• প্রেম ও জেহাদ শব্দদ্বয় এক ব্র্যাকেটে বসে কোন যুক্তিতে?


    0    158

    January 22, 2021

     

    দেশের মাটিকে আমরা ‘মা’ বলে জানি, কিন্তু যদি সেই মা ‘সারনেম’ ভেদে সন্তানের বাছবিচার করেন, তখন কেমন দাঁড়ায় ছবিটা?

    ‘মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও', লিখেছেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়।

    বুদ্ধি, বিবেক ও সংবেদনশীল মনের কাছে এটুকুই যুগে যুগে আমাদের প্রার্থনা। কিন্তু আজকের ভারতে যখন দেশপ্রেম আর দেশদ্রোহীর পরিচয় মাপা হচ্ছে ধর্মপরিচয় আর শ্রেণীবিভাজনের দাঁড়িপাল্লায়, তখন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই অমোঘ প্রার্থনার কি আদৌ মূল্য থাকছে? দেশ মানে তো কেবল কঠিন কাঁটাতার ঘেরা কোনো মানচিত্র নয়, মানুষই গড়ে তোলে দেশ । দেশের মাটিকে আমরা ‘মা’ বলে জানি, কিন্তু যদি সেই মা ‘সারনেম’ ভেদে সন্তানের বাছবিচার করেন, তখন কেমন দাঁড়ায় ছবিটা?

    আজকের ভারত তথা আমাদের মাতৃভূমির সামনে এটিই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে ।

    প্রেম, জেহাদ ও ঘরে ফেরা

    শাস্ত্রে বলেছে ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়,পরোধর্ম ভয়াবহ’—এই পরধর্মের প্রতি ভয়ের বাতাবরণই বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। এখানে ভয়ের ব্যবসার রকমারি নাম – ‘লাভ জেহাদ’, ‘ঘর ওয়াপসি’, ‘অনার কিলিং’, ‘ল্যান্ড জেহাদ’ ইত্যাদি।

    ভয়ের কারবারিরা দীর্ঘদিন ধরে বোঝাচ্ছে, মুসলিমরা পরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্র করে ‘অসহায়’ হিন্দু মেয়েদের প্রলুব্ধ করে বা ভয় দেখিয়ে বা বলপ্রয়োগ করে প্রেমের অভিনয় করে নিকাহ্ নামা পড়িয়ে বেগম বানিয়ে ফেলছে। এর পিছনে নাকি রয়েছে আন্তর্জাতিক চক্র, যারা অর্থ জোগাচ্ছে ধর্মান্তরণের মাধ্যমে সংখ্যাগুরু হওয়ার এই অভিনব জেহাদে। এরই নাম ‘লাভ জেহাদ’ বা ‘রোমিও জেহাদ’।

    আরও বোঝানো হচ্ছে, ভিনধর্মে মেয়েদের এই বিয়ের ফলে হিন্দুদের সম্পত্তি জোর করে দখল করে বা কম দামে কিনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে 'ল্যান্ড জেহাদ' চলছে।

    এমন ইসলামি জেহাদের অ্যান্টিডোট হিসেবে উগ্র হিন্দুত্ববাদী দাওয়াই-‘ঘর ওয়াপসি' । বিভিন্ন কারণে যারা হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন,তাদেরকে পুনরায় হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনা।

    এটা ছিল বছর ছয়েক আগের দাওয়াই। সাম্প্রতিককালে খুব কৌশলে উক্ত ‘বিভিন্ন কারণ’কে একেবারে ‘ডিলিট’ করে বোঝানো হচ্ছে যে, ভারতের সব মুসলিমই ধর্মান্তরিত হয়েছিল কোনও সুদূর অতীতে, ফলে সবারই এবার হিন্দু ঘরে ‘ওয়াপসি’ হওয়া দরকার । উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের এই বিষাক্ত ধর্মীয়-রাজনৈতিক কর্মসূচীর অংশ হয়ে যেমন ঐতিহাসিক স্থানের ইসলামি নামের হিন্দুত্বকরণ চলছে , তেমনই কেরালা, গোয়া, উত্তরপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা প্রভৃতি জায়গায় ‘ঘর ওয়াপসি’ অনুষ্ঠিত হচ্ছে । যাতে তেলেঙ্গানাতে ১২০০ জন ও উত্তরপ্রদেশের ফয়জাবাদে ২০ জন মুসলিমের হিন্দু ঘরে ‘ওয়াপসি’ হয়েছে। এটুকু ‘খবর’,বাকি খবর-না-হওয়া কেসের সংখ্যা কেউ জানে না । নেতাদের মুখে যা স্বেচ্ছায় ফিরে আসা, তা কতটা সত্য তাই বা জানে কে!

    ‘লাভ জেহাদ’ যেখানে একজন মুসলিম প্রেমিককে ‘দেশদ্রোহী’ ঘোষণা করছে, জনৈক হিন্দু প্রেমিকাকে বিয়ের অপরাধে এমনকী তার প্রাণসংশয় অবধি হয়ে পড়ছে, সেখানে একজন হিন্দু প্রেমিক ‘দেশপ্রেমিক’-এর মর্যাদা পাচ্ছে জনৈক মুসলিম প্রেমিকাকে বিয়ে করে ‘ঘর ওয়াপসি’ ঘটানোর নামে।

    সত্য সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ!

    প্রশ্ন হল, প্রেম ও জেহাদ শব্দদ্বয় এক ব্র্যাকেটে বসে কোন যুক্তিতে? হিন্দু মেয়ে ও মুসলিম ছেলের প্রেমকে ‘জেহাদ’ বলে ডাকা হবে কেন? প্রেম ‘পিট্যুইটারির খেলা’ হতে পারে, কাব্যময় অনুভূতি হতে পারে, কিন্তু সংকীর্ণ জাতপাত, ধর্ম বা সম্প্রদায়ের তল্পিবাহক কখনোই নয়। ভিন্ন ধর্মের দুজন অ্যাডাল্টের প্রেমে পড়া কি এতই অসম্ভব কোনও প্রকল্প যে একটা বিশাল আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের গল্প ফাঁদতে হবে?

    নয়া আইন

    'উত্তরপ্রদেশ বিধিবিরুদ্ধ ধর্ম সম্পরিবর্তন প্রতিষেধ অধ্যাদেশ ২০২০'তে বলা হয়েছে শুধুমাত্র একটি মেয়ের ধর্ম পরিবর্তনের উদ্দেশ্য নিয়ে দুই ধর্মের মধ্যে কোনও বিয়ে হলে দোষী ব্যক্তির দশ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড হতে পারবে। এই ধরনের ধর্মান্তরণের প্রমাণ পাওয়া গেলে সেই বিয়ে বাতিল বলে বিবেচিত হবে। তবে, বিয়ের ‘উদ্দেশ্য’ বোধক প্রমাণটি কীভাবে বের হবে তা বলা নেই।

    মনে রাখা প্রয়োজন, ধর্মান্তরণ সংক্রান্ত এই বিলে কেবল হিন্দু (২০১১ সালের আদমসুমারী অনুযায়ী ৯৭কোটি) ও মুসলিম (১৭ কোটি) ধর্মের মানুষের কথাই মাথায় রাখা হয়েছে, যেখানে ভারতে খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ, শিখ, পার্সি, জৈন, ইহুদি, জরাথ্রুষ্টিয়ান সহ আরও ১৬ কোটির অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও আছেন।

    অথচ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের জনক এই দলগুলি ‘হিন্দুয়ানি বাঁচাও’ ঝান্ডা হাতে প্রচার করছে। মুসলিম ছেলেরা কেবল জেহাদি প্রেমের দ্বারাই নাকি তাবৎ হিন্দুস্থানকে দখল করে ‘দারুল ইসলাম’ বানাতে চলেছে! কিন্তু কোনো মেয়েকে জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে নাকি সে স্বেচ্ছায় স্বামীর ধর্ম গ্রহণ করেছে—তার ‘প্রমাণ’ কীভাবে পাওয়া যাবে সে বিষয়ে সবাই চুপ। এবার উত্তরপ্রদেশকে অনুসরণ করে অন্যান্য রাজ্যেও যদি একই বিল পাশ হয় তবে মিশ্র সংস্কৃতির ঐতিহ্য নিয়ে ঢাক পেটানো ভারতের পক্ষে তা কতটা হিতকর হবে বলাই বাহুল্য। এমনিতেই গোরক্ষা কমিটি যেভাবে খাদ্যাভ্যাসের ফতোয়া জারি করে মুসলিমদের লিঞ্চিং ও নিধনে মেতে উঠেছে তাতে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সহনশীল মুখটি অনেক আগেই পুড়েছে।

    ভিনজাতে মেয়ের চলে যাওয়া মানে তো শুধু মেয়েরই যাওয়া নয়, তার গোটা শরীর ও জননাঙ্গও ভিন্ন সম্প্রদায়ের অধিকারভুক্ত হওয়া। পিতৃতন্ত্রের পক্ষে এমন ধিঙ্গিপনা বরদাস্ত করাটা পরাজয়েরই নামান্তর।

    এখন ভিনজাতের বিয়ে নিয়ে এই আইনটি লাগু হলে ভারতীয় সংবিধানের আর্টিকল ২১ (ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার),আর্টিকেল ২৫ (ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার) এবং স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট ১৯৫৪ (ভিন্ন ধর্মের নারী-পুরুষের বিয়ের স্বীকৃতি) সবকিছুই লঙ্ঘিত হবে। এতে ভারতের সেকুলার ছবিটা আদৌ সুরক্ষিত থাকবে কি?

    যে দেশের সুপ্রিম কোর্ট সমকামী অধিকারকে বৈধতা দেয়, একক মাতৃত্বকে স্বীকৃতি দেয়, সেই প্রগতিশীল দেশের বুকে এমন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক ও ‘প্রাইভেসি’ নষ্ট করে এমন বিল উত্থাপিত হয় কোন সাহসে তা ভাবতে হবে বৈকি!

    আবার যে দেশের দলিতরা নিজেদেরকে হিন্দুধর্ম বহির্ভূত হিসেবে দেখে, কেবলমাত্র ‘দলিত’ পরিচয়টিকেই ধর্মীয় ও সামাজিক পরিচিতি হিসেবে বেছে নিতে চায় এবং তাতে বিদ্বজ্জন, আইনজ্ঞরা পরামর্শ করতে বসেন, সেখানে তাদের ভিনজাতে বিবাহকে কী আইনে দেখা হবে  সেটাও ভাবতে হবে।

    নারীশরীরের মালিকানা

    ভিনজাতে বিয়ের ব্যাপারে পারিবারিক স্তরে প্রথম থেকেই নানা বাধা, অত্যাচার বিশেষ করে মেয়েদের জন্য একচেটিয়া বিপদ ছিলই। এমনিতেই মেয়েদের নিরাপত্তা কোনও দেশেই নেই। মনুবাদী শাসন, তালিবানি শাসন, শরিয়তি ফতোয়ায় জেরবার নারীজীবন। কী ঘরে, কী বাইরে সর্বত্র ধর্মের বেড়ি নিষিদ্ধ করেছে তাদের ঋজু চলাফেরা। না মানলে কোতল করেছে প্রকাশ্যে, নইলে ব্যাভিচারের বদনাম দিয়ে মাটিতে পুঁতে দিয়ে ঢিল ছুঁড়েছে মৃত্যু না আসা পর্যন্ত। আসলে ভিনধর্মের বিয়েতে পরিবারের মেয়েটি বা ছেলেটি কেবল হাতছাড়া হয় না, তাদের পারিবারিক ধর্মচর্চাও জোর ধাক্কা খায়। যে উপমহাদেশের পিতৃতন্ত্র আজও খাপ পঞ্চায়েতের ফরমান দিয়ে ঘরের মেয়েদের অসূর্যম্পশ্যা রাখে, অসবর্ণ বিবাহে চোখ রাঙায়, দলিত যুবকদের উচ্চবর্ণীয় মেয়েরা বিয়ে করলে জ্যান্ত পুড়িয়ে দেয় বা চণ্ডীমণ্ডপে মেয়েটিকে সমবেতভাবে ধর্ষণ করে টাঙিয়ে দেয়, শরিয়তের নিয়ম মেনে হিন্দু ছেলের সাথে প্রেম কেন বন্ধুত্ব অবধি করতে বাধা দেয় মুসলিম কন্যাকে, অন্যথায় প্রেমিকের সাথে বাড়ির মেয়েকেও জ্যান্ত কবর দিতে পিছপা হয় না—সেই সমাজ তো একটা মেয়ের জরায়ুর কর্তৃত্বকে এত সহজে ভিনজাতের হাতে ছেড়ে দিতে পারে না। ইসলামে সূরা বাকারা , সূরা মুমতাহিনা দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, কোনো মুসলিম নারী কোনো অমুসলিম পুরুষের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না। অনুরূপভাবে কোনো মুসলিম ব্যক্তি কোনো কাফের, মুশরিক নারীকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করতে পারে না। অর্থাৎ মুসলিম-অমুসলিমের কোনো বিয়েই বৈধ নয়।

    এছাড়াও শরিয়তি ফতোয়াবাদীদের মনগড়া নানা ব্যাখ্যা তো আছেই যার জেরে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের পালে লাগে বিষাক্ত হাওয়া। এসবেরই ফলাফল মুসলিম মেয়ের বাপ-দাদাদের হাতে হিন্দু প্রেমিকের ঘর জ্বালানো, কিম্বা যুগলকে কুপিয়ে হত্যা করা—ধর্মীয় বিধান এসবের ইন্ধন জোগালেও মূল বিষয় কিন্তু ওই মেয়েটির শরীরই। কোনো জাতিই চায় না তাদের খেয়েপরে বড় হওয়া মেয়ে ভিনজাতের ঔরসে গর্ভধারণ করবে। মধ্যযুগীয় বর্বরতার মত বিধর্মীর সাথে প্রেম (ধর্ম যাকে ‘ব্যাভিচার’ বলেছে) করায় পাথর ছুঁড়ে কিম্বা হাত-পা কেটে জ্যান্ত পুঁতে ফেলার বিধান না দিলেও, ভিনজাতে বিয়ের সিদ্ধান্ত মেয়েদের ঘাড়ে আজও নীতিপুলিশির খাঁড়া নামিয়ে আনে।

    যেখানে হত্যা আটকানো হচ্ছে সেখানে ‘চাপিয়ে দেওয়া’ খাপ সিদ্ধান্তকেই ‘মেয়ের চয়েস’ বলে নথিবদ্ধ করা হচ্ছে একুশে আইনের খাতায়!

    আমার চেনা এমন মুসলিম মেয়েও আছে যার বাবা মারা যাওয়ার পরে আত্মীয়রা সম্পত্তি আত্মসাতের উদ্দেশ্যে “ও মেয়ে তো হিন্দু ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে। অতএব বাপের সম্পত্তির ভাগ পাবে না” বলে মিথ্যে বদনামও দিয়েছিল। যাতে বিধর্মী বাড়ির বৌ হওয়ার কিম্বা স্পষ্টভাবে বললে বিধর্মীর দ্বারা অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার লেশমাত্র সুযোগের অনুমানেই তাঁকে তাঁর প্রাপ্য উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করাটা ‘জায়েজ’ হয়ে যায়! এটি যতটা বিচ্ছিন্ন কেস, ততটাই কিন্তু কঠোর বাস্তবও।

    নারীশরীরের একচেটিয়া মালিকানাই এই ‘লাভ জেহাদ’ ও তজ্জনিত ‘অনার কিলিং’-এর নেপথ্যের কারণ। ভিনজাতে মেয়ের চলে যাওয়া মানে তো শুধু মেয়েরই যাওয়া নয়, তার গোটা শরীর ও জননাঙ্গও ভিন্ন সম্প্রদায়ের অধিকারভুক্ত হওয়া। পিতৃতন্ত্রের পক্ষে এমন ধিঙ্গিপনা বরদাস্ত করাটা পরাজয়েরই নামান্তর।

    সেইজন্যই উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আগে হুঙ্কার ছাড়তেন—“ওরা যদি আমাদের একটা মেয়েকে বিয়ে করে,আমরা তবে ওদের একশোটা মেয়েকে বিয়ে করব।"

    এখন বলছেন, “যারা হিন্দু মেয়েদের সম্মান নিয়ে খেলছে, তাদের রামনাম সত্য হ্যায়ের যাত্রা শুরু হয়ে যাবে।”

    এই রামনাম সত্য হ্যায়ের প্রথম ধাপ হিসেবেই ‘লাভ জেহাদ বিরোধী’ আইন আনার জন্য ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা বিল’ উত্থাপন করা হচ্ছে। যদিও বিলের ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি বড্ড ফার্সিক্যাল।

    হ্যাপি হিউম্যান রাইটস ডে

    হিন্দুত্ববাদী জঙ্গিদের বিধর্মীদের ‘রামনাম সত্য হ্যায়’ করে দেওয়া যে স্রেফ হুমকি নয়, ঘোর বাস্তব, তার প্রমাণ পাওয়া গেল সাম্প্রতিক ঘটনাগুলিতে,

    ১। লখনৌতে একটি ইন্টার-রিলিজিয়ন বিবাহ অনুষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে।

    ২। মোরাদাবাদে ইন্টার-রিলিজিয়ন বিয়ের রেজিস্ট্রি করাতে এসে পুলিশের হাতে হেনস্থা হয়েছেন এক যুগল । এমনকী জেলাশাসকও তাঁদের ফিরিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ।

    ৩। লিভ-ইন সম্পর্কে থাকা মিরাটের যুগল প্রতিদিন হুমকির মুখে পড়ছেন। বিয়েও করতে পারছেন না ।

    ৪। ১৩ই ডিসেম্বর জন্মসূত্রে হিন্দু মেয়ে পিঙ্কি ওরফে মুসকানের (২২ বছর) বিষ ইঞ্জেকশানের মাধ্যমে গর্ভপাত করিয়ে প্রমাণ দেওয়া হল যে এসব ধর্মের উস্কানিমূলক গালভরা শব্দবন্ধগুলো আসলে মেয়েদের জরায়ুর উপর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একচেটিয়া গা-জোয়ারি অধিকার প্রয়োগের আধার। ধর্ম এখানে নিমিত্ত মাত্র।

    মুসকানের শাশুড়ির বিলাপেরও সুযোগ নেই, তাঁর ছেলে অর্থাৎ মুসকানের স্বামী রাশিদ (২৭ বছর) যে কোন্‌ জেলে পচছেন নাকি গুমখুন হয়ে গেছেন কেই বা জানে!

    অনাগত বাচ্চার 'রাম নাম সত্য হ্যায়' করে দিয়ে বিদ্বেষের কারবারিরা কথা রেখেছেন ।

    চমকের এখনও বাকি। বজরং দলের এক নেতা কোনো লুকোছাপা না করে বুক ঠুকে কৃতকর্মের কথা স্বীকার করেছেন। সবই নাকি দেশের হিন্দু মেয়েদের ‘ইজ্জত’ তথা ‘কালচার’-এর স্বার্থে!

    যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দ্বারা শত শহীদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছিলাম সাতচল্লিশের মধ্যরাতে, তার বাহাত্তুরে বৃদ্ধ অন্তরে এমন বিকৃতি ঘটেছে যে ‘দ্বেষপ্রেম’ দিয়ে সেই ঐতিহ্যের ভিত্তিপ্রস্তরকে নড়িয়ে দেওয়াটা বড্ড সহজ হয়ে পড়েছে ।

    কিন্তু এতে যে মেয়েটির সর্বনাশ হচ্ছে, তাঁর ইচ্ছে-অনিচ্ছের খবর কেউই নিচ্ছে না। 'অনার কিলিং'-এ নির্বিচারে নারীহত্যাকে আধুনিক পরিবারের সম্মান-ধর্মরক্ষার নাম দিয়েছে খাপ পঞ্চায়েত। যেখানে হত্যা আটকানো হচ্ছে সেখানে ‘চাপিয়ে দেওয়া’ খাপ সিদ্ধান্তকেই ‘মেয়ের চয়েস’ বলে নথিবদ্ধ করা হচ্ছে একুশে আইনের খাতায়! সেটা ধর্মান্তরিত করে ‘ঘর ওয়াপসি’ হোক কিম্বা মেয়ের অমতে স্বধর্মে বিয়ে হোক ।

    এভাবেই ধর্মের জিগির তুলে হিন্দু নারীদের ‘রক্ষা করা’র নামে এবার তাদের উপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ আরও কড়া হবে, হিন্দু মেয়েদের 'সম্মান' বাঁচাতে পায়ের বেড়ি আরও মজবুত করা হবে,পাশের মুসলিম যুবকের দিকে প্রেমাতুর দৃষ্টিতে তাকালে জবাই করার জন্য রামদা হাতে ছুটে আসবে গেরুয়াধারী, তিলক কাটা তাবৎ ধর্মরক্ষকেরা। ‘লাভ জেহাদ’ থেকে বাঁচানোর নামে পারিবারিক হিংসা ও অত্যাচার বৃদ্ধি পাবে ,অথচ প্রতিকারের উপায় বলে কিছু থাকবে না। অন্যদিকে নয়া আইনের ফাঁক গলে পাত্র-পাত্রী উভয়ের প্রতিই যে কেউ ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতে পারবে, কিন্তু আদালত অবধি সেসব কেস গড়াবে না। ইতিমধ্যেই আমরা প্রেম জেহাদ ও অনার কিলিং-এর নামে বহু খুনের কথা জানতে পেরেছি সংবাদ মাধ্যমে ।

    এমন অরাজক হিটলারি আইন কি ভারতের মত বৃহত্তম গণতন্ত্রে কাম্য?

    নানা জঙ্গি কর্মকাণ্ডের জেরে, অশিক্ষিত বিধান কিম্বা ধর্মীয় উগ্রতার পরিচয় দেওয়ার ফলে ইসলামোফোবিয়া গোটা দুনিয়াজুড়ে চলছে। এখন ‘লাভজেহাদ’-এর কারবারিরা খুব সহজেই এই ইসলামোফোবিয়াকে কাজে লাগিয়ে আপামর জনসাধারণের ‘রাইট টু চয়েস’কে প্রকাশ্যে হত্যা করছে, তবে কিছুটা ঘুরপথে। ‘নিজধর্ম বাঁচাও’-এর সুগার কোটেড ঘুরপথই এইসব উগ্রবাদী ফতোয়ার পক্ষে হাততালি জুটিয়ে দিচ্ছে। কারণ হাততালিদাতাদের মাথায় তখন একটাই ভাবনা, ‘এইবার কাটার-বাচ্চাদের মোক্ষম জবাব দেওয়া যাবে’, ‘এবার ওদের জব্দ করা যাবে’ ইত্যাদি।

    এই যে 'দ্যাখ কেমন লাগে' নীতি, এই যে গা-জোয়ারি একরোখা গুণ্ডাবাদ - মানুষ মারার হোলি খেলায় উন্মত্ত এই উগ্র জনতাই কি তবে দেশের ভাবী নাগরিক? হিন্দু-মৌলবাদই কি তবে লিখবে ভারতের নয়া ইতিহাস ?

    আর আমরা চুপচাপ স্রেফ ভোটের কালি মাখব?

    আর বছর বছর উইশ করেই যাব "হ্যাপি হিউম্যান রাইটস ডে" !

    ইসলামোফোবিয়া, হিন্দুত্ববাদ ও আজকের ভারত

    ইন্টারনেট জঙ্গিদের তাণ্ডবে যেমন কিছুদিন আগে তানিষ্কের একটা সম্প্রীতির বিজ্ঞাপন মুছে গেল ‘লাভ জেহাদে’র ধুয়া তুলে, তেমনি করেই কি ভালবাসা, সম্পর্ক ইত্যাদি ব্যক্তিগত পরিসরেও অমন উগ্রশক্তির নির্লজ্জ আস্ফালনের জেরেই এবার থেকে রাষ্ট্রযন্ত্র তার নয়া তালিবানি গিলোটিন নিয়ে নাক গলাবে আমাদের ডাইনিং কিম্বা বেডরুমে ?

    যদি ‘ইসলামোফোবিয়া’ই ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তির মাথাচাড়া দেওয়ার নেপথ্যের কারণ, তবে একটা সেক্যুলার রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ শাসকের তলিয়ে ভাবা উচিত উগ্রবাদের নেতিবাচক অন্ধত্ব কি আদৌ মহত্বের পথে অনুসরণযোগ্য? উদারনৈতিক চিন্তাধারার কণ্ঠরোধ করে ‘চন্দ্রাভিযান’ করা দেশকে আরও হাজার বছর পিছিয়ে দেব নাকি অন্যায়-অপরাধ-ভুলশিক্ষাকে সমূলে উপড়ে ফেলব ?

    রবীন্দ্র-নজরুল-মান্টোর দেশের মিশ্র সংস্কৃতিই আমাদের ঐতিহ্য এবং আমাদের দেশপ্রেমের আধার। তাই তো দাঙ্গায় ছেলেকে হারিয়েও আসানসোলের ইমাম সাম্প্রদায়িক শক্তির বিপক্ষে মাথা সোজা রেখে বলেন, “ছেলেকে হারিয়েছি। তবু বদলা চাই না।” পুত্রশোকে মুহ্যমান বাবার এই সহিষ্ণুতার জন্মদাত্রীই হল আমাদের মাতৃভূমি ভারত ।

    এমতাবস্থায় অসহিষ্ণু রাষ্ট্রশক্তি যদি কোনও বর্বরতাকে প্রশ্রয় দেয়, জনস্বার্থ বিরোধী বিল আনে ধর্মের নামে, তবে বুঝতে হবে উক্ত অসহিষ্ণু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীই উদ্দিষ্ট হিন্দুরাষ্ট্রের ভাবী নাগরিক।

    আরও বুঝতে হবে, যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দ্বারা শত শহীদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছিলাম সাতচল্লিশের মধ্যরাতে, তার বাহাত্তুরে বৃদ্ধ অন্তরে এমন বিকৃতি ঘটেছে যে ‘দ্বেষপ্রেম’ দিয়ে সেই ঐতিহ্যের ভিত্তিপ্রস্তরকে নড়িয়ে দেওয়াটা বড্ড সহজ হয়ে পড়েছে ।

    এই অসুস্থ সময় বারবার প্রশ্ন তুলছে, আবার এক পরাধীনতা, বৈষম্য ও মধ্যযুগীয় আঁধার কি গ্রাস করছে না আমাদের ? ইতিহাসের অন্ধকার যুগের পুনরাবৃত্তি কি তবে আমাদের ভবিতব্য? আমরা কি আদৌ শুনতে পাচ্ছি?

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics