• কাঁহাতক আর পরীক্ষার জন্য বসে থাকব?


    0    269

    July 6, 2021

     

    সকালে উঠে দেখলাম, খবরের কাগজ বলছে কোচবিহারের দিনহাটা হাইস্কুলের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে। সে ছিল মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। প্রতিভাবান, ভাল ছাত্রীটির স্বপ্ন ছিল মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করা। করোনা আবহে পরীক্ষা বাতিল হয়েছে শুনে সে আত্মঘাতী হয়। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে আমার স্কুলের দশম ও দ্বাদশের কিছু ছেলেকে ফোন করে ফেললাম, তারা ভাল আছে কিনা জানতে। অনিষ্টচিন্তা হয়েছিল বিশেষত 'ভালো ছেলে'-দের জন্য। তারা জানাল, ভাল আছে। যতটা হতাশা আশা করেছিলাম, তার চেয়ে অন্তত ভাল আছে৷ তারা বলল,

    -'আর ধৈর্য্য থাকছিল না। একটা কিছু এসপার-ওসপার হোক, একটা কিছু জানাক, এটাই চাইছিলাম।'

    -'পরীক্ষা হলে ভালই হত। কিন্তু কাঁহাতক আর পরীক্ষার জন্য হাঁ করে বসে থাকব?'

    মাধ্যমিকের এক সম্ভাবনাময় ছাত্র বলল।

    আর উচ্চমাধ্যমিকের সবচেয়ে উজ্জ্বল পরীক্ষার্থী বলল, -'আমার তো হায়ার সেকেন্ডারি নিয়ে বিরাট কিছু আশা ছিল না৷ নিট (ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষা) হলে বাঁচি। ওটাও ক্যান্সেল হলে চাপ।'

    দেখে ভাল লাগল যে কলকাতা শহরের সিবিএসসি আইসিএসই-র অনেক 'ভাল ছেলেমেয়েদের' মতো তারা ভেঙে পড়েনি। টুয়েলভ-এর ফার্স্ট বয়ের মতো গুটিকয়েকের আছে সুতীক্ষ্ম কেরিয়ার চিন্তা। তবু তারা মেনে নিয়েছে পরিস্থিতি। কিন্তু পরীক্ষার জন্য অধীর হতে হতে শেষ পর্যন্ত 'আর ভাল্লাগছেনা' পরিস্থিতিতে পৌঁছোনোর কথা তারা সবাই বলল।

    স্কুলটি সরকারি হলেও বড় মফস্বলে অবস্থিত। সেখানে মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেদের যাতায়াত। বয়েজ স্কুল। ছাত্ররা অনেক দিক থেকেই সুবিধাপ্রাপ্ত। কিন্ত দেখে ভাল লাগল যে কলকাতা শহরের সিবিএসসি আইসিএসই-র অনেক 'ভাল ছেলেমেয়েদের' মতো তারা ভেঙে পড়েনি। টুয়েলভ-এর ফার্স্ট বয়ের মতো গুটিকয়েকের আছে সুতীক্ষ্ম কেরিয়ার চিন্তা। তবু তারা মেনে নিয়েছে পরিস্থিতি। কিন্তু পরীক্ষার জন্য অধীর হতে হতে শেষ পর্যন্ত 'আর ভাল্লাগছেনা' পরিস্থিতিতে পৌঁছোনোর কথা তারা সবাই বলল। পরীক্ষার সঙ্গে জ্ঞানের যতটা সম্পর্ক, পারফরম্যান্সের সম্পর্ক তার চেয়ে বেশিও হতে পারে। তিন ঘণ্টার পারফরম্যান্সের জন্য সারা বছর প্রস্তুতি। পারফরম্যান্স অ্যাংজাইটির চিরস্থায়ী হওয়াটা তাদের কাছে বিরক্তিকর হচ্ছিল। বরং বেশি হতাশ হতে দেখলাম তাদের অভিভাবকদের। উক্ত দুই ছেলের অভিভাবকই আশা করেছিলেন ছেলেরা ঘর-ভরা নাম্বার আনবে। জেলাস্তরে সংবর্ধনা পাবে।

    হয়ত মেয়েটি বোঝেনি যে বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে প্রতিযোগিতার থেকে সহযোগিতার মনোভাবই কাম্য। হয়ত বোঝেনি, শিক্ষা আর পরীক্ষা সমার্থক নয়। বোঝেনি, পরিস্থিতি অনুযায়ী মানিয়ে নেওয়াটাও একটা শিক্ষা।

    একটু নিশ্চিন্ত হয়ে আবার মৃত ছাত্রীটির ভাবনায় ফিরলাম। পরীক্ষা বাতিল হওয়ায় ডিপ্রেশনে আত্মঘাতী হল সে। সে জানত যে নবম শ্রেণীর মূল্যায়নের ভিত্তিতে নম্বর পেয়ে সে হয়ত নিজের স্কুলেই উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হতে পারবে। তা সত্ত্বেও আত্মহত্যা কেন? কারণ 'সেরা' হওয়ার গরিমাটুকু চুরি করে নিয়ে গেল করোনা। কেন্দ্র সিবিএসসি আইএসসি পরীক্ষা বাতিল করায় আগেই দেখেছিলাম অনেকে সমাজমাধ্যমে সন্তানের 'ডিপ্রেশন'-এর কথা বলছেন অভিভাবকরা। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু যখন বলেছিলেন, দরকারে মাধ্যমিকের প্রশ্নপত্র শিক্ষার্থীর বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হবে, তখনও ব্যাপক 'হায় হায়, সব গেল' শুনেছিলাম। তাতে পরীক্ষার মান থাকে না। অথচ পরীক্ষা না বলে আজকাল ব্যাপারটাকে 'মূল্যায়ন'(ইভ্যালুয়েশন) বলা হয়। নিচু ক্লাসে নাম্বারের বদলে গ্রেড দেওয়া বা উঁচু ক্লাসে ঢালাও নাম্বার দেওয়া ইত্যাদির উদ্দেশ্য হল ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষাভীতি কাটানো। সনাতন 'পরীক্ষা' বিষয়টাকে ঘিরে শিক্ষকের 'দেখ কেমন লাগে' মনোভাব, ছাত্র-ছাত্রীর থরথর কম্পন, অভিভাবককূলের উচ্চাকাঙক্ষা ইত্যাদির আতিশয্য অনস্বীকার্য। কিন্তু নাম্বার পাওয়াটা তো শিক্ষার মোক্ষ নয়। শিক্ষালাভ সম্পন্ন হয়েছে কিনা, তা বোঝার জন্য 'মূল্যায়ন' চলতে পারে বড়জোর। হয়ত মেয়েটি বোঝেনি যে বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে প্রতিযোগিতার থেকে সহযোগিতার মনোভাবই কাম্য। হয়ত বোঝেনি, শিক্ষা আর পরীক্ষা সমার্থক নয়। বোঝেনি, পরিস্থিতি অনুযায়ী মানিয়ে নেওয়াটাও একটা শিক্ষা।

    চিরকাল ফেব্রুয়ারিতে মাধ্যমিক আর মার্চে উচ্চমাধ্যমিক হয়। অথচ সে সময়টা শিক্ষকদের ব্যস্ত রাখা হল ভোটের ট্রেনিং ও নির্বাচন কেন্দ্রের দায়িত্বে। স্কুলবাড়ি অনেক জায়গায় হয়ে গেল ভোটকেন্দ্র বা আধাসামরিক বাহিনীর আশ্রয়স্থল। সকলেই জানতাম, এর পর আসবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ।

    প্রশ্ন হল, যেহেতু রাতারাতি শিক্ষাব্যবস্থা আমূল বদলে ফেলা ও পরীক্ষা তুলে দেওয়া সম্ভব না, তাই এবারের 'পরিস্থিতি' কি পরীক্ষা নেওয়ার পক্ষে সত্যিই সম্পূর্ণ প্রতিকূল ছিল? শিক্ষকরা ও এই পরীক্ষার্থীরা ২০২১ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯শে এপ্রিল পর্যন্ত লাগাতার স্কুলে গেছেন। এটা ছিল করোনার ‘প্রথম ওয়েভ’ শেষ ও ‘দ্বিতীয় ওয়েভ’ শুরুর মাঝের সময়। সেসময় দু’মাস স্কুল খুলেছিল। রোটেশন পদ্ধতিতে ভাগ ভাগ করে ক্লাস হয়েছে। কিন্তু বস্তুত এই সময়টাই ছিল 'পরীক্ষার সময়'। চিরকাল ফেব্রুয়ারিতে মাধ্যমিক আর মার্চে উচ্চমাধ্যমিক হয়। অথচ সে সময়টা শিক্ষকদের ব্যস্ত রাখা হল ভোটের ট্রেনিং ও নির্বাচন কেন্দ্রের দায়িত্বে। স্কুলবাড়ি অনেক জায়গায় হয়ে গেল ভোটকেন্দ্র বা আধাসামরিক বাহিনীর আশ্রয়স্থল। সকলেই জানতাম, এর পর আসবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। জানতাম, ভোটযজ্ঞে স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন সেই দ্বিতীয় ঢেউকে ত্বরান্বিত করছে। তা সত্ত্বেও, সবচেয়ে নিরাপদ সময়টিতে পরীক্ষা না হয়ে, ভোটই হল। যথারীতি ভোটের পরে ঝাঁপিয়ে এল দ্বিতীয় ওয়েভ।

    তাদের পরীক্ষার 'দাম' আছে, কারণ তাদের সামনে 'কেরিয়ার' আছে, আর বাকিদের কেরিয়ার নেই, তাই পরীক্ষা সম্পর্কে তাদের বক্তব্যও না থাকাই উচিত? অনলাইন ক্লাসের মতো ডিজিটাল ডিভাইড এখানেও দেখা গেল।

    রোগের সংক্রমণ থেকে ছোটদের রক্ষা করাই উচিত। কিন্তু হয়ত যেমনটা বলা হয়েছিল, বাড়িতে প্রশ্ন পাঠানো বা হোম সেন্টারে পরীক্ষা ইত্যাদি করা যেত। অথচ রাজ্য সরকার যখন দেখল কেন্দ্রীয় বোর্ডগুলিও পরীক্ষা থেকে পিছু হটছে, তখন পিছু হটল তারাও। পরীক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার শেষপর্যন্ত তেমন মাথাই ঘামাল না। ২৪ ঘণ্টার নোটিশে ইমেইল পাঠিয়ে ছাত্র-ছাত্রী-অভিভাবক-সাধারণ মানুষকে বলা হল মতামত দিতে। যে ছাত্রীটি পড়াশোনার পাশাপাশি লকডাউনে ঝি-এর কাজ নিয়েছে, সে করবে ইমেইল? যে ছাত্র লকডাউনে বাবার সঙ্গে সবজি বেচে বা দুধ-খবরকাগজ দিতে যায় সে করবে ইমেইল? সব অভিভাবকের আছে ইমেইল আইডি? ছেলেমেয়ের ক্লাস, রোল নাম্বার না-জানা অভিভাবকদের? ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত অভিভাবকরা, মিড ডে মিলের জন্য বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানো অভিভাবকরা করবেন ইমেইল? নাকি ধরেই নেওয়া হয়েছে যে যারা মতামত দেবে, তাদের পরীক্ষার 'দাম' আছে, কারণ তাদের সামনে 'কেরিয়ার' আছে, আর বাকিদের কেরিয়ার নেই, তাই পরীক্ষা সম্পর্কে তাদের বক্তব্যও না থাকাই উচিত? অনলাইন ক্লাসের মতো ডিজিটাল ডিভাইড এখানেও দেখা গেল।

    এবার যখন কোনো পরীক্ষাই হয়নি, তখন সকলে হয়ত অনেক নাম্বারই পাবে বিকল্প পদ্ধতিতে, কিন্তু কলেজে ভর্তি হতে সবাই পারবে কি?

    মতামত যদি নিতেই হয়, তবে চিঠিতে মতামত নেওয়া যেত এক মাস ধরে। পরীক্ষা হবে কি হবে না, এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ক্লাস হবে কি হবে না। ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে একটানা স্কুল বন্ধ অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। মাঝের দু'মাস স্কুল খুলেছিল শুধু নবম থেকে দ্বাদশের জন্য। তাই মতামত নিতে হলে দেড় বছরের মধ্যে একবারও কেন মতামত নেওয়া হল না ডিজিটাল ডিভাইড নিয়ে? ক্লাস বন্ধ থাকা নিয়ে? বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে? দেড় বছর কেটে গেল, এখনও কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার অনলাইন ক্লাসের কোনো বিকল্প বা পরিপূরক ভাবতে পারল না বা ভাবতে চাইল না। এমনকী রেডিও বা টিভিকে আদৌ কাজে লাগানো হল না, যা স্মার্টফোন বা নেট কানেকশনের চেয়ে মানুষের হাতের নাগালের মধ্যে বেশি রয়েছে। মতামত নিতে হলে নেওয়া হোক মিড ডে মিল বিষয়ে। অভিভাবকদের ও ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করা হোক, মার্চ-এপ্রিল মাসে হঠাৎ ভোটের জন্য বরাদ্দ বাড়িয়ে আবার কমিয়ে দেওয়াকে তাঁরা অপমানজনক মনে করছেন কিনা। মানছি, বলে-কয়ে ভোটের জন্যই বাড়ানো হয়েছিল খাদ্যের পরিমাণ এবং ডাল-সোয়াবিন ইত্যাদি 'সাময়িক' বলা হয়েছিল। কিন্তু পুষ্টির ঘাটতিও কমেনি, লকডাউনও ওঠেনি। তাহলে বরাদ্দ কমানো কি কল্যাণকর সরকারের থেকে অভিপ্রেত? মতামত যদি নিতেই হয়, তবে প্রশ্ন করতে দেওয়া হোক, কেন পরীক্ষা ও মূল্যায়নের বিকল্প খোঁজার ব্যাপারে শিক্ষক সংগঠনগুলির সঙ্গে আলোচনা হল না? কেন 'হেডমাস্টার অ্যাসোসিয়েশন'-এর জানুয়ারিতে পাঠানো প্রস্তাবে (সব উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষার্থীদেরও টীকাকরণ করে দেওয়া হোক যাতে তারা অন্তত পরীক্ষা দিতে পারে) কর্ণপাতও করা হল না?

    প্রশ্ন উঠবে বিশেষত উচ্চমাধ্যমিক ছাত্র-ছাত্রীদের কলেজে ভর্তি হওয়ার পদ্ধতি নিয়েও৷ গতবার অর্থাৎ ২০২০ সালে উচ্চমাধ্যমিকের সময় কারও একটি, কারও দুটি পরীক্ষা বাকি ছিল—এ অবস্থায় লকডাউন শুরু হয়েছিল। বাকি পরীক্ষাগুলিতে গড় নাম্বার দেওয়া নিয়ে শোরগোল উঠেছিল। তার চেয়েও বড় কথা দেখা গিয়েছিল ৯৫% নাম্বার পেয়েও অনেকে কলেজে মনোমত বিষয় নিয়ে ভর্তি হতে পারছে না। এবার যখন কোনো পরীক্ষাই হয়নি, তখন সকলে হয়ত অনেক নাম্বারই পাবে বিকল্প পদ্ধতিতে, কিন্তু কলেজে ভর্তি হতে সবাই পারবে কি?

    আঙুল তোলা জরুরি, তবে ঠিক আঙুলটি। যে ছাত্ররা পরীক্ষা বাতিল হওয়ায় নিশ্চিন্ত, যারা খুশি, আর যারা দুঃখী—সকলেই বৃহত্তর জীবনকে বোর্ড পরীক্ষার থেকে বেশি কণ্টকাকীর্ণ, বেশি চ্যালেঞ্জিং হিসেবে অনুধাবন করবে শীঘ্রই। সময়ই তাদের তা শেখাবে। এ হয়ত তার সূচনা মাত্র। অন্যায় আছে, ক্ষুধা আছে, বৈষম্য আছে, দারিদ্র আছে। আছে অনন্ত লড়াই। সহজে হেরে যাওয়ার উপায় কই?

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics