খুব পজিটিভ ছিলাম যখন ফেব্রুয়ারিতে স্কুল খুলল
0 140আমার স্কুলটা দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার মগরাহাট ১ ব্লকের অন্তর্গত শেরপুর এলাকায়। উচ্চমাধ্যমিক কো-এডুকেশনাল এই শেরপুর রামচন্দ্রপুর হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষকতা করছি বিগত দু’বছর। গতবছর মার্চ মাসে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীন কোভিড১৯ এর জন্য যখন পুরো দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা হয় তখন মনেই হয়নি এর প্রভাব এত গভীরভাবে পড়বে আমাদের সবার ওপর। প্রথমদিকে আমরা ভেবেছিলাম দু-তিন মাসের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে এই সময়টা যেন ফুরোচ্ছেই না। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ছাত্রছাত্রীরা স্কুলের বাইরে। ছাত্রজীবনের সবচেয়ে মূল্যবান ও গঠনমূলক সময় এই স্কুলজীবনে একজন ছাত্র বা ছাত্রীর পঠনপাঠনের পাশাপাশি বিভিন্ন সহপাঠক্রমিক বিষয় ও বন্ধু বান্ধব, সহপাঠী, সিনিয়র দাদা-দিদি, জুনিয়র ভাই বোন এবং শিক্ষক শিক্ষিকাদের সঙ্গে মেলামেশার মাধ্যমে মনের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। কিন্তু সেই সবকিছুই এখন বন্ধ। নেই একসাথে প্রেয়ার করা, টিফিন শেয়ার করা, মিড ডে মিলের হলঘরে বসে একসাথে খাওয়াদাওয়া আর হুল্লোড়।
আমার স্কুলে এবছর কিছু ছেলেমেয়ে ভর্তিই হয়নি! যখন যোগাযোগ করেছি, জেনেছি তাদের কারো বিয়ে হয়ে গেছে, কেউ বা চলে গেছে কাজ নিয়ে অন্যত্র।
আমার স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা মূলত নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসে। তাই লকডাউনের কিছু সময় পর থেকে, পঠনপাঠনের ঘাটতি পূরণ করার জন্য প্রাথমিকভাবে শ্রেণীভিত্তিক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে এবং পরবর্তীকালে গুগল মিট-এর মাধ্যমে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ক্লাস শুরু করলেও, বেশিরভাগেরই স্মার্টফোন না থাকায় এই সুযোগ নিতে পারেনি। তখন শিক্ষাদপ্তরের উদ্যোগে মিড ডে মিল দেওয়ার সময়েই অভিভাবক মারফত ছাত্রছাত্রীদের এক্টিভিটি টাস্ক দেওয়া শুরু হয়। এতে ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হয় ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকার কারণে স্কুলছুটের সংখ্যা দিন-কে-দিন বাড়তে থাকে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে শিশুশ্রম এবং বাল্যবিবাহ। আমার স্কুলে এবছর কিছু ছেলেমেয়ে ভর্তিই হয়নি! যখন যোগাযোগ করেছি, জেনেছি তাদের কারো বিয়ে হয়ে গেছে, কেউ বা চলে গেছে কাজ নিয়ে অন্যত্র। আর যেহেতু আমাদের সমাজে সব কোপই আগে গিয়ে পড়ে মেয়েদের ওপর, তাই বিশেষ করে যাদের অনেক ভাইবোন আছে আর সংসারে আর্থিক অনটন, তারা সহজেই শিশুকন্যার বিয়ের ব্যবস্থার মাধ্যমে মুক্তির পথ খোঁজে।
আমাদের স্কুলে ধারাবাহিকভাবেই স্বয়ংসিদ্ধা টিম ও কন্যাশ্রী ক্লাবের উদ্যোগে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার মাধ্যমে নাবালিকা বিয়ে, পাচার, গার্হস্থ্য হিংসা বন্ধের চেষ্টা করা হয়। আমাদের ইংরেজির শিক্ষক পল্লব সেনগুপ্ত মহাশয় এই বিষয়ে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকায়, আর তাঁকে সবসময় সাহায্য করেন স্কুলের অন্যান্য শিক্ষক ও শিক্ষিকারা। পল্লববাবু চাইল্ড লাইনের সাথে যোগাযোগ করে এই নিয়ে এলাকায় কাজ করে চলেছেন বহুদিন। এর আগেও আমরা স্কুলের তরফে উদ্যোগ নিয়ে অনেক বিয়ে আটকেছি, পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েরা ফিরে এসে আবার স্কুলে পড়াশোনা করছে।
অনলাইন ক্লাসের সুবাদে এমনিতেও ইণ্টারনেটের ব্যবহার আগের থেকে অনেক বেড়েছে। এর ফলে তারা অজান্তেই অন্তর্জালের নানা অচেনা ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের জন্য বিপদ ডেকে আনছে।
এই কিছুদিন আগেই মিড ডে মিল দিতে একদিন স্কুলে গেছি। স্কুলের কাছেই থাকে এমন একজন অভিভাবক এসে জানান তাঁর মেয়ে একটি ছেলের সাথে পালিয়েছে। ক্লাস নাইনের ছাত্রী। আমি স্কুলের স্বয়ংসিদ্ধা গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম তৎক্ষণাৎ। শেষপর্যন্ত মেয়েটি ফিরে আসে, পড়াশোনাও আবার শুরু করে। কিন্তু এই ছাত্রী একা নয়, লকডাউনে এরকম বেশ কিছু ছাত্রীরই বিয়ে হয়ে গেছে বা তারা পালিয়ে গেছে, তাদের আর শিক্ষায় ফিরিয়ে আনা যায়নি। ছেলেদের মধ্যেও কয়েকজন বিভিন্ন কাজে জেলা বা রাজ্যের বাইরে চলে গেছে—এর মধ্যেই একদিন উচ্চমাধ্যমিকের এমন এক ছাত্রের সাথে আমরা যোগাযোগ করি তার অনুপস্থিতির বিষয়ে। সে নিজেই জানায়, স্কুল বন্ধ, তাই এক আত্মীয়ের সূত্রে কাজের খবর পেয়ে সে বাইরে চলে গেছে, আর আসতে পারবে না পরীক্ষা দিতে।
ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা অনিশ্চিত হওয়ার আরেকটা কারণ ইণ্টারনেটের বিপজ্জনক ব্যবহার। অনলাইন ক্লাসের সুবাদে এমনিতেও ইণ্টারনেটের ব্যবহার আগের থেকে অনেক বেড়েছে। এর ফলে তারা অজান্তেই অন্তর্জালের নানা অচেনা ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের জন্য বিপদ ডেকে আনছে। এই বিপদ থেকে ছাত্রছাত্রীদের রক্ষা করার জন্য আমরা এখন একটি বেসরকারি সংস্থার সাহায্যে ডিজিটাল লিটারেসি ও সিকিওরিটি-র ট্রেনিং দিয়ে তাদের সাবধান ও সতর্ক করার চেষ্টা চালাচ্ছি।
একদিকে স্কুল খুললে সংক্রমণের আশঙ্কা, অন্যদিকে স্কুলে না যাওয়ার একাধিক নেতিবাচক প্রভাব—এই দুইয়ের মাঝে দোদুল্যমান শিক্ষার ভবিষ্যত। আর শুধু শিক্ষাই তো নয়, স্কুলে না যাওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এমনিতেই আজকের দিনে বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে বাড়িতে একা, না আছে ভাইবোন, না কোনও খেলার সঙ্গী। তার ওপর স্কুলের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গ ও খোলামেলা পরিবেশ থেকে একটানা বঞ্চিত ওরা সবাই। এখন শুধু টানা বাড়িতে থাকার একঘেয়েমি, স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করতে পারার মনখারাপ।
প্রায় এক বছর পর স্কুল খুলল। ছাত্রছাত্রীদের মুখের হাসি আর আনন্দ দেখে মনে হচ্ছিল ওরা প্রাণ ফিরে পেল। আমরাও প্রত্যেকেই ভাবলাম, যাক এবার পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হবে এবং স্কুল তার পুরোনো ছন্দ ফিরে পাবে
স্কুলের ছেলেমেয়েদের মতোই প্রধান শিক্ষক হিসেবে আমারও কি কম কষ্ট? স্কুলের কর্মব্যস্ততা, স্টাফরুমে শিক্ষকদের সারাদিনের আনাগোনা, নানা কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা সবকিছুই অতিমারীর ধাক্কায় স্তব্ধ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে জীবনটাকে কেউ যেন জোর করে থামিয়ে রেখেছে। গতবছর অতিমারীর মধ্যেই আমরা কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকা মিলে বিদ্যালয়ে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করে মন কিছুটা হালকা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এই উদযাপনের মূল যারা—স্কুলে কিছু একটা হলেই যাদের উৎসাহের শেষ থাকেনা—সেই আমাদের ছাত্রছাত্রীরা ছিল না সেদিন। আরো বেশি করে ওদের অভাবটা বিঁধছিল কারণ প্রতি বছর এই দিনে ওদের নিয়ে পরিক্রমা, দেশ ও দেশাত্মবোধকে ঘিরে নানা কথা, গান, অনুষ্ঠান সেসব ছাড়া গোটা উদযাপনটাই একেবারে ব্যর্থ মনে হচ্ছিল। তাছাড়াও প্রধান শিক্ষক হিসাবে মিড-ডে মিল দেওয়া বা অন্যান্য কাজে বারবার স্কুলে যেতে হয়। ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ছাড়া শান্ত ফাঁকা স্কুলবাড়ি কেবল পীড়াই দেয়। ভরা স্কুলপ্রাঙ্গনে কচিকাঁচাদের কলতান যে শিক্ষক হিসেবে কত বড় পাওয়া, তা তো ভাষায় প্রকাশ্য নয়!
ছোট ছোট এই ছেলেমেয়েরাও সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত মাস্ক পরে থাকা বা অন্যান্য সবরকম বিধি মেনে চলছিল। যেভাবেই হোক যেন স্কুলে আসতে পারি—এটাই ওদের একমাত্র চাওয়া তখন।
তাই খুব পজিটিভ ছিলাম যখন ফেব্রুয়ারি মাসে প্রায় এক বছর পর স্কুল খুলল। ছাত্রছাত্রীদের মুখের হাসি আর আনন্দ দেখে মনে হচ্ছিল ওরা প্রাণ ফিরে পেল। আমরাও প্রত্যেকেই ভাবলাম, যাক এবার পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হবে এবং স্কুল তার পুরোনো ছন্দ ফিরে পাবে, আবার নতুন উদ্যমে সব শুরু হবে। স্কুল খোলার দিন থেকেই প্রতিদিন সব ক্লাসে ক্লাসে ঘুরেছি নিজে। যেহেতু একেবারে স্বাভাবিক অবস্থায় স্কুল খুলেছে তা নয়, তাই আমরা সরকারি নির্দেশ পাবার পরে পরেই অভিভাবকদের সঙ্গে সভা করে সমস্ত প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক বিধি নিয়ে আলোচনা করেছি। এমনকী ঠিক করেছিলাম সব ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে একসাথে ক্লাস করা হবে না। অলটারনেট করে ক্লাস হত। ক্লাসের ছাত্রসংখ্যা অনুযায়ী আমরা ভাগ করে নিয়ে একেকদিন একেকটা দলকে আসতে বলছিলাম। অর্থাৎ পঞ্চাশ শতাংশ ছাত্রছাত্রী নিয়ে একেকদিন ক্লাস হত। সবসময় মাস্ক পরে থাকতে হবে এবং লম্বা বেঞ্চের দু’ধারে দু’জন বসবে—এভাবেই নিয়ম করা হয়েছিল। অবাক হয়ে যাই, ছোট ছোট এই ছেলেমেয়েরাও সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত মাস্ক পরে থাকা বা অন্যান্য সবরকম বিধি মেনে চলছিল। যেভাবেই হোক যেন স্কুলে আসতে পারি—এটাই ওদের একমাত্র চাওয়া তখন। তবে টানা দু’মাসও স্কুল করা গেলনা, কারণ ইলেকশনের বেশ কিছুদিন আগেই রিকুইজিশন চলে এল এবং আমাদের স্কুল বন্ধ করে দিতে হল। ভোটের পর আবার স্কুল খুলেছিলাম। এমনকী সরকারি নির্দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রীরা টেস্টে সরাসরি এলাউ হয়ে গেলেও, আমরা ছেলেমেয়েদের একটু ভালোভাবে প্রস্তুত করার জন্য মক টেস্টের ব্যবস্থাও করেছিলাম। কিন্তু তিনটে বিষয়ের পরীক্ষা হতে না হতে আবার লকডাউন শুরু হয়ে গেল। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ সব আশায় জল ঢেলে দিল এবং স্কুল বন্ধ হয়ে গেল আবারও। আর এখন তো চারপাশের পরিস্থিতি ও বিশেষজ্ঞদের কোভিডের তৃতীয় ঢেউ নিয়ে সতর্কবার্তা স্কুল খোলার বিষয়টাকে আরোই অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
একজন শিক্ষক হিসেবে এটুকু বুঝতে পারছি, এই লকডাউন ও সেই সঙ্গে আমফান, যশ এর মতো ঝড় মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলছে তো বটেই, কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের জীবনের শুরুতেই শিক্ষাজগত থেকে এই দূরত্ব যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে চলেছে, তা গোটা একটা প্রজন্মকেই হয়ত একটা অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেবে। তাই প্রাণপণ চেষ্টা করে এই অতিমারীর মধ্যেও আমরা শিক্ষকরা যাতে ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছে যাই, তারা যাতে গঠনমূলক কাজে মন দিতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে পারি এবং কোনোভাবেই যাতে শিক্ষা থেকে তাদের দূরত্ব অনেকটা বেড়ে না যায় সেটা দেখতে পারি—এটাই এখন একমাত্র লক্ষ্য।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply