মী হওয়া সত্ত্বেও নিজের মেয়ের এহেন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি চট করে।
আর আমার মা এবং বাবা এই ভেবে ভারি মুশকিলে পড়ল যে ছেলে-বউমার সৎকারস্বরূপ তাদের মোটেও যথেষ্ট করা হয়ে উঠল না! এতে অবিশ্যি মনেতে তাদের খুশির জোয়ারে টান পড়ল না একরত্তি, কারণ তাদের একে অপরকে নির্বাচনের আখ্যানটিও যে ঠিক সিনেমায় যেমন হয় তেমনটিই। কলকাতার বিডন স্ট্রীট নিবাসী বদ্যিবাড়ির চন্দনার সাথে কলকাতায় চাকরির খোঁজ করতে আসা বর্ধমানের আগুরি গ্রামের ছেলে উত্তমের মেলবন্ধনটুকুও যে বিস্তর সংসার-সংগ্রামের ফল। মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়ির মেয়ে চন্দনার সাথে মূলত কৃষিজীবী পরিবারের ছেলে উত্তমের বিবাহে খুব বড় বাধা হয়ে উঠেছিল শ্রেণিবৈষম্য। আমার দাদামশাই তদানীন্তন বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনের হোতা এবং সাংস্কৃতিক জগতের একনিষ্ঠ কর্মী হওয়া সত্ত্বেও নিজের মেয়ের এহেন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি চট করে। অথচ মায়ের মামা-মাসিদের ছিল নিঃশর্ত সমর্থন। আর বাবার তরফের সব্বাই শুনেছি খুব আশ্চর্য হয়েছিলেন প্রেমজ বিবাহের প্রস্তাবে। কলকাতায় কর্মরত চাকুরে পাত্রের জন্য বড়সড় পণ হাঁকা যেতে পারতো - এমনটা ভাবতেই বা এদেশের মানুষের আর কীসে আটকায়!
তবে আমাদের এই আনন্দে শরিক হতে পারলেন না যাঁরা, পরে বুঝেছিলাম তাঁদের আপত্তিটুকু ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয় মোটেও। উলটে, তাদের সমাজ ও সেই সমাজের গোষ্ঠীভুক্ত যারা - তাদের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, এই আশঙ্কাই তাদের দূরে সরিয়ে রাখল। এই ব্যক্তি এবং সমাজের দ্বন্দ্ব - এর মূলে হল বর্তমানের আননে অতীতের ছায়াকে বড় করে দেখবার অভ্যাস। অনেকক্ষেত্রেই জাতিবিদ্বেষের পূর্বস্মৃতি ভবিষ্যতের পথ আগলে দাঁড়ায়। তখন ব্যক্তির পরিচয় শুধুমাত্র এককের ওপর নির্ভর করে থাকে না, বহুবর্ষজীবী শোষণের ইতিহাসে ভারাক্রান্ত মন তখন ব্যক্তির অবয়বে খুঁজে নেয় জনগোষ্ঠীর মুখ, নির্দিষ্ট হয়ে ওঠে সাধারণের প্রতীক। সেই পরিচয়ে হয়ত বা কারো কারো কাছে রাহী নন-বেঙ্গলি এবং আমি দিকু। তবে এই বৃত্তের ঘেরাটোপের বাইরে ব্যক্তিমানসের স্বচ্ছন্দ পদার্পণের জন্য ইতিহাসচেতনার প্রয়োজনও অনস্বীকার্য। অতীতের অনুপস্থিতিতে বর্তমান যেমন অস্তিত্ব হারায়, ঠিক তেমনই ভবিষ্যৎ এবং অতীত – এই দুইয়ের আকর্ষণ ও বিকর্ষণ ব্যতীত বর্তমানের গতিকে রোধ করা হয়। উপরন্তু, ব্যক্তিমানুষের স্বতন্ত্র পরিচয়ের মধ্যে তাঁর বৈবাহিক অবস্থান কোথায় এবং কখন কতটা গুরুত্ত্বপূর্ণ, সেই কথাটাও ভেবে দেখাটা জরুরি। ব্যক্তিগত পরিচয় দিতে গিয়ে একে অপরের সাথে সম্বন্ধের জের টেনে যেকোনও মানুষের আত্মসম্মানকে খর্ব করা হয় মাত্র। সঙ্গী নির্বাচনের অধিকার প্রয়োগকালে এই নৈতিক দায়িত্ব স্মরণ রাখাটা বাঞ্ছনীয়।
আমার ঠাকুমা তাঁর যৌবনে বিধবা হয়েছিলেন। অতঃপর বড় জায়ের প্রতাপে, জীবনের বেশিরভাগটা আমার প্রায় ছয় ফুট উচ্চতার ঠাকুমার পরনে সাদা খাটো ধুতি ছাড়া আর কিছুই ওঠেনি।
আমাদের লৌকিক ধারণায় এরকম একটি মত প্রচলিত আছে যে বিবাহ হল দুইটি পরিবারের মেলবন্ধন। এও সত্য যে আমাদের দেশীয় পরম্পরায় একক ব্যক্তির তুলনায় লোকসমাজের গুরুত্ত্ব চিরকালই বেশী। কিন্তু ইংরেজিতে যাকে বলে কমপ্যানিয়নেট ম্যারেজ - অর্থাৎ কিনা যে বিবাহের মূলে রয়েছে উভয় সঙ্গীরই পারস্পরিক সম্মতি, যেখানে দুই পক্ষের ব্যক্তিগত মতামত হল একসাথে থাকবার একমাত্র সম্মতিপত্র – সেই ক্ষেত্রে সবার উপরে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সত্য, তাহার উপরে নাই। রাহী ও আমার জীবনযাপনে এইটি একটি সাংবিধানিক সত্য। এহেন অবস্থানকে আত্মসর্বস্ব বলে ভুল হলেও, যারা একে ওপরকে বোঝে না অন্যদের তাদেরকে বোঝা ভারি মুশকিল। সাধে কী আর কবি বলেছেন - গোলেমালে গোলেমালে পিরিত করো না! আর আমার দিদিমা-ঠাকুমারা একে বলতো – আত্ম রেখে ধর্ম! আমার ঠাকুমা তাঁর যৌবনে বিধবা হয়েছিলেন। অতঃপর বড় জায়ের প্রতাপে, জীবনের বেশিরভাগটা আমার প্রায় ছয় ফুট উচ্চতার ঠাকুমার পরনে সাদা খাটো ধুতি ছাড়া আর কিছুই ওঠেনি। অথচ সন্তান-সন্ততিদের সাথে তাঁর সম্পর্ক অম্ল-মধুর হলেও, তিনি কোনদিন দেশ-গাঁয়ের একটিও আচার-অনুষ্ঠান কাউকে মানতে বলেননি মুখ ফুটে। বোধ করি, এই শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন জীবনের পাঠশালা থেকেই।
যুগপৎ এই উপলব্ধিও হয় যে এ শহরে যাদের আমরা এবং যারা আমাদের গ্রহণ করেছেন, তারাই আমাদের সমাজ। সেই সমাজ গঠনের প্রক্রিয়ায় ঠিক রাহী এবং আমার মেলামেশার মতই গুরুত্ব পেয়েছে চিন্তার ধারা এবং মননের সংস্কৃতির সাদৃশ্য। তাই তাঁদের সাহচর্যে আমাদের প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ এবং আত্মার শান্তি। সঙ্গী নির্বাচনের এক বৃহত্তর ক্ষেত্র এই সমাজ মনোনয়ন ও সম্পর্কের গঠন। নিজের সমাজ বাছাই করার মধ্যে যে স্বাধীনতা আছে, সে সমান সুখ বুঝি আর কিছুতেই নেই। তবে উদারনীতি এবং জীবনবোধের শিক্ষা – এই দুইয়ের মাধ্যমেই সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে জাতি ও ধর্মকে নতুন আলোয় দেখা সম্ভব। এই দেখার মধ্যে দিয়ে সবার আগে নিজেকে চেনা হলেই, বৃহত্তর রূপে লোকহিতৈষী হওয়া সম্ভব।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
লেখাটি সুচিন্তিত, আবেগপূর্ণ আর আন্তরিক। সমাজ বুঝি এভাবেই পাল্টায়।বাস্তবতার সাথে, পরিস্হিতির সাথে যে সমাজ পাল্টায় না, তা কালের নিয়মেই তামাদি হয়ে যায়। কিন্তু রাহী- শান্ত্বনু’রা থাকছে থাকবে, তাদের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে। তাই ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে সুন্দর কিছু গড়ে তুলবে ওরাই। আন্তরিক শুভেচ্ছা আর সমর্থন জানাই।