• হারিয়ে যাওয়া ক্লাসরুমের গল্প


    1    202

    July 6, 2021

     

    বছর ১২ আগের কথা। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস। জয়েন করতে চলেছি দক্ষিণ দমদমের একটি হাইস্কুলে। সদ্য পাওয়া সরকারি চাকরি। মনে অগাধ স্ফূর্তি আর স্বপ্নপূরণের আনন্দ। কিন্তু স্কুলের চৌহদ্দিতে পা দিতেই ‘ধুক করে নিভে গেল বকুভরা আশা’। সময় তখন ভরদুপুর। এ সময় তো টিফিনের বিরতি থাকার কথা। আর টিফিন টাইমের ইস্কুল বাড়ি মানেই তো হাজারো ছাত্রছাত্রীদের কিচিরমিচিরে ভরে থাকা গমগমে ব্যাপার-স্যাপার। আমার নিজের স্কুলজীবনের স্মৃতি হাতড়ে তেমন ছবিই তো খুজেঁ পেলাম। কিন্তু কই, তেমন কিচ্ছটিু নেই তো! শান্তশিষ্ট পরিবেশ, শুধু নীচু ক্লাসের দু’জন ছাত্রী শুকনো মুখে উঠোনের কল থেকে বোতলে জল ভরছে আর বছর তেরোর ছাত্রটি মুড়ির ঠোঙা হাতে উদাস দৃষ্টিতে দেখছে ভাদ্রের আকাশে উড়ন্ত চিলের গতিবিধি। 

    বুঝেছিলাম স্বভাবগম্ভীর দিদিমণির খোলস ছেড়ে আমাকে ওদের ‘দিদি’ হয়ে উঠতে হবে।

    অচিরেই হেডমাস্টার মশাই বুঝিয়ে দিলেন ব্যাপারখানা। বুঝলাম এ ইস্কুলের ছাত্রসংখ্যা নেহাতই হাতে-গোনা। আরও অবাক হলাম শুনে যে এ তল্লাটের বহু বাংলা মাধ্যম স্কুলের চিত্রটাই এমন। বেশিরভাগই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। অভাবের ছাপ স্পষ্ট ওদের মলিন পোশাকে আর শুকনো মুখে। বলতে দ্বিধা নেই, প্রথম প্রথম একটু মন খারাপ হত যখন ক্লাসে পড়াতে গিয়ে প্রত্যাশামতো সাড়া পেতাম না। কিন্তু সে মনখারাপ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে গিয়েছিলাম, ‘ওরাই ভালোবাসতে জানে, খুলতে জানে মনের কল’। বুঝেছিলাম স্বভাবগম্ভীর দিদিমণির খোলস ছেড়ে আমাকে ওদের ‘দিদি’ হয়ে উঠতে হবে।

    বাঁধা গতের লেখাপড়ায় মন নেই বটে, কিন্তু অন্য সবকিছুতে ওদের অদম্য উৎসাহ। সরস্বতীপুজোর আয়োজন করতে হবে, কিন্তু বাজেট সীমিত। নিজেরাই খুঁজে পেতে নিয়ে এল ভাঙা বাঁশের টুকরো, বাতিল ঝুড়ি, পুরোনো খবরের কাগজ—এসব দিয়েই হবে পরিবেশবান্ধব পুজো। স্কুলে তৈরি হবে লাইব্রেরি, নিজেরাই সাজিয়ে ফেলল বইয়ের তাক, ভূগোল দিদিমণির সাহচর্যে একচিলতে ছাদটাতেও দিব্যি ফুল আর সবজির বাগান করে ফেলল। সেই সবজি মিড-ডে-মিলের খিচুড়িতে পড়তেই ওদের আনন্দ দেখে কে!

    ছোট্ট হাতগুলো তখন ঘর সামলায়, এমনকী রান্নাও করে। ফলে রোলকলের খাতায় অনেকের নামের পাশেই উপস্থিতির চেয়ে অনপুস্থিতির চিহ্নই বাড়তে থাকে দিনের পর দিন।

    খুব অল্প সময়েই বুঝেছিলাম ওদের ভালোবাসাটা নির্ভেজাল। বিশেষ করে নীচু ক্লাসের বাচ্চারা খুব সহজেই আমাদের কাছে উজাড় করে দেয় ওদের সবটুকু ভালোলাগা, মন্দলাগা। হয়ত বাড়ির উঠোনের ছোট্ট নয়নতারার কুঁড়ি বেরিয়েছে—সেই খবরটাও মোটেই অকিঞ্চিৎকর নয় ওদের কাছে। ইস্কুলে এসেই স্যার-ম্যাডামদের বলতে হবে সেই ‘আশ্চর্য’ কথাটা। আসলে ওদের কথা শোনার তেমন কেউ নেই যে! বাবারা কেউ রিক্সা চালান, কেউ বা কাজ করেন মুদি দোকানে, কেউ সদ্য নির্মীয়মান ফ্ল্যাটের সিকিউরিটি গার্ড। এতটুকু আয়ে কলকাতা শহরে জীবনযাপন করা বড় কঠিন। তাই মায়েরাও সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েন রান্না বা ঠিকে কাজে। ছোট্ট হাতগুলো তখন ঘর সামলায়, এমনকী রান্নাও করে। ফলে রোলকলের খাতায় অনেকের নামের পাশেই উপস্থিতির চেয়ে অনপুস্থিতির চিহ্নই বাড়তে থাকে দিনের পর দিন। আর স্কুলে এলেও বাড়ি ফিরে স্কুলের পড়াটুকু ঝালিয়ে নেওয়ার পরিবেশ কই? সন্ধ্যে হলেই এক-কামরার ভাড়া ঘরে পুরোদমে টিভি চলতে থাকে। সারাদিন পরিশ্রমের পর বাড়ি ফিরে হা-ক্লান্ত বাবা-মায়েদের বিনোদন বলতেও তো ওইটুকুই।

    তাই তো ওদের অনেকেরই অনেকখানি জুড়ে আমরা—ওদের ভাষায় ‘সের’ আর ‘মেডাম’রা। হ্যাঁ, খাতায় এমন বানানের বহর দেখে যতবারই শুধরে দিতে গেছি, ততবারই একই ভুল। কিন্তু কী আশ্চর্য, বছরের মাঝখানে স্কুলে এসে ভর্তি হল যে শিশুটি, তাকে যে বিশেষ যত্নে আগলে রাখতে হবে সেটা কোনওদিন শেখাতে হয় নি ওদের। অটিজমের সংজ্ঞা না-জানা বাচ্চাগুলো কী অসম্ভব মায়া আর ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরেছে ওদের নতুন বন্ধুকে, ঠিক যেমন করে ছাদ-বাগানের গাছে নতুন ফুল ফুটলে তাকে আদরে আগলায়। আর যখন লকডাউন জারি হল, অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হল ইস্কুল, তখন ওদের প্রথম চিন্তাই ছিল সাধের গাছগুলোকে নিয়ে। কে দেবে জল? কে করবে যত্ন? ছোট্ট কপালে চিন্তার ভাঁজ ছিল স্পষ্ট। 

    লকডাউন দীর্ঘমেয়াদী হতেই অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছিল। নাহ, একশো শতাংশ উপস্থিতি কোনোদিনই ছিল না সেই ক্লাসে। করোনা তো তখন থাবা বসিয়েছে ওদের অনেকের পরিবারের রুটি-রুজিতে। ফোনে নেট-প্যাক ভরানো তখন শৌখিনতারই নামান্তর। গুটিকয়েককে নিয়ে ক্লাস চলে গুগল মিট-এ। কিছুদিন বাদেই লক্ষ্য করি ক্লাস নাইনের মনোজ বারবার অন্যমনস্ক। জিজ্ঞেস করলে বলে, 

    -“ম্যাম, ভিডিও অপশনটা বন্ধ রাখি?”

    বলি, “কেন রে বাবা, কতদিন তোদের সঙ্গে দেখা হয়না। ফোনের ওইটুকু পর্দায় তোদের সুস্থ-স্বাভাবিক মখুগুলো দেখলেও তো তবু স্বস্তি পাই কিছুটা…”।

    তবু আবার একই অনুরোধ আসে। খানিক পরে বুঝি বয়ঃসন্ধিপ্রাপ্ত আত্মসচেতন কিশোর আসলে লজ্জা পায় তার বাড়ির পরিবেশ নিয়ে। যদি স্যার-ম্যামদের চোখে পড়ে যায় তার ঘরের দৈন্য, যদি পাশের ঘরের বাসিন্দার অশ্রাব্য কটুকথার ঝগড়া শুনতে পেয়ে যায় কেউ—সে বড় লজ্জার হবে ওর কাছে। বলি, তুই যেমনটায় স্বচ্ছন্দ, তেমনটাই কর।

    কিন্তু মোবাইলের ছোট্ট পরদায় সেইসব অমূল্য অভিব্যক্তি মিসিং। 

    কয়েকজনকে নিয়েই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ক্লাস চলে। হ্যাঁ, খুঁড়িয়েই। দুধের স্বাদ তো পিটুলিগোলায় মেটে না! টেনিদার বনভোজনের গল্প শুনে ক্লাসে হাসির রোল উঠত। ‘পথের পাঁচালী’র দুর্গার মৃত্যুদৃশ্যে পিন-পতন নিস্তব্ধতা। মতি নন্দীর কোনি যখন হিয়াকে চড় কষিয়ে অপমানের জ্বালা মেটাতো, তখন লাস্ট বেঞ্চের পড়াশোনায় সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা মেয়েটাকেও হাতের মুঠি শক্ত করে ফেলতে দেখেছি। পরীক্ষায় পাস নম্বর তুলতে হয়তো হিমশিম খাবে ও, কিন্তু জীবনের আরো অনেক শক্ত হার্ডল পার হওয়ার সাহসটুকু যে সঞ্চয় করতে পেরেছে, সেই বিশ্বাসই সেদিন স্বস্তি দিয়েছিল আমাকে। কিন্তু মোবাইলের ছোট্ট পরদায় সেইসব অমূল্য অভিব্যক্তি মিসিং। 

    পড়ার ফাঁকে নানারকম কথা হয়। প্রায় প্রতিদিনই ওদের জিজ্ঞাসা থাকে, 

    -ইস্কুল কবে খুলবে ম্যাম? 

    -জানি না রে বাবু ... 

    শুনে অবাক হয়। ওরা তো জানে ওদের সঅঅঅব প্রশ্নের সুলকুসন্ধান স্যার-ম্যামরা দিতে পারেন। তাহলে এটা কেন জানেন না? 

    একদিন ক্লাস সেভেনের তমাল খুব উত্তেজিত হয়ে বলে, 

    -ম্যাম জানো, সুমিতার খুব অসুখ। 

    জানা গেল ওদের ক্লাসেরই মুখচোরা শান্ত মেয়েটি দুরারোগ্য ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। সেখানেও করোনা থাবা বসিয়েছে ছোট্ট রুগ্ন শরীরটায়। চিকিৎসার খরচের জন্য আমাদের উদ্যোগী হওয়ার সময়টুকু দেয়নি সুমিতা। বড্ড তাড়াতাড়ি না-ফেরার দেশে চলে গেছে সে৷ লকডাউনের দুঃসহ স্মৃতিতে সারাজীবন সুমিতা থেকে যাবে। 

    ক্লাস টেনের মাধুরী তো বেশ নিয়মিতই ছিল, তাহলে হঠাৎ সে ফাঁকি দিচ্ছে কেন?

    তবু সময়ের নিয়মেই ‘নিয়মে’ ফিরতে হয়। তারই মাঝে খেয়াল করি অনলাইন ক্লাসে উপস্থিতির সংখ্যা আরো কমছে। ক্লাস টেনের মাধুরী তো বেশ নিয়মিতই ছিল, তাহলে হঠাৎ সে ফাঁকি দিচ্ছে কেন? জানা গেল সংসারের হাল ফেরাতে বিউটি পার্লারের কাজ শিখছে সে। দুপুরে ক্লাসের সময়টা তার ওইখানেই ব্যয় হয়। ওই ক্লাসেরই শুভজিৎ আর বিপ্লবও বড়বাজারে কোনো এক দোকানের কাজে লেগে পড়েছে, নইলে সংসার চলবে না। ‘সবজু সাথী’ প্রকল্পের ফর্ম ফিল-আপ করতে গিয়ে অনেক ছাত্রের খোঁজ নিয়ে জানতে পারি ওরা আর পড়বে না। মানে ওরা ‘পড়তে চায় না’ নয়, ওরা ‘পড়তে পারবে না’। ফোনের ওপার থেকে কুন্ঠিত স্বর জানায়,

    -ম্যাম, আমি মনে হয় আর মাধ্যমিকটা দিতে পারব না৷

    -কেন পারবি না? ক্লাসে ‘কোনি’ পড়িয়েছি না তোদের? কী শিখলি তবে সেখান থেকে?

    কেউ চুপ করে থাকে, কেউ সামান্য বিরতি নিয়ে জবাব দেয়, ‘চেষ্টা করব ম্যাম’। 

    ‘চেষ্টা’—এই ছোট্ট কথাটার জোর অনেক। এই চেষ্টা-কে সম্বল করেই তো ক্লাস টেনের মৌমিতা গ্রামের বাড়িতে নিজের বিয়ে আটকাতে মাথা ন্যাড়া করে ফেলেছিল। পালিয়ে এসেছিল শহরে। একরত্তি মেয়েটার জেদ আর সাহস দেখে অবাক বনেছিলাম। কিন্তু করোনার জেরে মৌমিতা শহরের আশ্রয়টাও হারিয়েছে। জানিনা গ্রামের বাড়ি ফিরে আর কতদিন ‘চেষ্টা’ করে নিজের বিয়ে রুখতে পারবে সে।

    পৃথিবীর অসুখ সারলে আবার একদিন স্কুল শুরু হবে চেনা ছন্দে। প্রেয়ার লাইনের শৃঙ্খলা ভেঙে কেউ একজন ছুট্টে এসে খুব উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকবে, ‘জানো ম্যাম...’।

    কিন্তু সেদিন বোধহয় নিয়ম ভাঙার জন্য একটুও বকুনি খাবে না সে।

     
     



    Tags
     



    1 Comment
    • গা শিরশির করা বাস্তব।লেখনীর গুণে তার মধ্যেও আশার আভাস।খুব ভালো লাগলো।দিদিমণি মনের সহমর্মিতা কে কুর্নিশ

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics