নিজস্ব পরিচয়টুকু বেছে নেবার অধিকার না থাকলে?
0 171ভাবছি, কোথা থেকে শুরু করব। মূল প্রশ্ন কোনটা—আমাকে পছন্দসই সঙ্গী নির্বাচন করতে দেওয়া হবে কিনা, নাকি পছন্দসই সঙ্গীর সঙ্গে আমাকে একটা সমাজ-রাষ্ট্র-ধর্ম-নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসারে সম্পর্ক করে চলতে হবে সেটা আমার পছন্দসই হোক বা না হোক। আর এই যে ‘আমি’, যে সঙ্গী পছন্দ করতে পারবে বা পারবে না, সেই ‘আমি’টাই বা কে? তাকে সমাজ-রাষ্ট্র-ধর্ম পছন্দ করে তো? ঠিকঠাক একটা গোটা মানুষ হিসাবে মানে তো? সে জীবনের বাদবাকি সব কিছু পছন্দ অনুযায়ী নির্বাচন করতে পায় তো? যত ভাবছি মূল প্রশ্ন কোনটা, ততই গুলিয়ে যাচ্ছে।
আর উল্টোদিকে সমাজ-রাষ্ট্র-ধর্ম রাজত্ব করে আনুগত্যের ওপর দাঁড়িয়ে এবং সব ধরনের আনুগত্যের মধ্যে অন্যতম প্রধান হল যৌনতাভিত্তিক আনুগত্য।
অলরেডি এই ১০ই জানুয়ারি হুগলীর ঘটনায়, অর্থাৎ জয়ন্তী বিশ্বাস ও তৌসিফ হকের ওপর ঘটে যাওয়া মানবাধিকার হননের ঘটনায়, হোটেল কাকে স্বামী-স্ত্রী বলে মনে করছে, কারা তাদের বিবাহিত সম্পর্ক প্রমাণ করতে পারছে বা পারছে না, এইটা নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয়ে চলেছে।
প্রশ্ন এক, দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ আদৌ কেন কিছুর প্রমাণ দেবে? এবং প্রশ্ন দুই, পুরুষ ও নারীর ভিন্ন ধর্ম বলেই কি প্রমাণের দায় গুরুত্ব পাচ্ছে? এর মধ্যে আবার পুরুষটি মুসলমান, অর্থাৎ ‘লাভ জিহাদ’ তত্ত্ব খাপে-খাপ বসে যায়, কিন্তু উলটোটা হলেও কি বিয়ের সার্টিফিকেট এত নম্বর পেত?
ভেবে দেখতে গেলে এই পছন্দসই সঙ্গী নির্বাচন বিষয়টা অনন্তকাল ধরে পরিবারের—বকলমে সমাজ-রাষ্ট্র-ধর্মের—গলায় কাঁটা হয়ে খচখচ করে চলেছে। পছন্দসই যা কিছু তাই নিয়েই আসলে সমস্যা। পছন্দ বা ইচ্ছা, স্বপ্ন বা কামনা, বিদ্রোহের বীজ পোঁতা হয় এইসব আবেগের হাত ধরেই। আর উল্টোদিকে সমাজ-রাষ্ট্র-ধর্ম রাজত্ব করে আনুগত্যের ওপর দাঁড়িয়ে এবং সব ধরনের আনুগত্যের মধ্যে অন্যতম প্রধান হল যৌনতাভিত্তিক আনুগত্য। সম্পর্ক তৈরি, পরিবার গঠন, প্রজনন, সম্পত্তির দাবীদার, সতীত্ব—জীবনের প্রত্যেকটা পদক্ষেপে জড়িয়ে রয়েছে যৌনতাভিত্তিক নিয়মগুলো, আর কে কত অনুগতভাবে সেগুলো পালন করে চলছে, বা চলছে না, নিক্তি মেপে তার হিসাব কষা এবং দরকার মতো টাইট দেওয়াই সমাজ-রাষ্ট্র-ধর্মের মুখ্য কাজ।
যেটা আরও সন্দেহজনক সেটা হল এই মৌলবাদী চাপ কিন্তু কেবল সমাজ বা ধর্ম দিচ্ছে না, যা আমরা এতকাল দেখে এসেছি, আজ চাপ দিচ্ছে স্বয়ং রাষ্ট্র। যদিও এটা চিরকালই স্বতঃসিদ্ধ যে রাষ্ট্র-সমাজ-ধর্ম আসলে একটা তেপায়া টুল, যার পায়াগুলো একজোটে কাজ না করলে সে গদি ওলটাবে।
যৌনতাভিত্তিক আনুগত্য আবার স্থান-কাল-পাত্র বিশেষে বদলাতে বদলাতে যায়। এই মুহূর্তে এ দেশে বাস করা মানুষের কাছ থেকে যে ধরনের আনুগত্য আশা করা হচ্ছে, দাবী করা হচ্ছে বা চাপানো হচ্ছে সেটার একটা নির্দিষ্ট চেহারা আছে। সেটা গত পঞ্চাশ বছরের তুলনায় অনেক বেশি উচ্চকিত অতিদক্ষিণপন্থী, সংখ্যাগুরুনির্ভর এবং মৌলবাদী। এবং যেটা আরও সন্দেহজনক সেটা হল এই মৌলবাদী চাপ কিন্তু কেবল সমাজ বা ধর্ম দিচ্ছে না, যা আমরা এতকাল দেখে এসেছি, আজ চাপ দিচ্ছে স্বয়ং রাষ্ট্র। যদিও এটা চিরকালই স্বতঃসিদ্ধ যে রাষ্ট্র-সমাজ-ধর্ম আসলে একটা তেপায়া টুল, যার পায়াগুলো একজোটে কাজ না করলে সে গদি ওলটাবে। গোড়ার দিকে অন্তত এই রাষ্ট্র একটা ভাব দেখিয়েছিল যে সে নাগরিকের কথা নিরপেক্ষভাবে ভাববে, অন্তত আইন বলে আর বিচারব্যবস্থা বলে কিছু থাকবে যা শাসনকে সংযত করবে, সংবিধান বলে কিছু একটা থাকবে। সবটাই সমাজ আর বিশেষত ধর্মের ধ্বজা ধরে ঘটবে না। এসব ভাবনা জলে ফেলে দিয়ে আপাতত সব আনুগত্যের নিয়মই জয় শ্রীরাম হুঙ্কার ছাড়ছে।
সব ধরনের সমাজেই যৌনতাভিত্তিক আনুগত্যের নিয়মগুলোতে বদল ঘটানো সবথেকে কঠিন হয় কারণ আমরা বাইরে বিস্তর বিপ্লবের বুলি কপচাই বটে কিন্তু ঘরের মধ্যে কোনও স্ট্রাকচারাল বদল/বিপ্লব চাই না।
এটা মানতে হবে সব ধরনের সমাজেই যৌনতাভিত্তিক আনুগত্যের নিয়মগুলোতে বদল ঘটানো সবথেকে কঠিন হয় কারণ আমরা বাইরে বিস্তর বিপ্লবের বুলি কপচাই বটে কিন্তু ঘরের মধ্যে কোনও স্ট্রাকচারাল বদল/বিপ্লব চাই না। তাই আজ যখন সার্বিকভাবে অতিদক্ষিণ মৌলবাদী শাসনের রেজিমে ঢুকে যাচ্ছে দেশ, তখনও ওই ‘যৌনতাভিত্তিক’-এর ঘাড়েই সব থেকে বেশি চাপ পড়ছে। এবং এই চাপের কেন্দ্রে চিরকাল বসে ছিল/আছে নারী(চিহ্নিত) প্রাণীরা বা তাদের যৌন শরীরগুলো, যার যৌন ‘পবিত্রতা’র ওপর সমাজ-ধর্ম-রাষ্ট্রের সম্মান(?) নির্ভর করে থেকেছে চিরকাল। ফলে তাদের ওপর আনুগত্যের নিয়ম আরও ঘনীভূত হতে থাকে। ফলত আজ অমুক বিশ্বাসের নারী(চিহ্নিত) যৌন শরীর কেন তমুক হক পুরুষকে বেছে নিল বলে এমনকী হোটেল কর্তৃপক্ষেরও ঘুম উড়ে যাচ্ছে, তার কারণ ছেলেপুলেগুলো তো সেই হকদের দলই ভারী করবে!
নারী (চিহ্নিত) প্রাণীরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবে না, জিন্স বা এইধরনের অপসাংস্কৃতিক পোশাক পরবে না, মেক আপ করে পুরুষ ভোলাবে না ইত্যাদি। এবং এটা জারি হয়েছে সেই ২০১৭ থেকে, যাঁরা চালাচ্ছেন তাঁরা সত্যিই মনে করছেন নরকের দ্বার নারীকে সামলে না রাখলে সব ধ্বংস হয়ে যাবে।
আমাদের মেয়েগুলোকে উচ্ছন্নে পাঠাল কে, নাকি মেয়েগুলো জন্মসূত্রে উচ্ছন্নে যাওয়া বলেই আমাদের এত সমস্যা—এই ডিম আগে না মুরগি আগে-র জটিল তত্ত্বে না ঢুকে ডিম আর মুরগি দুয়েরই একসঙ্গে সত্যনাশ করে যে দেওয়া যায় সেটা দেখিয়েছে হরিয়ানার কোনও কোনও অঞ্চলের পঞ্চায়েত। এরা কেউ খাপ পঞ্চায়েত নয়, এরা আইনসম্মত পদ্ধতিতে নির্বাচিত লোকাল গভর্নেন্স সিস্টেম, ফলে ধরে নিতে হবে এঁরা স্থানীয় জনগণেশের মতেরই প্রতিফলন ঘটাচ্ছেন। তাঁরা ডিম ও মুরগি একসঙ্গে নিধনের যে নিদানটি দিয়েছেন সেটা হল নারী(চিহ্নিত) প্রাণীরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবে না, জিন্স বা এইধরনের অপসাংস্কৃতিক পোশাক পরবে না, মেক আপ করে পুরুষ ভোলাবে না ইত্যাদি। এবং এটা জারি হয়েছে সেই ২০১৭ থেকে, যাঁরা চালাচ্ছেন তাঁরা সত্যিই মনে করছেন নরকের দ্বার নারীকে সামলে না রাখলে সব ধ্বংস হয়ে যাবে। আর এই সামলে রাখার অন্য পিঠেই আছে অনার কিলিং, এবং অন্যান্য হেট ক্রাইম, যা যৌনতাভিত্তিক আনুগত্য বজায় রাখার দাওয়াই হিসাবে মুড়িমুড়কির দরে ব্যবহৃত হয়ে চলেছে।
রাষ্ট্রই এই অধিকার দিয়েছিল, আর আজ সেই রাষ্ট্রই এক্কেবারে হাত তুলে নিয়েছে। সে আর এমনকী লোক দেখানো নাগরিক অধিকার রক্ষার দায়টুকুও নিচ্ছে না, বরং কে নাগরিক এবং কার কোন অধিকার রক্ষা করা রাষ্ট্রের কর্তব্য সেই ধারণাটাই গুলিয়ে দিতে চাইছে।
কোন কোন মাপকাঠিতে যৌনতাভিত্তিক আনুগত্য মাপা হয় এবং কেন, সেটা বোঝা একটুও কঠিন নয়। যৌনতা মানে শুরুতেই ধরে নেওয়া হয় বিষমকামী যৌনতা যার জন্য নারীচিহ্নিত আর পুরুষচিহ্নিত দুরকম সক্ষম শরীর লাগে। সক্ষমতার বিচার একদিকে হয় শারীরিক-মানসিক সক্ষমতা, আর অন্যদিকে জনন সক্ষমতার হিসাবে। জনন এখানে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ জনন দিয়েই পরিবার তৈরি হয়, সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা হয়, সমাজ ও সভ্যতা এগিয়ে যায়। তাই জনন বস্তুটাকে কন্ট্রোল করার প্রয়োজন থেকে বিয়ে নামক ইন্সটিটিউশন তৈরি হয়েছে যার মাধ্যমে সমাজ-রাষ্ট্র-ধর্মের তেপায়া টুল সবথেকে চমৎকার বোঝাপড়ায় আসতে পেরেছে। বিয়েকে যদি আমরা যৌনতাভিত্তিক আনুগত্য প্রকাশের পাদপীঠ বলে ধরি, তাহলে সেই বিয়েটা ঘটতে হয় কমপ্যাটিবল ধর্ম, কমপ্যাটিবল জাত, কমপ্যাটিবল অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক শ্রেণী ইত্যাদি ধরে, আর কে কার সঙ্গে কমপ্যাটিবল হবে বা হবে না সেটাও ঠিক করে ওই তেপায়া টুল তথা সিংহাসন। এই কমপ্যাটিবিলিটি বা ম্যাচিং হওয়াটা জরুরি ছিল চিরদিনই, সেই ম্যাচিং-এর মধ্যে পাত্রী আর পাত্রের পছন্দ কোনওকালেই গুরুত্ব পায়নি, পরিস্থিতির বদল ঘটেছে শুধু এইখানে যে এতকাল তবুও একটা স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট ছিল(আছে?), রাষ্ট্রই এই অধিকার দিয়েছিল, আর আজ সেই রাষ্ট্রই এক্কেবারে হাত তুলে নিয়েছে। সে আর এমনকী লোক দেখানো নাগরিক অধিকার রক্ষার দায়টুকুও নিচ্ছে না, বরং কে নাগরিক এবং কার কোন অধিকার রক্ষা করা রাষ্ট্রের কর্তব্য সেই ধারণাটাই গুলিয়ে দিতে চাইছে।
এই গুলিয়ে যাওয়া রাজত্বে ‘লাভ জিহাদ’ আইনি স্বীকৃতি পেয়ে গেছে, যার জেরে গত ডিসেম্বরে বিজনৌরের ঘটনায় বন্ধুর জন্মদিনের নেমন্তন্ন খেয়ে ফেরার পথে এক মুসলমান কিশোরকে পুলিশ তুলে নিয়ে যেতে পেরেছে হিন্দু কিশোরীকে অপহরণ এবং জোর করে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টার অভিযোগে। হিন্দু কিশোরী আর তার মা চেঁচামেচি করেছেন বিস্তর এই বলে যে এসব কিছু ঘটেনি, কিশোরী তার নিজের বাড়িতেই আছে, তাকে কেউ কিছু করেনি। ফলত পুলিশ অতি তৎপরতার সঙ্গে মেয়েটির বাবাকে দিয়ে ছেলেটির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনিয়ে চমৎকারভাবে মামলা সালটে ফেলেছে। আবার এই গুলিয়ে দেওয়া সময়ের সুযোগে গত বেশ কিছু বছর ধরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্যালেন্টাইন ভ্যান্ডালিজম রমরম করে বেড়ে চলেছে, যার সবটা কেবল বিশেষ কোনও অতিদক্ষিণ দল শাসিত রাজ্যে (উত্তরপ্রদেশ বা কর্ণাটক কিম্বা মহারাষ্ট্র) ঘটছে এমন নয়, এমনকী কেরালাও নাম লিখিয়েছে এই ভ্যান্ডালিজম মহাযজ্ঞে। এবং এই ধরনের সব জায়গায় যেটা লক্ষণীয় সেটা হল পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা, যেটাকে শুধু ওপরতলার রাজনৈতিক চাপ বলে অতিসরলীকরণ করলে ভুল হবে। তেপায়া টুলের মধ্যে পুলিশও তো আছে, সে শুধু রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ তাই তো নয়, তার সমাজও আছে আর ধর্ম তো আছেই।
এমনকী পরিবারের মানুষজন এই ‘অনৈতিক’ একত্রবাসকে সমর্থন করলেও হিংসা থামে না কারণ আসলে কোন ব্যক্তিমানুষ বা কোন নির্দিষ্ট পরিবার কাকে সমর্থন জানাল বা জানাল না তাতে এদের কিছু আসে যায় না। পরিবারের ধারণাটাকে কাজে লাগানো হয় আনুগত্যবোধ জোরদার করার জন্য।
এবার একটু অন্যভাবে ভাবা যাক। পছন্দসই সঙ্গী নির্বাচনের অধিকার তো শুধু বিয়ের অধিকার নয়, বিয়ে যত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবেই স্বীকৃতি পেয়ে থাক না কেন, তার বাইরেও সঙ্গী নির্বাচন ঘটতে পারে। যৌনতাভিত্তিক আনুগত্যের আদর্শ শিকল তৈরি হয় খাপে খাপ ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী, কুষ্ঠীঠিকুজীর বিবাহিত মেলবন্ধনে, যার জন্য বিয়ের সময় এইসব জায়গায় ম্যাচ না খেলে যথাযথ আনুগত্য প্রকাশ হল না বলে রাজ্যিসুদ্ধু লোক যে লেভেলের হুঙ্কার ছাড়ে তা অনার কিলিং অবধি পৌঁছে যেতে পারে বলে আমরা জানি। এই ব্যাকড্রপের ওপর দাঁড়িয়ে বিয়ে না করে নারী(চিহ্নিত) প্রাণী পুরুষ(চিহ্নিত) প্রাণীর সঙ্গে ঘোরাফেরা বা বসবাস করছে দেখলে আরও কী কী হতে পারে ভাবলে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। ভ্যালেন্টাইন ভ্যান্ডালিজম তো ঝলকমাত্র, আসল কাহিনীর খবর হয়ত রাখিই না। সেখানে কাউকে ধরে গাছের সঙ্গে বা কুকুর কিম্বা গাধার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ‘শুদ্ধ’ করে তোলার চেষ্টা করে পরিবারের লোকেরাই, কিম্বা পরিবার থেকে দূরে অন্য শহরে অবিবাহিত একত্রবাস করা আলাদা জেন্ডারের মানুষদের বাড়িতে জোর করে ঢুকে পড়ে ভাঙচুর চালায় স্বঘোষিত নীতিরক্ষক দল। এমনকী পরিবারের মানুষজন এই ‘অনৈতিক’ একত্রবাসকে সমর্থন করলেও হিংসা থামে না কারণ আসলে কোন ব্যক্তিমানুষ বা কোন নির্দিষ্ট পরিবার কাকে সমর্থন জানাল বা জানাল না তাতে এদের কিছু আসে যায় না। পরিবারের ধারণাটাকে কাজে লাগানো হয় আনুগত্যবোধ জোরদার করার জন্য। পরিবার ওই তেপায়া টুলের পায়ার তলায় আটকানো রবারের টুপি বই আর কিছু নয়।
যৌনতাভিত্তিক আনুগত্য বস্তুটাই দাঁড়িয়ে আছে বিষমকামী যৌনতার ওপরে, যা করতে হলে একজনকে পুরুষ এবং আরেকজনকে নারী হিসাবে নিজের নিজের লিঙ্গভূমিকা বা জেন্ডারকে মেনে নিতে হয়। যারা সেটা করছে না তারা গোড়াতেই গলদ করে বসে আছে, তাদের ক্ষেত্রে পছন্দসই সঙ্গী নির্বাচনের প্রশ্নটাই অবান্তর হয়ে যায় না কি?
এরও পরের ধাপে আরও কিছু মানুষ আছে যাদের জন্য ‘পছন্দসই সঙ্গী নির্বাচনের অধিকার’ খুব ধোঁয়াটে, অনেক দূর থেকে দেখা স্বপ্নের মত আবছা একটা ধারণা। ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি দিয়ে বানানো যৌনতাভিত্তিক আনুগত্যের তালিকায় জেন্ডার আর সেক্সুয়ালিটি যখন এসে ঢুকে পড়ে তখন আর বলার মতো বিশেষ কিছু অবশিষ্ট থাকে না। কারণ যৌনতাভিত্তিক আনুগত্য বস্তুটাই দাঁড়িয়ে আছে বিষমকামী যৌনতার ওপরে, যা করতে হলে একজনকে পুরুষ এবং আরেকজনকে নারী হিসাবে নিজের নিজের লিঙ্গভূমিকা বা জেন্ডারকে মেনে নিতে হয়। যারা সেটা করছে না তারা গোড়াতেই গলদ করে বসে আছে, তাদের ক্ষেত্রে পছন্দসই সঙ্গী নির্বাচনের প্রশ্নটাই অবান্তর হয়ে যায় না কি?
কিম্ভূত-ক্যুইয়ার প্রাণীদের নিজস্ব পরিচয়টুকু বেছে নেবার অধিকারই নেই, ফলে পছন্দসই সঙ্গী বাছার অধিকার আসবে কোথা থেকে? আবার যখন এই পরিচয়গুলোর মধ্যেই দুয়েকটা পরিচয় স্বীকৃতি পাবে, তেপায়া টুল বছে বেছে এদের মধ্যে কয়েকটাকে অল্পস্বল্প স্বীকৃতি দেবে, তখন কিন্তু তার সঙ্গে ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী ইত্যাদি অন্যান্য অবস্থানগুলোও জুড়ে যাবে।
ধরা যাক, একজন ট্রান্সমানুষ একজন পুরুষ(চিহ্নিত) মানুষকে পছন্দসই সঙ্গী হিসাবে নির্বাচন করল, কিম্বা দুজন নারী(চিহ্নিত) প্রাণী পরস্পরকে সঙ্গী হিসাবে বেছে লেসবিয়ান সম্পর্কে ঢুকল, একজন জেন্ডার ক্যুইয়ার মানুষ একজন অ্যাসেক্সুয়াল মানুষকে বেছে নিল, একজন পলিঅ্যামোরাস প্যানসেক্সুয়াল মানুষের নির্বাচিত সঙ্গী হল একজন বাইজেন্ডার বাইসেক্সুয়াল, একজন হেটেরোসেক্সুয়াল পুরুষ ও একজন ট্রান্সলেসবিয়ান।১ এই শব্দগুলোর অর্থ পর্যন্ত তেপায়া টুল জানে না, এইসব কিম্ভূত-ক্যুইয়ার প্রাণীদের নিজস্ব পরিচয়টুকু বেছে নেবার অধিকারই নেই, ফলে পছন্দসই সঙ্গী বাছার অধিকার আসবে কোথা থেকে? আবার যখন এই পরিচয়গুলোর মধ্যেই দুয়েকটা পরিচয় স্বীকৃতি পাবে, তেপায়া টুল বছে বেছে এদের মধ্যে কয়েকটাকে অল্পস্বল্প স্বীকৃতি দেবে, তখন কিন্তু তার সঙ্গে ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী ইত্যাদি অন্যান্য অবস্থানগুলোও জুড়ে যাবে। তখন হিন্দু লেসবিয়ানের সঙ্গে হিন্দু লেসবিয়ানই সম্পর্ক করতে পারবে কিনা, বা নমশূদ্র ট্রান্স ও ব্রাহ্মণ ট্রান্স এক পঙক্তিতে বসে খাবে কিনা, এইসবও ক্যুইয়ার যৌনতাভিত্তিক আনুগত্যের নিয়মের অংশ হবে।
আগের প্যারাগ্রাফের শেষ লাইন লিখতে লিখতে মনে হল এই ‘যখন’ আর ‘তখন’ মার্কা ফিউচার টেন্স দিয়ে কাকে ভোলাচ্ছি আমি? কোনও এক অতি প্রগতিশীল আইয়ারজননী তাঁর সমকামী পুত্রটির জন্য কি অলরেডি এই মর্মে ‘পাত্র চাই’ কলামে বিজ্ঞাপন দেননি – কাস্ট নো বার বাট আইয়ার প্রেফারড? এটা ঘটেছিল কারণ ঘটানো যায়, তারপর একটু মুচকি হেসে বলে দিলেই হয় ‘এত বোঝ মা, আর ঠাট্টা বোঝ না?’ আর এরও পরে, এই ‘ঠাট্টা’রও ওপরে ভয়ানক সিরিয়াসলি এলজিবিটি আন্দোলন ম্যারেজ ইক্যুয়ালিটি রাইটস চায় সেই তেপায়া টুলের কাছ থেকেই, বিষমকামীদের মতো অ-বিষমকামীদেরও বিয়ে নামক ইন্সটিটিউশনে ঢোকার এবং দিল্লি-কা-লাড্ডু যথাসম্ভব খাবার ও পস্তাবার অধিকার দিতে হবে, এই দাবীতে!
এখনো ভাবছি, মূল প্রশ্নটা তাহলে কী!
বি :দ্র :
ট্রান্সমানুষ – যিনি জন্মসূত্রে পাওয়া শারীরিক লিঙ্গনির্ভর জেন্ডারের পরিচয়কে মানতে আস্বীকার করেন
লেসবিয়ান – যিনি নিজেকে নারী বলে মনে করেন ও আরেকজন নারীচিহ্নিত মানুষের প্রতি যৌন কামনা অনুভব করেন
জেন্ডার ক্যুইয়ার – যিনি নারী আর পুরুষ এই দুই জেন্ডার বিভাজনকে অস্বীকার করে নিজেকে এর বাইরে কোথাও দেখতে পান
অ্যাসেক্সুয়াল – যিনি সাধারণভাবে সেক্সুয়াল মানুষের নিরিখে যৌন কামনাহীন ও যৌনকর্মে অনাগ্রহী, এঁর কামনা ও তার প্রকাশ অন্যরকম এবং সাধারণ সেক্সুয়াল মানুষের অজানা
পলিঅ্যামোরাস – যিনি একাধিক প্রেম ও কামের সম্পর্কে একসঙ্গে থাকতে চান ও পারেন, এঁর সম্পর্কগুলির মূল ভিত্তি সততা ও স্বচ্ছতা
প্যানসেক্সুয়াল – যিনি সব ধরনের জেন্ডারের মানুষের প্রতি যৌন কামনা অনুভব করেন
বাইজেন্ডার – যিনি নিজেকে একই সঙ্গে নারী এবং পুরুষ, এই দুই জেন্ডার পরিচয়ে পরিচিত করতে চান
বাইসেক্সুয়াল – যিনি নারী ও পুরুষ, এই দুই জেন্ডারের মানুষের প্রতি যৌন কামনা অনুভব করেন
হেটেরোসেক্সুয়াল – যিনি বিষমকামী যৌনকামনা অনুভব করেন ট্রান্সলেসবিয়ান – যিনি নিজের জন্মসূত্রে পুরুষ চিহ্নিত শরীরকে নারীচিহ্নিত শরীরে রূপান্তরিত করে, নারীচিহ্নিত মানুষের সঙ্গে সমকামী সম্পর্কে আছেন বা থাকতে চান
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply