• প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তর অজানা


    1    241

    July 6, 2021

     

    স্কুল আসলে কী? শিশুমনে প্রশ্ন জাগে। ক্রমে সে বুঝতে পারে স্কুল তার নিজের বাসস্থানের মত, কিন্তু আকারে বড় একটা বাড়ি। সেখানে মায়ের মতন দেখতে আন্টি বা মিস থাকে। তারা চক হাতে বোর্ডে লেখে, ছবি আঁকে, দুষ্টুমি করলে বকে, আরো কত কী! এসবের বাইরে স্কুল মানে শিশু বা কিশোরমনে একঝাঁক বন্ধুর সাথে মাঠে হুটোপুটি, টিফিন ভাগ করে খাওয়া, লাস্ট বেঞ্চে বসে বন্ধুর সাথে ফিসফিসানি, টিচারকে তার চরিত্রের সাথে মানানসই ডাকনাম দেয়া, ফাঁকা সময়ে তাদের চলন-বলন নকল করে হেসে গড়িয়ে পড়া, বন্ধুদের বাহবা কুড়ানো বা টিচারদের বকুনি উপহার পাওয়া—এমন অনেক কিছু।

    এভাবেই একদিন ইশকুলবেলা শেষ হয়েছিল। কিছু বছর পরে আবার ঢুকে পড়লাম ইশকুলেই। দিদিমণিদের যুগ তো কবেই শেষ, তাই মিস হতে মজাই লেগেছিল। স্কুলটি উত্তর ২৪ পরগণারর মহকুমা শহর ব্যারাকপুরে, গঙ্গার তীরে, ক্যান্টনমেন্ট অঞ্চলে অবস্থিত। ১৯৪৬ সালে স্থাপিত স্কুলটি ওই অঞ্চলের প্রথম মেয়েদের উচ্চ বিদ্যালয়, যা বিভিন্ন অস্থায়ী ঠিকানায় থেকে ১৯৮৬ সাল নাগাদ সদরবাজার অঞ্চলে নিজেদের পাকাপাকি ঠিকানায় আসে। বিরাট মাঠ, প্রচুর বৃক্ষ জাতীয় গাছ ঘেরা সাদামাটা স্কুলবাড়ি। বিভিন্ন সময়ে অঞ্চলের অধিবাসীদের আর্থিক সহযোগিতায় এবং সর্বোপরি সরকারি অর্থানুকূল্যে দোতলা ভবন ও হলঘরসহ পরিপূর্ণ রূপ পেয়েছে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অগণিত ইংরেজী মাধ্যম এবং বেসরকারি স্কুলের দাপটে ক্রমশ স্কুলের ছাত্রীসংখ্যা কমতে থাকে। তবু এখনো ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট গার্লস হাই স্কুল ব্যারাকপুর-মণিরামপুর অঞ্চলের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ছাত্রী নিয়ে পথ চলছে।

    স্কুলের ছাত্রীদের অধিকাংশই আসে নিম্নবিত্ত অবাঙালি পরিবার থেকে এবং তারা  দ্বিতীয় প্রজন্মের পড়ুয়া। তাদের মায়েরা অনেকেই এই বিদ্যালয়েরই ছাত্রী। চাকরিজীবনের শুরুতে অমনোযোগী ছাত্রীদের অভিভাবকদের ডেকে পাঠাতাম। একদিন এমনই এক ছাত্রীর মা এসে বলেছিলেন, "এসব ছোটখাট ব্যাপারে ডেকে পাঠাবেন না, আপনারাই মেরে ধরে দেবেন। আমি আয়ার কাজ করি। একদিন না গেলে মাইনে কাটা যায়। একার রোজগারে তিন তিনটে মেয়েকে পড়াতে হয় তো!"

    অনেক মেয়েকে দেখতাম কয়েক পিরিয়ড ক্লাস চলার পর মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে। সকালে মায়ের সাথে বাড়ি বাড়ি ঘর মোছা, বাসন মাজার কাজ করে খেয়ে আসা সম্ভব হয়নি

    কথার সূত্রে জেনেছিলাম তার স্বামী তাদের ছেড়ে আবার বিয়ে করে অন্য জায়গায় থাকে। আস্তে আস্তে এক আপাত অচেনা জগত চোখের সামনে খুলে গেল। কত মেয়ে রোজ দেরি করে স্কুলে এসেছে। কারণ কী? ছোট ভাই বা বোনকে স্কুল থেকে এনে বা স্কুলে নামিয়ে দিয়ে নিজে ছুটতে ছুটতে স্কুলে আসে। অনেক মেয়েকে দেখতাম কয়েক পিরিয়ড ক্লাস চলার পর মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে। সকালে মায়ের সাথে বাড়ি বাড়ি ঘর মোছা, বাসন মাজার কাজ করে খেয়ে আসা সম্ভব হয়নি, অথবা মা-বাবা সকালে কাজে চলে যাবার পর আগের রাতের বাসি রুটি খেয়ে স্কুলে এসেছে। কাউকে হয়ত মাসের শেষে টিফিন কেনার পয়সা দিতে পারেনি মা।  টিফিনবেলায় খাবার কেনার পয়সা নেই বলে মুখ শুকনো করে গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থেকেছে।

    তারপর যখন মিড-ডে-মিল প্রকল্প এল, সমস্যার অনেকটা সমাধান হলো। শিক্ষিকারা হাল ধরলেন। মেয়েদের জন্য পুষ্টিকর খাবারের তালিকা অনুসারে শিক্ষিকাদের পূর্ণ তত্ত্বাবধানে মেয়েরা পেট ভরে টিফিনে খাবার পেল। পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত খাবার বরাদ্দ করা হলেও, উদ্বৃত্ত খাবারে উঁচু ক্লাসের মেয়েরা যারা খেয়ে আসতে পারেনি বা সেদিনের মতো টিফিন আনেনি, তাদেরও সংকুলান হয়ে যেত। এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা টাকার সাবধানী ও হিসেবি ব্যবহারের ফলে আস্তে আস্তে কিছু টাকা জমিয়ে প্রয়োজনীয় বাসনপত্রও কেনা হল। মেয়েদের স্বত:স্ফুর্ত অংশগ্রহণে তাদের শারীরিক দুর্বলতাজনিত সমস্যার অনেকটা সমাধান হল।

    কিন্তু নিয়মে বাধা পড়ল গতবছর। লকডাউনের পর অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্কুলের পাট উঠে গেল। প্রতি মাসে অভিভাবকদের হাতে কাঁচামাল বন্টন করা শুরু হল। চাল-ডাল-আলু-সাবান নিতে আসা মায়েদের প্রশ্ন একটাই, "দিদি, স্কুল কবে চালু হবে?"

    তাদের অনেকেই মেয়েকে স্কুলের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে পাঠিয়ে কাজে যেত। অনেক পরিবারের খাবারের জোগানের জন্য তখন রেশন আর স্কুল থেকে পাওয়া এই সামগ্রীটুকুই ভরসা। একজন মেধাবী ছাত্রীর মা খুব আক্ষেপ করে বলেছিলেন, "দিদি, মেয়েটা পড়াশুনা করে কিন্তু খুব মনমরা হয়ে আছে। ওর বাবা ফুচকা বিক্রি করে, এই সময়ে তো রোজগারপাতি কিছুই নাই, কী করে চালাবো বুঝতে পারি না"। যে ছাত্রীর মা বিউটি পার্লারের কাজ করে পেট চালাতো, তাকেই বা কী বলে সান্ত্বনা দিই!

    এদিকে পড়াশোনা কিন্তু থেমে নেই। সরকারি নির্দেশক্রমে প্রতিটা ক্লাসের মেয়েদের হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার নিয়ে পড়ানোর জন্য গ্রুপ তৈরী হয়েছে। দীর্ঘদিন বাড়ি বসে থাকার বিরক্তি ঝেড়ে ফেলে সবাই বিপুল উদ্যমে অডিও বা ভিডিও ফাইল পাঠিয়েছি, বীরবিক্রমে সিলেবাস শেষ করেছি। প্রতি মাসে আ্যক্টিভিটি করতে দেওয়া হয়েছে। অভিভাবকদের মাধ্যমে তা স্কুলে জমা পড়েছে। সংশোধনের পর আবার পরের মাসে তারা সেটা ফেরত পেয়েছে। তবু সবাইকে এর আওতায় আনা যায়নি। যে সমাজব্যবস্থায় শিক্ষার সমান অধিকার সুনিশ্চিত হয় না, তাতে শিক্ষার্থীর বিকাশ নিয়েও কোনও প্রশ্ন চলে না। পাশ-ফেলের ঝামেলা ছাড়াই যখন অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ হওয়া যায়, তখন এ নিয়ে প্রশ্ন করা নিষ্প্রয়োজন মনে করে চাল-ডাল-আলু-সাবান থলেতে ভরে মাস্ক পরা অভিভাবক পথ হাঁটেন।

    স্কুলের মেয়েদের অধিকাংশই সরকার থেকে বিনামূল্যে পাওয়া বইয়ের বাইরে অন্য প্রয়োজনীয় বই কিনতে পারতো না। একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণিতে ঐচ্ছিক বিষয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা ছিল আরো প্রকট। তাই বিদ্যালয়ের শিক্ষিকারাই দায়িত্ব নিয়ে নিজেরা বই দিয়ে, বিভিন্ন জায়গা থেকে বই সংগ্রহ করে, বিদ্যালয় তহবিল থেকে কিছু বই কিনে একটা-দুটো আলমারি দিয়ে গড়ে তুলেছিল লাইব্রেরি। দীর্ঘসময় তাঁরা ক্লাসের পাশাপাশি লাইব্রেরিয়ানের দায়িত্বও সামলেছেন, কারণ সরকারি নিয়ম অনুসারে নির্দিষ্ট সংখ্যক বই না হলে ওই পদের জন্য আবেদন গ্রাহ্য করা হত না। অবশেষে স্কুল সেই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছে, কয়েক বছর আগে একজন লাইব্রেরিয়ান পায়। ছাত্রীদের রুটিনে যোগ হয় লাইব্রেরি ক্লাস। রোজকার একঘেয়ে পড়ার মাঝে গল্পের বই পড়ার মজা কে না চায়! তাই লাইব্রেরি হয়ে উঠল সবার ভালোলাগার ঘর। শুধু তাই নয়, এর কয়েক বছরের মধ্যেই স্কুল পেল দুটো প্রজেক্টর মেশিন। বইয়ের পড়া পর্দায় দেখে মেয়েরা ভারি আনন্দ পেল। আর মাঝে মাঝে ফেলুদা, গুপি-বাঘা আর মনোজদের অদ্ভুত বাড়ির লোকজনকেও সেই পর্দায় দেখা গেল।

    এরপরের ঘটনা অনেকটা সেই পর্দায় দেখা চেনা গল্পের মতোই। কোভিড-লকডাউন-আম্ফান-আবার স্কুল খোলা-ভোটের মিলিটারি ক্যাম্প-আবার লকডাউন এসব যেন অফুরান ফিল্মের রোলের মতো চলেই যাচ্ছে। আর একের পর এক সমস্যা মাথা চাড়া দিচ্ছে।

    সরকারি নিয়ম অনুসারে ছাত্রী ভর্তির জন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের বেশি টাকা নেওয়া যায় না। অথচ দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ থাকার কারণে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত ক্লাসের অনেক বিষয়ের জন্য অস্থায়ী শিক্ষিকা নিয়োগ করতে হয়েছে। শুধু পঠন-পাঠন ছাড়াও স্কুলের অফিসের প্রভূত পরিমাণ কাজের জন্যেও অস্থায়ী সহযোগী নিয়োগ করা হয়েছে। নিয়োগ করা হয়েছে রাত পাহারাদার এবং দ্বাররক্ষী। এসব কিছুর জন্য যে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হয় তার সংকুলান করা ক্রমশ দুরুহ হয়ে যাচ্ছে। প্রথমত এসব খরচ বাবদ স্কুল কোন সরকারি সাহায্য পায় না। দ্বিতীয়ত দারিদ্র্যসীমার নিচের পরিবারের ছাত্রীদের একটা বড় অংশ স্কুলের মাইনে দিয়ে উঠতে পারেনা। তারা চেষ্টা করে কিস্তিতে পরিশোধ করার। লকডাউনে সেইসব ছাত্রীর অভিভাবকেরা অনেকেই কাজ হারিয়েছেন বা বিকল্প কিছুর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছেন। এই পরিস্থিতিতে তারা স্কুলের ভর্তির ফিজ দিতে নিতান্তই অসমর্থ।

    ছাত্রী-শিক্ষিকা-গাছপালা-মাঠ-স্কুলবাড়ি এসব মিলে ইশকুল নামের যে প্রাণবন্ত সত্ত্বা, তা দুরারোগ্য এক ব্যাধিতে ভুগছে। এর নিরাময় কে করবে?

    এদিকে লকডাউন ছাড়াও রয়েছে আম্ফানের আঘাত। চাকরি জীবনের শুরু থেকেই মন ছুঁয়ে গেছিল এই স্কুলের নানা উৎসব, যার অন্যতম ছিল বৃক্ষরোপণ। প্রতি বছর অরণ্য সপ্তাহের একদিন শিক্ষিকাদের উদ্যোগে বনদপ্তর থেকে নিয়ে আসা গাছের চারা মহা উদ্দীপনা নিয়ে রোপণ করা হত। সেই ছোট্ট চারাগাছগুলি কথা রেখেছিল। সবুজ পাতার আঁচলের ছায়ায় তারা স্কুলকে ঘিরে রেখেছিল। গতবছরের আম্ফানের তান্ডবে তারা অনেকেই আজ শুধু স্মৃতি। সেইসব অর্জুন, ছাতিম, স্বর্ণচাঁপা, মেহগনি গাছেরা শবের মতো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। এবছরে মাথার উপরে গনগনে চৈত্রের রোদ জানান দিয়েছে তাদের নীরব হাহাকার। নিয়মিত স্কুল না চলার কারণে আম্ফানে স্কুলের ভেঙে যাওয়া দেয়াল টপকে বাইরের লোক ঢুকে যাচ্ছে। চুরি হয়ে গেছে বহু কষ্টে তিলে তিলে জমানো টাকায় কেনা মিড-ডে-মিলের বাসনপত্র। কাচের জানালার ভেঙে যাওয়া পাল্লা দিয়ে জল ঢুকে অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় পড়ে আছে বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরি। লাইব্রেরির তালা ভেঙে, বইয়ের আলমারি ভেঙে ছত্রখান হয়ে গেছে, নষ্ট হয়েছে ছোটদের অনেক বই। এসবের ক্ষতিপূরণ কীভাবে সম্ভব? কে দেবে? সরকার? রাষ্ট্র? শিক্ষাব্যবস্থা?

    ছাত্রী-শিক্ষিকা-গাছপালা-মাঠ-স্কুলবাড়ি এসব মিলে ইশকুল নামের যে প্রাণবন্ত সত্ত্বা, তা দুরারোগ্য এক ব্যাধিতে ভুগছে। এর নিরাময় কে করবে?

    প্রশ্নগুলো আছে সবার মনেই, কিন্তু উত্তর অজানা।

     
     



    Tags
     



    1 Comment
    • ভীষণ ভাল লাগলো, আপনাদের ছাত্রী রা নিশ্চয়ই অনুপ্রাণিত হবে এই সহানুভূতি সম্পন্ন লেখাটি পড়ে।

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics