• হুড়োহুড়ি ছেড়ে চুপচাপ ত্রাণের লাইনে


    0    168

    July 6, 2021

     

    গত মার্চে সরকারি নির্দেশে প্রথম যখন বিদ্যালয়গুলো বন্ধ হল তখন আমরা কেউই বুঝতে পারিনি সামনে কী আসতে চলেছে। তার প্রায় এক সপ্তাহ পর ঘোষণা হল লকডাউন৷ হঠাৎ করেই যেন সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গেল৷ হারিয়ে গেল আমার কুড়ি বছরের নিয়মিত স্কুল যাওয়া আর ছাত্রীদের সঙ্গে সুন্দর সময় কাটানোর অভ্যাস৷ মাথায় ভিড় করে এল নানা দুর্ভাবনা৷ কী করবে আমার মেয়েগুলো? পড়া ছেড়ে দেবে না তো? হারিয়ে যাবে না তো জীবনের মূলস্রোত থেকে?

    আমার স্কুল দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কুলপি ব্লকে করঞ্জলী বালিকা বিদ্যালয়(মাধ্যমিক)। ছাত্রীসংখ্যা প্রায় বারশো৷ এই এলাকায় এখনও শিশুপাচার, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রমের হার অনেক বেশি, যেখানে শিশুরা, বিশেষ করে মেয়েরা, প্রতিদিন নানা বিরূপতার সম্মুখীন৷ তার ওপর বারবার প্রকৃতির প্রত্যাঘাত—গত বছর আমফান, এবারে ইয়াস—এই শিশুদের আরও বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে৷

    এখানে পঁচাত্তর ভাগ মানুষের জীবিকা অন্যের জমিতে চাষবাস আর মাছ ধরা—তাদের সন্তানের পড়াশুনা নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ কম৷ তাই এই অঞ্চলের শিশুদের জীবনে এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে৷ কিন্তু লকডাউনের ফলে শিশুদের সাথে যোগাযোগ রেখে চলাই কঠিন হয়ে পড়েছে৷ নবম-দশম শ্রেণীর ছাত্রীদের অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে কিছু পড়াশুনা কিম্বা মোটামুটি যোগাযোগ রাখতে পারলেও, নিচু ক্লাসের ছাত্রীদের সঙ্গে সেই যোগাযোগ রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে—বেশিরভাগেরই বাড়িতে ফোন নেই, অথবা অনেক সময়ই তা রিচার্জের অভাবে সচল থাকে না৷ কিন্তু পড়াশুনার সাথে ওদের যোগাযোগ বহাল রাখতে প্রতিবার মিড ডে মিল বিতরণের সময় পড়াশুনার কিছু অংশ বুঝিয়ে তার প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন জেরক্স করে দিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ অসুবিধা হলে কোন দিদিমণির সাথে যোগাযোগ করবে তাঁর নাম ও ফোন নম্বরও সঙ্গে দেওয়া হয়েছে৷ এতে কিছু কিছু ক্লাস থেকে অনেক ফোন কল পেয়েছি৷ তা যে সবসময় পড়াশুনা সংক্রান্ত, তা কিন্তু নয়৷ অনেক সময় শুধুই দিদিমণিদের সাথে কথা বলতে চেয়েছে। আমরাও বুঝেছি স্কুলে আসার জন্য ওরা ঠিক কতটা ছটফট করছে৷ বারবার শুনেছি, ‘কবে স্কুলে আসব’?

    যে বিদ্যালয়প্রাঙ্গণ তাদের নিয়ে মুখরিত থাকত, তা আজ একলা দাঁড়িয়ে৷ যেখানে তারা পড়াশুনা-খেলাধূলা-গান-নাচ করে নিশ্চিন্তে সময় কাটাতে পারত, সেই ক্লাসরুমগুলো যেন এখন ভীষণ একা, দুঃসময়ের প্রহর গুনছে৷ অন্যদিকে শিশুরাও বন্ধুহীন হয়ে ঘরবন্দী৷ এমনকী কারো কারো সেই ঘরটুকুও ভেসে গেছে ইয়াস-এর দুর্যোগে বাঁধ ভেঙে আর নদীর জলোচ্ছ্বাসে। যে বাচ্চাটা মিড ডে মিলের লাইনে দাঁড়িয়ে হুড়োহুড়ি করত কখন তাড়াতাড়ি খেয়ে একটু খেলে নেবে, সে আজ চুপচাপ থালা হাতে দাঁড়িয়ে থাকে ত্রাণ-শিবিরের লম্বা লাইনে৷ সে যেন ছুটতে ভুলে গেছে, ভুলে গেছে তার দুষ্টুমি৷ পড়াশুনা, খেলাধূলা সবকিছু পাশে সরিয়ে তারা এখনই নতুন এক জীবনসংগ্রামে সামিল৷ জল যে তাদের সবই ভাসিয়ে নিয়ে গেছে—ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তাদের ভবিষ্যৎ৷ যে মেয়েগুলো ভোরবেলা উঠে নদীর ধার ধরে দৌড় প্র্যাক্টিস করতে করতে একদিন জাতীয় অ্যাথলিট হওয়ার স্বপ্ন দেখত, তারাও এখন বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ত্রাণের লাইনে ব্যস্ত৷

    বেশিরভাগ অভিভাবকেরই প্রধান জীবিকা চাষবাস, আনাজ বাগান, মাছ ধরা আর ছোট ছোট ভেড়ি চালানো৷ কিন্তু ইয়াস-এ তার সবই নোনাজলে ধুয়ে গেছে৷ গাছ, মাছ, কিছু গবাদি পশুপাখি মরে চারিদিকে পচা দুর্গন্ধ৷ আর তারই মাঝে এদের নতুন জীবনযুদ্ধ৷ এতদিন পর্যন্ত এ অঞ্চলের মানুষ কখনও নদীর এই ভয়ঙ্কর রূপ দেখেনি৷ নদী ছিল এদের বড় আপন৷ এক দুর্যোগে তাদের সেই বিশ্বাস সম্পূর্ণ ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে৷ তারা আজ আতঙ্কিত৷ লকডাউনের ফলে আগেই বেশ কিছু মানুষ ভিনরাজ্য থেকে নিজের গ্রামে ফিরে এসেছিল৷ অল্পবিস্তর যে অনটন শুরু হয়েছিল, এই ইয়াস দুর্যোগের পর তা আরো প্রকট হচ্ছে৷ পরিবারের সদস্য সংখ্যা কমানোর জন্য প্রথম কোপটা পড়বে বাড়ির মেয়ের উপর—১৮ বছরের আগেই তাকে বসিয়ে দেওয়া হবে বিয়ের পিঁড়িতে৷ তার লেখাপড়া, খেলাধূলা নিয়ে তার যা কিছু স্বপ্ন তা জলাঞ্জলি দিয়ে মুখ বুজেই মেনে নিতে হবে অভিভাবকের অসহায়তা৷ বাড়ির ছোট ছেলেটিকেও রোজগারের জন্য লাগিয়ে দেওয়া হবে ছোটখাট কাজে কিম্বা পাঠিয়ে দেওয়া হবে ভিনরাজ্যে৷ ক্রমশ বাড়বে স্কুলছুট, বাল্যবিবাহের সংখ্যা৷ খাতা-কলমে আমরা যে পরিসংখ্যান দেখতে পাই, তা বোধহয় বাস্তবের খুবই সামান্য অংশমাত্র৷ এর ওপর রয়েছে প্রলোভনের ফাঁদ৷ অভাবের মধ্যে বেড়ে ওঠা বাচ্চাদের নতুন মোবাইল দেওয়া, ফোনে রিচার্জ করে দেওয়া, বাইকে করে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া—এই ছোট ছোট ইচ্ছেপূরণের মাধ্যমে এদেরকে খুব সহজেই বিপথে ও বিপদের দিকে নিয়ে যাওয়া যায়৷ মেয়েটি পাচার হয়ে যায় অন্য রাজ্যে আর ছেলেটি হারায় শিশুশ্রমিক হিসেবে৷ একটু ভালো থাকার ইচ্ছেই অনেক সময় এদের অন্ধকার জগতে ঠেলে দেয়৷

    আবার ভালো থাকার ইচ্ছে থেকেই সরকারী নির্দেশ না মেনে মিড ডে মিল আনতে অভিভাবকের বদলে অনেক সময়ই ছাত্রীরাই ছুটে চলে এসেছে নিজেদের প্রিয় স্কুল আর প্রিয় দিদিমণিদের সঙ্গে দেখা করতে৷ আসলে স্কুল মানে তো শুধু পড়াশুনা নয়, আরো অনেক কিছু—যে মেয়েটা কোনওদিন আঁকাই শেখেনি, সে নির্দ্বিধায় সবার সাথে বসে পড়ে আলপনা আঁকতে কিম্বা স্কুলের নানা অনুষ্ঠানের নাচগানে অংশগ্রহণ করে ফেলে নাচে তেমন পারদর্শী নয় এমন অনেকেই৷ স্কুল বন্ধ থাকার ফলে এই আনন্দ থেকে ওরা বঞ্চিত। আমরা এই সময়ে ওদের বলতাম ছবি এঁকে বা কিছু লিখে পাঠাতে—শূন্য স্কুলপ্রাঙ্গনেই বিভিন্ন জায়গায় সফট বোর্ডে লাগানো ওদের সেইসব কীর্তিকলাপ৷ এছাড়াও লকডাউনে ওদের পাঠানো নাচ-গান-কবিতা দিয়ে আমরা পালন করেছিলাম রবীন্দ্রজয়ন্তী, স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস৷ নবম-দশম শ্রেণীর ছাত্রীরা বিদ্যালয়ে এসে দূরত্ববিধি মেনে পালন করেছিল কন্যাশ্রী দিবস৷

    তবে এসব করেও কিছুতেই আমরা চল্লিশ শতাংশের বেশি ছাত্রীর কাছে পৌঁছতে পারছি না৷ ছাত্রীদের একটা বিরাট অংশ একটানা বিচ্ছিন্নই থেকে যাচ্ছে৷ তবে আশার কথা, ২০২০-র ধাক্কায় একটা বড় সংখ্যক ছাত্রীকে স্কুলে আর ফিরে পাব না বলে যে আশঙ্কা করেছিলাম, তা ভুল প্রমাণ করে ২০২১ শিক্ষাবর্ষেও বেশিরভাগই পরের ক্লাসে নাম তুলেছে৷ হয়ত পড়াশুনা সেভাবে না করেই, অনেক কিছু না-জানা নিয়েই ওরা চলে গেল পরের ক্লাসে, কিন্তু স্কুলের গণ্ডির মধ্যে ধরে রাখাটাই এই পরিস্থিতিতে আমাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ৷ সেদিক থেকে হয়ত আমরা কিছুটা সফল৷ তাই লকডাউন হোক আর ইয়াসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আমরা আমাদের সীমিত সামর্থ্য নিয়ে বারবার ছুটে গেছি ওদের পাশে—যাতে ওরা কখনই না ভাবে জীবনের এই কঠিন লড়াইয়ে ওরা একা৷

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics