• আইন, সমাজ, জীবনসঙ্গী ও আমার গল্প


    1    254

    February 9, 2021

     

    কিছুদিন পরেই সরস্বতী পুজো। এই সময়টা এলেই মনটা কেমন স্কুলের দিনগুলোতে ফিরে যায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে কৈশোরের স্মৃতি। এই সময়টা আমাদের সবচেয়ে মনখারাপের সময় ছিল—আমাদের মানে আমার আর আমার প্রাণের বন্ধু (পড়ুন বান্ধবী) জয়ব্রতর। একে তো অনাকাঙ্ক্ষিত শরীর, ছোট চুল, শাড়ি পরতে না পারা নিয়ে খেদের শেষ নেই, তার ওপর সরস্বতী পুজোর দিনে আবিষ্কার করতাম উঁচু ক্লাসের যে দাদাটির মুখ হৃদয়ে তিরতির কাঁপন ধরাচ্ছে, সে পাশের গার্লস স্কুলের বাসন্তী শাড়ি-পরিহিতা মেয়েটির প্রেমে হাবুডুবু! আমাদের তখন হৃদয়ের দুকূল ছাপিয়ে ‘উথলে নয়নবারি’ অবস্থা।

    ছোটবেলায় কখনও মন খুলে হেসেছি বলে মনে পড়ে না। টিউশনে পড়া বুঝতে না পারলেও চুপ করে থাকতাম, পাছে আমার কথা বলার ভঙ্গিতে সবাই হেসে ওঠে।

    উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত আমাদের পড়াশোনা একটি বয়েজ স্কুলে। স্কুলে কেবল আমরা দুজনই পরস্পরের বন্ধু ছিলাম। একেবারে অভিন্নহৃদয় বন্ধুত্ব যাকে বলে আর কী! আর কোনো বন্ধু ছিল না আমাদের। থাকা সম্ভবও নয়, কারণ আমাদের সাথে সাথে বাকি সহপাঠীরাও ততদিনে বুঝে গিয়েছিল যে আমরা ওদের থেকে আলাদা। মফস্বলে একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে এরকম একটি ব্যতিক্রমী জীবন নিয়ে বড় হয়ে ওঠা খুব সহজ ছিল না। ইন্টারনেট শব্দটা প্রথম শুনলাম ক্লাস এইট-নাইনে পড়ার সময়‌। তার আগে তথ্যভান্ডার বলতে বাড়িতে আসা দৈনিক সংবাদপত্র এবং পাড়ার লাইব্রেরী। আমাদের অল্পশিক্ষিত, রক্ষণশীল পরিবারে নিজেকে নিয়ে এবং নিজের অনুভূতিগুলো নিয়ে কথা বলাও সম্ভব ছিল না। কারণ ছোটবেলা থেকেই পরিবারের সকলের আচরণ বুঝিয়ে দিয়েছিল আমার স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশটাও(পড়ুন মেয়েলি) তাঁদের পক্ষে লজ্জার, অসম্মানের। নিজের অন্তরকে প্রাণপণে চেপেচুপে, ঢাকাঢুকি দিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম। ছোটবেলায় কখনও মন খুলে হেসেছি বলে মনে পড়ে না। টিউশনে পড়া বুঝতে না পারলেও চুপ করে থাকতাম, পাছে আমার কথা বলার ভঙ্গিতে সবাই হেসে ওঠে। তারপর ক্রমে ইন্টারনেট এল, সোশ্যাল মিডিয়ার আবির্ভাব ঘটল। ধীরে ধীরে জানতে পারলাম আমার অন্তর-প্রকৃতিটা কোনও অসুখের ফল নয়। বেশিরভাগ মানুষের মতো না হলেও, আমি অস্বাভাবিক নই। আমার নিজেকে হীন মনে করার কোনও কারণ নেই, কারণ আমি প্রকৃতিরই এক অন্যরকম সৃষ্টি। আমার মতো আরও অনেক মানুষ আছেন গোটা বিশ্ব জুড়ে। এই আত্মবিশ্বাস অর্জন করার পর আমার বাবা-মায়ের কাছে নিজের সম্পর্কে সবটা খুলে বলি এবং সাথে এটাও জানাই আমার পক্ষে মিথ্যে কোনও জীবন যাপন করা সম্ভব নয়। আমি যা, নিজের সম্পর্কে ঠিক সেই বার্তাই বাইরে গোটা জগতকে দিতে চাই। তখন আমি সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছি। বলাই বাহুল্য এই যাত্রাপথ সহজ ছিল না এবং এখনও সহজ নয়।

    পাছে কোনরকমভাবে নিজের নারীসত্ত্বার প্রকাশ হয়ে পড়ে, এই নিয়ে উৎকণ্ঠার শেষ ছিল না। তাই প্রেমের প্রকাশ তো দূরস্থান, যৌবনোদ্গমের সময়টায় সমবয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে যে স্বাভাবিক প্রেমের বা ভালোলাগার উচ্ছ্বাস দেখেছি, সেই সুখ থেকে শতহস্ত দূরে আমার বয়ঃসন্ধি

    পরিবারে বা সমাজে যে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে, তা কিছুটা হলেও সহজ করেছে আইনি পরিবর্তন—এদেশে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ে ৩৭৭ ধারার রদ। এই প্রসঙ্গেই আসি ভালোবাসার মানুষ বা জীবনসঙ্গী নির্বাচনের কথায়।

    আমরা যে সময়টায় বড় হয়ে উঠছি, সেসময়টায় কোথাও ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের কোনো‌ মর্যাদাজনক ছবি কোথাও ছিল না। মূলধারার ছবিতে, চলচ্চিত্রে আমাদের মতো চরিত্রগুলোকে বিকৃত করে, যৌনতার একটা অশ্লীল পরত চড়িয়ে প্রকাশ করা হত, যা অত্যন্ত কুরুচিকর। ফলত সাধারণ মানুষের একটা প্রবণতাই ছিল ঐ পর্দায় দেখা চরিত্রগুলোর সাথে আমাদের মতো বাস্তব চরিত্রকে সংযুক্ত করে দেখার। যে কারণে আমরা নিজেকে নিয়ে সবসময়ই খুব সঙ্কুচিত হয়ে থাকতাম‌। পাছে কোনরকমভাবে নিজের নারীসত্ত্বার প্রকাশ হয়ে পড়ে, এই নিয়ে উৎকণ্ঠার শেষ ছিল না। তাই প্রেমের প্রকাশ তো দূরস্থান, যৌবনোদ্গমের সময়টায় সমবয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে যে স্বাভাবিক প্রেমের বা ভালোলাগার উচ্ছ্বাস দেখেছি, সেই সুখ থেকে শতহস্ত দূরে আমার বয়ঃসন্ধি অন্ধকারময় কারারুদ্ধ অবস্থায় ছিল। প্রেমের স্বপ্নময় জগত ছিল কেবল আমার কল্পনায়। কেউ বাস্তবে আমাদের ভালোবাসতে পারে এবং সেই ভালোবাসার মানুষটির সাথে ঘর যে বাঁধা যায় এটাই ছিল ভাবনার অতীত।

    নারীগর্ভকে ব্যবহার করে পুরুষের নামাঙ্কিত বংশলতিকাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে মূল পিতৃতান্ত্রিক ধাঁচাটি আছে তা আমাদের অস্তিত্বের কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে এবং সেই কারণেই এই গোটা সমাজব্যবস্থা থেকেই আমরা ব্রাত্য।

    যদিও আপাতদৃষ্টিতে খুব কম সময়ে দ্রুত পরিস্থিতির বদল চোখে পড়ছে। ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের গোচরে আসছে আমাদের ওপর ঘটে চলা এই দীর্ঘ শতকের নিপীড়ন।  আমরা অনেক ট্রান্সজেন্ডার নারী-পুরুষকে তাঁদের ভালোবাসার মানুষটির সাথে সামাজিক বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে দেখেছি, আমাদের প্রেমজীবন মূলধারার ছবির বিষয় হতে শুরু করেছে। কিন্তু আলোর ক্ষীণ আভাস পেলেও এখনও কাটেনি অন্ধকার। ৩৭৭ রদ পরবর্তী সময়ে আমাদের সহবাসে বা সামাজিক বিবাহে অসুবিধে না থাকলেও সেই বিবাহের কোনও আইনি স্বীকৃতি নেই। বিবাহ নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠান থেকে কোনও হেটেরোসেক্সুয়াল দম্পতি যে সামাজিক সুরক্ষা, মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পেয়ে থাকেন, আমাদের ক্ষেত্রে এর কোনওটিই নেই। বস্তুত ‘পছন্দমতো জীবনসঙ্গী নির্বাচন করা’ এই কথাটির মধ্যেও একটা প্রিভিলেজ আছে,  আমাদের জীবন এখনও সেই জায়গা থেকে সহস্রযোজন দূরে অবস্থান করছে। মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক দাবি সনদ (Universal Declaration of Human Rights) অনুযায়ী মানুষ জন্মেই স্বাধীন। কিন্তু বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌনতার মানুষরা এখনও সেই অর্থে মানবাধিকারের পরিসরেই আসেনি। তাই জীবনসঙ্গী বাছার স্বাধীনতা বা চয়েস তো আমাদের কাছে সোনার পাথরবাটি!

    যৌনতার দিক থেকে রাষ্ট্রের নজরে সবেমাত্র আমরা অপরাধী তকমা থেকে মুক্তি পেয়েছি বটে, কিন্তু শুধুমাত্র জেল-হাজতের শাস্তি থেকে মুক্তি দিয়েই রাষ্ট্র তার দায় সেরেছে। এই রাষ্ট্রেরই ক্ষুদ্রতম একক হল পরিবার। একটি পরিবারে যখন কেউ সমকামী অথবা রূপান্তরকামী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন প্রথম যে প্রশ্নটি ওঠে তা হল বংশের কী হবে?  অর্থাৎ নারীগর্ভকে ব্যবহার করে পুরুষের নামাঙ্কিত বংশলতিকাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে মূল পিতৃতান্ত্রিক ধাঁচাটি আছে তা আমাদের অস্তিত্বের কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে এবং সেই কারণেই এই গোটা সমাজব্যবস্থা থেকেই আমরা ব্রাত্য। এবং রাষ্ট্রও যে পক্ষান্তরে এই পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকেই শক্ত করতে চায় এর প্রমাণ মেলে যখন বর্তমান সরকার আমাদের পাঁচ হাজার বছরেরও পুরোনো সভ্যতার ঠিকাদার হয়ে এই কথা বলে যে এই ধরনের বিবাহ আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি বহির্ভূত।

    ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা এই আইনের কোনও সরাসরি প্রভাব কি প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌন পরিচয়ের কোনও মানুষের জীবনে পড়বে? এককথায় না। তাহলে ‘আমাদের ইস্যু’ না হওয়া সত্ত্বেও এই আইন নিয়ে কথা বলব কেন?

    আর ঠিক এই কারণেই এখানে ভারতের পাঁচ রাজ্যে ভিনধর্মে বিয়ে সংক্রান্ত নতুন অর্ডিন্যান্স-এর কথা প্রাসঙ্গিক। ৩৭৭ ধারা রদের রায়ে গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছিল, সংবিধান কোনওদিনই সংখ্যাগরিষ্ঠের নৈতিকতাকে সমাজের নৈতিকতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে দিতে পারে না। তাই যেকোনও দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সম্মতিতে একে অপরের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন ‘অসাংবিধানিক’ বা অনৈতিক নয়। ভারতের সংবিধানের এই উদারনৈতিক মানসিকতাকে সরাসরি আঘাত করে তথাকথিত ‘লাভ-জিহাদ’ বিরোধী রাজ্যস্তরের এই ধর্মান্তরণ সংক্রান্ত নতুন আইন। ভিনধর্মের পুরুষ-নারীর বিয়েতে ধর্মীয় মৌলবাদীদের আপত্তি। এই আপত্তি পরিবারের স্তরে সবসময়ই ছিল, কিন্তু ইদানিং ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্রও এই ব্যাপারে আইনি আপত্তি জানাতে শুরু করেছে। ভিন্ন ধর্মে বিয়ে করলে প্রমাণ দিতে হবে যে এই বিয়ে আসলে ধর্ম পরিবর্তনের অছিলা নয়। মানে দোষ আছে মনে করেই বিচার শুরু হবে। যদি দেখা যায় প্রমাণ নেই তেমন তাহলে ছাড় মিললেও মিলতে পারে।

    ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা এই আইনের কোনও সরাসরি প্রভাব কি প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌন পরিচয়ের কোনও মানুষের জীবনে পড়বে? এককথায় না। তাহলে ‘আমাদের ইস্যু’ না হওয়া সত্ত্বেও এই আইন নিয়ে কথা বলব কেন? কারণ, এই আইনটি প্রণয়নের পেছনে আইন প্রণেতাদের যে মানসিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা ধর্মীয় মৌলবাদী মানসিকতার সরাসরি প্রকাশ হলেও তার অন্তরে মিশে আছে পিতৃতন্ত্রের হিংসাত্মক চেহারা। এই একই মানসিকতা ইন্ধন জোগায় বিভেদকামিতাকে। এবং এই মানসিকতারই জন্ম ইস্তক শিকার হয়ে চলেছি আমরা, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরাও।       

    আমার পার্টনারের সঙ্গে আমার দাম্পত্যজীবন পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। এই ক’বছরে আমাদের বাইরের প্রতিকূলতার সাথে সমান তালে পাল্লা দিয়ে লড়তে হয়েছে পারিবারিক প্রতিকূলতার সাথেও। আমরা সাধারণভাবে দেখে থাকি একটি হেটেরোসেক্সুয়াল সম্পর্কের ক্ষেত্রে নানা ওঠাপড়া, টানাপোড়েনের সময়ে সাপোর্ট সিস্টেম হিসেবে পরিবার, সমাজ কীভাবে একযোগে কাজ করে, কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে সর্বত্র শুনতে হয় ‘এ আবার কী’! , ‘এ টেঁকে নাকি’? খুব কাছের দু-একজন বন্ধু শুভাকাঙ্ক্ষী ছাড়া আমাদের দাম্পত্যজীবনের কোনও উদযাপন কোথাও হয়নি। কেবল দুজন দুজনের ভালোবাসা, বিশ্বাস ও ভরসাই আমাদের একসাথে চলার একমাত্র পাথেয়। তবু আমরা অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর, একটা মেট্রো শহরে থাকি বলে আমাদের জীবন অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু মফঃস্বলে, শহরতলিতে, গ্ৰামাঞ্চলে প্রতিনিয়ত আমাদের মতো মানুষদের যে কতটা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে যখনই রাস্তাঘাটে কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টি বা টিপ্পনীর সামনে খুব সঙ্কুচিত লাগে, তখনই নিজেকে মনে করাতে থাকি আমি ভারতের একজন নাগরিক। সংবিধান অনুযায়ী আর পাঁচজন নাগরিকের থেকে আমার সামাজিক মর্যাদা কোনও অংশে কম নয়। আজ যদি এই সাংবিধানিক মূল্যবোধটিকে আওড়ানোর সুযোগও চলে যায়, তাহলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস প্রকট না হয়েও প্রচ্ছন্নভাবেই আমাদের মত মানুষের জীবনকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে। প্রেম, ভালোবাসা, সঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতাকে তাই জিহাদের সাথে একাসনে বসালে, তার ভিত্তিতে আইন তৈরি হলে সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক যে পরিসর ব্রিটিশ-উত্তর ভারত তৈরি করেছে, সেই প্রাণটিই শেষ হয়ে যাবে।

     
     



    Tags
     



    1 Comment

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics